একলা পথিক; অনেক আকাশ . . .পর্ব- ২

একলা পথিক; অনেক আকাশ . . .পর্ব- ২

প্রায় চার দশক আগে আকাশগঙ্গার বালুচর ধরে শুরু তার পথচলা । দিকচক্রবাল দিয়েছিল মায়াভরা ছায়া ছায়া আদুরে আলাপ। অনেক আকাশ তাদের তারকা- রবি- শশী নিয়ে আলোকময় ক’রে রেখেছে একলা পথিকের চলার পথ। সেই সূর্যস্নাত যাত্রাপথের গোধূলিবেলায়; পথিক মনের সিংহাবলোকন। আড্ডা উৎসারিত ব্যতিক্রমী জীবনের সে উপাখ্যান- আজ অক্ষরবন্দী।

সম্পাদনা- অনুপম আচার্য; আইনজীবী উচ্চন্যায়ালয়, কোলকাতা। উচ্চতম ন্যায়ালয়; নিউদিল্লী।
গ্রন্থনা- উৎপল মৈত্র; কোলকাতা।

কাজের শুরু

কলেজ জীবনে তিনি বহু বিজ্ঞান শিবির, প্রদর্শনী, সেমিনার, কর্মশালায় অংশ নেন। বিশ্ব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক গবেষক দলের সদস্য হিসাবে অসমের মানস অভয়ারণ্যে ধনেশ পাখি ও গোল্ডেন লেঙ্গুর-এর ওপর বিশেষ গবেষণা চালান। 
বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট পলিটেকনিক কলেজে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন। যেখান থেকে বের হওয়ার পর তিনি কোলকাতার এক বেসরকারী নির্মাণ সংস্থায় সাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেন। আশির দশকের শুরুতে সল্টলেক জুড়ে তখন জোর কদমে চলছে নির্মাণের কাজ। বহুতল বাড়ি নির্মাণের জন্য পাইল ফাউন্ডেশন চলছে। দিনরাত ঢং-ঢং শব্দে চলছে লোহার বড় বড় পাইপ মাটিতে ঢোকানোর কাজ। নির্মাণ কাজ দেখা শোনার দায়িত্ব পার্থপ্রতিমের ওপর। শ্রমিক শোষণ, সঠিক সুরক্ষা উপকরণ ছাড়াই শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগানো, স্থানীয় নেতা-মাতব্বরদের মাঝে মধ্যে মদ খাওয়ানো। থানা ফিটিং রাখা। রড-সিমেন্ট চুরি, পাওনা বকেয়া আটকে রেখে শ্রমিকদের রাতদিন কাজ করতে বাধ্য করা। চোর পুলিশের খেলা তার ভালো লাগল না। প্রযুক্তির বৌদ্ধিক প্রয়োগের চেয়ে অন্যসব বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কয়েকটি কোম্পানিতে যোগাযোগ করা হলো। কম বেশী সবাই একরকম। বছর খানেকের মধ্যেই বুঝে গেলেন। তার মন- মনন ও মানসিকতা যে রঙতুলিতে সম্পৃক্ত; এ ক্যানভাস তার উপযুক্ত নয়। এক দাদা তাকে বললেন- ‘পড়াশুনার যদি একটাই লক্ষ্য হয় চাকরি পাওয়া; তবে সমাজে শুধু ভৃত্য তৈরী হবে, প্রভু তৈরী হবে না।’ কথাটা তার মনে ধরলো। শুরু হলো অন্য এক অন্বেষণ। পার্থপ্রতিম চললেন অন্য পথের সন্ধানে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স’। এখানে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পান সি. ভি. রমন। ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের আর্থিক সহায়তায় শুরু হতে চলেছে বিজ্ঞান সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম চর্চার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মশালা।

পার্থপ্রতিম ছাত্রজীবনে বহু বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন, পুরস্কৃত হয়েছেন। গ্রামের উপযোগী প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রশংসিত হয়েছিলেন সেকারণে বিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর ডিগ্রী না থাকা সত্ত্বেও তাকে এই বিষয়ে চর্চার সুযোগ দেওয়া হয়। সেইখানে এই কোর্সটি স্থানীয়স্তরে পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ‘‘সায়েন্স অ্যাসোশিয়েশান অফ বেঙ্গল’’- এর কর্ণধার ডঃ শুভব্রত রায়চৌধুরী। এই কর্মশালায় তিনি দেশের স্বনামধন্য বিজ্ঞান সাংবাদিকদের সান্নিধ্যে আসেন। পথিক গুহ, সমরজিৎ কর, ইন্দিরা গান্ধীর বিজ্ঞান উপদেষ্টা বাসন্তী দুলাল নাগ চৌধুরী আরও বহু কৃতি মানুষের কাছে বিজ্ঞান সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ নেন। এরপর তিনি ফিরে আসেন তার মনমতো পেশার জগতে। আনন্দবাজার পত্রিকা, আজকাল, বর্তমান, গণশক্তি, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, জ্ঞানবিচিত্রা (ত্রিপুরা) বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তার প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এই সময় তিনি তাঁর নামের থেকে সংস্কারমূলক পদবী ত্যাগ করেন।

অধ্যাপক আনন্দগোপাল ঘোষ; প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান; উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় -  আমার চোখে ডাঃ পার্থপ্রতিম ৬ নম্বর ব্যক্তি। তিনি আর পাঁচজনের মতো নয়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমি তাকে দেখছি। তার সামাজিক কর্মকান্ডের বিভিন্ন রকম ব্যাপ্তি। কখনও বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের নিয়ে রক্তদান উৎসব। কখনও আবার মনীষীর মূর্তির স্থাপনের উদ্যোগ, কখনও সাহিত্য বাসরের আয়োজন করা। এর পাশাপাশি গান তৈরী করা, প্রদর্শনীর আয়োজন করা, চা-শ্রমিক পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার বিকাশ ঘটানো। তার অনাগত দিনগুলির প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইল।

ডাঃ পার্থপ্রতিম পান; বিভাগীয় প্রধান; উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও বাচিক শিল্পী- মুখোমুখি না হলেও ডাঃ পার্থপ্রতিমের সাথে পরিচয় দীর্ঘদিনের। তিনি একসময় উত্তরবঙ্গের এক জনপ্রিয় পত্রিকার স্বাস্থ্য বিষয়ক পাতায় নিয়মিত লিখতেন। সে সময় তার লেখা পড়তাম। তিনি নামের সাথে সংস্কারমূলক পদবী ব্যবহার করেন না। যেহেতু আমিও বহুকাল ধরে সাহিত্য জগতে রয়েছি, আমাদের দু’জনের নামের সাদৃশ্য আছে তাই অনেকে আমার সাথে বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেন। এখন আমরা পরস্পরের কাছে এসেছি। পার্থপ্রতিম আমার অগ্রজ। তিনি ভালো মানুষ, কাজের মানুষ, গুণী মানুষ। বহু ধরনের সৃজনে তিনি সম্পৃক্ত ।

♦  ♦  ♦

পদবীতে পদাঘাত

“চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।”

অর্থাৎ, “গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।” শ্রীমদ ভগবদগীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ১৩ শ্লোকে তথাকথিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গর্বের সাথে এই ঘোষণা দিয়েছেন।

শ্রীমধুসূদন হয়তো, কার কী গুণ বা যোগ্যতা ? সে ভিত্তিতে তার কী কর্ম করা উচিত- সে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই ভিত্তিতে বর্ণ বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিল। এই চর্তুবর্ণ- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র  ভেদাভেদ প্রথা অনেকেরই কমবেশি জানা। পরবর্তীকালে সেটাই বংশানুক্রমিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাসের ছেলে দাস হবে, ভট্টাচার্যের ছেলে ভট্টাচার্য। সে তার পৌরোহিত্য করার যোগ্যতা বা গুণ থাকুক, বা নাই থাকুক। এর পাশাপাশি কিছুক্ষেত্রে পূর্ব পুরুষের প্রাপ্ত উপাধি বংশানুক্রমিক ভাবে মিশে গেছে পারিবারিক পদবির সাথে। রায় চৌধুরী, চক্রবর্তী, মজুমদার আরো বহু কিছু।

অধ্যাপক শ্যামল শীল যখন তার পরিচয় দেন- তখন আমরা বুঝে ফেলি তিনি আজ অধ্যাপক হয়েছেন ঠিকই, তবে চার- পাঁচ পুরুষ আগে তার বংশধরেরা অন্য মানুষের চুল কেটে বেড়াত। একইভাবে চিকিৎসক অজিত সূত্রধর- এর নাম শুনে বোঝা যায় তারা পাঁচ পুরুষ আগে কাঠের কাজ করতেন। এই চার-পাঁচ পুরুষ আগে কারো পৈতৃক পেশা, নামের সাথে বয়ে বেড়াতে হবে; এটা একটা অশ্লীল- কুপ্রথা। যা একসময় ছিল ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত সুধা, তাই আজ পরিণত হয়েছে বিষবাষ্পে; যা আজও প্রবলভাবে বর্তমান। সরকারি সুযোগসুবিধা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই পদবীটাই এখন অন্যতম বিচার্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সংরক্ষণ থাকতে পারে, তবে স্বাধীনতার ৭৫ বছরের পরে জাতপাত নয়, তার ভিত্তি হোক ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থা। যে সকল শিশু- কিশোরের পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল তাদের দেওয়া হোক বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ। কম মেধা সম্পন্ন কিশোর বা যুবককে জাতপাতের ভিত্তিতে উচ্চতর সুযোগ দিলে; দেশের প্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হবে। এই সংরক্ষণ বন্ধ করলে ভারতীয় রাজনীতি সাবালক হবে। তখন জাতপাত নয়; স্থানীয় উন্নয়ন, কর্মসংস্হান, শিক্ষাবিস্তার, স্বাস্থ্য পরিষেবা এগুলিই ভোটযন্ত্রে প্রাধান্য পাবে। দেশে যখন বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র জারি হয়েছে তখন এইসব মধ্যযুগীয় প্রথা অবিলম্বে বিলোপ হোক। সুনীল শীলের নাম, হোক না সুনীল আকাশ। অধ্যাপক বাদল সূত্রধর পরিচিত হোক বাদল বাউল নামে। যিনি যে নামে পরিচিত হতে চান; আইনানুগভাবে তাঁর জন্য সে সুযোগও থাকা উচিত। নামের সঙ্গে পদবি উল্লেখ মানুষে-মানুষে বৈষম্য, অহমিকা, হিংসা ও দূরত্ব রচনা ছাড়া; অন্য কোনো শুভবোধের উন্মেষ ঘটায় কী ?

শিকারী জিম করবেটের ‘মাই ইন্ডিয়া’ স্মৃতিচারণ গ্রন্থের একটি ঘটনা মনে পড়ে যায়। মোকমা ঘাট এলাকায় করবেট স্থানীয় কচিকাঁচাদের জন্য একটি স্কুল ঘর তৈরী করেছিলেন। গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া, বাঁশ কাঠির দেওয়াল দেওয়া স্কুল ঘর। শুরু হয়েছিল লেখাপড়া। কিন্তু বাধ সাধলেন গাঁয়ের মোড়লেরা। একই ঘরের মধ্যে নমঃশুদ্র ছেলেটির সাথে ব্রাক্ষ্মণ ছাত্রটি কী ভাবে বসবে ? চাপে পড়ে জিম করবেট চালটি রেখে ঘরের চারদেওয়াল খুলে ফেলে দিলেন। তখন আর সেটি ঘর রইল না। মাতব্বরদের বাধাও রইল না। হ্যাঁ, আর কতকাল ? করবেটের মতো নব প্রজন্মকে পদবির প্রাচীর ভাঙ্গার কাজে এগিয়ে আসতে হবে; চেতনার দৃঢ় পদাঘাত।

অতনু চৌধুরী; বাচিক শিল্পী; আকাশবাণী শিলিগুড়ি - পার্থপ্রতিম আমার বহু দিনের বন্ধু। পিছিয়ে পড়া ডুয়ার্স এলাকায় থেকে ও যেসব কাজ করে চলেছে তার প্রশংসার দাবি রাখে। তার দ্বারা বহু মানুষ উপকৃত হয়। আমাদের আকাশবাণীতেও বহুবার অনুষ্ঠান করেছে। দূরবীন, প্রোজেক্টর, ল্যাপটপ দিয়ে মানুষকে আকাশ দেখায়, আকাশ চেনায়। আকাশ ঘিরে বহু ধরনের কুসংস্কার এখনও আমাদের মাঝে রয়েছে। অনেকে আঙ্গুলে, হাতে পাথর ধারণ করে ভাবে ভাগ্য পরিবর্তন করা যাবে। সে ভুল ভাঙ্গাতে পার্থপ্রতিম বহু বছর ধরে নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ত সময়েও প্রয়োজনীয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াই তার লক্ষ্য এবং কর্তব্য। এই কর্তব্যে অবিচল থেকে ডুয়ার্সের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বেঁচে থাকার রসদ যোগান। পার্থ এইসব করেই আনন্দ পায়, আগামীতেও করবে।

জনবিজ্ঞান আন্দোলন

১৯৮৬ সালে মে দিবসের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে  ৬ই নভেম্বর থেকে ১২ই নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ দপ্তরের উদ্যোগে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে এক বিরাট সর্বভারতীয় বিজ্ঞানমেলার আয়োজন করা হয়। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সরকারী সংস্থা ও বিজ্ঞান ক্লাব সাতদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। সল্টলেক স্টেডিয়ামের নীচে সে সময় আবাসিকদের থাকার জন্য ডর্মিটরি ছিল। আমরা সেখানে দল বেঁধে থাকতাম। আমার সাথে গিয়েছিল ভাই লালটু (দেবাশিষ কুন্ডু)। আমাদের প্রোজেক্ট এর বিষয় ছিল চামূর্চীর মহাকাল গুহা। ভূ-বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় এই গুহাকে বলে স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাগমাইট কেভ। চুনাপাথর বা ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের সঙ্গে পাহাড়ি আম্লিক জলের রাসায়নিক ভাঙ্গাগড়ার খেলা চলে এই আঁধার ঘেরা কন্দরে। প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়ালে পাহাড়ের গুহার ভেতর নেমে  এসেছে পাথরের তৈরী লম্বা লম্বা শিবের জটা। জটা থেকে অবিরাম টুপটাপ ঝরে পড়ছে জলবিন্দু। এই জলে রয়েছে দুরারোগ্য চর্মরোগ আরোগ্য করার ক্ষমতা। আমরা অমল স্যার এর স্কুল কোয়ার্টারে অর্থাৎ লালটুদের বাড়িতে বেশ কিছু দিন ধরে প্রোজেক্টটি বানিয়ে ছিলাম। আমি, লালটু মহাকালে গিয়ে সেই গুহা থেকে পাথর জমা ত্রিশূল ও জটার বড় টুকরো ভেঙ্গে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের মডেল, চার্ট, ডিমনেস্ট্রেশন সবকিছু খুব আকর্ষণীয় ছিল। অমলস্যার নিজে আমাদের পাশে থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন বিষয় আমাদের মাথায় দিতেন। লালটু মডেল বানানো, চার্ট তৈরীতে খুব ওস্তাদ।

সুভাষ চক্রবর্তী চিরকালই বেশ প্রাণবন্ত-হুজুকে ছিলেন। তার জনসংযোগ ছিল গগনচুম্বী। বহুলোকের নাম ও পরিচয় তার মগজস্থ ছিল। অল্প আলাপের লোকজনকেও তিনি নাম ধরে ডাকতেন। আমাদের বলতেন ছোটো বিজ্ঞানী। আমাদের এই প্রদর্শনী চলার সময় একদিন সকালে সুভাষদার সাথে মিঠুন চক্রবর্তী সল্টলেক স্টেডিয়ামে হাজির। ডিস্কো ডান্সারের সৌজন্যে তার জনপ্রিয়তা তখন আকাশছোঁয়া। আমরা এ খবর শোনামাত্রই সবাই দৌড়ে গেলাম মিঠুনদাকে দেখতে। সে সময় মোবাইল বিপ্লবও হয়নি, আমাদের কাছে ক্যামেরাও ছিল না। আমরা গিয়ে মিঠুন চক্রবর্তীর সাথে শেক-হ্যান্ড করলাম। খুব সম্ভবত হোপ ৮৬ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির ব্যাপারে এসেছিলেন সরজমিন করতে। সে সময় ঐ  খুদে বিজ্ঞানীদের নিয়ে সুভাষদা একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ করিয়েছিলেন। সেই ম্যাচে সুযোগ নেওয়ার জন্য সবাই হুটোপুটি লাগিয়ে দেয়- “আমি খেলবো, আমি খেলবো . . . আ মি খে ল বো।” আমি আয়োজক দাদাকে মজা করে একটু গম্ভীরভাবে বললাম- ‘না, আমি খেলবো না। সুব্রত কাপ খেলতে গিয়ে একটা চোট লেগেছে।’ আমি সুব্রত কাপের প্লেয়ার ভেবে তিনি আমাকে ‘মিনিস্টার ইলেভেন’ দলে সুযোগ দেন। সে খেলায় বেশ মজা হয়েছিল।

সুভাষদার বিভিন্ন কাজে একটা শাহী ব্যাপার থাকে। আটদিন ব্যাপী সেই অনুষ্ঠানে খাওয়াদাওয়ার দায়িত্বে ছিল বিজলী গ্রিল ক্যাটারার। সে সকালের ব্রেকফাস্ট থেকে, দুপুরের লাঞ্চ, সন্ধ্যায় স্ন্যাক্স, রাতে ডিনার সবদিনই বিয়ে বাড়ির মতো খাওয়া দাওয়া। শেষমেশ অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলাম এইসব ধরনের ভালো খাওয়ার খেতে খেতে। বাড়ি ফিরে মা কে বলেছিলাম- ‘মসুর ডাল আর আলু সেদ্ধ ভাত দাও। আর কিছু দেওয়ার দরকার নেই।’

সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে বহু মানুষের সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। সেখান থেকে নির্বাচিত হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়া সর্বভারতীয় ছাত্র সম্মেলনে আমাদের প্রোজেক্টটি নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে খুব কাছে থেকে জ্যোতি বসুকে দেখি। সে সভায় দোভাষী নিয়ে জ্যোতিবাবু বক্তব্য রাখেন। দু’ মিনিট ইংরাজিতে বলে চুপ করছেন আর আরেকজন উদাত্ত কন্ঠে সেটিকে তেলেগু ভাষায় অনুবাদ করে বলছেন। আমরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া অতিথিরা জ্যোতি বসুর একদম কাছাকাছি ছিলাম। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা পি.সুন্দরাইয়া, বিজয়ওয়াড়ায় আমরা গিয়েছিলাম তাঁর স্ত্রীর সাথে দেখা করতে। ইটের পাঁচিল দেওয়া টিনের চালের একতলা ছোট্ট বাড়িতে তিনি থাকতেন। কোলকাতা থেকে একজন বাংলাভাষায় তাকে চিঠি লিখেছিলেন অনেকদিন আগে। শ্রীমতি সুন্দরাইয়া ভাঙা বাংলা বলতে পারলেও পড়তে পারতেন না। সেই চিঠি তাকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। সে স্মৃতি আজও জ্বলজ্বলে মনের মণিকোঠায়।

তুষারকান্তি সরকার; প্রাক্তন শিক্ষক- কখনও সে বিজ্ঞানে, কখনও সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতায়, কখনও সে আত্মপ্রকাশ করে জনপ্রিয় লেখায়- শব্দের মায়াজাল বোনায়। সে ইতিমধ্যেই বিভূষিত হয়েছে বিভিন্ন সম্মাননা, সম্বর্ধনা ও প্রশংসায়। ঝুলিতে ভরেছে অসংখ্য পুরস্কার। সে আর কেউ নয়; আমার অন্যতম প্রিয় ছাত্র ডাঃ পার্থপ্রতিম।
একদা পাখির নীড়ের মতো শান্ত ডুয়ার্সের একটি জনপদ জলপাইগুড়ি জেলার বানারহাটে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যশালী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে একাদশ-দ্বাদশ শাখার প্রথম শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হই। পড়ানোর বিষয় রসায়ন। তখন পার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র- একটি কিশোর বালক।  অবসর গ্রহণের পর ভালোবাসার টানে আমি বানারহাট জনপদে  আবাস গড়লাম, এখন ডাঃ পার্থপ্রতিম এই অঞ্চলের একটি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
লক্ষ্য করেছিলাম পার্থপ্রতিমের ভেতর ছিল একধরনের ‘প্রজ্ঞামিশ্রিত পাগলামি’- যা অনুসন্ধিৎসা ও মেধায় সিক্ত, মনীষার আলোকে উজ্জ্বল। এই পাগলামিকে কিছুটা প্রশ্রয় দেওয়া ছিল আমার একটি কাজ। পার্থ তার চলার পথে নিজেকে আরো উন্নত করুক, বহু মানুষ ওর দ্বারা উপকৃত হোক, মনে প্রাণে এই কামনাই করি ।

ইসকা

আশির দশকে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন বিজ্ঞান ক্লাব আন্দোলনে। ষাট দশকের শেষদিক থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে ওঠে। বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে জানা, বোঝা ও নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় বিজ্ঞানকে  কাজে লাগানোর লক্ষ্য নিয়ে তৈরী হয় বিজ্ঞান ক্লাব। বিজ্ঞানের মডেল তৈরী, ছাত্র-ছাত্রীদের বিজ্ঞানের রহস্য হাতে কলমে শেখানো, পরিবেশ সংরক্ষণ, কুসংস্কার দূর করা এইসব বিভিন্ন বিষয়ে সাধারণ জনগণের সামনে তুলে ধরাই এই বিজ্ঞান ক্লাবগুলির উদ্দেশ্য ছিল।

পরবর্তীকালে পূর্বভারতের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা বিজ্ঞান ক্লাবগুলিকে নিয়ে একটি সম্মিলিত সংগঠন বা আমব্রেলা অরগানাইজেশন তৈরী হয়। EASTERN INDIA SCIENCE CLUB ASSOCIATION সংক্ষেপে ‘ইসকা’(EISCA) । বিভিন্ন বিজ্ঞান ক্লাব তাদের স্থানিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে তাদের নিজ নিজ এলাকায় বিজ্ঞান চেতনা প্রসারে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ক্লাবগুলি পরস্পরের মধ্যে অভিজ্ঞতা, সুবিধা-অসুবিধা, ভাবনা ও মত বিনিময় করার লক্ষ্য নিয়েই চলতে থাকে ইসকা-র কর্মকান্ড। ১৯৮৩ সালে ইসকা সরকারীভাবে নথিভুক্ত হয়। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উড়িষ্যা এইসব রাজ্য থেকে বহু বিজ্ঞান ক্লাব ইসকা-র সদস্য হয়। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিধিরা ইসকা-র বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেয়। পার্থপ্রতিম বিজ্ঞান সাংবাদিকতার সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়েন জনবিজ্ঞান আন্দোলনে। ১৯৯০-৯১ ও ৯২ পরপর তিন বছর তিনি ইসকার সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন। ঠাকুরনগর, গড়িয়া, কাকদ্বীপ বিভিন্ন স্থানে পার্থপ্রতিমের নেতৃত্বে জাতীয় বিজ্ঞান ক্লাব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় ইসকার সভানেত্রী ছিলেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজির ডেপুটি ডিরেক্টর ডঃ অনিতা পাকড়াশী।

লভিনু সঙ্গ তব . . .

অনিতা পাকড়াশী- আমাদের অনিতাদি ছিলেন এক উদারমনস্ক বৈজ্ঞানিক। তাদের পারিবারিক ঘরানার মধ্যে শিক্ষা- বিজ্ঞান- গবেষণা জড়িয়ে ছিল। তার দাদা  অশোক কুমার বড়ুয়া  ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানী, তার গবেষণার বিষয় ছিল ঘনপদার্থবিজ্ঞান। পদার্থবিজ্ঞানের এই শাখাতে বিভিন্ন ঘন পদার্থের নানা ধর্ম, যেমন-অতিপরিবাহিতা, অর্ধপরিবাহিতা, অয়শ্চৌম্বকত্ব ইত্যাদি গবেষণা হয়।   পরে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সাইন্স -এর ডাইরেক্টর হন। অনিতাদির সহধর্মী ছিলেন বিজ্ঞানী সতীশ চন্দ্র পাকড়াশী। সর্পগন্ধ্যার উপাক্ষার ও ঘুমের ওষুধের ওপর তার গবেষণা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রশংসিত হয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতি হন। তার উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে কলকাতায় ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। যে সম্মেলনের উদ্বোধক ছিলেন ভারতের তৎকালীন  প্রধানমন্ত্রী পি.ভি. নরসীমা রাও।

অনিতাদি থাকতেন গড়িয়াহাটে মেঘমল্লার নামের এক বহুতল আবাসনে। ইসকার বিভিন্ন সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে আলাপ- আলোচনার জন্য অনিতাদির বাড়িতে প্রায়ই যেতে হতো। দিদি কখনই খালি মুখে ফিরতে দেননি। তখন ল্যান্ডফোনের যুগ। এমনও হয়েছে দিদির বাড়িতে গিয়েছি, দিদি বাড়িতে নেই। ফোন করে জানলাম তিনি গবেষণার কাজে ল্যাবেই রয়েছেন। সেন্ট্রিফিউগাল মেশিনে স্পেসিমেন বসিয়েছেন। তবুও ওনার বাড়ির লোককে বলে দিতেন- “পার্থপ্রতিমকে কিছু খেতে দিস। তারপর পরে একদিন আসতে বলিস। আমার আসতে একটু দেরি হবে।” কলকাতার লোক সম্বন্ধে উত্তরবঙ্গের অনেকের একটা ধারণা রয়েছে। তারা কৃপণ ও অতিথি পরায়ণ নয়। আসলে, জায়গা হিসেবে মানুষের স্বভাব চরিত্রটা বিচার করাটা সঠিক হয় না।

অনিতাদির সাথে কেমিক্যাল বায়োলজির বহু বিজ্ঞানীর গবেষণা পদ্ধতি সামনে থেকে দেখেছি। আমার সাথে সে সময় সঙ্গী ছিল অগ্রজ অলোক দাস। অলোকদা থাকতেন এন্টালীতে। আমি তখন সল্টলেকের কে.বি. ব্লকে থাকি। ১৯৮৯  সালে উত্তর চব্বিশ পরগণার ঠাকুরনগরে বিজ্ঞান ক্লাব সম্মেলন ও তিনদিন ব্যাপী বিজ্ঞান মেলা হয়। সে সময় অনিতাদি আমাদের সাথে লোকাল ট্রেনে চেপেই ঠাকুরনগরে গিয়েছিলেন। গান- আড্ডা- হাসি-ঠাট্টা- ঝালমুড়ি খাওয়া বেশ মজা করে সে যাত্রাপথ কেটেছিল। জীবনে চলার পথে দেখেছি- মানুষ যখন একটা বড় পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন তাদের আর নাক শিটকানি, বাছ-বিচার থাকে না। আমরা যারা ছোটো মাপের মানুষ, তারাই সবসময় ইগো ও অহমিকাকে আঁকড়ে ধরে রাখি।

ডঃ দীপঙ্কর রায় - এমনই আরেকজন মানুষ ছিলেন দীপঙ্করদা। কলকাতার সেন্ট পল ক্যাথিড্রাল চার্চের মাঠে বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করতো জহর শিশুভবন ও NCERT। চার্চের মাঠ জুড়ে তৈরি হতো প্রদর্শনীর প্যান্ডেল। আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ছাড়াও এই মেলায় আসতো বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা।

আমি তখন একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। ডুয়ার্সের এক গ্রামীণ স্কুল থেকে এই মেলায় মডেল নিয়ে গিয়েছি। বাদামি রঙের আটপৌরে খদ্দরের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, পায়ে আদ্যিকালের চামড়ার চটি; এক ভদ্রলোক উত্তরবঙ্গের বিজ্ঞান সংগঠনগুলি সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি ঘুরে বেড়াতেন মেলা প্রাঙ্গণে। আপনি কী করেন? জিজ্ঞাসা করতে তিনি বলেছিলেন- “আমি এই আর কী... শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথেই যুক্ত।” তাঁর পোশাক- আশাক হাবভাব দেখে আমরা ধরে নিয়েছিলাম, তিনি নিশ্চয়ই কোনো ইস্কুলের দপ্তরী বা অশিক্ষক কর্মী। তাছাড়া যদি টিচারই হন; তবে তো সগর্বে নিজের পরিচয় দিতেন।

পরে অন্য সূত্রে জানতে পারি তিনি ডঃ দীপঙ্কর রায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক। এরপর বিজ্ঞান ক্লাব আন্দোলনের সূত্র ধরে বহুবার দীপঙ্করদার বাড়িতে গেছি। তিনি যাদবপুরের ১৩ রিজেন্ট স্টেট-এ থাকতেন। ভাই ও ভ্রাতৃবধুর সাথে। তার ভাইবউ শান্তি স্বরূপ ভাটনগর সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। ওনার বাড়িতে দেখছি কাজের মাসি ছাড়া আর  সকলেই ডক্টরেট।

দীপঙ্করদার সাথে বোস ইনস্টিটিউট, সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক, ন্যাশনাল ইনস্ট্রুমেন্টস আরো বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিজ্ঞানীদের কাজকর্ম-গবেষণার ধরন-ধারন খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। ইসকার সাধারণ সম্পাদক থাকার  সময় দীপঙ্করদার যাদবপুর-এর বাড়িতে নিয়মিত যেতাম। তখন দেখছি বহু স্কুলের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দীপঙ্করদার তত্ত্বাবধানে পি.এইচ.ডি করছেন। তারই পাশাপাশি পাড়ার ছোট্ট ছেলেটি পিতা পুত্রের বয়সের সমষ্টি সংক্রান্ত পাটিগণিতের অঙ্ক দীপঙ্করদার কাছ থেকে বুঝে নিচ্ছে। ছেলে-বুড়ো-গবেষক-অজ্ঞ সকলকেই সমান মনোযোগ দিয়ে পড়াতেন। দীপঙ্করদা ইসকা (Eastern India Science Club Association)-কে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসতেন। দীপঙ্করদার মতে- ‘ইসকার সদস্য ক্লাবগুলি তাদের নিজস্ব পরিচিতি (Identity) বজায় রাখতে পারবে। বৃহৎ সংগঠন কোনো ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র ক্লাবগুলিকে গ্রাস করবে না। বিষয়টি বিভিন্ন ফুলে গাঁথা মালার মতো হবে। স্থানীয় প্রয়োজন, সমস্যা, উপলদ্ধি অনুসারে বিজ্ঞান ক্লাবগুলি কাজ করবে এটাই হল ইসকার লক্ষ্য।’ ইসকার সাধারণ সম্পাদক হয়ে আমি পূর্বভারতের বিজ্ঞানক্লাবগুলির মধ্যে সমন্বয়ের কাজে লেগে পড়ি। সে সময় রায়দীঘি, ক্যানিং, ঠাকুরনগর, কিষাণগঞ্জ, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। সব জায়গায় দেখেছি দীপঙ্করদার আপনজন ছড়ানো।

পদ্ধতিগত কারণে আমার সাথে দীপঙ্করদার বহুবার মতভেদ ও মতান্তর হয়েছে। তবে কোন ক্ষেত্রেই মনান্তর হয়নি, দীপঙ্করদা সবসময় সহযোগিতা করেছেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ ডি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি এস সি ছাড়াও গবেষণার কাজে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গেছেন। সান্নিধ্যে এসেছেন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীদের। শুধু গণিত নয়, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল সব বিষয়েই ডঃ রায়ের অগাধ পান্ডিত্য। প্রসঙ্গ তুললেই হল, যে কোনো বিষয়ে তিনি নির্বিকারে বলতে পারতেন।

পরে মাটির টানে ও পারিবারিক কারণে আমি ডুয়ার্সে চলে আসি। দীপঙ্করদা তখনো যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০২ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সভাগৃহে আমাকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস পুরস্কার দেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখি দীপঙ্করদা অনেক আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন- ‘পার্থপ্রতিম তোমার এই পুরস্কার পাওয়াতে আমি খুব খুশি হয়েছি।’

জীবনে চলার পথে বহু লোক দেখেছি। তবে ডঃ দীপঙ্কর রায়ের মতো নিরহঙ্কারী, প্রচার বিমুখ, গদির লোভহীন, নিরলস মানুষ তেমন কাউকে চোখে পড়েনি।

ডঃ শুভব্রত রায় চৌধুরী- কলকাতার বিখ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারের ৩৪তম প্রজন্ম। হ্যাঁ, সাবর্ণ রায়চৌধুরীর কাছ থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে জব চার্নক কলকাতা, সুতানুটি, গোবিন্দপুর গ্রামগুলি নিয়েছিলেন। তাদের বাণিজ্য প্রসারিত করার জন্য।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এম.এস.সি। তারপর আবার সমাজবিজ্ঞান নিয়ে  স্নাতকোত্তর  করেন। তারপর পি.এইচ.ডি.। তাঁর গবেষণার বিষয় ‘সামাজিক দর্শন ও মূল্যবোধ’।  যাদবপুর ইউনিভার্সিটি রিজিওনাল কম্পিউটার সেন্টারে তিনি দীর্ঘদিন ইনফরমেশন এনালিস্ট এর কাজ করেছেন । কলকাতা শহরে কম্পিউটার চর্চার শুরুয়াৎ হয় এই আর.সি.সি.-তেই।
পরবর্তীকালে দেশের বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠানে তিনি দায়িত্বশীল পদে ছিলেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির তিনি ছিলেন উপদেষ্টা। মধ্যপ্রদেশের টেকনো গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে তিনি দীর্ঘ ছ’বছর উপাচার্যের পদ অলংকৃত করেন।
জনমানসে বিজ্ঞান চেতনা প্রসারে তিনি গড়ে তোলেন সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল (স্যাব)। বিশেষত সুন্দরবন এলাকায় থাকা জনমানসে তিনি বিজ্ঞানচেতনা প্রসারে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাঁর উদ্যোগে বেশ কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক গান রূপায়িত হয়েছে, যা ভারতরত্ন ভূপেন হাজারিকার কন্ঠে গীত হয়েছে।
অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন - ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর হাত থেকে নিয়েছেন জহরলাল নেহেরু পুরস্কার। গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য পুরস্কার পান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে। একসময় সম্পাদনা করেছেন বিজ্ঞানমেলা পত্রিকাটি। বিজ্ঞান জনপ্রিয় করতে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া সায়েন্স ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন (ইসকা)-র সাথেও।
আমার সাথে পরিচয় ’৮০ এর দশকের শেষদিকে। তারপর সম্পর্কটা দাদা-ভাইয়ের মতো দাঁড়ায়। শুভব্রতদার সবচেয়ে মনকাড়া বিষয় হল তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে মন খুলে মিশতে পারেন। শিক্ষা- কুল মর্যাদায় উচ্চস্তরের হলেও সকল শ্রেণীর সঙ্গে তিনি সমান সাবলীল। তার কাছ থেকে বহু কিছু শিখেছি। এখনও শিখি।

দীপক দাঁ- এমনই আরেকজন মানুষ হলেন দীপক দাঁ। গোবরডাঙ্গার। ৬০-এর দশকে তারা গোবরডাঙ্গা রেনেশাঁস ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন। এটাই পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বিজ্ঞান ক্লাব। গোবরডাঙ্গা রেনেশাঁস ইনস্টিটিউটে বহুমুখী কর্মকান্ড চলত। ধোঁয়াহীন চুলা, গ্রামের মানুষের উপযোগী স্বল্প মূল্যের শৌচাগার, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী, বয়স্কদের স্বাক্ষরতা আরো বহু কিছু। আশির দশকে আমি গোবরডাঙ্গাতে গিয়েছি। সেখানে আমার বন্ধু ছিল শিক্ষক স্বপন চক্রবর্তী। দীপক দাঁ সে সময় বেহালার সুরসোনা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। দীপক দাঁ পরবর্তীকালে ‘গোবরডাঙ্গা গবেষণা পরিষদ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সমাজবিজ্ঞান ও নানাবিধ গবেষণামূলক পত্র-পত্রিকা প্রকাশনের ক্ষেত্রে গোবরডাঙ্গা গবেষণা পরিষদ এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। দীপক দাঁ শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও টিউশন করে রোজগারের দিকে যাননি। সারাটা জীবন জনবিজ্ঞান আন্দোলনেই কাটিয়ে দিয়েছেন। এখনও দীপক দাঁ-র সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করি। তার সুচিন্তিত মতামত, যুক্তিনিষ্ঠ পরিবেশন আমাকে ঋদ্ধ করে।

 

 

শঙ্কর চক্রবর্তী- আরেকজন গুণী মানুষ ছিলেন শঙ্কর চক্রবর্তী। ছোটোখাটো ছিপছিপে চেহারা। আমি যে তিন দশক ধরে অডিও ভিস্যুয়াল শো করে চলেছি তার অন্যতম প্রেরণা শঙ্করদা। শঙ্করদা তখন স্লাইড প্রোজেক্টরের সাহায্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অডিও ভিস্যুয়াল শো করতেন। তার গলার স্বর একটু সানুনাসিক হলেও তার বাচনভঙ্গী বেশ আকর্ষণীয় ছিল। বহু বছর ধরে তিনি জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ গঠিত হওয়ার পর তিনি তার সভাপতি হন।

ডঃ অমিত চক্রবর্তী- তখন আকাশবাণীতে যাতায়াত করি। সে সূত্রে অমিতদার সাথে পরিচয়। ডঃ অমিত চক্রবর্তী মনোবিজ্ঞানের গবেষক। জনবিজ্ঞানের বহু প্রবন্ধ ও বই লিখেছেন। সে সময় তিনি আকাশবাণী কলকাতার বিজ্ঞান বিষয়ক আধিকারিক। ওনার সাথে ছিলেন ডঃ সুভাষ সান্যাল। অমিত দা দীর্ঘদেহী, দীর্ঘনাশা, উজ্জ্বল গৌরবর্ণের ব্রাহ্মণ। সুভাষদা-ও ফরসা, গোলগাল তার চেহারার মধ্যে একটি অতি কোমলভাব ছিল।  আমরা সে সময়কার উঠতি সাংবাদিক বন্ধু-বান্ধবীরা অমিতদা এবং সুভাষদার জুটিকে আড়ালে রাধাকৃষ্ণ বলতাম। আমাদের কথিকাগুলির স্ক্রিপ্ট অমিতদা সুন্দরভাবে সম্পাদনা করে দিতেন। অমিতদা ভারত সরকারের এন.সি.ই.আর.টি (NCERT) ফেলো নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে বিজ্ঞান ট্রেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে উত্তরবঙ্গ হয়ে আসামে গিয়েছিল। অমিতদা এসেছিলেন শিলিগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জংশনে। শিলিগুড়িতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনও হয়। সেই প্রেস কনফারেন্সে আমিও সক্রিয় ভূমিকায় ছিলাম। আমি আমার লেখার প্রথম বই ‘হৃদয়ের কথা’ ডঃ অমিত চক্রবর্তীকে উৎসর্গ করি। অমিতদা মনোবিজ্ঞান নিয়ে টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে বহু অনুষ্ঠান করে চলেছেন। ডুয়ার্সে চলে আসার পর আমি অমিতদার একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। যেটা উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়।


কবি ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ- আরেকজন ব্যতিক্রমী মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলাম। তিনি হলেন ভূমেন্দ্র গুহ। ভূমেনদা সল্টলেকের এক আবাসনে থাকতেন। বেশ রাশভারী তার আচার-আচরণ। ঘরের ভেতর হাউসকোট পরে থাকতেন। চুরুট খেতেন। তিনি আমার লেখা ‘হৃদরোগ’ সংক্রান্ত বইটির একটা সমালোচনা লিখে দেন। আমি যে নামের সাথে পদবী ব্যবহার করি না এবং কেন করি না সেটা জানার পর বিষয়টি ভূমেনদাকে খুব আকর্ষণ করে। আমার গ্রন্থ সমালোচনার সাথে আমার ব্যক্তিজীবনের এদিকটাও তিনি উল্লেখ করেন। জীবনের শেষদিকে দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তবে কাউকে কিছু জানান নি।  ২০শে ডিসেম্বর ২০১৫ সালে ঘুমের মধ্যেই কাঞ্চন ফুলের কবি চলে যান জীবন নদীর ওপারে।


পীযূষকান্তি সরকার- আরেকজন কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী পীযূষকান্তি সরকার। তখনও স্বনামধন্য হন নি। পীযূষদা আমাদের সল্টলেকের কে.বি. , কে.সি ব্লক আবাসনে মাঝে মধ্যে থাকতেন। পীযূষদা ইংরেজীতেও সুন্দর কবিতা লিখতেন। ৬ ফুটের বেশি লম্বা রোগা ছিপছিপে, মাথায় বাবরি চুল, গালে দাড়ি। যে কোনো জনমানুষের ভীড়ে পীযূষদাকে আলাদাভাবে চেনা যায়। রবীন্দ্র সংগীতের এক ভিন্ন স্বাদের গায়কী ছিল তাঁর মধ্যে। পীযূষদার সাথেও বহু মানুষের কাছে গিয়েছি। তিনি বিভিন্ন সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র পেতেন। আমিও তার সাথে বিনা খরচে বহু অনুষ্ঠান শুনেছি। সেখান থেকেই জেনেছি যুগলবন্দীর চাপান- উঠান।

এক রোববার সকালে রবীন্দ্র সদনে পীযূষদার অনুষ্ঠান ছিল। আমি সেই অনুষ্ঠানের আয়োজনের ক্ষেত্রে পীযূষদার সাথে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। পীযূষদার সাথে সুচিত্রা মিত্রের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তিনি তখন কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। তাই পীযূষদার অনুষ্ঠানে আসতে পারেনি। খুব সম্ভবত সেটা ছিল পীযূষকান্তি সরকারের প্রথম একক রবীন্দ্র সংগীত অনুষ্ঠান।

মঞ্চে পীযূষদার সাথে শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়। সুমনের সাথে পীযূষদার বেশ সখ্য ছিল। তার কাছে সুমনের অনেক কথা শুনেছি। তখনও সুমনের ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবাম আত্মপ্রকাশ করেনি। সেভাবে সেলিব্রিটি হয়ে ওঠেনি। সেখানে সুমনের সাথে তার জার্মান স্ত্রী মারিয়া ও তার বাচ্চা মেয়ে ছিল। পীযূষদা সুমনের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল চা বাগানের ছেলে বলে।

সে অনুষ্ঠানে পীযূষদার সাথে তবলা সংগত করেছিল টনি বোস। অনুষ্ঠানের শেষ গানটি ছিল - ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি . . . ।’ টনি ডুগিটাকে বিড়ের ওপর কাৎ করে কেমন যেন বাজালো, গ্রাম্য তালযন্ত্রের শব্দতাল উঠে এলো। যা আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছিল। পীযূষদা পরে বলেছিলেন- ‘পার্থপ্রতিম, টনি বড় শিল্পী হবে, ওর পথ আলাদা। ও যে রবীন্দ্র সদনের মঞ্চে বসে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে তবলায় সংগত করছে এ কথা জানতে পারলে ওর দাদারা টনিকে ধরে পেটাবে।’ কুমার বোস, জয়ন্ত বোস  টনিকে ধরে পিটিয়েছিল কী না জানা নেই। তবে সেদিনের সেই তবলিয়া টনি আজ প্রখ্যাত সরোদ শিল্পী পন্ডিত দেবজ্যোতি বোস।

অম্লান দত্ত-  পীযূষদার সাথেই প্রথম যাই অধ্যাপক অম্লান দত্তের বাড়িতে। অম্লান দত্ত সে সময় সল্টলেকের একটি একতলা বাড়িতে থাকতেন। বাড়িতে  একাই থাকতেন। বাড়ি ভর্তি বিভিন্ন বইপত্র। অম্লান দত্ত নিজের হাতে চা করে আমাদের খাওয়ান। পরবর্তীকালে একাও গিয়েছি ওনার বাড়িতে। ঠিক একইভাবে তিনি আমাকে চা খাইয়েছেন। অম্লান দত্তের কাছে জেনেছিলাম চীনের বেশিরভাগ হাসপাতালে আধুনিক অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের ট্র্যাডিশ্যানাল চিকিৎসা পদ্ধতি চলে। যে যেমনটি নিতে চায়, সে রোগী বা তার পরিবার সেভাবেই চিকিৎসা পরিষেবা নিতে পারে। সেখানেই একদিন দেখা হয় আনন্দ পাবলিশারের কর্ণধার বাদল বসুর সাথে। সাদা ধুতি পাঞ্জাবী, কালো কুচকুচে চেহারার এক বলিষ্ঠ পুরুষ। বহুবার বলা সত্ত্বেও অধ্যাপক দত্ত আমাকে আপনি বলেই সম্বোধন করতেন। যা আমার কাছে অত্যন্ত লজ্জা ও বিরক্তিকর বিষয় ছিল।

দীপেন সেন- আমাদের সল্টলেকের কে.বি. ব্লকে আমার ফ্ল্যাটের নীচেই থাকত আরেক পাগল মানুষ দীপেনদা, দীপেন সেন। তিনি একাই থাকতেন।  বাউল-বাউল ভাবের মানুষ ছিলেন। ভারত সরকারের এক দপ্তরে কাজ করতেন। তিনি মূলত মঞ্চ সজ্জা করতেন বিভিন্ন নাটক ও অনুষ্ঠানের। নাটক পাগল মানুষ ছিলেন তিনি। খালেদ চৌধুরীর সাথেও কিছুদিন কাজ করেছেন। বাগবাজারের গিরিশ মঞ্চে একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল; ছিল দিদিমণি ও ছাত্রীদের নাটক। দীপেনদার সাথে আমি গিয়েছিলাম মঞ্চ সাজাতে। ধুন্দুল এর খোসা, ব্রাউন পেপার, আরো সব হাবিজাবি জিনিস দিয়ে আমরা মঞ্চ সাজিয়ে ছিলাম। অনেকে তা প্রশংসা করেছিল। সে সময় ‘বুধ সন্ধ্যা’ নামে এক সাহিত্য বাসর চলত। সুনীল গাঙ্গুলী আরো সব বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা সেখানে যেতেন। দীপেনদাও নিয়মিত যেতেন। তার সাথে একবার সে সান্ধ্য আসরে গিয়েছিলাম। তবে আমার মনে হয়েছিল সেখানে হুইস্কি বেশি, কাব্য সাহিত্য একটু কম।

শিবনারায়ণ রায়- কলেজ স্ট্রীট কফিহাউসের একটি ঘরে প্রতি মাসে একদিন র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট সদস্যদের আড্ডা আসর বসতো। দীপক দাঁ -র সাথে সেখানে প্রথম যাই। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু শুনে এই রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়ে। সেই টানেই আমি যাই, মানবেন্দ্র নাথ রায়ের অনুসারী অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের কাছে। শিবনারায়ণ রায় সে সময় সল্টলেকের এক আবাসনে থাকতেন, তিনি ও বউদি। তিনি বেশ অমায়িক ভদ্র লোক ছিলেন। তাঁর পড়াশোনার পরিধি এত বিশাল ছিল যে, সব কিছু আমার মাথায় ঢুকত না। তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সমাজতত্ত্ববিদ, কবি সাহিত্যিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলতেন। এর পাশপাশি স্পেন্ডার, মিল্টন, গ্যেঁটে আরো বহু মানুষের কথা তাঁর আলোচনায় উঠে আসত। তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলিও তাঁর কথার মতনই বহুমাত্রিক পান্ডিত্যে ভরা। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভারতবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। মার্কস, ফ্রয়েড ও রাসেলের যৌথ প্রভাবে গঠিত হয়েছিল তাঁর চিন্তাবিশ্ব। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, যুক্তিবাদ ও মানবতন্ত্র তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে স্থান করে নিয়েছিল। তিনি ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।

গবেষণা, সাহিত্যচর্চা, মননচর্চা, শিল্পবোধ – সবকিছুতেই তিনি ছিলেন উলটো হাওয়ার পন্থী। স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটেছেন আমৃত্যু। কোনো প্রলোভন, ভীতির সামনে নিজেকে নত করেননি। মনুষ্যত্বকে সবার ওপরে ঠাঁই দিয়েছেন এবং মানুষের অসীম সম্ভাবনায় আস্থা রেখেছেন নিরন্তর। তাঁর চিন্তা ও কর্মের কেন্দ্রে ছিল মানবতন্ত্র। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই তিনি মননশীল রচনা লিখেছেন। কবি হিসেবেও তাঁর সাফল্য প্রশ্নাতীত। তবে তাঁর প্রতিভার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে চিন্তক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে।

ইংরেজি সাহিত্যের কৃতী ছাত্র শিবনারায়ণ যৌবনের শুরুতেই মানবতাবাদী বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁর প্রভাবেই শিবনারায়ণ র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পরবর্তী সময়ে মানবতন্ত্রী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। আক্ষরিক অর্থেই ইহজাগতিকতাবাদী ছিলেন তিনি। যে-জগৎ জীবন ও মৃত্যুর সীমায় আবদ্ধ এবং যে-জগৎ ইন্দ্রিয়গোচর ও যুক্তিগ্রাহ্য সেই জগৎকেন্দ্রিক মানবজীবনের সাধনাই ইহজাগতিকতা। পরকাল, আত্মা বা অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক কোনো চিন্তা-ভাবনা ইহজাগতিকতার কাছে মূল্যহীন।

কথা আর না বাড়িয়ে আমার একজন অদেখা প্রিয় মানুষের উক্তি দিয়ে শেষ করি। “শিবনারায়ণ রায় এর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আমি বিশ্বের প্রতিটি অংশে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। ... আমাদের সময়ের বেশিরভাগ লেখকদের তুলনায় তার লেখাগুলি আরও যুক্তিসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে।”- বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল।

সুন্দরলাল বহুগুণা - আরেকজন ভারত বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি। উত্তরখন্ডের তেহরি গাড়োয়াল জেলার এই মানুষটির আর নতুন করে পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই। পরাধীন ভারতের লাহোর থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে এম.এ করতে যান। সেখানে পড়াশোনা বাদ দিয়ে জড়িয়ে পড়েন স্বাধীনতা সংগ্রামে। তারপর ১৯৪৯ থেকে তিনি দলিত আদিবাসীদের নিয়ে সমাজ উন্নয়ণের কাজে নেমে পড়েন। পায়ে হেঁটে ঘুরতে থাকেন  হিমালয় পার্বত্য এলাকার গাড়োয়াল অঞ্চল। ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় গাড়োয়াল জেলার চামেলী গ্রামে নগরায়ণ ও শিল্পায়ণের জন্য আড়াই হাজার গাছকে নিলাম করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সরকারি ঠিকাদাররা যখন গাছ কাটতে চামেলী গ্রামে আসে তখন ওই গ্রামের মহিলারা এক অভিনব কায়দায় প্রতিবাদ করেন। তারা গাছকে নিজের সন্তানের মত জাপটে ধরে, আঁকড়ে ধরে। তাদের ওই মানসিকতার সামনে পিছু হটেন সরকারি ঠিকাদার বাহিনী। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সুন্দরলাল বহুগুণা। গাছকে জড়িয়ে থাকা বা গাছের সাথে ‘চিপকে’ থাকা প্রতীক হিসাবে সারা ভারতে তথা বিশ্বে মাইলফলক হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলন, ‘চিপকো আন্দোলন’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

আন্দোলন ক্রমশ চামেলী গ্রাম থেকে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য গ্রামে। গাড়োয়ালের ৩৫টি গ্রাম ওই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে রাজ্যস্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সমগ্র আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সুন্দরলালের সাংগঠনিক ক্ষমতা ও পদ্ধতি নিয়ে সর্বত্র আলোচনা শুরু হয়।

বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে সুন্দরলালকে দেশীকোত্তম সম্মান জানানো হয়। তখন আমি বিভিন্ন পত্রিকায় স্বাস্থ্য, পরিবেশ, বিজ্ঞান নিয়ে ফ্রি-ল্যান্স করছি। আমি সে অনুষ্ঠানে কভার করতে যাই। পরবর্তীতে বহুগুণাকে সম্বর্ধনা জানানো হয় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংঠনের পক্ষ থেকে। বিপ্লব হালিম ও আরো কয়েকজন সেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সে সময় তার সাথে আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। আমি তখন বহুগুণাজীকে বলেছিলাম- ‘আমাদের ডুয়ার্সে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আদিবাসী মানুষেরা রয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকেই টোটেমবাদের বিশ্বাসী। যারা প্রকৃতি উপাসক, গাছপালাকে কেন্দ্র করে এখানে জিতিয়া, করম আরো বহু ধর্মীয় উৎসব হয়।’ এটা শুনে তিনি ডুয়ার্সে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যদিও পরবর্তীতে তিনিও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বয়সও অনেক হয়ে যায়। সেভাবে আমিও আর জোরাজুরি করিনি। ২০২১ সালের ২১শে মে কোভিড- ১৯ এর ছোবলে সুন্দরলাল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর আর ডুয়ার্সে আসা হয়নি। আমার নেওয়া সুন্দরলাল বহুগুণার সাক্ষাৎকার ‘বর্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

 

মেধা পাটেকর- ১৯৯১ সালে নাগপুরে সি. কে. নাইডু রোডের সিভিল লাইনে ‘ইন্ডিয়ান পীস সেন্টার’ (Indian Peace Centre)। সেখানেই ‘ইকোলজি অ্যান্ড স্পিরিচুয়ালিটি’ -র ওপর এক জাতীয় কর্মশালা হয়। সেই শিবিরে আমি পূর্ব ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নিই। আমার নামটি সুপারিশ করে কোলকাতার ‘সঙ অব ইউনিটি এন্ড লিবার্টি’ সংক্ষেপে ‘সোল’ এর অধিকর্তা প্রবাল সরকার । এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু যুবক-যুবতী এসেছিল। চারদিন ধরে পরিবেশ, ইকোসিস্টেম, ওয়াইল্ড লাইফ, পরিবেশের ওপর শিল্প বিপ্লব ও সভ্যতার বর্তমান অগ্রগতির প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। পরিবেশের বিভিন্ন প্যারামিটার নিয়ে এই শিবিরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখানেই এসেছিলেন মেধা পাটেকর। তিনি নদীর বড় বাঁধ ও ছোটো বাঁধ নিয়ে বহু আলোচনা করেন। মেধার সাথে সেখানেই প্রথম পরিচয়। স্বাভাবিকভাবেই তিনি তখন আরো তরতাজা, আরো ধারালো তার বাচনভঙ্গি।

 

ডাঃ শুভেন্দু চ্যাটার্জী- ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংস্থার প্রবীর ঘোষের মাধ্যমে তার সাথে আলাপ। তাঁর ফিল্মি ইমেজটা আমার বইয়ের প্রচারে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। একে তো কোন আদ্দিকালে পাশ করেছেন; তার ওপর সেভাবে ডাক্তারী করেন না। এইসব কার্ডিওলজির ডাক্তারী ব্যাপার স্যাপার কী আর বুঝবেন ? পান্ডুলিপিটি তাঁর হাতে দেওয়ার পর আমার সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ ব্যাপারে নিজের কাছে নিজেই বহুবার ক্ষমা চেয়েছি।

আমার লেখা হৃদরোগ সংক্রান্ত ‘হৃদয়ের কথা’ বইটি তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন। বহু জায়গায় বিষয়গত ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। ‘ফ্যালটস টেট্রালজি’ হৃদবিজ্ঞান বা কার্ডিওলজির এক জটিল বিষয়। এ সম্বন্ধে যে সংজ্ঞা আমি লিখেছিলাম- তা কিছুটা অস্পষ্ট ছিল। শুভেন্দুদা তা সুন্দরভাবে সম্পাদনা করেন। স্থানাভাবে তার সম্পূর্ণ মন্তব্য আমার বইতে ছাপা যায় নি। পেশাগত ভাবে চিকিৎসক না হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান ছিল আপ- টু- ডেট।

গল্ফ গ্রিনের এক সম্ভ্রান্ত আবাসনে তিনি থাকতেন। সেখানেও কয়েকবার তার সাথে দেখা করেছি। গম্ভীর ও মিশুকে -এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ছিল শুভেন্দুদার মধ্যে। ঘটি বলেই বোধ হয় মিষ্টি খেতে বেশি ভালোবাসতেন; খাওয়াতেনও। বাড়িতে সবসময় সেন মহাশয়ের সন্দেশ থাকতো।

পেশাগত ভাবে বেশিদিন ডাক্তারী করেননি। তবে কারা কারা তাঁর দেওয়া ওষুধ খেয়েছেন সেই তালিকাটা যে কোন ডাক্তারের কাছে ঈর্ষার বিষয়। ছবি বিশ্বাস, সমরেশ বসু, পাহাড়ি স্যান্যাল, উত্তম কুমার, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, সাবিত্রী চ্যাটার্জী, দিলীপ রায় আরো বহু স্বনামধন্য মানুষ। টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ার বাইরেও তাঁর বন্ধু, কাছের মানুষের সংখ্যা অগুণতি। এটা সম্ভব হয়েছে তিনি সকলের সমব্যথী ছিলেন বলে। হয়তো চিকিৎসক হওয়ার কারণে তিনি অন্যের ব্যাথা-বেদনা সহজেই অনুভব করতে পারতেন। দৃঢ়চেতা, স্পষ্টবক্তা, পরিমিত রসরোধ, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক এই মানুষটি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ইচ্ছে ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার কাজে মরণোত্তর দেহদান করার। পারিবারিক সম্মতি না মেলায় তা পারেননি। তবে প্রয়াণের আগে তিনি তাঁর চোখদুটি আই ব্যাঙ্কে দান করে গেছেন। চিকিৎসকেরা তাঁর ইচ্ছা পূরণে গাফিলতি করেননি। তাই তাঁর দুটি চোখ আলো ছড়াবে আরো বহু দূরে।

ইন্দ্রজিৎ সামন্ত- আরেকজন মানুষ ইন্দ্রজিৎ সামন্ত। ‘শরিক’ নামে একটি সংস্থা চালাতেন। প্রেসিডেন্সি থেকে অর্থনীতিতে এম.এস.সি করেছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একবছরের জুনিয়র। কলকাতা গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন থেকে হাঁটা পথে তার দোতলা বাড়ি। বনেদি পরিবারের মানুষ। চেহারার মধ্যেও একটি জমিদারী ভাব ছিল। সাদা ধবধবে পাজামা ও পাঞ্জাবী পরতেন। কোলকাতায় আমার অনেক কর্মকান্ডের সাথী অলোকদার (অলোক দাস) সূত্রে তার সাথে আলাপ।  ইন্দ্রদা বহুরকমের পড়াশোনা করত। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবস্থার বিবর্তন নিয়ে তার বেশ স্বচ্ছ ধারণা ছিল। প্রসঙ্গ তুললেই তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের সুন্দর উত্তর দিতে পারতেন। ইন্দ্রদার মায়ের সাথেও আমার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। সেই বয়সেও তার চেহারা বেশ সুন্দর ও আকর্ষণীয়। তিনি খুব সুন্দরভাবে কথা বলতেন। ইন্দ্রদা অর্থনীতির ছাত্র হলেও তার প্রিয় বিষয় ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান । ইন্দ্রজিৎদার কাছ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের বহু পাঠ পেয়েছি। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলী, মার্টিন লুথার, টমাস হব্স, জন লক, জ্যাঁ জ্যাক রুশো, জর্জ উইলহেলম ফ্রেডারিক হেগেল, টমাস হীল গ্রীন, অগাস্ট কোঁতে আরো বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দর্শন তার মুখ থেকে শোনা। ইন্দ্রদা একসময় ‘নকশাল আন্দোলন’-এর সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে মূলস্রোতে ফিরে আসেন। তার ইংরাজী উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গী বেশ উচ্চমানের ছিল। ইন্দ্রজিৎদার সাথে রায়দীঘি, বেলপাহাড়ি আরো বহু জায়গায় গিয়েছি।

প্রবাল সরকার- এভাবেই একদিন পরিচয় হয় প্রবাল সরকারের সাথে। তিনি সং অফ ইউনিটি অ্যান্ড লিবার্টি সংক্ষেপে ‘সোল’ বলে একটি সংস্থা চালাতেন। তার সংস্থাটি ছিল মূলত বিজ্ঞানভিত্তিক। প্রবালদা বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে বহুমুখী কাজ করতেন। স্বাস্থ্য বিষয়ে ফ্লাসকার্ড তৈরী, পোষ্টার তৈরী, প্রোজেকশন স্লাইড তৈরী এসব ছিল তার কর্মকান্ড। আমি প্রবালদার  ভাইয়ের মত হয়ে গিয়েছিলাম। ওনার সাথে দক্ষিণবঙ্গে বহু জায়গায় গিয়েছি। প্রবালদার স্ত্রী রত্না সরকার, তার বোন লিপিকা সরকার আমরা সবাই মিলে বিজ্ঞান প্রদর্শনীর আয়োজন, মাইম শো আরো বহুকিছু করতাম। মেদিনীপুরের নারায়ণগড়, রায়দীঘি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েছি। প্রবালদা এক আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ শিবিরের স্কলারশিপ পেয়ে জাপানে গিয়েছিলেন। প্রবালদার বাবা সঞ্জীব সরকার ‘সি.সি.সি.এ’ বলে একটি সংস্থা চালাতেন। সঞ্জীব মেসোমশাই, প্রবালদা পরবর্তী সময় এরা আমার বাড়ী মধুবনে কয়েকবার আসেন।

ডঃ শুভাশিস মাইতি- সে প্রায় দু’ দশক আগের কথা। জলপাইগুড়ি শহরের এক বিজ্ঞান সংস্থা “লাইট অফ সায়েন্স”- এর উদ্যোগে ২০০৩ সালের ১০ই এপ্রিল এক যুদ্ধ বিরোধী সেমিনার ও অডিও ভিস্যুয়াল শো এর আয়োজন হয়েছিল মারওয়াড়ি হিন্দি বালিকা বিদ্যালয়ে। সেখানে আমি অডিও ভিস্যুয়াল শো করতে যাই। সেখানেই যুদ্ধ ও পরিবেশ বিষয়ক সেমিনারে বক্তা হিসেবে এসেছিলেন সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর গবেষক ডঃ শুভাশিষ মাইতি। সেখানেই আলাপ জমে এই বিরল ব্যক্তিত্বের মানুষটির সাথে। তিনি সে সময় ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সহসভাপতি ছিলেন। শুভাশিসবাবু শিবদাস ঘোষের আদর্শে অনুপ্রাণিত এসইউসিআই (SUCI) দলের সদস্য। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর বিজ্ঞানী হয়েও তাঁর জীবনযাত্রা ছিল একেবারে মাটির কাছাকাছি। তারপর বিভিন্নভাবে শুভাশিসদার সাথে বহু আলাপ-আলোচনা ও মত বিনিময় হয়েছে। মৌলালিতে একটা গলির ভেতর ব্রেকথ্রু-এর অফিস ছিল। সেখানে শুভাশিসদা বহু কলেজ- ইউনিভারসিটির ছাত্রছাত্রীদের টিউশনি পড়াতেন। অনেকক্ষেত্রে অনেককে বিনা পারিশ্রমিকেই পড়াতেন। SUCI দলের সাথে যারা যুক্ত তাদের জীবন দর্শন, দৈনিক জীবনযাপন পদ্ধতি একেবারেই ভিন্ন সুরে বাঁধা। তাদের ত্যাগ, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় একেবারেই উচ্চ পর্যায়ের। অন্য রাজনৈতিক দলগুলিতে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখি তারা ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের কথা চিন্তা করে দলে ঢোকে বা দলের ঝান্ডা নেয়। এদের ক্ষেত্রে একেবারেই আলাদা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম স্বাভাবিকভাবেই আমার দেখা হয়নি। ছোটোবেলায় ঠাম্মা ও কাকার মুখে তাদের ত্যাগ বলিদানের কথা শুনেছি। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু SUCI মনোভাবাপন্ন DSO সমর্থকদের দেখেছি, যা আমাকে আবিষ্ট করেছে। এদের মতাদর্শ বা কর্মপদ্ধতি কতটা ঠিক? এদের সদস্য সংখ্যা কত? লোকসভা ও বিধানসভায় ক’টা আসন জেতে ? এইসব প্রশ্ন ছাপিয়েও এদের ত্যাগ, নিষ্ঠার কাছে মাথা নিচু করতে হয়। উত্তরবঙ্গে এসেও দেখেছি আলিপুরদুয়ারের বন্ধু অভিজিৎ রায়, জলপাইগুড়ির ভ্রাতৃপ্রতিম সুজিত ঘোষ এদের যা মেধা ও যোগ্যতা এরা ইচ্ছা করলে ভালো চাকরি-বাকরি জুটিয়ে প্রচলিত সমাজের সাথে খাপে খাপ মিলিয়ে ‘দাঁড়িয়ে’ যেতে পারতো। এরা সে পথে হাঁটেনি। এরা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। 

আমার জীবনতরীর সহযাত্রী সুকন্যাও ইউনিভারসিটিতে পড়ার সময়  DSO- এর প্রতি অনুরক্ত ছিল। সেই সূত্রেই দীপালিদির সাথে পরিচয়। দীপালি অধিকারী ক্যালকাটা ইউনিভারসিটিতে এম.ফিল করছিলেন। DSO নেত্রী ছিলেন। উদারমনস্ক, চিন্তাশীল, সংগ্রামী মহিলা। আমাদের দুজনের প্রেমপর্যায়ে দীপালিদির এক বিশেষ অবদান ছিল। আমার ও সুকন্যার অভিভাবক ছিলেন। ঘটনাক্রমে পরবর্তীকালে ডঃ শুভাশিস মাইতির সাথে দীপালিদির বিয়ে হয়। তবে বিজ্ঞানী শুভাশিস মাইতি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে ২রা অক্টোবর ২০১৩ তে চলে যান; তাঁর স্ত্রী ও কন্যা সন্তানকে রেখে। আমাদের দীপালিদি এখন পরিবর্তিত সামাজিক পটভূমিতে অন্য লড়াই লড়ে চলেছেন। সবাই যখন যে যার আখের গোছাতে ব্যস্ত সে সময় এরা জীবন, কেরিয়ার, সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে কীভাবে যে লড়াই করে; তা ভেবে আমি অবাক হয়ে যাই।

মাঝে মাঝে মনে হয় যারা ঘটনাচক্রে সেভাবে গদির স্বাদ পান নি তাদের পক্ষে সৎ থাকাটা সম্ভব। আমাদের নেতাজী সুভাষচন্দ্র যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতেন; তবে তিনি এমন বহুজন শ্রদ্ধেয় থাকতে পারতেন কী না সেবিষয়ে সন্দেহ মনের মাঝে দানা বাঁধে।

সে সময় বিভিন্ন মানুষের কাছে যেতাম। তাদের কথা শুনতাম, তাদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় যেতাম, তাদের কিছু কিছু কাজও করে দিতাম, ফাই ফরমাশ খাটতাম। প্রচলিত কথায় যাকে বলে বেগার খাটা। ঘরের খেয়ে অনেকটা বনের মোষ তাড়ানোর মত। সে সময় আত্মীয়- বন্ধুবান্ধবরা সেটা নিয়ে ঠাট্টা- তামাশা করতো। তবে জীবনের গোধূলি বেলায় এসে মনে হয় প্রত্যেকের জীবনে এ ধরনের কাজ করাটাও দরকার। এখনকার যুবক-যুবতীদের মধ্যে দেখি তারা প্রথমেই হিসেব কষে, একাজে তার কতো আর্থিক লাভ হবে। বাবা- মায়েরাও ছোটবেলা থেকে শিশু- কিশোরদের এই পাটিগণিত শেখাতে চান। এই যে বিভিন্ন ব্যতিক্রমী মানুষের কাছে যাওয়া, তাদের সাথে ওঠা বসা করা, তাদের ভাবনাগুলি বোঝার চেষ্টা- কর্মজীবনে এগুলি বিভিন্ন সম্পদ হিসেবে ধরা দেয়। জীবন দর্শনটাকে পরিশীলিত করে। সমাজ, সভ্যতা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠে। যা এ জীবনের অমূল্য সম্পদ।

ভূমিবদল

হ্যাঁ, ব্যক্তিজীবনে তিনি অনেক সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনদশক আগেই তার লেখা প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, আজকাল, বর্তমান, দৈনিক বসুমতি, সানন্দা, গণশক্তি আরোও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। নিয়মিত অংশ নিয়েছেন আকাশবাণী কোলকাতা ও দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে। সাধারণত যারা এই ধরনের সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত থাকে; তাদের উপযুক্ত পীঠস্থান ভারতের সংস্কৃতি নগরী কোলকাতা। উনিও সেভাবেই মহানগরীর বুকে একের পর এক মাইলস্টোন পার হচ্ছেন আপন ছন্দে। বেশিরভাগ সৃজনশীল মানুষই এইসব প্রান্তিক এলাকা ছেড়ে মহানগরের দিকে পা বাড়ান। পার্থপ্রতিমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরোপুরি উল্টো হয়ে গেল। সাফল্যের বেশ কয়েক সোপান ডিঙিয়ে গিয়েও আবার নেমে আসছেন মাটির কাছাকাছি। এতকিছুর পরেও হঠাৎ করে জীবনের সব ছন্দই এলেমেলো হয়ে গেল। দীর্ঘ দশ বছর মহানগরীর জীবন কাটিয়ে তিনি ফিরে এলেন চা-বাগিচার সবুজ গালিচায়। তবে, তার এই ফিরে আসা আলো থেকেও অন্ধকার অভিমুখে নয়। বরং অন্ধকার এলাকাগুলিকে জ্ঞানের আলোক উদ্ভাসিত করার এক হার না মানা সংকল্প। পিছিয়ে থাকা এলাকায় বসে সৃজনশীল কাজ করা খুবই  কষ্টসাধ্য।

বাবা প্রয়াত হয়েছেন। বাড়িতে বৃদ্ধা মা ও বৃদ্ধ কাকাবাবু। ছোটো ভাই চাকরি পেয়ে বাধ্য হয়ে চলে গেছে দূরের চা-বাগিচায়। পরিবার ও মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, অন্যদিকে মহানগরীতে ঝলমলে গণমাধ্যমের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের হাতছানি। শ্যাম আর কূলের অদ্ভুত টানাপোড়েন। যেসব সুযোগ বহু মানুষের কাছে কাঙ্খীত থেকে যায়; তা হস্তগত করার পরেও গঙ্গাপারে সব  রেখে ঘরে ফিরল ঘরের ছেলে। 

তারপর শুরু হল অন্য সংগ্রাম। কাকাবাবু অনিল কুমার বোস হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। তারই কাছে চললো ডাক্তারি শেখার কাজ। ডাক্তারি বইপত্র তো আগে বাড়িতে ছিলই। সেগুলো নিয়ে চললো অন্যরকম পড়াশোনা। মন দিয়ে কোমর বেঁধে লেগে গেলেন। জীববিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার সুবাদে তিনি ঢুকে গেলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে। রাতভর চললো পড়াশোনা। এইভাবে কাউন্সিলের পরীক্ষা দিয়ে তিনি রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক (আর.এম.পি.) হিসেবে পেশায় নেমে গেলেন।

 ♦ ♦ ♦

ডঃ শুভব্রত রায় চৌধুরী; প্রাক্তন উপাচার্য ; টেকনো গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি; ভূপাল; প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘স্যাব’-   পার্থপ্রতিমের সাথে আমার অন্তরঙ্গতা ১৯৮৭ সাল থেকে। সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশান অফ বেঙ্গল; আলিপুর চিড়িয়াখানার উল্টো দিকে থাকা অডিও ভিসুয়াল সেন্টারে বিজ্ঞান মেলা ও কর্মশালার আয়োজন করে। ঐ সময় সে ডুয়ার্স এর এক গ্রাম থেকে তার মডেল ও প্রোজেক্ট নিয়ে কলকাতায় আসে। তার মৌলিক চিন্তাভাবনা ও উপস্থাপনা তৎকালীন রাজ্যপাল নুরুল হাসান,  পরিবেশমন্ত্রী ভবানী মুখার্জী ও আর বহু গুণীজনের প্রশংসা অর্জন করে। তার এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ আমরা তার হাতে ‘সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড’ বা ‘বিজ্ঞান পুরস্কার’- তুলে দিই।
     ১৯৮৮সালে ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের আর্থিক আনুকূল্যে বিজ্ঞান সাংবাদিকতা ও গনমাধ্যম চর্চার ওপর বিশেষ পাঠক্রম শুরু হয়। সেই পাঠক্রমে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি তার ছিল না। আমি কর্তৃপক্ষকে পার্থপ্রতিমের বিশেষ  গুণাবলি জানিয়ে এই পাঠক্রমে তার অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিই। এখন বিজ্ঞান সাংবাদিকতা, জনবিজ্ঞান ও সামাজিক আন্দোলনে ডাঃ পার্থপ্রতিম এক পরিচিত নাম। সেদিন জহুরী হিসেবে আমি যে সঠিক ছিলাম; সে কথা ভেবে আশি ছুঁইছুঁই বয়সে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াই।

♦ ♦ ♦

প্রিয় ডিয়ার

আদিবাসী অধ্যুষিত চা-বাগিচার সবুজ প্রান্তর জুড়ে রয়েছে বহু সুকুমার মনের মানুষ। এর পাশাপাশি রয়ে গেছে যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনুন্নত পরিকাঠামো। চা বাগিচাগুলিতে ইংরেজ আমলে তৈরী হাসপাতাল থাকলেও সেখানে যথাপোযুক্ত ওষুধ ও স্বাস্থ্যগত জরুরী প্রয়োজন সামাল দেওয়ার মতো পরিকাঠামো নেই। এইসব বিভিন্ন কারণে চা-বাগিচা এলাকা হয়ে উঠেছে অন্ধ-কুসংস্কারের আঁতুড় ঘর।

কৈশোর থেকে ডাঃ পার্থপ্রতিম পরিবেশ, স্বাস্থ্য, কুসংস্কার দূরীকরণ এইসব বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত। আশির দশকের শেষদিকে ডুয়ার্সের সাধারণ মানুষের মন থেকে কুসংস্কার দূর করা, তাদের স্বাস্থ্য সচেতন করা, পরিবেশ রক্ষার কাজে তাদের সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা। এসব ভাবনা নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ডিয়ার’।

উত্তরের দিগন্তরেখা জুড়ে রয়েছে নীলাভ গিরিমালা। তারই কোল বেয়ে নেমে আসা সবুজ বনানী। কোথাও আবার সীমানা হারানো চা বাগিচার শ্যামল গালিচা। কখনো অলস পায়ে হেঁটে চলা বুনো হাতির দল, পায়ে সাদা মোজা পরা বাইসনের হুটোপুটি। জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলার চা বাগিচা অধ্যুষিত ডুয়ার্স এলাকা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান সচেতনতা আরও বিভিন্ন বিষয়ে পিছিয়ে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে বিজ্ঞানভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ডুয়ার্স এক্সপ্লেরেশন অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট রিভ্যালী সংক্ষেপে ‘ডিয়ার’। ডুয়ার্স এলাকার আদিবাসী মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য - পরিবেশ সচেতনতা ও কুসংস্কার দূর করাই এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। ‘ডুয়ার্স এক্সপ্লোরেশন এন্ড অ্যাডভান্সমেন্ট রিভ্যালী (ডিয়ার)’ এই নামকরণের মধ্যে সুন্দর দ্যোতনা আছে। ফ্রেঞ্চ ‘রিভিল্জ’ শব্দ থেকে ইংরাজিতে এসেছে ‘রিভ্যালী’ শব্দটি। যার অর্থ হলো- ‘ভোরে সৈনিকদের জাগিয়ে তোলার জন্য বাজানো বিউগল’ -এর বিশেষ ছন্দ।

সংস্থাটি সরকারী ভাবে নথিভুক্ত হয় ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখে। যদিও সংস্থাটি তারও কয়েকবছর আগে থেকে এই কাজটি শুরু করেছিল।
ডিয়ার তার অডিওভিসুয়্যাল শো শুরু করেছিল ‘মহাবিশ্ব মহাকাশ’ শিরোনামে। পরবর্তীকালে পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে ‘নিকট প্রতিবেশী’, ব্লাড প্রেসার ও হৃদরোগ নিয়ে ‘হৃদয়ের কথা’, ছাত্রছাত্রীদের সঠিক দিশা দেখাতে ‘শুভ কর্মপথে’ -এখন সব মিলিয়ে বারো-তেরোটি শিরোনাম। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষে কবির মহাকাশ ভাবনা নিয়ে তৈরী করেছে ‘তোমার অসীমে’। প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে নতুন নতুন বিষয়। আরো আকর্ষণীয় হয়ে চলেছে উপস্থাপনা। ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন (ডি.বি.আই.টি.এ) এর আর্থিক সহযোগিতায় ডিয়ার ১৯৯৭ সালে একটি শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে আসে। এ বিষয়ে বিশেষ সহযোগিতা করেন ডি.বি.আই.টি.এ -এর তৎকালীন সচিব সমরেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জি। এর ফলে দূর আকাশের গ্রহ- নক্ষত্ররা চলে আসে চোখের সামনে। মহাকাশ ও কুসংস্কার নিয়ে সচেতনতা বাড়ে ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।
ডিয়ারের উদ্যোগে ও ইষ্ট ক্যালকাটা সায়েন্স সেন্টারের সহযোগিতায় ডুয়ার্সের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত হয় কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান। আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটা, মড়ার খুলিকে জলপান করানো, জীবন্ত মানুষকে শূন্যে ভাসানো, বান মারা প্রভৃতি আকর্ষণীয় খেলা দেখানো হয়। ব্যাখ্যা করা হয় এর পেছনে থাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কারণগুলিকে। সাধারণ মানুষ কিভাবে বিভিন্ন ভন্ড ওঝা- গুণিন ও সাধুবাবাদের দ্বারা প্রতারিত হয় তা এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়।

ফি-বছর ডুয়ার্সে হানা দিচ্ছে বিভিন্ন মারণ ব্যাধি। এবছর ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া তো পরের বছর এনকেফেলাইটিস। রোগ হানা দেওয়ার সাথে সাথে ডিয়ারের সদস্যরা কোমর বেঁধে ফেলেন। রোগের কারণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পদ্ধতি, রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাপত্র -এসব নিয়ে করা হয় সহজবোধ্য অডিওভিসুয়্যাল প্রেজেন্টেটেশন। সাথে সাদ্রী, বাংলা, নেপালী ভাষার ভাষ্য। তারপর নিরন্তন ছুটে চলা। তখন আর দিনক্ষণ নেই। সন্ধ্যা নামার সময় হলেই চা-বাগিচার আদিবাসী পল্লী থেকে বনবস্তির আঙ্গিনায় ল্যাপটপ, প্রোজেক্টার, পর্দা ও আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে হাজির ডিয়ারের অডিওভিসুয়্যাল টিম। বিগত দিনে ডিয়ার -এর এইকাজে বিশেষভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া-র সচীব রামঅবতার শর্মা ও মালবাজার -এর মহকুমা শাসক শ্রী জ্যোতির্ময় তাঁতি।

উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকা মেখলিগঞ্জ, চ্যাংরাবান্ধা, আলিপুরদুয়ার, মালবাজার, ওদলাবাড়ি, মেটেলি, নাথুয়া, ধূপগুড়ি,  আরও বিভিন্ন জায়গায় তারা এই শো করে চলেছে।
এন.জি.ও নয়; ‘ডিয়ার’ নিজেকে বিজ্ঞান ক্লাব বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসে। এন.জি.ও পরিচয়ে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে। যারা সরকারী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানের টাকায় দেশ উন্নয়নের কথা বলে। দেশ সেবার নামেই যাদের আয় রোজগার হয়, সংসার চলে। শোনা যায়, অনেক এন.জি.ও সরকারী ও বিদেশী টাকা নয়ছয় করে। ডিয়ারের সব সৈনিকই প্রকৃতঅর্থে স্বেচ্ছাসেবী। আদর্শগত কারণে ডিয়ার কোন সরকারী ও বিদেশী আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করে না। তাদের কথায়- ‘‘বনের মোষ তাড়াতে গেলে তা ঘরের খেয়েই করা ভাল। তাতে সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের বিশ্বাস যোগ্যতা বজায় থাকে। এতে আত্মতৃপ্তি মেলে। নেশার উৎস যদি সামাজিক দায়বদ্ধতা হয়; সেক্ষেত্রে নেশা থেকে পেশাকে আলাদা রাখলে নেশার প্রতি সৎ থাকাটা অনেক সহজ। তাছাড়া সরকারী ও বিদেশী অনুদান পেতে গেলে বহুক্ষেত্রে কমিশন, পার্সেন্টেজ, কাটমানির বিষয়টি এসে গেছে। সামাজিক কাজ করতে এসেও নৈতিকতাকে বিসর্জন দিলে আর থাকে কী? এটা হলে ধান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীদের সাথে নিজেদের তফাৎ করাই তো মুশকিল হয়ে যাবে।”

ডিয়ারের কর্মকান্ডকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় জাদুঘর (ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম) ডিয়ার এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের পুরাতত্বের সম্ভার নিয়ে কলকাতা থেকে ছুটে এসেছে ডুয়ার্সে। ডুয়ার্স এখনও মশাবাহিত রোগপ্রবণ এলাকা। ডিয়ারের ব্যবস্থাপনায় ও ডি.বি.আই.টি.এ- এর সহযোগিতায় ২০ টি চা বাগানের স্বাস্থ্য কর্মীরা ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য কলকাতায় বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ডিয়ারের সদস্য- সদস্যরা তৈরী করেছে পতঙ্গ, পরিবেশ বিষয়ক বহু পোষ্টারসেট, চার্ট-মডেল। আদিবাসী চিত্রশিল্পী বাবলু মাহালীর তুলিতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে ইকোসিস্টেম, খাদ্য খাদকের প্রাকৃতিক সম্পর্ক, রাসায়নিক কীটনাশকের ক্ষতিকারক দিকগুলি। রাসায়নিক কীটনাশক বিষে কীভাবে নিঃশব্দে বিষিয়ে যাচ্ছে ডুর্য়াসের নদীনালা অরণ্য বনানী। রয়েছে তার সচিত্র বিবরণ। এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রহ- নক্ষত্রের ঝকঝকে রঙিন ছবি ও তার খুঁটিনাটি বিষয়। ডুয়ার্স এলাকায় যেসব কীট পতঙ্গ পাওয়া যায় তাদের দেহ সংরক্ষণ করেছে ডিয়ারের সদস্যরা।

বিভিন্ন সময় ডিয়ার করেছে বসন্তবাসর। ডিয়ারের মূল কার্যালয় বানারহাট আদর্শপল্লী মধুবনে বসেছে শিল্প সংস্কৃতির আসর-‘মধুবনে বসন্তবাসর’। সহযোগিতায় ছিল নিখিলভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের জলপাইগুড়ি শাখা। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখক, সম্পাদক, কবি, উপন্যাসিক, গবেষক, লোক শিল্পী সকলে এসেছেন দল বেঁধে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষ, আকাশবাণী শিলিগুড়ির কেন্দ্র অধিকর্তা শ্রীপদ দাশ, বাচিক শিল্পী স্বর্ণকমল চট্যোপাধ্যায়, অতনু চৌধুরী,  অধ্যাপক অর্ণব সেন, জনজাতি গবেষক প্রমোদ নাথ, কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত, চিকিৎসক ও লেখক ডাঃ উজ্জ্বল আচার্য, সম্পাদক বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়, লোকসংস্কৃতি গবেষক প্রেমানন্দ রায়, সম্পাদক রমেন দে, সাহিত্যিক হীতেন নাগ, জেলা বাস্তকার ও কবি গোপাল মন্ডল, গবেষক ডঃ রমাপ্রসাদ নাগ, কবি সুনীল চত্রবর্তী, সম্পাদক ডঃ শিপ্রা সেনধর, গবেষক ডঃ জ্যোৎস্নেন্দু চক্রবর্তী, কিরাতভূমি পত্রিকার সম্পাদক অরবিন্দ কর, ভ্রমণ লেখক গৌরী শঙ্কর ভট্টাচার্য, গল্পকার তুষার চট্টোপাধ্যায়, কবি ডঃ অমিত কুমার দে, অধ্যাপক বিমলেন্দু দাম, আকাশবাণী প্রযোজক কিংশুক সরকার, কবি ডাঃ বিজয় ভূষণ রায়, সম্পাদক ডঃ কৃষ্ণ দেব, কবি কাজি গোলাম কিবরিয়া, উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকার কার্টুনিষ্ট ‘অভি’ এর পাশাপাশি এসেছেন বাঙলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার উল ইসলাম, কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ের আইনজীবি অনুপম আচার্য, নৌপ্রযুক্তিবিদ ও অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমার আশীষ মুখার্জি ও আরো অনেকে।

ডিয়ার -এর উদ্যোগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান হয়ে চলেছে। ডিয়ার এর ব্যবস্থাপনায় বিখ্যাত তাত্ত্বিক মহাকাশ বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম স্টিফেন হকিং এর স্মরণ সভায় উপস্থিত ছিলেন ডুয়ার্স এলাকার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছেলে মেয়েরা। এ অনুষ্ঠানে বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকল্যাণ ভট্টাচার্য বলেন- “অসাড় দেহ নিয়ে স্যার হকিং যে ভাবে আমৃত্যু জটিল গবেষণার কাজ চালিয়ে গেছেন তা বিশেষচাহিদা সম্পন্ন মানুষজনের কাছে চিরদিনের প্রেরণা হয়ে থাকবে।”


আপাত শান্ত ডুয়ার্স বিগত দু’-তিন দশক ধরে মাঝে মাঝেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। কখনো জাতিগত, কখনো ভাষাগত বিচারে এই ভূখন্ড নিয়ে বিভিন্ন ভাগ বাটোয়ারার দাবী উঠেছে মাঝে মাঝেই। এইসব জাতিগত, ভাষাগত আন্দোলনের ঢেউ স্বাভাবিক ভাবে আছড়ে পরেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। অদূর অতীতে ঘন ঘন বন্ধ, পথ অবরোধ, অগ্নিসংযোগ এমন কী দাঙ্গায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এই প্রেক্ষাপটে ডিয়ার -এর সদস্যরা প্রথম থেকেই সদার্থক ভূমিকা নিয়েছে। ডুয়ার্স এলাকার ইতিহাস, বর্তমানের মধ্যে থেকেই তারা খুঁজে পেতে চেয়েছে সমস্যা সমাধানের স্থায়ীপথ। এ নিয়ে আলোচনা সভা ও কর্মশালার আয়োজন করেছে ডিয়ার। ডুয়ার্সের বিভিন্ন ভাষাভাষীর শ্রমিকনেতা, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, অধ্যাপক, সমাজকর্মীরা মুক্ত মনে অংশ নিয়েছেন এইসব অনুষ্ঠানে। বানারহাটের তরুণ সংঘ ভবনে আয়োজিত “পাহাড় ও সমতলের ঐক্য- সংহতি ও প্রেক্ষাপট ডুয়ার্স” শীর্ষক কর্মশালায় আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন- ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষ, ধূপগুড়ি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ইতিহাসবিদ ডঃ নীলাংশু শেখর দাস, প্রশান্তদেব মহিলা মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা ডঃ শীলা দত্ত ঘটক,  চা বিশেষজ্ঞ রাম অবতার শর্মা ও আরো অনেকে।

ডিয়ার তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনন্যতার দাগ রেখেছে। তাদের অনুষ্ঠান ‘রক্তের বন্ধনে ডুয়ার্স’ বিশেষ প্রশংসার অর্জন করে। ডুয়ার্সের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ক্যারন চা বাগান থেকে অসুর, জয়ন্তী থেকে ডুপপা, লোকসান থেকে লিম্বু এছাড়াও রাভা, ওঁরাও, মেচ, সাঁওতাল, হোর, শেরপা, মুন্ডা, রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ এই রক্তদান উৎসবে অংশ নেন। এর পাশাপাশি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, শিখ, জৈন ধর্মের মানুষের উপস্থিতিতে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে উৎসব প্রাঙ্গন। এ প্রসঙ্গে কার্ত্তিক ওঁরাও হিন্দি সরকারী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রহুল মিঞা বলেন- “ডুয়ার্স ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র সংস্করণ। বহু জাতি ও ধর্মের মানুষ এখানে বাস করে। এতো ছোট ভূখন্ডে এতো বেশী ভিন্ন জাত ও ধর্মের মানুষ এদেশে আর কোথায় বাস করে বলে আমার জানা নেই। এ ধরনের ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান ডুয়ার্সের ঐক্য ও সংঘতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।  ”

ডিয়ার বিভিন্নভাবে তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে। বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক কবি সুনীল চক্রবর্তীকে ডিয়ারের পক্ষ থেকে প্রথম সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেটাই ছিল এই এলাকার কোনো ব্যক্তি বিশেষকে কেন্দ্র করে প্রথম নাগরিক সম্বর্ধনা। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আনন্দগোপাল ঘোষ, সাংবাদিক জ্যোতি সরকার ও আরো অনেকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে উত্তরবঙ্গের ব্যতিক্রমী গুণীজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘ডিয়ার স্মারক সম্মান’ । যে সময় মানুষ রক্ত দিতে ভয় পেত; সেসময়ে নিস্বার্থভাবে নিজ কিডনি দান করেন বানারহাটের হর্ষ বক্সী। ডাব্লু.বি.সি.এস উত্তীর্ণ হয়েও প্রশাসনিক কাজে যান নি। বাবার স্মৃতি বিজড়িত বানারহাট উচ্চবিদ্যালয়ে কম বেতনে শিক্ষকতা করে জীবন কাটিয়েছেন শৈবাল ভট্টাচার্য। কার্টুন শিল্পকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন শিলিগুড়ির মলয় মুখোপাধ্যায় বা ‘অভি’। উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকার তিনি নিয়মিত শিল্পী। বহু সহস্রাধিক মনোজ্ঞ কবিতা, ছড়া লিখেছেন শিক্ষক অমিতকুমার দে। গবেষণা করেছেন ইংরাজি সাহিত্যে অরণ্যের প্রভাব নিয়ে। গয়েরকাটার বিনায়ক বোস (গনেশ) ‘আরণ্যক’ নামের প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠন করে তুলে বহু শতাধিক কচিকাঁচাকে আগামীর জন্য গড়ে করেছেন। চামূর্চীর রেজা করিম দীর্ঘ কয়েকদশক ধরে ডুয়ার্স এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। বানারহাটের মধুবনের বসন্তবাসরে এদের সবার হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘ডিয়ার স্মারক সম্মান’।   

ডিয়ার এর এইসব কর্মকান্ড সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রশংসিত হয়েছে। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর আনন্দলোক পত্রিকা সমাজ সচেতনতামূলক কাজে ব্যতিক্রমী প্রয়াস চালানোর জন্য ডিয়ারের কর্ণধার ডাঃ পার্থপ্রতিম-কে শিক্ষাক্ষেত্রে ‘সেলাম বেঙ্গল’ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন। জলপাইগুড়ি জেলার ঐতিহ্যশালী পত্রিকা কিরাতভূমির পক্ষ থেকে ডাঃ পার্থপ্রতিম-এর হাতে কিরাতভূমি স্মারক সম্মান তুলে দেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। ২০০৪-০৫ আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সচেতনতা বর্ষে জলপাইগুড়ি মহকুমা পরিষদের পক্ষ থেকে ডিয়ারে সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘বিজ্ঞান সচেতনতা স্মারক সম্মান’। এছাড়াও ‘চিকরাশি’ পত্রিকার প্রদত্ত সম্মান, কোচবিহারের ‘ছায়ানীড়’ সংস্থা, হলদিবাড়ি হাই স্কুল কমপিউটার প্রোজেক্ট, উত্তরবঙ্গ নাট্য জগৎ এর গুণীজন সংবর্ধনা আরো বহু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান সম্বর্ধিত করেছে ডিয়ার এর সদস্যদের। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলে সম্প্রসারিত হয়েছে ডিয়ার এক কর্মকান্ড। আনন্দবাজার পত্রিকার বরিষ্ঠ সাংবাদিক অনিন্দ্য জানা ডিয়ার এর কাজকারবার নিয়ে সুবিশাল প্রবন্ধ লিখেছেন ‘উত্তরের নায়ক’ শিরনামে। তবে এসব ছাড়াও ডিয়ার এর সৈনিকেরা পেয়েছে ডুয়ার্সের আদিবাসী ও বহু সম্প্রদায়ের মানুষের স্নেহ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা -এটাই তাদের চলার পথের মূল পাথেয়, তাদের আপসহীন লড়াইয়ে প্রধান রসদ। চিবুকে সংকল্প নিয়ে তারা এখনো তাদের সংকল্পে বিভোর- কুসংস্কারমুক্ত, পরিবেশ সচেতন এক দেশ গড়ার।

♦  ♦  ♦

ফিরোজ খান; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি;  শেবি.ও আরজি; বোস্টন; ম্যাসাচ্যুসেটস; ইউ.এস.এ- ডুয়ার্স  অঞ্চলের খবর অনেকদিন রাখিনি। হঠাৎ করে ৫৭ বছর পর বানারহাট হাই স্কুল প্রাঙ্গণে যখন পুরনো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা হলো। জানলাম ডুয়ার্সের অবহেলিত এলাকায় আমারই স্কুলের এক ছাত্র ব্যতিক্রমী কাজ করছে। ভাই ডাঃ পার্থপ্রতিম স্বাস্থ্য পরিবেশ, কুসংস্কার এসব নিয়ে প্রায় তিনদশক ধরে সচেতনতামূলক কাজ করে চলেছে। ওর স্ত্রী সুকন্যা বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। কারো কাছে হাত পাতে না। সরকারী বা বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই নিজ উদ্যমে এগিয়ে চলে। আমি খুব আশ্বস্ত হলাম শেষ পর্যন্ত একজন এগিয়ে এসেছেন এলাকার স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও পরিবেশ সচেতনতার উপর কাজ করতে।  কারণ আমি নিজে একজন পলাতক। কাজ তো করিনি এমনকি দেশ ছেড়ে এসেছি।
যখন পার্থপ্রতিম কে ফোন করলাম উত্তর পেলাম খুবই চমৎকার। পার্থ প্রতিম বললেন - "আপনি কিন্তু ছুটি কাটাবার জন্য আসবেন না, আমাদের সঙ্গে যদি কাজ করতে পারেন, আইডিয়া দিতে পারেন তবেই আপনার ডুয়ার্স আসাটা সার্থক হবে "। এত সুন্দর আহ্বান এত প্র্যাকটিক্যাল, আমি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম। আবার আসিব ফিরে"।

♦  ♦  ♦

অরূপ গুছাইত; জনসংযোগ আধিকারিক; পঃ বঃ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ; পঃ বঃ সরকার- আমি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও জনসংযোগ নিয়ে পড়াশোনা করছি তখন বি.বি. গাঙ্গুলী স্ট্রিটের দৈনিক বসুমতী পত্রিকার গোল টেবিলে পার্থদার সাথে পরিচয়। পার্থদা সে সময় বসুমতী পত্রিকার বিজ্ঞান পাতায় লিখতেন। তখন জনবিজ্ঞান আন্দোলনে পার্থদা সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। পার্থদার নেতৃত্বে সে সময় বিভিন্ন বিজ্ঞান ক্লাবের সম্মেলন হত। তারপর পার্থদা ডুয়ার্সে নিজের জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। আমিও দৈনিক বসুমতী পত্রিকার চাকরি নিয়ে শিলিগুড়িতে আসি। দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক সে সময় আরো সুদৃঢ় হয়। পার্থদার মধুবনে আমি বহুবার এসেছি। ডুয়ার্সের প্রতি তার ভালোবাসা, বিভিন্ন সামাজিক কাজের প্রতি তার নিষ্ঠা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমার লেখা উপন্যাসে পার্থদা রয়েছেন। সদা হাস্যময়, নিরহংকারী, উচ্চগ্রামের রসবোধ আমাকে আকর্ষণ করে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পার্থদার বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে, লিখেছেন বেশ কয়েকটি মূল্যবান বই। যা পাঠক সমাজকে সমৃদ্ধ করেছে।

♦  ♦  ♦


বিনায়ক বোস; প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; ‘আরণ্যক’, গয়েরকাটা- পার্থদার সাথে বহুদশকের পরিচয়। ‘আরণ্যক’ -এর উদ্যোগে শিশু-কিশোরদের নিয়ে আমরা যখন নেচার স্টাডি ক্যাম্প শুরু করি, পার্থদা প্রথম থেকেই আমাদের সাথে রয়েছে। আরণ্যকের সহযোগিতায় পার্থদা বহুবার তার অডিও ভিস্যুয়াল শো আমাদের গয়েরকাটায় দেখিয়েছেন। কখনও পতঙ্গ-পরিবেশ, কখনও মহাকাশ, কখনও ডেঙ্গু প্রতিরোধ এইসব বিভিন্ন বিষয়ে প্রদর্শনী হয়েছে। বহুকাল আগেই থেকেই  তার টেন্ট, প্রোজেক্টর, টেলিস্কোপ নিয়ে বিভিন্ন প্রকৃতি পাঠ শিবিরে পার্থদা হাজির হয়ে চলেছেন। সেদিনের কচিকাঁচারা আজ বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে। তার সংগৃহীত বিভিন্ন পোকামাকড় ও প্রাণীর বায়োলজিক্যাল স্পেসিমেন পার্থদা আমাদের আরণ্যককে উপহার দিয়েছেন। পার্থদার জবাব নেই। দাদা আর দশজনের থেকে একদম আলাদা।

♦  ♦  ♦

» » একলা পথিক, অনেক আকাশ- পর্ব -৩          

একলা পথিক, অনেক আকাশ- পর্ব -১ « «

Join our mailing list Never miss an update