একলা পথিক; অনেক আকাশ . . . পর্ব - ১

একলা পথিক; অনেক আকাশ . . . পর্ব - ১

প্রায় চার দশক আগে আকাশগঙ্গার বালুচর ধরে শুরু তার পথচলা । দিকচক্রবাল দিয়েছিল মায়াভরা ছায়া ছায়া আদুরে আলাপ। অনেক আকাশ তাদের তারকা- রবি- শশী নিয়ে আলোকময় ক’রে রেখেছে একলা পথিকের চলার পথ। সেই সূর্যস্নাত যাত্রাপথের গোধূলিবেলায়; পথিক মনের সিংহাবলোকন। আড্ডা উৎসারিত ব্যতিক্রমী জীবনের সে উপাখ্যান- আজ অক্ষরবন্দী।

সম্পাদনা- অনুপম আচার্য; আইনজীবী উচ্চন্যায়ালয়, কোলকাতা। উচ্চতম ন্যায়ালয়; নিউদিল্লী।
গ্রন্থনা- উৎপল মৈত্র; কোলকাতা।

আঁধার ঘরের আলো

সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্ত ছুঁই -ছুঁই। ৩১সি জাতীয় সড়ক ধরে ছুটে চলেছে গাড়িটি। গাড়ির সাথে সমান তালে পেছন পানে ছুটে যাচ্ছে শাল- সেগুনের জঙ্গল, নদীর ব্রিজ, চা-বাগিচার সেড ট্রি, অনামী পাহাড়ী ঝোরা। গাড়িতে তিন- চারজন সাওয়ারী। গন্তব্যস্থল গঞ্জ-মফস্বলের কোন স্কুল বা গ্রামীণ ক্লাব।

মাদারীহাট মাঠের ঈশান কোণে দু’টি বাঁশের সাথে আড়াআড়িভাবে টাঙ্গানো রয়েছে সাদা পর্দা। সূর্য ডোবার পালা শেষ হওয়ার পরেই; পর্দা চুঁইয়ে নামছে আঁধারের ধূপছায়া। প্রোজেক্টারের রশ্মিবিম্বে পর্দায় ফুটে উঠছে রকমারি রঙের আলোকবিন্দু- রেখা। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ভেসে আসছে আবহসঙ্গীত। সুললিত কণ্ঠে ভাষ্য শুরু করলেন ডাঃ পার্থপ্রতিম। আজকের বিষয়- ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’। এমনি করেই তিন দশকের বেশি সময় ধরে আঁধার মাঝে তিনি এঁকে চলেছেন আলোর স্বপ্নছবি।

সাধারণতঃ সপ্তাহে একদিন বরাদ্দ এই সামাজিক কাজে। বৃহস্পতিবার করে ডাঃ পার্থপ্রতিম তার দলবল নিয়ে পৌঁছে যান গ্রাম- গঞ্জে, স্কুল- ক্লাবে। পর্দা টাঙিয়ে প্রোজেক্টারের সাহায্যে চোখের সামনে তুলে ধরেন অনেক কিছু। কখনো ভর সন্ধ্যায় খোলা মাঠে, কখনো দিনদুপুরে চারদেওয়ালের মাঝেই তৈরী করেন আকাশ ভরা সূর্য-তারা।  ভয়েজার -২ মহাকাশযানে করে আপনাকে নিয়ে যাবেন শনির বলয়ের একদম কাছে, নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটনে, কখনো মহাশূন্যে দাঁড়িয়ে দেখবেন আমাদের মমতাময়ী মাটির পৃথিবীকে। কখনো আবার মানবদেহের নাড়ী-নক্ষত্র, ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ সংক্রান্ত অনেক তথ্য, ছবি, রোগ প্রতিরোধের উপায়। সঙ্গে থাকে গান- আবহ সঙ্গীত, আর ডাঃ পার্থপ্রতিমের সুমধুর ভাষ্য। ডাঃ পার্থপ্রতিমের ভাষায়- “রোগের বিষয়ে সঠিক জ্ঞান, উপযুক্ত পথ্য ও সংযত জীবনযাপনে রুখে দেওয়া যায় যে কোন মারণ ব্যাধিকে। দ্বিতীয়ার দূর্বা- চন্দনে নয়; স্বাস্থ্য সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা ও তার প্রয়োগের মধ্য দিয়েই যমদুয়ারে পড়বে কাঁটা।”

শুরু করেছিলেন মহাকাশ দিয়ে। অডিওভিজ্যুয়াল শো-র নাম ছিল ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’। তারপর ব্লাড প্রেসার ও হৃদরোগ নিয়ে ‘হৃদয়ের কথা’। ডায়াবেটিস নিয়ে ‘ব্যাধির নাম ডায়াবেটিস’, পতঙ্গ ও পরিবেশ নিয়ে ‘নিকট প্রতিবেশী’ সব মিলিয়ে ত্রিশটির বেশী শিরোনাম। কবিগুরুর জন্মের সার্ধশতবর্ষে তৈরি করেছেন ‘তোমার অসীমে . .’। স্বামীজির ক্ষেত্রে ‘শিক্ষায় বিবেক’। কোভিড উত্তর পরিস্থিতিতে ‘মানুষ হওয়ার সহজপাঠ’। প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে নতুন নতুন বিষয়। আরো আর্কষণীয় হয়ে চলেছে উপস্থাপনা।

শুরুতে মহাকাশ কেন? উত্তরে জানালেন- “মানুষ তার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই তাকিয়েছে আকাশের পানে। দিনের শেষে রাত এলে সেই অন্ধকারের মাঝে প্রাচীন গুহাবাসী মানুষ একদিকে যেমন ভীত- সন্ত্রস্ত হয়েছে; অন্যদিকে আকাশের গ্রহ-তারার আলোয় তারা খুঁজে পেয়েছে তাদের আশা- আকাঙ্ক্ষা- ভুত- ভবিষ্যতের দেবতাকে।  কিছু কিছু মানুষ আকাশের গায়ে ফুটে ওঠা বিভিন্ন উজ্জ্বল নক্ষত্র- গ্রহগুলিকে কাল্পনিক রেখা দিয়ে যোগ করে ভাবল, এটা মাছের মতো দেখতে। নাম দিল- মীন রাশি। সিংহের মতো দেখতে যেটি, তা হল সিংহ রাশি। এভাবেই মেষ, বৃশ্চিক . . . রাশিগুলি তৈরী। ছোটোবেলায় আমরা যে আকাশে বিভিন্ন আকারের মেঘ দেখে ভাবতাম- এটা হাতির মাথা, ওটা ঘোড়ার লেজ। রাশির ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম।

ইতিমধ্যে কিছু মানুষ আকাশের গ্রহ বা নক্ষত্রদের দেব-দেবীর রূপ দিয়ে পূজোপাঠ শুরু করে। লেখা হয় বিভিন্ন ধর্মীয় কাল্পনিক গল্পগাথা। সূর্য, চন্দ্রের মহিমা যেমন বর্ণিত আছে হিন্দু, ইসলাম শাস্ত্রে। একইভাবে ভেনাস, অ্যাপেলো, ইউরেনাস রয়েছে গ্রীক উপকথায়। তারা ব্যাখ্যা করতে থাকেন- আমাদের মানবজীবনের বিভিন্ন সাফল্য, ব্যর্থতা নির্ভর করে এই দেবী- দেবতাদের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির ওপর। তারা বিভিন্ন পাথর, কবচ-রত্ন ধারণেরও বিধান দেয়।

আজও বহু মানুষ নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের ভ্রান্তমায়ায় মাদুলি, তাবিজ- পাথর ধারণ ক’রে কপাল বদলানোর ভাবনায় মগ্ন থাকে। কোটি কোটি টাকার ভন্ড ব্যবসা চলে।

মানুষের সাথে আকাশের সম্পর্ক নিবিড়তর। তাই আকাশ ঘিরে জল্পনা, কল্পনা, সংস্কার- কুসংস্কারের অন্ত নেই। আমাদের যেগুলো রীতি-রেওয়াজ তার বেশিরভাগটাই আকাশ নিয়ে। সে পূর্ণিমারাত্রে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা, ঈদ উৎসব, বা চৈনিক চুওনজি এসবই সূর্য, চাঁদ ঘিরে। এমন আরো বহু উদাহরণ রয়েছে। তবে মানুষের ভাগ্য মূলতঃ নির্ভর করে তার শ্রম, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও আর্থসামাজিক অবস্থানের ওপর।

তিনদশক আগে তিনি যখন এ যাত্রা শুরু করেন তখন ডিজিটাল প্রোজেকশন প্রযুক্তি বাজারে আসেনি। ম্যাজিক লন্ঠনের মতো প্রোজেক্টার দিয়ে যাত্রার শুরুয়াৎ। প্রতিটি স্লাইড হাত দিয়ে পাল্টাতে হতো। কিছুক্ষণ চালানোর পর প্রোজেক্টার গরম হয়ে উঠতো। কতবার যে উত্তপ্ত বাল্ব -এ ছেঁকা খেয়েছেন তার ঠিক নেই। ডুয়ার্সের এক গ্রামে বসে প্রোজেকশন স্লাইড পাওয়াও বেশ মুস্কিলের ব্যাপার। দিল্লীর বিজ্ঞান প্রসার, বোম্বের তেজরাজ বা অনেক সময় বিদেশী বন্ধুদের কাছে হাত পেতেছেন স্লাইডের খোঁজে। কখনো  নিজে কলকাতার বার্ন এন্ড শেফার্ড ও চিত্রবাণী থেকে প্যানক্রোম্যাটিক ফিল্ম এনে ছবি তুলে তাকে স্লাইড করেছেন। প্যানক্রোমাটিক ফিল্ম এক বিশেষ ধরনের ফিল্ম। যেখানে ফিল্মে নেগেটিভ নয়; সরাসরি পজিটিভ ছবি ওঠে। মূলতঃ প্রোজেকশন স্লাইড  ও সিনেমা তৈরীর কাজে এই ফিল্ম ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের স্লাইড তৈরী করাও বেশ ব্যয়বহুল। সেসময়ে উত্তরবঙ্গে অল্প কিছু মানুষই এই ফিল্ম নিয়ে কাজ করতেন।

১৯৯৪ -তে বিয়ে করেছেন। প্রেম বিবাহ। প্রথম দিকে কন্যাপক্ষ রাজি ছিলেন না এধরনের ছন্নছাড়া ছেলের হাতে মেয়ে দিতে। তারপর যেমনটি হয়; সব মিটমাট। অধ্যাপক শ্বশুরমশাই কিছু যৌতুক দিতে চান জামাইকে। শেষমেশ বিষয়টি এড়ানো যাচ্ছে না দেখে জামাই নিলেন এক জার্মান ‘লাইকা’ স্লাইড প্রোজেক্টার। এতে প্রতিটি স্লাইড হাত দিয়ে পাল্টানোর ঝামেলা নেই। পর্দার ছবিও খুব ঝকঝকে স্পষ্ট। রিমোট কন্ট্রোলে ছবি আগুপিছু করা যায়।

কিন্তু প্রযুক্তি তো থেমে থাকে না। আজ যা নতুন; কালই তা পুরোনো হয়ে যায়। কয়েক বছর যেতে না যেতেই বাজারে এসে গেল ডিজিটাল প্রোজেক্টার। কমপিউটার বা ডিভিডি প্লেয়ার থেকে ছবি সরাসরি পর্দায় পড়ে। স্লাইড তৈরীর ঝামেলা নেই। সঙ্গে হাজারো সুবিধা। মুভি বা চলচ্চিত্র এ প্রোজেক্টারে দেখানো যায়। শুরু করলেন কমপিউটারের কলাকৌশল শিখতে। পাওয়ার পয়েন্ট, ফটোসপ, কোরেল ড্র, সাউন্ড এডিটিং, ভিডিও এডিটিং -এর খুঁটিনাটি বহুকিছুই শেখা হলো।

কিন্তু এসব হলে কী হবে? ল্যাপটপ, প্রোজেক্টার সবকিছু মিলিয়ে প্রায় লক্ষাধিক টাকার ব্যাপার। দিদির অনুমতি নিয়ে বেচে দিলেন ব্যাঙ্ককর্মী দিদির দেওয়া সোনার আংটি। স্ত্রী সুকন্যা তখন উচ্চমাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের টিউশন পড়ান। বেশ কিছু টাকা জমিয়েছিলেন; ভেবেছিলেন মোটা অঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট করবেন। তা আর হলো না। পুরো টাকাটাই দিয়ে দিলেন এই কাজে। আর দেবেন নাই বা কেন? মিঞা-বিবি দু’জনেই বিশ্বাস করেন- ‘এন.এস.সি, কে.ভি.পি, চাইল্ড ফিউচার পলিসি করলেই সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হয় না। আগামী প্রজন্মের পানের জন্য দরকার নিষ্কলুষ জল, বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য দরকার নির্মল বাতাস, মানসিক বিকাশের জন্য চাই কুসংস্কারহীন- সৃজনশীল পরিবেশ।’ তাঁদের সন্তান ‘সাম্য’ বড় হয়ে সকল বৈষম্যের ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হবে- এই দম্পতির এটাই বাসনা।

আগে বিষয়টি ছিল সিনেমা তৈরি করার মতই কষ্টসাধ্য। প্রথমে কোন একটা বিষয় বিশেষ ভাবে জানতে হয়। সে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, এনকেফেলাইটিস যে বিষয়ই হোক। রোগের কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় এগুলো সব লিপিবদ্ধ করতে হয়। তারপর তার সাথে সংশ্লিষ্ট কি কি ছবি মানানসই হবে সেগুলোকে চিহ্নিত করা। সেই ছবিগুলোকে তৈরি করে কালার ট্রান্সপেরেন্সি স্লাইড বানানো হত।

এখনো অনেকটা একইরকম। বিষয়ভিত্তিক চিত্রনাট্য তৈরি করতে হয়। তারপর প্রয়োজনীয় ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ, শব্দ সংযোজনার জন্য প্রয়োজনীয় মানানসই  সাউন্ড ক্লিপ যোগাড় করা, ভিডিও ও ফটো ট্রান্সজিশন এফেক্ট দেওয়া, সবশেষে সম্পাদনা ও ভাষ্যের মহড়া। পুরোপুরি তথ্যচিত্র নির্মাণের মতো। প্রত্যন্ত ডুয়ার্স এলাকায় যেহেতু এবিষয়ে কোন পেশাদার লোক পাওয়া যায় না; তাই পুরো কাজটা একহাতেই করতে হয়। যতদূর জানা গেছে-এ ধরনের অডিও ভিজুয়্যাল শো উত্তরবঙ্গে তিনিই প্রথম শুরু করেন। আজও করেন, আর করেন সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে। চষে বেড়িয়েছেন উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মেখলিগঞ্জ, চ্যাংরাবান্ধা, হলদিবাড়ি, কোচবিহার থেকে আলিপুরদুয়ার, মালবাজার, ওদলাবাড়ি কোথায় না গিয়েছেন।    

তিনি যখন শুরু করেছিলেন তখন অডিওভিসুয়্যাল শো- টা ছিল এই এলাকায় বেশ নতুন ব্যাপার। আসলে কচিকাঁচা বা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও শুধু কথা বলে তাদের কোন বিষয় সঠিকভাবে বোঝানো বা ভাবার উপযোগী করে গড়ে তোলা বেশ কঠিন বিষয়। অডিওভিসুয়্যাল শোর ক্ষেত্রে সাদা পর্দা টাঙানো হয়। তাতে অন্ধকার ঘরে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ছবি ফুটে উঠত। অনেকটা সিনেমার মত। তবে সিনেমা বা তথ্যচিত্রের সাথে মূল ফারাকটা হচ্ছে, তথ্যচিত্র বিষয়টি একমুখী। যাকে বলে ওয়ানওয়ে কমিউনিকেশন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশ্ন বা আলাপচারিতার মাধ্যমে দর্শকদের বিষয়ের সাথে সংপৃক্ত করা হয়। এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে এই ধরনের কাজ খুবই সহজ হয়ে গেছে। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন এর মাধ্যমে এখন এগুলো প্রায় জলভাত। এখন তিনি ল্যাপটপ ও ডিজিটাল লাইট প্রসেসিং প্রোজেক্টার ব্যবহার করেন।

ফি বছর ডুয়ার্সে হানা দিচ্ছে বিভিন্ন মারণ ব্যাধি। এবছর ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু তো পরের বছর এনকেফ্যালাইটিস, চিকুনগুনিয়া। রোগ হানা দেওয়ার সাথে সাথেই কোমর বেঁধে ফেলেন এই চিরতরুণ মানুষটি। রোগের কারণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পদ্ধতি, রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাপত্র এসব নিয়ে তৈরি করেন সহজবোধ্য অডিও- ভিসুয়্যাল প্রেজেন্টেশন। সাদরী, বাংলা, নেপালীভাষায় ভাষ্য। তারপর, মৃত্যুর দিগন্ত টপকানো ক্লান্তিবিহীন দৌড়। তখন আর কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ নেই। দিনমণি দিবাকর অস্তগামী হওয়ার পরেই হাতে প্রোজেক্টার, কাঁধে ল্যাপটপ; পৌঁছে যান চা বাগিচার আদিবাসীপল্লী বা বনবস্তীর আঙ্গিনায়। হ্যাঁ, সন্ধ্যে নামার সময় হলে, পশ্চিমে নয় পূবের দিকে, চোখটি খুলে ভাবান তিনি- কোন্ দেশে রাত হচ্ছে ফিকে . . .।

» » He has been fighting superstitions and teaching Science to Adivasis. . .




রাম অবতার শর্মা; সচিব; ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন; ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ- ডুয়ার্সের জনমানসে ডাঃ পার্থপ্রতিম একটা পরিচিত নাম। চা শ্রমিক পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলা, কুসংস্কার দূর করা ও আরো নানাবিধ কাজকর্মে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। পার্থপ্রতিম সুবক্তা, তার বাচনভঙ্গী খুব সাবলীল ও সহজবোধ্য। বহু পুরস্কার ও সম্মাননাও পেয়েছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমি তাকে দেখে আসছি। সে যে কাজ করে; তার জন্য অর্থ লাভের আশা করে না। কাজের প্রতি ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তাকে এ পথে চালিত করে। স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন বইও লিখেছেন। ল্যাপটপ- প্রোজেক্টর কাঁধে তার এই ছুটে চলা;  অজ্ঞানতার অন্ধকারের থেকে চেতনার উজ্জ্বল আলোর অভিমুখে তার লড়াই। আমার চোখে সে সমাজকল্যাণে উৎসর্গীকৃত এক প্রাণ।

♦  ♦  ♦   

 

♦  ♦  ♦ 


                                     

জন বার্লা; কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী; ভারত সরকার- ডাঃ পার্থপ্রতিমকে আমি বহুকাল থেকেই দেখে আসছি। বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে দাদা সক্রিয়ভাবে থাকেন। কখনও ডেঙ্গু নিয়ে, কখনও এনকেফেলাইটিস নিয়ে তিনি ল্যাপটপ ও প্রোজেক্টরের সাহায্যে রোগ সম্বন্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করেন। আমার লক্ষীপাড়া চা বাগানেও এধরনের অনুষ্ঠান করেছেন। ডুয়ার্স এলাকা স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, শিক্ষা এইসব বিভিন্ন বিষয়ে পিছিয়ে রয়েছে। বহু মানুষের মধ্যে এখনও স্বাস্থ্য ঘিরে কুসংস্কার রয়েছে। পার্থদা যে কাজ করেন, এই ডুয়ার্স এলাকার জন্য এই ধরনের কাজ খুবই জরুরী।

♦  ♦  ♦  

ধরার বুকে ধরা

চারদিকে সবুজ চা বাগিচা আর অরণ্য-বনানী। তারই মাঝে ছোট্ট জনপদ বানারহাট। চা-বাগিচা আর রেলস্টেশন ঘিরে গড়ে ওঠা জনবসতি। রেলের কোয়ার্টারগুলি ইংরেজ আমলের। ঘরগুলি লাল ইটের, মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে। পোকামাকড়, সাপ-খোপের হাত থেকে বাঁচার জন্য। এমনই এক কোয়ার্টারে ধরার বুকে ধরা দিয়েছিলেন বসু পরিবারের এই সদস্য। ১৩ই নভেম্বর ১৯৬২; মঙ্গলবার।  ওপার বাংলা থেকে আসা ছিন্নমূল পরিবারের একটাই লক্ষ্য ছিল নতুন দেশে, নতুন মাটিতে একটা আস্তানা গড়ে তোলা। যেখানে থাকবে অভয়, নিরাপত্তা, সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ। তাই কেক কাটা, জন্মদিন পালন তাদের মনোজগতে ঠাঁই পায়নি।  সে সময় জন্মপঞ্জী বা শংসাপত্রের প্রচলন ছিলনা। আর ডেট-অফ-বার্থ বলে এখন যেটা প্রচলিত; তখনকার সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকই সেটা তাঁর ইচ্ছামতো স্কুলখাতায় তুলে দিতেন। সেকারণে সে সময়ের অনেকেরই জন্মতারিখ সরকারি খাতায় সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি।

ছোট্ট রেল কোয়ার্টারে তাদের একান্নবর্তী পরিবার। গর্ভধারিণী গীতা বসু, বাবা সুশীল কুমার বসু ছিলেন ভারতীয় রেলের কর্মী।  ঠাম্মা, বাবা, কাকা, জ্যাঠতুতো- খুড়তুতো দিদি-বোন ওই ছোট্ট জায়গাতেই কেমন করে যেন এঁটে যেত। ডুয়ার্সের এই রেল স্টেশন তখন ছিল অন্যরকম। লাইনগুলি ছিল মিটার গেজ। তবুও তখন প্রাণচঞ্চল ছিল এই স্টেশনটি। বিহারের কাটিহার থেকে মাছ, লিচু আসত ট্রেনে চেপে। কমলালেবু, চা, ডলোমাইট পাড়ি জমাত দূর দেশে। ঘন্টা পড়ত ঢং-ঢং-ঢং। রেলের ইঞ্জিনগুলি ছিল বাষ্পচালিত। কয়লার ধোঁয়া ছাড়ত কু-উ-উ-ঝিক্-ঝিক্। কয়লার গনগনে উনুনের ওপর থাকত ঢাউস বেলনাকার বয়লার। সেই চলমান উনুন বয়লার টেনে নিয়ে যেত বগিগুলিকে। ডিজেল ইঞ্জিনের পুঁ-পুঁ তখন নেই বললেই চলে। ট্রেনের যাত্রায় গেলে সঙ্গে কয়েকটি রুমাল আবশ্যক ছিল। জানলার কাছে বসে থাকা যাত্রীদের চোখে ঢুকে যেত কয়লার কণা। সেগুলি আলতোভাবে বের করতে হত চোখ থেকে। রায় সাহেবের ‘পথের পাঁচালি’-র দৌলতে সে স্মৃতি আজও দৃশ্যমান। তার জন্মের কিছুমাস পর বসু পরিবার রেল কোয়ার্টার ছেড়ে চলে আসে বানারহাট আদর্শপল্লীতে। সেখানে মাটির ভিটেতে কাঠের বেড়া দেওয়া টিনের চালের ঘর। সেখানেই স্বাভাবিক নিয়মে বড় হতে থাকে এক ছোট্ট বালক; ধুলো- মাটি- কাদা মেখে . . .।

সাধনা বসু- আমার ভাই পার্থপ্রতিম, আমরা ওকে ডাকি ‘ধুনু’ বলে। ছোটোবেলা থেকেই ও একটু অন্যরকম। বিভিন্ন বিষয়ে ও কৌতূহলি। বড় দুষ্টুও ছিল। তবে ওর দুষ্টুমির মধ্যে বরাবরই একটা মেধা মিশে থাকত। আমাদের বাড়িতে একটা পুরোনো অ্যাংলো সুইস দম দেওয়া টেবিল ঘড়ি ছিল। কিছুদিন তা বন্ধ হয়ে থাকে। সে সময় বানারহাটে জলের খুব সংকট। পয়সার বিনিময়ে কয়েকজন লোক টিনে জল ভরে বাড়ি বাড়ি দিয়ে যেত। আমরা তাদের বলতাম ‘পানিওয়ালা’। একবারে বাঁশের বাংকুয়াতে দু’টিন জল নিয়ে আসত ঘাড়ে করে। কয়েকদিন পর নজর এলো ঘড়িটি যথাস্থানে নেই। বাড়ির আমরা ভাবলাম পানিওয়ালাই বোধহয় ঘড়িটি নিয়ে গেছে। তাকে মারধর করে জিজ্ঞাসাবাদের উপক্রম হল। সে সময় ধুনু কাঁদতে কাঁদতে খাটের তলা থেকে সেই ঘড়ির ব্যাগ বের করে দিল।
পরে জানা গেল- ধুনু আর ওর কালাদা লুকিয়ে জামগাছের তলায় গিয়ে রান্নাঘরের সাঁড়াশি ও কলমছুরি নিয়ে ঘড়িটিকে খুলে চালু করার চেষ্টা করে। তারপর যথারীতি তার স্প্রিংপত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। ও আর ওর দাদা ভয় পেয়ে থতমত খেয়ে যায়। যন্ত্রপাতি কুড়িয়ে একটা ব্যাগে ভরে রেখে দেয়। ওরা ভাবে পরে সবকিছু জোড়া লাগিয়ে ঘড়িটিকে আবার চালু করবে।

ধুনু এখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে লেখে, বেশ কয়েকটি বইও লিখেছে। সে সময় প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে গেলে স্লেটে ‘সরস্বতী’ বানান লিখে প্রধান শিক্ষককে দেখাতে হত। এটা ভেবে এখন আমার খুব ভালো লাগে যে- ভাইকে সরস্বতী বানান লেখা আমি শিখিয়েছিলাম।

♦  ♦  ♦  

গায়ত্রী বসু ভৌমিক- ভাই পার্থপ্রতিম ছোটোবেলা থেকেই অন্যরকম। আমাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। আর্থিক অবস্থাও সে সময় ভালো ছিল না। তবুও সব কষ্টের মধ্যে বেশ আনন্দে দিন কাটত। ভাই যখন ব্যাঙ্গালোরে যাচ্ছে, ভারতের রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা হবে। সে সময় খুব ভালো জামা কাপড় ছিল না। কোনটা বোতাম ছেঁড়া, কোন প্যান্টটার নীচে ফাটা। ওর লাটাইয়ের সুতো দিয়ে আমি সেগুলো সেলাই করে দিয়েছিলাম। তারপর কতদিন যে কীভাবে কেটে গেল . . । ও এখন বহু কিছু করে। কমপিউটার গ্রাফিক্স এর সাহায্যে আমার একটি প্রমাণ মাপের ছবি ও তৈরী করে দিয়েছে। সেই পুরোনো রাজ-রাজাদের তৈলচিত্রের মতো।

♦  ♦  ♦ 

স্কুলবেলা

মূলত ওপার বাংলা থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষের নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন; চারাগাছ হয়ে মাথা তুলছে গ্রাম গঞ্জে। গড়ে উঠেছে নতুন পল্লীসংঘ, গ্রন্থাগার, স্কুল। প্রাথমিক স্কুলটির সরকারি নাম ছিল বানারহাট স্টেট প্ল্যান প্রাইমারি স্কুল। কিন্তু লোকের মুখে মুখে তা হেডমাস্টার মাখনলাল ব্যানার্জির নাম অনুসারে মাখনবাবুর স্কুল। স্কুলে তিনি ছাড়া আর তিনজন দিদিমণি ছিলেন। সরকারি খাতায় পার্থপ্রতিমের  যে জন্মতারিখ, তা মাখনবাবুর প্রদত্ত। মাখনবাবু ক্লাসে অঙ্ক শেখাতেন। ব্ল্যাকবোর্ডে একটা অঙ্ক কষে জিজ্ঞাসা করতেন - কীরে বুঝছস ? বলতাম বুঝছি স্যার। সঙ্গে সঙ্গে পালটা প্রশ্ন- ‘কী বুঝছস বুঝা ?’ সে এক ঝামেলা, ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে গিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অঙ্ক করতে হত। একদিন বললাম- ‘বুঝি নাই স্যার।’- স্যার তৎক্ষণাৎ বললেন-  ‘কী বুঝস নাই বুঝা।’  সেও মহা ঝামেলার বিষয়।

না, পন্ডিত স্যারের বাড়ির আমড়া গাছটা আজ আর নেই। থাকার কথাও নয়। সে কতদিন আগের কথা। স্কুল ছুটির পর সবাই ছুটতাম সেই গাছের দিকে। গাছের মগডালে ঝুলে থাকা আমড়া পাড়া নিয়ে কত ঢিল ছোড়াছুঁড়ি। যার ঢিলে আমড়া পড়ত সে লক্ষ্যভেদী অর্জুন। মুখে যুদ্ধ জয়ের উল্লাস।
ক্লাস ফোরে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে হাইস্কুলে প্রবেশ। ক্লাস ফাইভ থেকে বিভিন্ন স্মৃতি মোড়া স্কুলবেলা। ইতিহাস পড়াতেন শৈলেন মন্ডল। ক্লাসে হিস্টোরিক্যাল ম্যাপ নিয়ে আসতেন। প্রাণ ঢেলে পড়াতেন। কখনও পলাশীর যুদ্ধ, ঝাঁসির রাণী, কখনও শিবাজির ঝুড়ির মধ্যে পলায়ন. . . কথা আর প্রাণের আবেগে আমাদের মনের পটে ছবি আঁকতেন। নন্দলালদার ঘন্টা যে কখন বেজে যেত তা টের পেতাম না।

বাংলা পড়াতেন সুনীলকুমার চক্রবর্তী। বানারহাট স্কুলের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক। অকৃতদার, গেরুয়া পাঞ্জাবির সঙ্গে চিদম্বরম স্টাইলে সাদাধুতি। জীবনযাত্রা ছিল ঋষিতুল্য। ছাত্রছাত্রীদের কাছে পরিচিত ছিলেন কবিস্যার নামে। দীর্ঘদেহী, উন্নত নাসা, মাথা ভরা কোঁকড়া চুলের সঙ্গে ছিল তার উদাত্ত কণ্ঠস্বর। সুযোগ দিলেই হল, যেকোনো বিষয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা নির্বিকারে বলে যেতেন। তা সে আইনস্টাইনের জন্মদিন হোক বা শিক্ষক দিবস। যে কোনো প্রসঙ্গ উঠলেই সাবলীলভাবে টেনে আনতেন স্বামীজি, নেতাজি ও রবীন্দ্রনাথকে। কবি, সাহিত্যিক, জননেতাদের বহু অজানা কথা তাঁর মুখে শুনেছি। স্কুলে বাংলা পড়াতেন আর একজন শিক্ষক সুশীলচন্দ্র পাল। কথাবর্তা চালচলনে প্রকৃত অর্থেই সুশীল ছিলেন। সঠিক শব্দ চয়ন করে ধীরে ধীরে কথা বলতেন। পান্ডিত্য ছিল, তবে তার প্রকাশভঙ্গি ছিল অতিমাত্রায় বিনয়ী ও পরিশীলিত।

সে সময় ক্রিকেটের এত রমরমা ছিল না, মাঠজুড়ে দাপিয়ে বেড়াত ফুটবল। বিভিন্ন স্কুলগুলির মধ্যে নিয়মিত ফুটবল টুর্নামেন্ট হত। স্কুল থেকে দল যেত। সঙ্গে দু-তিন লরি চেপে যেত সমর্থকেরা। সে কী উত্তেজনা। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে ছেলেদের নির্দেশ দিতেন সুভাষ স্যার। পারলে নিজেই মাঠে ঢুকে গোল করেন। ছেলেদের ভুলচুকে শুয়ার-হারামি বলে গালিগালাজ করতেন। আবার জিতলে মিষ্টিমুখ।

স্কুল বেলায় ফুটবল তো ছিলই, তার পাশাপাশি ছিল সারাবেলা-হরেক খেলা। চা-বাগিচার মধ্যে লুকোচুরি খেলতাম। নাম ছিল উসিকুশি। পাথর বা লোহার চাকতি ছুঁড়ে দিতে হত নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। তারপর হাতের পাঞ্জা দিয়ে হত মাপঝোপ। সফল হলে পাওয়া যেত সিগারেটের খালি প্যাকেট। আমরা বলতাম ডিগ্গেল খেলা। এছাড়াও ছিল পিট্টু, লাট্টু, দাড়িয়াবান্ধা আরও কত কী। ছুটির দিনে তারের বাঁকানো হাতল দিয়ে দিনভর চাক্কা চালানো।

সে সময় চা বাগানে শ্রমিকদের মনোরঞ্জনের জন্য মাঝেমধ্যে বিনাপয়সায় সিনেমা দেখানো হতো। মাঠের মাঝে দুটি বাঁশ পুঁতে টাঙানো হত সাদা পর্দা, তাতে প্রোজেকটার দিয়ে দেখানো হত ছবি। একটা সিনেমায় চার পাঁচবার ইন্টারভেল। আশেপাশের বাগানে সিনেমা হবে খবর পেলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে পৌঁছে যেতাম মাঠে। চা শ্রমিক পরিবারের সঙ্গে মাঠে চটি পেতে বসে যেতাম সিনেমা দেখতে। শেষ দৃশ্যে যখন নায়ক ভিলেনকে ধরে পেটাচ্ছে, আমরাও গলা ফাটিয়ে নায়ককে উৎসাহিত করতাম- ‘আউর মারো, মারো শালাকো , খুন নিকাল দো...।’ আমাদের উৎসাহে নায়ক ভিলেনকে দুটো ঘুঁষি বেশি মারতো কি না ! তা তখন জানা নেই। তবে রাতে বাড়ি ফিরলে চিত্রনাট্যের কুশীলবেরা বদলে যেত। মেজদি আমাকেই দিত রামধোলাই। কান ধরে শপথ করাতো- ‘আর কোনোদিন যাবো না’। পরের বার যথারীতি . . .।

কালীপূজোর সময় চা বাগানের আদিবাসী ছেলেছোকরা বাড়ি বাড়ি ঘুরত দেউশি করতে। সোমরা, মোহন, সঞ্চি, বুধুয়ার দলে আমিও ভিড়ে যেতাম। ঘুরতাম বাবু, মাইজিদের বাড়ি। মাটিতে লাঠি ঠুকে গলা ছেড়ে ছড়া কাটতাম- ‘ঝিলমিলি ঝিক্কা দেউশিরে/ বাবুকা ঘরমা দেউশিরে/ এক্ক পয়সা দেউশিরে...।’ চাল, আলু, পয়সা জুটত, তাই দিয়ে হত ভুরিভোজ। সরস্বতী পুজোর সময় চার-পাঁচদিন ধরে চলত স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উৎসব। সে এক হইহই কান্ড। ছেলেমেয়েদের নাটক, মাস্টার- দিদিমণিদের নাটক, আবৃত্তি, গান, নাচ আরও কত প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন হাতের কাজ ও বিজ্ঞান মডেল প্রদর্শনী হত। মডেল তৈরিতে নেতৃত্ব দিতেন সত্যব্রত বিশ্বাস ও অজিত সরকার। ছয়- সাতটা ঘর জুড়ে থাকত বিজ্ঞান -ভূগোলের জিনিসপত্র। চা বাগান থেকে বাবু- মাইজিরা গাড়ি চেপে আসত সে অনুষ্ঠান দেখতে। ছেলেমেয়েরা নাটকের মহড়া দিত। শ্রেণিশোষণ ও দিনবদলের ভাবনা নিয়ে একের পর এক নাটক। এদেশের মহেশ থেকে ওদেশের লিং-চিং। নাটকের সব সংলাপ অমল স্যারের মুখস্থ। শ্রেণীহীন সমাজের বাসনা ছিল তার ঘুমে জাগরণে। লি সাও চি-র ‘হাউ টু বি এ গুড কমিউনিস্ট’ হয়তো অমল স্যার আত্মস্থ করেছিলেন। অমল স্যার ছিলেন প্লেন বি.কম। নিজ আখের গোছানোর পাটিগণিতে পি.এইচ.ডি করা কমিউনিস্টরা তখনও সেভাবে বাজারে আসেনি। ব্যাকডেটেড অমল মাস্টার স্বপ্নমেদুর গলায় গানে সুর দিতেন -‘প্রভাতের সূর্যে রাঙা ওই দিগন্ত চক্রবাল/ ভয় কী কমরেড, আমাদের প্রিয় রঙ লাল...।’

ভালো ছাত্র নয়। কোনো মতে এক থেকে দশের মধ্যে থেকে যেতাম। ক্লাসে পড়ার বই থেকে উলটোপালটা বইই পড়ার ঝোঁক বেশি ছিল। এরিক মারিয়া রেমার্ক, জুলে ভার্ন, আলেকজান্ডার ডুমা, চালর্স ডিকেন্স, ডেনিয়াল ডিফো, জনাথন সুইফট্, মেরী শেলী, এডগার অ্যালেন পো, লুইস ক্যারল এর লেখাগুলি গ্রোগ্রাসে গিলতাম। বিদেশি সাহিত্য পড়ার নেশা মাথায় ঢুকিয়ে ছিলেন নরেনদাদু। বানারহাট হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজি শিক্ষক। সুঠাম চেহারার সঙ্গে মাথায় ছিল চকচকে টাক। আদি বাংলার বরিশালে নিজে একটা স্কুল চালাতেন। তারপর দেশভাগের দগদগে ক্ষত বুকে নিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে এসেছিলেন সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল দাদুর বাড়ি। নরেনদাদুর নাতনি সুজাতা ছিল আমার বাল্যসখী। ওর ডাকনাম সাকু। ওর বোন ছিল বনা, ভাই ডাকু। প্রায় সন্ধ্যাবেলায় দাদু আসতেন আমাদের বাড়িতে চা খেতে। চাঁদদি, কুনু, ছোড়দি সবাই দাদুর কাছে আবদার জানাতাম গল্প শোনানোর জন্য। হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো ঘিরে শুরু হতো গল্পদাদুর আসর। তার গলায় ছিল অসাধারণ মডিউলেশন আর নাটকীয়তা। বাবা-কাকারাও নিজেদের গাম্ভীর্য বজায় রেখে আড়ালে দাঁড়িয়ে সে গল্প শুনতেন। রাত বেড়ে গেলে সাকু হাঁক পেড়ে দাদুকে ডাকত। পরের এপিসোডের জন্য চলত প্রতীক্ষা।

সে সময় জাতীয়স্তরে বিজ্ঞান প্রদর্শনী হত। ভারত সরকারের এন.সি.ই.আর.টি এই প্রদর্শনীর আয়োজন করতো। জেলাস্তরে যারা প্রথম, দ্বিতীয় হত তারা যেত কলকাতায় পূর্বভারত বিজ্ঞান মেলায়। বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়াম ও সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চের মাঠে এই আসর বসত। পূর্ব ভারত বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত হয়ে গিয়েছিলাম ব্যাঙ্গালোরের জাতীয় বিজ্ঞান শিবিরে। অভিভাবক হিসাবে সঙ্গে গিয়েছিলেন শিক্ষক তুষারকান্তি সরকার।  এন.সি.ই.আর.টি. এর উদ্যোগে ব্যাঙ্গালোরের লালবাগ গার্ডেনে বসেছিল জাতীয় বিজ্ঞান শিবির। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা জড়ো হয়েছিল এই আসরে। শিবিরের উদ্বোধন করেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি। আমার উদ্ভাবিত 'ওয়াটার টেলিস্কোপ' যন্ত্রটি  রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি, কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী গুন্ডু রাও, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এস. বি. চ্যবন, শীলা দীক্ষিত ও আরও অনেকের নজর কাড়ে। হোঁচট খাওয়া ইংরাজিতে কিছুক্ষণ কথা হলো রাষ্ট্রপতির সাথে। রাষ্ট্রপতি আমার আবিষ্কৃত ওয়াটার টেলিস্কোপ যন্ত্রটির খুব প্রশংসা করেন।

বইপড়া ছাড়া আবৃত্তি, নাটক করা, বিজ্ঞানের মডেল বানানোর নেশা ছিল। সাপ, ব্যাঙ, গিরগিটি, চামচিকা এসব ধরে ফর্মালডিহাইড দিয়ে বোতলে পুরে রাখতাম। ব্যাঙ, গিরগিটির চামড়া মাংস থেকে হাড় ছাড়িয়ে সেগুলিকে আবার আঠা দিয়ে জুড়ে কঙ্কালের পূর্ণ অবয়ব দিতাম। একাজে আমাদের গুরুদেব ছিলেন কেষ্ট দা; ভালো নাম কৃষ্ণপদ কুন্ডু। বানারহাট হাইস্কুলের ল্যাবরেটরির দায়িত্ব ছিল কেষ্টদার ওপর।

যেভাবে ক্যালেন্ডার পুরানো হয়, সেভাবেই এক সময় ক্লাস টেন এ পৌঁছে গেলাম কৈশোর থেকে যৌবনে। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। তখন বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। ফাগুন এল তার রঙের আগুন নিয়ে। বনে নয়, মনে। আকাশটাকে শুধু চোখে রেখে মন হারানোর দিন। গোটা গোটা অক্ষরে রাত জেগে ভালোবাসার স্বপ্নালু চিঠি লেখা। পড়ার বইয়ের ভাঁজে প্রিয়তমার চিঠি রেখে বারবার পড়া। প্রিয়জনকে একটু চোখে দেখার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা। অপটু ছন্দে কবিতা লেখা। গায়ত্রী দিদিমণির মেয়ে সেঁজুতি এক প্রদশর্নীর সময় দিয়েছে লাল গোলাপ। সে রাতটা বিনিদ্র কেটেছিল। স্কুলের পর কলেজে। কখন যে শৈশব-কৈশোর-যৌবন থেকে সময়ের রেলগাড়ি আমাকে নিয়ে চলেছে বার্ধক্যের অভিমুখে -তা টের পাইনি। সেই লেত্তি, সেই লাট্টু আজ বেপাত্তা। সেঁজুতির দেওয়া সেই গোলাপ আজ হয়তো কোনো বইয়ের ভাঁজে চ্যাপ্টা বিবর্ণ। বেয়াড়া মনদোতারা তবু যেন পিলু, ইমনকল্যাণের সঙ্গে মাঝে মাঝে বেহাগ বাজায়।


ছন্দা ঘোষ দস্তিদার- পার্থপ্রতিম আমার বহুদিনের বন্ধু। একই স্কুলে পড়াশোনা করেছি। যে কোনো বিষয়ে ওর মজার মজার রসিকতা বন্ধুমহলে ওকে বেশ জনপ্রিয় করেছিল। ভারতের রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডির কাছ থেকে যখন ও প্রশংসিত হয়ে স্কুলে ফিরে এসেছিল; সে সময় আমরা সব বন্ধুরা ওকে ঘিরে খুব আনন্দ করেছিলাম। আমার বাবা স্বর্গীয় ডাঃ ননীগোপাল দেব, চা-বাগানের চিকিৎসক হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। বাবা যখন উচ্চ বেতনক্রমে অন্য জায়গায় চাকরি পেয়েছিলেন, সে সময় বাগানের শ্রমিকেরা সঙ্গবদ্ধ হয়ে তাকে যেতে দেননি। বিভিন্ন সূত্রে শুনতে পাই, চিকিৎসক হিসেবে পার্থপ্রতিম বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। বহু পুরস্কার সম্মাননা আজ ওর ঝুলিতে। তবে সে একইরকম বিনয়ী ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে রয়ে গেছে। ভালো থাকিস পার্থ। এই শুষ্ক, কঠিন, কঠোর পৃথিবীতে তোর মত মানুষের বড় প্রয়োজন।

♦  ♦  ♦

 

♦  ♦  ♦



লিপিকা বোস ঘোষ- পার্থ আমার বানারহাট হাই স্কুলের সহপাঠী। আমি বিবাহসূত্রে, ৩৫ বছর কৃষ্ণনগরে বসবাস করছি। এখানে এক সরকারী উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকতা করি। ছাত্র হিসেবে পার্থপ্রতিমের তেমন কোনো নজরকাড়া ফলাফল ছিলনা। তবে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা ও চর্চা করত; যেগুলি পাঠ্যসূচীতে ছিলনা। স্কুলের ৭৫ বছরপূর্তি উৎসবে তাকে আবার কাছে পাই। আমার সঙ্গে স্বামী আইনজীবী সুব্রত ঘোষ গিয়েছিল, ওর-ও খুব ভালো লেগেছে। দেখলাম ও বেশ সুন্দরভাবে মঞ্চ সঞ্চালনা করছে। ও বহুরকম ভালো কাজ করে। আগামীতে আরো করবে। ওর বন্ধু হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।

বিষাদ বেলা

আমরা কেষ্টদার অনুপ্রেরণায় বিভিন্ন পোকামাকড় ধরে বেড়াতাম। সে সময় আমি ক্লাস টুয়েল্ভে এর ছাত্র বানারহাট শিশু উদ্যান তৈরী হচ্ছে আমার বাড়ির বেশ কাছেই। সেই উদ্যানের ভেতরে কৃত্রিম পাহাড়ের পাশে থাকছে ছোট্ট জলাশয়। সেই জলাশয়ে শালুক ও পদ্ম রাখার পরিকল্পনা। সেই পাকা জলাশয়ে একদিন একটি সাপের বাচ্চা কোনোমতে পড়ে যায়। আমার সঙ্গী সাথীরা খবর দিল সে কথা। যথারীতি ছুটলাম সাপটাকে দেখতে, ফুট দেড়েক লম্বা হবে।  কালো কুচকুচে, গায়ে কিছু দূর পর পর শাঁখের আংটির মতো সাদা দাগ।  খুব বেশি মোটাও না। ছুটে বাড়িতে এলাম। লুকিয়ে বাড়ি থেকে শিশি বোতল, লাঠি, দড়ি জোগাড় করে হাজির হলাম পার্কের চৌবাচ্চার কাছে। অনেক কসরতের পর সাপটিকে বোতল বন্দী করে রেখে দিলাম রান্নাঘরের পেছনে; সবার চোখের আড়ালে। ভাবলাম সাপটাকে কেষ্টদার কাছে দিয়ে আসব। আমাদের বাড়ির সামনে নরেনদাদুর এক ছেলে ছিল স্বপন গুহ রায়। বেশ সাহসী ও ডানপিটে।  আমরা স্বপন কাকু বলেই ডাকতাম। তখন বানারহাট আদর্শপল্লীটা ছিল মূলত ওপার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তু কলোনী। প্রতিটি বাড়ির সাথে প্রতিটি বাড়ির একটা আত্মিক যোগাযোগ ছিল। তখন তো মোবাইল, টিভি সিরিয়াল বা অন্য কোনো বিনোদন ছিল না। কার বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে সেটাও আরেক বাড়ির মানুষ জানত। মনার বাবা যে ডালের বড়ি দিয়ে লাউ পাতার চচ্চড়ি খেতে ভালোবাসতেন সেটাও আমার মায়ের অজানা ছিলনা। রান্নাবান্নার পরে বাটি চালাচালি হত। স্বপনকাকু প্রায় সকালেই আমাদের বাড়িতে চলে আসত। বাসক গাছের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে ডাক দিতেন বৌদি- ও- বৌদি। মা তাকে ডাঁটি ভাঙ্গা কাপে চা দিয়ে একটা ‘এস’ বিস্কুট ধরিয়ে দিলেন। সেদিনও যথারীতি কাকু চা-বিস্কুটটি খেলেন, আমি প্রবল উৎসাহের সাথে কাকুকে আমার সাপ ধরার গল্প শোনালাম। কাকু বলল- ‘নিয়ে আয় তো দেখি।’ রান্নাঘরের পেছন থেকে সাপের বোতলটা এনে কাকুকে দিই। কাকু সাপটাকে বের করে তার ঘাড়ের কাছে ধরে সকলকে দেখাতে থাকে। আমার খেলার সাথী রত্না সে সময় কলসি, বালতি নিয়ে যাচ্ছিল জল ভরতে। কাকু রত্নার দিকে সাপটাকে এগিয়ে দিয়ে ভয় দেখায়। রত্না কলসি-বালতি নিয়ে পড়ে নালায়। এইসময় কাকুও কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সাপটা কাকুর তর্জনীতে কামড়ে ধরে, কাকুও আঙ্গুল ঝেড়ে সাপটাকে ফেলে দেয়। তারপর আবার সাপটাকে বোতলে ভরে রাখি। এই ঘটনা শুনে মা ছুটে আসে, শাড়ির পাড় এনে আঙ্গুল বাঁধতে চায়। কাকু বলে ওরকম কিছু লাগবে না, একটু কেরোসিন তেল দিন তো। মা এদিকে চেঁচামেচি করছে। আর স্বপনকাকু হাতে একটু কেরোসিন তেল ঢেলে বাজারের দিকে গেল। মা পইপই করে বলতে লাগলো স্বপন ডাক্তারের কাছে যাও।

দুপুরে খাওয়ার পর শুনি কাকুর অবস্থা ভালো না। কাকুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে সময় বানারহাটে কোনো হাসপাতাল ছিল না। বানারহাট লাগোয়া ভুটানের সামসীতে কাকুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন ডাঃ গিরীন্দ্র নাথ শর্মা। তারপর স্বপনকাকুর দাদা ঝন্টু কাকু বললেন- সাপটা নিয়ে এখনি যেতে হবে। আমি, ঝন্টুকাকু, পিলুমামা সাপটাকে নিয়ে রওনা দিলাম সামসীতে। সামসীর হসপাতালে পৌঁছানোর পর সেখানে বেশ লোকজনের ভীড়। একজন গুণীনও সেখানে উপস্থিত। কাকুর জ্ঞান নেই। হাসপাতালের বেডে কেমন যেন আড়ামোড়া ভাঙছে আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। গুণীন আমাকে বলল সাপটাকে হাসপাতালের মাঠে ছেড়ে দিতে। আমি আর ঝন্টুকাকু সাপটাকে ছেড়ে দিলাম। সাপটাও খুব কাহিল, নড়তে চড়তে পারছে না। এদিকে গুণীন মন্ত্র পড়ে চলেছে। ডাঃ শর্মা আমাদের ধমক দিয়ে বললেন- ‘হাসপাতালে আরোও অনেক রোগী রয়েছে, এভাবে সাপ ছেড়ে দেওয়াটা মোটেই ঠিক নয়।’ তারপর আমি আবার সাপটাকে বোতলবন্দী করি। কিছুক্ষণ পরে ডাঃ শর্মা জানিয়ে দেন কাকু আর জীবিত নেই। তখন সন্ধ্যা নামছে। এক লরিতে চেপে কাকুকে নিয়ে আসা হল বানারহাটের বাড়িতে।

এরপর শুরু হল বিভিন্ন গুঞ্জন। স্বপনকাকুর নিশ্চল দেহ নিয়ে কী করা হবে, সে নিয়ে নানা মুনি নানা মত দিতে শুরু করে। শোনা গেল বিভিন্ন গল্পগুজব। কেউ বলল কলার ভেলায় করে কাকুকে তিস্তা নদীতে ভাসিয়ে দিলে সবচেয়ে ভালো হয়। কেউ বলল স্থানীয় ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক করলে কাকু আবার বেঁচে উঠতে পারে। মাথাভাঙায় এক ওঝা আছেন, যিনি তিন দিনের সাপে কাটা মরাকেও জ্যান্ত করে তুলেছেন। তিস্তা বা তোর্ষা নদীতে ভাসিয়ে দিলে সেটা হয়তো বাংলাদেশে পৌঁছে যেতে পারে। সেখানে বড় বড় ওঝা রয়েছেন, যারা স্বপনকাকুকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারবেন।
 
আশি ছুঁই ছুঁই নরেনদাদুকে সেই সময় এক যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে দেখলাম। উনি বললেন- স্বপনকে দাহ করতে হবে। বহু মানুষের অনেক সিদ্ধান্ত ও পরামর্শকে উপেক্ষা করে তিনি অনড় রইলেন। পরে দাদুর মুখে শুনেছিলাম এভাবে মৃতদেহ ভাসিয়ে দিলে সেই দেহ হয়তো কোনো গ্রামের নদীর কিনারায় দুর্গন্ধ ছড়াবে ও পরিবেশ দূষণ ঘটাবে। তাছাড়া কেউ কেউ হয়তো স্বভাববশতঃ গুজব ছড়াবে। বলবে- ‘রংপুরে গিয়েছিলাম সেখানে দেখলাম একজনকে হুবহু স্বপনের মতো দেখতে।’ যেগুলো আমাদের প্রিয়জনদের মধ্যে উৎকন্ঠা ও বেদনা সঞ্চারিত করবে। এ দুনিয়ার তীব্রতম বেদনা- জনকের বর্তমানে সন্তানের চলে যাওয়া। সে পরিস্থিতিতে নরেনদাদুর এই সুচিন্তিত বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত আজও আমার মনোজগতে শ্রদ্ধা ও প্রকৃত সমর্থন জোগায়। পরে জেনেছিলাম স্বপনকাকুকে যে সাপটি কেটেছিল সেটা কালচিতি বা কালাচ সাপের বাচ্চা। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম- বাঙ্গারুস কেরুলিয়াস। এরা সাধারণত ২-৩ ফুট লম্বা হয়। এরা কামড়াতে চায় না, কিন্তু যদি কামড়ায় তবে বেশ কিছুক্ষণ কামড়টাকে ধরে রাখে যার ফলে দংশিত প্রাণীর শরীরে অনেকটা বিষ ঢুকে যায়। এর বিষে মারাত্মক নিউরোটক্সিন থাকে। নিউরোটক্সিন গোত্রের বিষ হওয়ার কারণে এই বিষ দংশিত ব্যক্তির স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেমকে আক্রমণ করে। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর বেশ কিছু লোক এই সাপের কামড়ে মারা যায়। বর্তমানে সঠিক সময়ে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন ও কৃত্রিম শ্বাস- প্রশ্বাসের ব্যবস্থা পেলে অনেক রোগী বেঁচেও যায়।

স্বপনকাকুকে দাহ করার পর আমাদের কেষ্টদা সেই প্রাণঘাতি সাপটিকে ফর্মালডিহাইড সলিউশনে দিয়ে বোতলে রেখে দেয়। সে রাতে কেষ্টদা একটি কবিতা লিখেছিলেন, যার কয়েকটি লাইন বেলা-অবেলায় আজও মনকে আনমনা করে-
“বয়সটা যে ঝড়ের পাখি, বুড়ো মনটা মানে না / স্বপ্ন ভাঙা রিক্ত জেটি, জলের আলপনা, /কালচিতিতে কাটল তারে,  গর্ভিনী যন্ত্রণা।/”

♦  ♦  ♦

উমেশ শর্মা; গবেষক ও প্রাবন্ধিক - অপরূপা ডুয়ার্সের দরিদ্রতম চা শ্রমিকদের সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে ক্যারন, লুকসান, চামুর্চি বাগানে ক্ষেত্র সমীক্ষার কাজে গিয়ে প্রথম আলাপ হয়েছিল ডাঃ পার্থপ্রতিমের সঙ্গে। বছর ত্রিশেক আগে তিনি আদর করে তাঁর চেম্বার থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়িতে। বাড়ির ছোট্ট লনের পাশে ফুলে ফুলে সজ্জিত উদ্যান দেখবার মতো। কথায় কথায় জানতে পারলাম- তিনি ভালোবাসেন ফুলের মতো শোভিত বিচিত্র সমাজ ও সংস্কৃতিতে বর্ণময় ডুয়ার্সের জনজাতিকে। মহাভারতের অর্জুনের মতই তিনি তীরন্দাজ। তার পঞ্চবাণ নিক্ষিপ্ত হয় ওই জনপদ সংলগ্ন জনপদবাসীর অশিক্ষার বিরুদ্ধে,  অসচেতনতার বিরুদ্ধে, দারিদ্র- অস্বাস্থ্য  বিরুদ্ধে এবং সমাজ ও সংস্কৃতির মান উন্নয়নের লক্ষ্যে। ওই আলাপ সূত্রে আজ দীর্ঘদিন ধরে তিনি আমার সুপ্রিয় অনুজ।

১১ নম্বর গাড়ি অর্থাৎ দু পায়ে হেঁটে হেঁটে পিছিয়ে পড়া জনপদবাসীর সঙ্গে হয়েছেন একাত্ম। তার একাত্মতা ঘটেছে অরণ্য ও আরণ্যক প্রাণীর রক্ষায় নিয়োজিত পরিবেশ বান্ধবদের সঙ্গে। জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক মাতব্বর হবার প্রত্যাশায় নয়; হৃদয়ের ঔদার্য দিয়ে জনপদবাসীর হয়েছেন আত্মার আত্মীয়। এ যুগে নিঃস্বার্থভাবে সমাজসেবার কাজে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ ডাঃ পার্থপ্রতিম। তিনি আমার ও আমাদের বান্ধব।

♦  ♦  ♦ 

“একলা পথিক, অনেক আকাশ . . .” -এই বইটি বাংলা প্রকাশনার জগতে এক নতুন স্বাদের সংযোজন।  প্রচলিত যেসব বৈদ্যুতিন পুস্তক বা ই-বুক রয়েছে সেগুলি তথ্য প্রযুক্তির দৃষ্টিভঙ্গিতে পি.ডি.এফ (PDF) অথবা ইপাব(EPUB) ফাইল। এই বইগুলির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল এগুলি একবার ইন্টারনেট বা বিশ্বতরঙ্গে প্রকাশিত বা পাবলিশড্ হলে সেগুলি আর সংশোধন বা সংযোজনের উপায় থাকে না। সংশোধন বা সংযোজন করতে হলে নতুন ফাইল রূপে আবার উপস্থাপিত করতে হয়। আবার নতুন লিঙ্ক তৈরী করতে হয়।
“একলা পথিক, অনেক আকাশ . . .” -এই বইটির ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে না। যে কোন সময় সংশোধন বা সংযোজন করা যেতে পারে। এই বইটির মনোজ্ঞ পাঠকেরা একই লিংকে ক্লিক করে সবসময় সংশোধিত এবং সংযোজিত রূপটি দেখতে পাবেন। তাই এটা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এক ডায়নামিক ই-বুক বা গতিময় বৈদ্যুতিন পুস্তক।
বইটির সাতটি পর্ব; সপ্তকান্ড রামায়ণের মতো। প্রতি পর্বের শেষে পরবর্তী পর্বে যাওয়ার লিঙ্ক রয়েছে। বইটির মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু লিংক বা সূত্র রয়েছে যেখানে ক্লিক করলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মূল প্রকাশিত রচনা পড়তে পারবেন বা ভিডিও দেখতে পারবেন। পরে পুনরায় “একলা পথিক, অনেক আকাশ . . .” -এর নির্দিষ্ট পর্বেও ফিরতে পারবেন।
এই ই-বুকটি মূলত যারা চলভাষ ব্যবহার করেন তাদের কথা মাথায় রেখে তৈরী। এক কথায় যাকে বলে মোবাইল ফ্রেন্ডলি।
বর্তমান কালে বিশেষত নবীন প্রজন্মের মধ্যে ছাপা বই পড়ার রীতি এখন প্রায় অস্তমিত। বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতিতে আর্থিক লাভ-লোকসানের পাটিগণিত  মাথায় না রেখে সংকলক ও প্রকাশক এই বইটিকে বিনামূল্যে সকল পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে দৃঢ় সংকল্প।
এই বইটি পড়ার ক্ষেত্রে QR -কুইক রেসপন্স প্রযুক্তি সংমিলিত রয়েছে। যার ফলে পাঠকেরা QR Code স্ক্যান করে সহজেই বইটি পড়তে পারবেন। মোবাইলে ফেসবুক লগিং করা থাকলে পাঠকেরা সহজেই এই বইটির সম্পর্কে মতামত জানাতে পারবেন। যা অন্য পাঠকের কাছেও পৌঁছে যাবে। প্রতিটি পর্বের উপরে থাকা নির্দিষ্ট হোয়াটসঅ্যাপ আইকনে ক্লিক করে পর্বের লিঙ্কটি অনায়াসে পৌঁছে দেওয়া যাবে প্রিয়জনদের কাছে।
 “একলা পথিক, অনেক আকাশ. . .” কোনো একক ব্যক্তির লেখা জীবনী গ্রন্থ নয়। প্রায় অর্ধশত মানুষের কথা, অনুভূতি অক্ষরবন্দী হয়েছে এই বইটিতে। দেশের মন্ত্রী, মৎস্যবিক্রেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রাজমিস্ত্রী, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান, লোকশিল্পী, গবেষক, চা-শ্রমিক, সরকারী আধিকারিক, সাংবাদিক, সঙ্গীত সংগ্রাহক, গৃহবধূ, প্রধান শিক্ষকসহ বহু গুণীজন এক বিরল ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের অনুধাবনে মুখ খুলেছেন, কলম ধরেছেন বা আঙুল রেখেছেন ল্যাপটপের কীবোর্ডে। যা শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়; বিশ্ব সাহিত্যে বিরল।
এটা সে অর্থে জীবনী বা আত্মজীবনীও নয়; আড্ডা বা আলাপচারিতায় উঠে আসা শব্দপুষ্পকে অক্ষরের সুতোয় গাঁথা এক মালা। মহানগরী থেকে অনেক দূরে আদিবাসী অধ্যুষিত চা-বাগিচার সবুজ গালিচায় থাকা এক ব্যতিক্রমী প্রাণের উপাখ্যান। জীবনের গোধূলিবেলায় এসে এক ভিন্ন পথের পথিকের ফিরে তাকানো বা সিংহাবলোকন। তাঁর ফেলে আসা দিনগুলি নিয়ে মুখ খুলেছেন, কলম ধরেছেন তার কাছের-পাশের মানুষজন। ‘ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁওয়ায় নয়;’ নৈর্ব্যাক্তিক যুক্তিবাদী মন নিয়ে, তাঁরা মত প্রকাশ করেছেন আপন কথকতায়।

বিষয়সূচী (পরবর্তী পর্বগুলি পড়তে নির্দিষ্ট লিঙ্কে ক্লিক করুন)

একলা পথিক; অনেক আকাশ . . . পর্ব - ১

আঁধার ঘরের আলো
১). রাম অবতার শর্মা; সচিব; ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন; ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ
২). জন বার্লা; কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী; ভারত সরকার

ধরার বুকে ধরা
৩). সাধনা বসু
৪). গায়ত্রী বসু ভৌমিক

স্কুলবেলা
৫). ছন্দা ঘোষ দস্তিদার
৬). লিপিকা বোস ঘোষ

বিষাদ বেলা
৭). উমেশ শর্মা; গবেষক ও প্রাবন্ধিক

একলা পথিক; অনেক আকাশ . . . পর্ব - ২

কাজের শুরু
৮). অধ্যাপক আনন্দগোপাল ঘোষ; প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান; উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
৯). ডাঃ পার্থপ্রতিম পান; বিভাগীয় প্রধান; উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও বাচিক শিল্পী

পদবীতে পদাঘাত
১০). অতনু চৌধুরী; বাচিক শিল্পী; আকাশবাণী শিলিগুড়ি
জনবিজ্ঞান আন্দোলন
১১). তুষারকান্তি সরকার; প্রাক্তন শিক্ষক
ইসকা
লভিনু সঙ্গ তব . . .
ভূমিবদল
প্রিয় ডিয়ার

১২). ফিরোজ খান; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি;  শেবি.ও আরজি; বোস্টন; ম্যাসাচ্যুসেটস; ইউ.এস.এ
১৩). অরূপ গুছাইত; জনসংযোগ আধিকারিক; পঃ বঃ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ; পঃ বঃ সরকার
১৪). বিনায়ক বোস; প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; ‘আরণ্যক’, গয়েরকাটা


একলা পথিক; অনেক আকাশ . . . পর্ব - ৩

ক্লিনিক
১৫). জয়কান্ত বর্মন;  নির্মাণকর্মী (রাজমিস্ত্রী)
১৬). শ্রীমতি পম্পা লোধ
১৭). সুশীল মুর্মু; স্বাস্থ্য সহায়ক; বানারহাট চা বাগান
১৮). সংযোগিতা মহালী; শিক্ষিকা

মহামিলনের তান
১৯). অধ্যাপক দীপক কুমার রায়; উপাচার্য; রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়
২০). সৈয়দ নজরুল হক; গীতিকার, লোক শিল্পী ও সাংস্কৃতিককর্মী

সুদূরের পিয়াসী . . .
২১). আশীষ মুখোপাধ্যায়; নৌ-প্রযুক্তিবিদ ও অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমার
২২). চন্দন দাশগুপ্ত; অবসর প্রাপ্ত- অ্যাডিশন্যাল লেবার কমিশনার; প. ব. সরকার

অঙ্কন ও প্রচ্ছদ
২৩). কৃষ্ণ দেব; অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও সংগ্রাহক
২৪). প্রসেনজিৎ ভৌমিক; চিত্রশিল্পী

আলোকচিত্রচর্চা
২৫). অনিরুদ্ধ ঘোষ (বিজু)
তবুও দুজনে
২৬). সুকন্যা আচার্য
২৭). অঞ্জু আচার্য

» » দোঁহারে দেখেছি দোঁহে- ডঃ রামজীবন আচার্য।
আজ যত যুদ্ধবাজ . . .
► ►খবরে প্রকাশ

২৮). দেবাশিষ ভট্টাচার্য; বাচিক শিল্পী ও কবি

একলা পথিক; অনেক আকাশ . . . পর্ব - ৪

হৃদয়ের কথা
২৯). সুকল্যাণ ভট্টাচার্য; প্রধান শিক্ষক
স্বর্গাদপি গরীয়সী . . .
সেই গড়গড়াতেই . .
গ্রামোফোন

৩০). ধীরেন দাস; মাছ বিক্রেতা
সোনার কলমে
কমপিউটার ও প্রযুক্তি


একলা পথিক; অনেক আকাশ . . . পর্ব - ৫

গীতিকাব্য
৩১). ডঃ শীলা দত্ত ঘটক; বিজ্ঞান অধ্যাপিকা ও সঙ্গীত শিল্পী
» » চা-বলয়ের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে গান বাঁধলেন ডাঃ পার্থপ্রতিম।
৩২). অরুণ গৌতম; তবলিয়া ও সঙ্গীত সংগ্রাহক
মঞ্চ থেকে রঙ্গমঞ্চে
৩৩). মিতালি রায়; প্রাক্তন বিধায়ক ধূপগুড়ি
৩৪). মুক্তামালা চ্যাটার্জী

পথে প্রান্তরে
৩৫). গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য; ভ্রমণ সাহিত্যিক
ভবত্যেকনীড়ম্
নীতিশিক্ষার পাঠশালা . . .

৩৬). শ্রীপদ দাস; প্রাক্তন কেন্দ্র অধিকর্তা, আকাশবাণী শিলিগুড়ি
৩৭). কানাই চট্টোপাধ্যায়; নাট্যকর্মী ও বনসাই শিল্পী


একলা পথিক; অনেক আকাশ . . . পর্ব - ৬

ঈর্ষা
৩৮). তপন রায়; চলচ্চিত্র পরিচালক
তার জীবন, তার মরণ . . .
৩৯). রাজেশ প্রধান; শিক্ষক ও সাংবাদিক
তার রাজনীতি তার দেশ
তাঁর ঈশ্বর

৪০). নিতাই চন্দ্র দাস; সম্পাদক; বানারহাট শীতলাবাড়ি উন্নয়ন কমিটি
৪১). ডঃ নিরুপম আচার্য; অধ্যাপক; ভাঙড় মহাবিদ্যালয়


একলা পথিক; অনেক আকাশ . . . পর্ব - ৭

আত্মজ জটায়ু
৪১). ডঃ অমিত কুমার দে; কবি
রাঙাতি
৪২). সুব্রত গুহ;  অধ্যক্ষ; আইবি প্রসেস অ্যান্ড টেকনোলজি সলিউশনস; মানাসাস, ভার্জিনিয়া; ইউ.এস.এ
৪৩). পর্ণপ্রতিম

পুরস্কার ও সম্মাননা
৪৪). ডঃ চন্দন খাঁ; কবি ও অধ্যাপক
স্বীকারোক্তি
আমার পাওয়া ‘নোবেলগুলি’
সঞ্চি

Join our mailing list Never miss an update