একলা পথিক; অনেক আকাশ . . .পর্ব- ৩

 একলা পথিক; অনেক আকাশ . . .পর্ব- ৩

প্রায় চার দশক আগে আকাশগঙ্গার বালুচর ধরে শুরু তার পথচলা । দিকচক্রবাল দিয়েছিল মায়াভরা ছায়া ছায়া আদুরে আলাপ। অনেক আকাশ তাদের তারকা- রবি- শশী নিয়ে আলোকময় ক’রে রেখেছে একলা পথিকের চলার পথ। সেই সূর্যস্নাত যাত্রাপথের গোধূলিবেলায়; পথিক মনের সিংহাবলোকন। আড্ডা উৎসারিত ব্যতিক্রমী জীবনের সে উপাখ্যান- আজ অক্ষরবন্দী।

সম্পাদনা- অনুপম আচার্য; আইনজীবী উচ্চন্যায়ালয়, কোলকাতা। উচ্চতম ন্যায়ালয়; নিউদিল্লী।
গ্রন্থনা- উৎপল মৈত্র; কোলকাতা।

 

ক্লিনিক

কাকা ডাঃ এ. কে বোসের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসক জীবন শুরু করেন। সর্বদা স্বাধীনচেতা পার্থপ্রতিমের কাছে এই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক পেশাটি বেশ মন মতো হয়েছিল।  স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির সুবাদে হিউম্যান অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি তার আত্মস্থ ছিল। এই সুবিধাই তাকে চিকিৎসক হিসেবে অনন্য স্থানে নিয়ে যায়।
প্রথম থেকেই তিনি তার ক্লিনিকে সহযোগী হিসেবে দু’-তিনজন সহযোগীকে নিয়োগ করেন। সে ধারা সবসময় বজায় থেকেছে। নার্স, কম্পাউন্ডার নিয়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা এলাকার বহু মানুষের কাছে ঈর্ষা ও বিস্ময়ের বিষয় হয়ে ওঠে। তার সান্নিধ্যে আসা সেদিনের কচি-কাঁচারা আজ সমাজে বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত। সবাই মূলত আদিবাসী চা-শ্রমিক পরিবার থেকে উঠে আসা। কেউ বা হয়েছেন চা বাগিচার হেল্থ অ্যাসিসটেন্ট, কেউ আবার আই.সি.ডি.এস সুপারভাইজার, কেউ বর্তমানে আশাকর্মী। কারও বিয়ে হয়ে গেছে সুদূর হরিয়ানায়। সেখানে তিনি এখন গ্রামীণ মহিলাদের মধ্যে হোমিওপ্যাথি স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে চলেছেন। তার বিভিন্ন সহকর্মীরা বিভিন্ন সময় কাটিয়েছেন তার সান্নিধ্যে। কেউ বা ৬ মাস, এক বছর, কেউ বা কাটিয়েছেন সাত- আটবছর।

 চা বাগান অধ্যুষিত ডুয়ার্স এলাকায় বেশিরভাগ চা বাগিচা রবিবার ছুটি থাকে। তাই শ্রমিক পরিবারের মানুষজন তাদের কেনাকাটা, চিকিৎসা আর সবকিছু দৈনন্দিন কাজের জন্য এই দিনটিকেই বেছে নেয়। স্বাভাবিকভাবেই বানারহাট, বীরপাড়া, গয়েরকাটা এইসব মফঃস্বল বন্দরগুলিতে বহু বছর ধরে রবিবারে হাট বসে। পার্শ্ববর্তী বাগানগুলি থেকে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার জন্য বহু মানুষ ছুটে আসে এইসব স্থানে।
সে কারণেই পার্থপ্রতিম এই দিনটিতে সচরাচর কোথাও যান না। বিষয়টি যে শুধু অর্থনৈতিক তা নয়। পার্থপ্রতিমের কথায়- “আমাদের এই প্রতিষ্ঠান দু’ পুরুষের, বয়স প্রায় ৭০ পেরিয়েছে। আমারও তিন দশক হয়ে গেল। প্রথমদিকে যে শিশুটি মায়ের কোলে চেপে এসেছিল; সে এখন তার পুত্র বা কন্যাকে নিয়ে আমার কাছে আসে। এ পেশার এক পারম্পরিক দায়বদ্ধতাও থাকে। চেম্বারে এসে ডাক্তারবাবুকে না পেলে রোগীরা অসহায় ও বিপন্ন বোধ করে।”
এদিকে আবার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য স্বাভাবিকভাবে রবিবার দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়ে থাকে। এখানেই হয়ে যায় উভয়সংকট। তাকে বিনম্র চিত্তে বহু অনুষ্ঠানে সভাপতি, প্রধান অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে হয়।
এ বিষয়ে অনেক উদ্যোক্তারা নেপথ্যে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন। নানাবিধ কাজ করেন ঠিকই, তবে পেশার প্রতি তার দায়বদ্ধতা কোনো অংশে কম নয়।
এমনও হয়েছে রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর তার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন- “তোর কিছু হয়নি, ঠিক হয়ে যাবি। এই খাবার-দাবারগুলি ঠিক সময়মতো খাবি। সকালে উঠে খালিপেটে এক লিটার জল খাবি। বাজারের মোমো, চাউমিন, কুরকুরে, চিপস্ এইগুলি খাবি না।” তাতেই দেখা যায় বিনা ওষুধে এইসব রোগী টনটনা।

তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন ঠিকই, তবে তার কাছে বিভিন্ন ধরনের ডাক্তারী যন্ত্রপাতি রয়েছে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে তিনি এগুলি কিনেছেন। আসলে তিনি যে অঞ্চলে থাকেন সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। বেশিরভাগই চা-বাগিচার শ্রমিক পরিবারের মানুষজন। যেমন- মটরের দানা কোনো শিশুর কানে গভীরভাবে ঢুকে গেলে তাকে যখন ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়; তখন স্বাভাবিকভাবেই উপযুক্ত যন্ত্রের অভাবে তাকে দূরে বড় হাসপাতালে রেফার করা হয়। তখন গাড়ি ভাড়া করে সে মহকুমা বা জেলা হাসপাতালে রোগীকে পৌঁছানো বেশ ব্যয় সাপেক্ষ। খাজনা থেকে অনেকক্ষেত্রে বাজনাটাই বেশি হয়ে যায়। এই ডাক্তারবাবু তাই রোগীর কথা চিন্তা করে, লাভ লোকসানের পাটীগণিতে না গিয়ে তিনি এসব যন্ত্র কিনে রেখেছেন। যাতে কিছুটা হলেও অবস্থা সামাল দেওয়া যায়। কিছুটা হলেও স্বস্তি দেওয়া যায় গরীব গুব্বো মানুষগুলিকে। তার কাছে রয়েছে কান-নাক- গলা পরীক্ষার জন্য ই.এন.টি ডাইগোনেস্টিক সেট। ফরেন বডি রিমুভাল কিটস্, আই এণ্ড ইয়ার আলসার সিরিঞ্জ, অরাল কিউরেট সেট আরো বহু কিছু।  এছাড়া ওয়েইং মেশিন, হাইট এন্ড বি.এম.আই মেজ্যারিং স্কেল। দু-তিন প্রকারের স্টেথোস্কোপ ও গোটা তিন প্রকারের রক্তচাপ মাপার যন্ত্র রয়েছে। তার কাছে এমনও বহুমূল্য যন্ত্র রয়েছে যা কিনা বছরে দু’ থেকে তিনবার প্রয়োজন হয়। তার কাছে থাকা নার্সদেরও তিনি এবিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন।

তার চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ধরনটাও ব্যতিক্রমী। রোগ তীব্রতা বা জটিলতার ওপর নয়; তার ভিজিট নির্ভর করে রোগীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর। যে সব রোগীদের নিজস্ব চারচাকা, এসি রুম রয়েছে তাদের জন্য ভিজিট সর্বাধিক। চাবাগিচার শ্রমিক পরিবারের মানুষজনদের তা প্রায় নামমাত্র। বেশীরভাগ রোগীরাও বিনা বিবাদে তার এই ‘ভেদভাব’  ব্যবস্থা মেনে নেন। আবার এমনও দেখা যায়- কেউ তার জাইলো ডি ৪ গাড়িটি অনেক দূরে রেখে, পায়ে হেঁটে তার চেম্বারে আসেন।   

সবচেয়ে বড় বিষয় হল সব জায়গায় কম্পিউটার বা এ ধরনের কিছু শিখতে গেলে মাসে মাসে পয়সা দিতে হয় । স্যারের এখানে কমপিউটার শেখাও যায়, পয়সাও পাওয়া যায় । আজকে যে আদিবাসী মেয়েটি প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক করার কাজটি করছে । স্যারের ছোঁয়ায় না এলে সে রোদে পুড়ে- বৃষ্টি ভিজে বিঘা হাজিরায় চা বাগানের পাতা তুলতো।

সময়ের সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী জগতও পরিবর্তিত হয়। আজ যা অতি প্রয়োজন, কালই তা ব্রাত্য হয়ে যায়। পার্থপ্রতিম যখন ক্লিনিকে বসে ডাক্তারি শুরু করেন সে সময় তা ছিল কাঠের বেড়া দেওয়া টিনের চালের দোচালা ঘর। কম্পিউটার, ল্যাপটপ সেখানে ব্যবহার করার মত উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। তা সময়ের দাবী মেনে তিনি তার ক্লিনিকটাকে নতুন করে তৈরী করার কাজে হাত দিলেন।  অনেক চেষ্টা করে তিনতলা পাকা ক্লিনিক তিনি তৈরী করলেন।  এখানে তার কাছে কাজ করতে আসা চা বাগিচার কিশোরী-যুবতীরা কম্পিউটার ও আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হতে পারে। ২০০৮ সালের ৩রা জুলাই তার সেই ক্লিনিক উদ্বোধনে আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিল বহু গুণীজন। স্থানীয় বহু চিকিৎসক, বানারহাট থানার আধিকারিক, স্কুল শিক্ষক, কন্ঠশিল্পী ও আরও অনেকে। স্বাভাবিকভাবেই, এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোনো পূজা পার্বণের ব্যবস্থা ছিল না। তবে পেট পূজা ছিল। ছিল নাচ- গান- আড্ডার আসর।  সকল গুণীজনের উপস্থিতিতেই চিকিৎসালয়ের ফিতা কেটে দ্বার উদঘাটন করেন সেই রাজমিস্ত্রী জয়কান্ত বর্মন। যার হাতুড়ি-কোরনি ও ঘামের ছোঁয়ায় তৈরী হয়েছে তার চিকিৎসালয়।

এখন তার ক্লিনিকে ডেস্কটপ কম্পিউটার, ল্যাপটপ ছাড়াও  রয়েছে ফিজিওথেরাপি শেখার বিভিন্নরকম উপকরণ। রয়েছে ইনফ্রারেড ল্যাম্প, হিটপ্যাড, বিভিন্ন ধরনের ভাইব্রেটার, ম্যাসাজার, বডিরোলার, ফিংগার রিং আরো বহু কিছু । চা বাগিচার মেয়েদের ফিজিওথেরাপি শিখিয়ে কিছুটা আত্মনির্ভরশীল করার প্রয়াস তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন।

চিকিৎসক হিসাবে তিন দশক কাটিয়ে দেওয়ার পর, আজ যখন জীবনের সায়াহ্নে তিনি কোনো রোগীর কার্ডিও-রেসপিয়ো রেসিয়ো বা সিরাম ক্রিয়েটিনিন নিয়ে চিন্তামগ্ন; সে সময়  কোনো যুবতী শিশুর হাত ধরে এসে আচম্বিতে ভক্তিভরে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে- “স্যার, পেহেচানে হামে? ম্যায় ইয়াহা পে কাম করতি থি।” স্মৃতির পটে টোল না পড়া মানুষটি তখন ভাবতে থাকেন; বছর পনেরো আগে সেই যুবতীর কিশোরবেলার মিষ্টি মুখাবয়বটি। দেখি মনে জাগে, কি না জাগে . . .।

♦  ♦  ♦

জয়কান্ত বর্মন;  নির্মাণকর্মী (রাজমিস্ত্রী) -প্রায় ৪০ সন আগত জোগালি, পাছত্ রাজমিস্ত্রীর কাজ করির নাইগছং। ভাইল্লা মানষির ছোট বড় মেলা ঘরবাড়ি মোর হাতত্ গড়া হছে। ওটেকোনা উমরা  বউ-ছাওয়া নিয়া বাঁচি আছে। কিন্তুক ডাক্তারবাবুর ক্লিনিক বানেয়া মুই যে আনন্দ আর ভালোবাসা পাইছং তা এজীবনত ভুলিম না। নয়া ঘর-সোন্দার দিন  সগায় গনেশ, নারায়ণ পূজা করে কিন্তুক ডাক্তারবাবু নাচন, গান আর কথার অনুষ্ঠান কইল্লেক। ওটেকোনা দারোগাবাবু, বড় বড় মাষ্টার আরোও অন্য অন্য ডাক্তারবাবুও ছিলো।  সগার আগত ডাক্তারবাবু মোক দিয়া দোকান ঘরের ফিতা কাটাইলেক। মোর তো ভয়তে হাত-পাও কাপির লাগছিল।  জনমে এমন কাজ করং নাই, আর হয়তো করিমও না। মুই ত্যামন নেকা পড়া করং নাই, মুখ্য-সুখ্য মানষি। প্যাটের দায়ত অ্যালা সিকিমত থাকং।  ওটেকোনা পাইসা-কড়ি ভাল পাওয়া যায়। য্যালা এদিকোনা আইসং, দুরত থাকি হইলেও ডাক্তারবাবুর  দাওয়াখানাক এক্না ভক্তি করি যাং।
(প্রায় ৪০ বছর ধরে প্রথমে জোগালি, পরে রাজমিস্ত্রী কাজ করে চলেছি। বহু মানুষের ছোটো- বড় বহু ঘর বাড়ি আমার হাতেই তৈরী হয়েছে। সেখানে তারা তাদের পরিবার নিয়ে বেঁচে আছেন। তবে, ডাক্তার বাবুর ক্লিনিক তৈরী করে আমি যে আনন্দ ও ভালোবাসা পেয়েছি, এজীবনে কোনোদিন ভুলবো না। ঘরে ঢোকার দিন সবাই গণেশ পূজা, নারায়ণ পূজা করে। ডাক্তার বাবু গান-নাচ, কথার বিভিন্ন অনুষ্ঠান করলেন। সেখানে দারোগাবাবু, বড় বড় মাষ্টারমশাইরা ছিলেন, আরো অনেক ডাক্তার ছিলেন। সবার সামনে ডাক্তারবাবু আমাকে দিয়ে দোকানঘরের ফিতা কাটালেন। আমার তো ভয়ে হাত-পা কাঁপছিল। জীবনে কোনোদিন এই কাজ করিনি, হয়তো করবোও না। আমি তো সেরকম পড়াশোনা করি নি, মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ। পেটের দায়ে এখন সিকিমে আছি। ওখানে পয়সাপত্র একটু ভালো পাওয়া যায়। যখনই এদিকে আসি, দূর থেকে হলেও ডাক্তারবাবুর দাবাখানাকে একবার প্রণাম করে যাই।)


♦  ♦  ♦

শ্রীমতি পম্পা লোধ - আমার মেয়ে ছোট্ট পেখমকে কোলে নিয়ে ডাঃ পার্থপ্রতিমের কাছে প্রথম যাই। ডাক্তারবাবু শুধু ওষুধ দিতেন না, রোগের কারণ, প্রতিকার ও বিভিন্ন বিষয়ে সাবলীলভাবে বোঝাতেন। সে সময় তিনি উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় নিয়মিত স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখতেন। আমি তার পাঠক ছিলাম। পেখম এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে স্বনির্ভর শিল্প উদ্যোগী। ডাঃ পার্থপ্রতিম ডাক্তারী ও বিজ্ঞান নিয়ে  বহু লেখালেখি করেন ঠিকই; তবে উনি মূলতঃ শিল্প- সাহিত্যের মানুষ।  এখন মাঝে মধ্যে তার সাথে কথা হয়। যেভাবে কথায় কথায় কবিতা ও গানের লাইন কোট করেন তা আমার কাছে বিস্ময়কর। তার পড়াশোনার ব্যাপ্তি আজও আমায় মুগ্ধ করে।

♦  ♦  ♦

সুশীল মুর্মু; স্বাস্থ্য সহায়ক; বানারহাট চা বাগান - স্যারের কাছে আমার চিকিৎসা বিজ্ঞানের হাতেখড়ি। আমি স্যারের এই ক্লিনিকের কর্মী ছিলাম। স্যার সবসময় আমাকে পড়াশোনার বিষয়ে অনুপ্রাণিত করতেন। আমি স্যারের সাথে বেশ কিছু সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিই; সে প্রায় ত্রিশবছর আগের কথা। মেখলিগঞ্জ ও আরো বহু জায়গায় গিয়েছি।  ল্যাপটপ প্রোজেক্টারের সাহায্যে গ্রামের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয় নিয়ে প্রদর্শনী করি। স্যার ওয়েষ্টবেঙ্গল ভলেন্টারি হেল্থ অ্যাসোসিয়েশন- এর সাথে যোগাযোগ করে আমাকে কোলকাতায় পাঠিয়ে ছিলেন ম্যালেরিয়ার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে। আমি স্যারের সাথে শিলিগুড়ি রেডিও সেন্টারে গিয়ে প্রোগ্রাম করেছি। স্যার আমার কাছে সবসময় অনুপ্রেরণার উৎস।

♦  ♦  ♦

♦  ♦  ♦

সংযোগিতা মহালী; শিক্ষিকা -  স্যারের কাছে আসা আমার জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা । স্যারের কাছে যারা থাকে, তিনি তাদের বিভিন্ন বিষয় শেখান- ইংরেজী গ্রামার, চিঠি লেখা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি, কম্পিউটার আরোও বহু কিছু ।  এখানে নিয়মিত একাধিক পেপার রাখা হয় । এছাড়াও স্যার বহু ধরনের বইপত্র ও পত্রিকা কেনেন । পড়াশোনার বিষয়ে আমাদের সবসময় অনুপ্রাণিত করেন। আমার এই শিক্ষিকা হওয়ার পেছনেও স্যারের অবদান রয়েছে। স্যার মেরা বড়া পাপা। স্যার বলেন- “আমাদের গাদাগাদা টাকা নেই। সালমান খানের মতো চেহারা নেই। এই দুনিয়ায় আমাদের লড়তে গেলে, জ্ঞানকে সম্বল করেই লড়তে হবে।”

♦  ♦  ♦

মহামিলনের তান

যখন উত্তরের জানালা দিয়ে আসে হিমেল হাওয়া, ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু, নতুন ক্যালেন্ডারের শুরুয়াৎ। তখন এক ভিন্নধর্মী উৎসবে মেতে ওঠে ডুয়ার্স। ১৪ই জানুয়ারী ‘ডুয়ার্স দিবস’। বিগত ১২বছর ধরে এটাই ডুয়ার্সের নিজস্ব উৎসব; একান্ত আপন দিন উদযাপন। পশ্চিম ডুয়ার্সের মংপং থেকে কুমারগ্রাম। তিস্তা থেকে সংকোশ নদী। ১৬০ কিমি লম্বা এই ভূখন্ড বর্তমানে ‘ডুয়ার্স’ নামেই পরিচিত। মেচ, রাভা, টোটো, লিম্বু, রাজবংশী, কোচ, ওরাঁও, সাঁওতাল, মুন্ডা, বিহারী, বাঙালী, নেপালী, আরো বহু জাতি, জনজাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর বাস। সুবিশাল হিন্দু মন্দির, মসজিদ,  সুসজ্জিত গির্জা, নীল আকাশে হাত বাড়ানো বৌদ্ধ প্যাগোডার চূড়া, গুরুদ্বার সবই আছে ডুয়ার্সে।  প্রায় ১৪৯টি ভাষা- উপভাষায় কথা বলে এই এলাকার মানুষ। সারা দেশে আয়তনের তুলনায় সবচেয়ে বেশী প্রকারের জনজাতির মানুষ বাস করেন এই ভূখন্ডে।

অতীতে সকলে পাশাপাশি থেকে একে অপরের সুখ-দুঃখের সামিল হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেই অতীত ঐতিহ্যে আঘাত লাগে। ১৯৮৬ সাল থেকেই ডুয়ার্সকে গোর্খাল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে শুরু হয় এক নতুন আন্দোলন; যা ২০০৮ সালের দিকে তীব্র আকার নেয়। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, কামতাপুর পিপলস্ পার্টি, আরো কিছু ভাষা জনগোষ্ঠী ও গণসংগঠনগুলির ডাকা বনধ, পরিবহন ধর্মঘট, পথ অবরোধে জেরবার হয় জনজীবন। নরহত্যা, অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে শান্ত- শ্যামল এই জনপদে। ফলে কিছুটা হলেও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরী হয় বিভিন্ন ভাষা- সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে। শিক্ষা- যোগাযোগ- স্বাস্থ্যপরিষেবা  বিভিন্ন বিষয়ে পিছিয়ে থাকা ডুয়ার্সে এ এক গোদের ওপর বিষফোঁড়া।

সেই সময় ছিল রাজনৈতিক পালা বদলের সন্ধিক্ষণ । ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা ভোটের পাটিগণিত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাকে সমর্থন করলে বা কার বিরোধীতা করলে ব্যালট বক্স-এ ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে সেটা নিয়ে তারা চিন্তামগ্ন। ডুয়ার্স এলাকার মানুষের সংকট ক্রমেই বড় আকার নিতে থাকে। যারা প্রায় একশতক এর বেশী সময় ধরে পাশাপাশি ছিলেন; তাদের মধ্যেই সৃষ্টি হয় অবিশ্বাসের পরিমন্ডল।

কোলকাতা মহানগরীতে এক দশক কাটিয়ে পার্থপ্রতিম সে সময় পাকাপাকি ঘর বেঁধেছেন চা বাগিচার গালিচায়। সে সময় তিনি প্রত্যক্ষভাবে সংবাদ মাধ্যমের সাথে যুক্ত। তারই উদ্যোগে সংবাদ মাধ্যমের সাথে যুক্ত থাকা ডুয়ার্স এলাকার সাংবাদিকদের যুক্ত করে তৈরী হয়েছে ‘ডুয়ার্স জার্নালিস্ট ক্লাব’। তিনি তার সম্পাদক।
সংকট ঘনীভূত হলে প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলির উদাসীনতার মাঝে পার্থপ্রতিম আওয়াজ ওঠান- “এভাবে চলতে পারে না। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের একত্রিত হওয়ার সময় এসেছে।” সংবাদমাধ্যমের সাথে যুক্ত থাকা মানুষগুলির কিছু সুবিধা রয়েছে। এরা অনেকটা সর্বত্রগামী। সি.পি.আই.এম- এর যেমন মুশকিল তৃণমূল কংগ্রেসের ডাকে সাড়া দেওয়া। ওদিকে বিজেপি- এর ডাকে কংগ্রেস যেতে পারে না। সাংবাদিকদের আহ্বানে তেমন কোনো ছুঁতমার্গ নেই।

এই পরিস্থিতিতে ডুয়ার্সের ভূমিপুত্র ডাঃ পার্থপ্রতিম চিবুকে সংকল্পের কাঠিন্য নিয়ে এগিয়ে এলেন। সংবাদ মাধ্যমের সাথে যুক্ত থাকা ভাই- বন্ধুদের সাথে নিয়ে কোমর বাঁধলেন দিন বদলের স্বপ্নমেদুরতায়। এগিয়ে  এলেন- সাংবাদিক রাজেশ প্রধান, দিলীপ চৌরাসিয়া, রমনকুমার ঝা, শুভজিৎ দত্ত, বাবলু রহমান, মুস্তাক মুর্শিদ হোসেন, নাসিরুদ্দিন গাজী, অনুপ সাহা, বিদেশ বোস ও আরো অনেকে। এর সাথে এলেন সমাজ সচেতন কিছু ব্যক্তি। অমরনাথ ঝা, বলরাম রায়, ঘুরন্ড ওঁরাও, রমেশ লাকড়া, সুকল্যাণ ভট্টাচার্য, সোমেশ্বর পান্ডে, দেবযানী সেনগুপ্ত, রেমা চৌধুরী ও বহু মানুষ। সঙ্গে যোগ দিলো কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ক্লাব ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। ২০১০সালের ১৮ই নভেম্বর ধূপগুড়ি ব্লকের বানারহাটে একসভায় আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, পিপিপি, ডুয়ার্স মিল্লাত ইসলামিয়া, কামতাপুর পিপলস্ পার্টি- এইসব নীতি-আদর্শগতভাবে পরস্পর বিরোধী সংগঠনগুলিকে মুখোমুখি আলোচনার টেবিলে বসিয়ে দেওয়া হয়। সরকার-প্রশাসন যে কাজ করতে এতদিন ব্যর্থ হয়েছে, ঢাল তলোয়ারহীন সামান্য কয়েকজন মানুষ এই অসাধ্য কীভাবে সাধন করলো? সে প্রশ্নই ঘুরতে থাকে সাধারণ মানুষের মুখেমুখে। সেসভায় সোজা সাপটাভাবে বলা হয়- "বিভিন্ন ভাষাভাষী- সম্প্রদায় ও গণসংগঠনের গণতান্ত্রিক দাবীদাওয়া  থাকতেই পারে, তবে খেয়াল রাখতে হবে তাদের আন্দোলনের পদ্ধতি যেন সাধারণমানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হনন না করে। কামতাপুর পৃথক রাজ্য, ষষ্ঠ তপশীল, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, গোর্খাল্যান্ড এইসব বিভিন্ন দাবী  পুরণ করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের রয়েছে। যা দিল্লী বা কলকাতায় বসে থাকা কর্তাব্যাক্তিদের বিষয়। গঙ্গা বা যমুনা-র ওপারে থাকা নীতি প্রণেতারা কী সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা পরের বিষয়। সেক্ষেত্রে ডুয়ার্সে থাকা মানুষজন নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক হানাহানিতে লিপ্ত হবে কেন? আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা মাথায় রেখেই বিষয়টিকে ভাবতে হবে।" আশি ছুঁই ছুঁই চা শ্রমিক সংগঠক চিত্ত দে -সে সভায় সভাপতিত্ব করেন। সেই সভায় ঠিক হয় আগামী অর্থাৎ ২০১১ সালের ১৪ই জানুয়ারী ডুয়ার্সের শান্তি-সম্প্রীতি ও প্রগতির লক্ষ্য নিয়ে পালিত হবে ‘ডুয়ার্স ডে’। সেই সভায় ‘‘ডুয়ার্স ডে’’ উদযাপনের  জন্য কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন চিত্ত দে ও সাধারণ সম্পাদক ডাঃ পার্থপ্রতিম।

১৮৬৪ সালের ১৪ই জানুয়ারী ব্রিটিশ সার্জেন রেইনী তৎকালীন বড়লাট লর্ড এলগিনকে একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন- ডুয়ার্স এলাকার ভৌগোলিক গুরুত্ব, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা। তারপর থেকেই ব্রিটিশ সরকার এই এলাকায় তাদের প্রভাব বিস্তারের দিকে অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই পান্ডববর্জিত জনমানবহীন এলাকায় প্রভাব বিস্তার করার উদ্দেশ্য ছিল- পার্শ্ববর্তী ভুটান, নেপাল, তিব্বত ও চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর ইংরেজদের সামরিক নজরদারী বাড়ানো। অরণ্য- বনানী কেটে তৈরী হয় চা-বাগিচা, শুরু হয় রেললাইন পত্তনের কাজ। সেকারণেই বেছে নেওয়া হয় এই দিনটিকে। শুরু হয় জোর কদমে প্রস্তুতি। অশান্তির বাতাবরণ কাটিয়ে ভালো দিনের কামনায় কোমর বেঁধে নেমে পড়ে অযুত নিযুত মানুষ। তিস্তা থেকে সংকোশ নদী, বিভিন্ন এলাকার মানুষ তাদের মত করে এই দিনটি পালনে এগিয়ে আসে। কোথাও হয় একদিনের ফুটবল প্রতিযোগিতা, কোথাও মহিলাদের জন্য লুডো প্রতিযোগিতা, কোথাও শীতের হিমেল হাওয়ায় খিচুড়ি খাওয়া, কোথাও স্থানীয় উন্নয়ন ও শিল্প সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা সভা।
ডুয়ার্স  বা চা-বাগান ঘিরে এর আগে যে কোন উৎসব হয়নি; তা নয়।  বিভিন্ন জায়গা থেকে চাঁদা একাট্টা করে এক জায়গায় বড় প্যান্ডেল হয়েছে। এসেছে সরকারী ও বেসরকারী আর্থিক আনুকূল্য, মন্ত্রী মশাই ফিতে কেটেছেন। বুকে রাধাবল্লভীর মতো বড়সড় ব্যাজ, মন্ত্রীমহোদয়ের দীর্ঘ রাজনৈতিকভাষণ, পেছনে বসে থাকা দর্শকদের হাই তোলা। উদ্যোক্তাদের নাম ছাপানো ব্যাগ, টুপি, স্পন্সর কোম্পানির বড়সড় স্টল। সাথে ফুচকা, এগরোল, চাওমিন. . .। অনুষ্ঠানের পর উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও স্বজনপোষণের অভিযোগও ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায় পাতায়।

এসব কিছুই করতে রাজি হয়নি এই অভিনব উৎসবের আয়োজকেরা। হোক না সবকিছু প্রাণের পরশে! নবীন আবেগে! -সেটাই তারা চাইছেন। যেভাবে জিতিয়া-করম, ফুলপাতি, ইদ্, হোলি হয় সেভাবেই কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া হোক এক উৎসব। কোন নির্দিষ্ট ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নয়; ডুয়ার্সে বসবাসকারী সকল মানুষের আন্তরিক উৎসব।
তৈরী হয় দিবস উদযাপনের প্রতীক বা লোগো। ডুয়ার্স কথাটির উৎপত্তি ইংরাজি ‘ডোর’ বা বাংলার ‘দ্বার’ শব্দ থেকে। দরজা খুলে একজন তাকিয়ে আছে উত্তরের দিকে, দূরে পাহাড়ের দুই শৃঙ্গের মাঝ থেকে সূর্য উঠছে। সম্মুখে আলোকিত সূর্য, পেছন পানে অন্ধকার। নতুন প্রভাতের পানে দন্ডায়মান এক ছায়ামূর্তি- অদ্ভুত ব্যাঞ্জনা ভরা এই ডুয়ার্সদিবসের প্রতীক।

বিবাহ বা চাকরী সুত্রে যারা এখন ডুয়ার্সের বাইরে রয়েছে ১৪ই জানুয়ারী এদিনের জন্য সকলকে নিজ নিজ বাড়িতে ফেরার ডাক দিয়েছে উদ্যোক্তা সমিতি। এভাবেই পঁচিশবছর পর দেখা হয় কালচিনির সুনিতা ছেত্রীর সাথে গার্গী গাঙ্গুলীর। বহুবছর পর মিলিত হয় দুই বাল্য বন্ধু . . . ।
১৪ই জানুয়ারী সন্ধ্যায় আলোকমালায় সাজে ডুয়ার্স। ডুয়ার্সের হিন্দুমন্দির,  মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার, বৌদ্ধমন্দির, অফিস-কাছারি, বাড়িঘরে সন্ধ্যা ছটা থেকে আটটা পর্যন্ত প্রদীপ- মোমবাতি- বিজলিবাতি জ্বালে এই এলাকার মানুষজন। না একে কেউ ‘দীপাবলী’ বলছেন না; বলছেন আলোক উৎসব। কেন না সেই নামের সাথে এক বিশেষ ধর্মের ছোঁয়া রয়েছে।  সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ডুয়ার্স দিবস উপলক্ষ্যে শিলিগুড়ি তরাই ব্লাডব্যাঙ্ক এর উদ্যোগে ভ্রাম্যমান রক্তদান শিবির অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে ডুয়ার্সের বিভিন্ন স্থানে। তাদের উদ্যোগে রক্তের বন্ধনে বাঁধা পড়েছে ডুয়ার্স। কোথায় একদিনের ফুটবল প্রতিযোগিতা। কোথাও মহিলাদের লুডো প্রতিযোগিতা, কোথাও ডুয়ার্স ভিত্তিক আলোচনা সভা, ভ্রাম্যমান ডুয়ার্স ভিত্তিক ক্যুইজ প্রতিযোগিতা। কেউ বা আয়োজন করছে লোকগানের আসর। আবার কিছু কিছু ক্লাবে শিশির ভেজা শৈত্য সন্ধ্যায় খিচুড়ি পিকনিক।  ‘ডুয়ার্সের নদী বন/ করবো মোরা সংরক্ষণ’ স্লোগান দিয়ে পদযাত্রা। যে যেমন পারে, যেমনটি চায়।

হ্যাঁ 'ডুয়ার্স ডে' ব্যক্তি বিশেষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নিয়ে ধরা দিয়েছে। ডুয়ার্স দিবস উদযাপন সমিতির সভাপতি হাজি মহম্মদ গুলজার বলেন- "পবিত্র ঈদ্ যেমন দীর্ঘ অনুশীলনের পর খুশির তোফা নিয়ে আসে, ঠিক সেভাবেই ডুয়ার্স দিবস আমাদের কাছে আসে।”
"হ্যাপি ক্রিসমাসের হিমেল মিষ্টি আমেজ নিয়ে আমরা সবাই মিলে আবার মাতবো আনন্দে। সান্তাক্লজ আমাদের ডুয়ার্সবাসীর জন্য ১৪ই জানুয়ারী অনেক শান্তি- সম্প্রীতি ও উন্নয়নের বার্তা নিয়ে আসবে" -এই কথাই জানান বিন্নাগুড়ি চা বাগিচার প্রিষ্ট সাইমান।

ডুয়ার্স হলো লোকসংস্কৃতির অন্যতম খনি। মেচ, রাভা, কোচ, সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, টোটো, ডুপপা আরো কতসব জনজাতির সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ এই ভুখন্ড। বর্তমানে বলিউড কালচারের প্রভাবে হারাতে বসেছে সেই পুরোনো ঐতিহ্য। অনেকের আশা 'ডুয়ার্স ডে'-তে লোক সংস্কৃতির পুনর্জীবন ঘটবে। প্রাণের আবেগে গাইবো সবাই মিলিত ঐকতানে। লোকসংস্কৃতি চর্চার ওপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে এই উৎসবের আয়োজকেরা। তারা মনে করেন সুর-তাল-ছন্দের কোন জাতপাত ধর্ম-বর্ণ নেই, এটা সর্বত্রগামী।
উদ্যোক্তারা জানান- স্বাধীনতার পরবর্তীকালে এই এলাকায় তেমন কোন শিল্প গড়ে ওঠেনি। ইংরেজ জমানার ‘চা শিল্প’ এখন বিভিন্ন কারণে বহু অসুবিধার সম্মুখীন। অতীতে ভারত, পূর্ব পাকিস্তান ও নেপালের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাজের সুত্রে মানুষেরা ডুয়ার্সে এসেছে। আজ জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ভীন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে এই এলাকার যুবক-যুবতী। সকলকে সম্মিলিতভাবে এলাকার উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে হবে, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য গড়ে তুলতে হবে কর্মসংস্থান। এখানে ঘৃণ্য রাজনীতির কোন স্থান নেই। 'ডুয়ার্স ডে' তে আমরা সেটাই ভাববো।

রবীন্দ্রনাথ নিজে চেয়েছিলেন উৎসব সব সময় ধর্মীয় বেড়াজাল ভেঙ্গে হয়ে উঠুক প্রকৃতিকেন্দ্রিক- সার্বজনীন। তাই তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতনে ঘটা করে সরস্বতী পুজো করেন নি। প্রচলন করেছিলেন বসন্ত উৎসব, পৌষ মেলা, হলকর্ষণ আরো কত কিছু। 'ডুয়ার্স ডে' উদযাপনের ভাবনা মাথায় আসার পেছনে যে রাবীন্দ্রিক প্রভাব রয়েছে সে কথা মুক্তচিত্তে স্বীকার করলেন উদ্যোক্তারা।

উদ্যোগটি ব্যতিক্রমী; তাই হয়তো একটু সময় লাগবে জনমানসে আরো ব্যাপকতা পেতে। তবে ইতিমধ্যেই সদিচ্ছা ছাড়িয়েছে দেশের সীমানা। মাটির আবেগ ছাপিয়ে গিয়েছে সীমান্তের কাঁটাতার। বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস-এর ফিরোজ খান, ভার্জিনিয়ার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুব্রত গুহ, নিউইয়ার্কের জন. এফ কেনেডি ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্টের আধিকারিক কল্যাণ দেবনাথ রীতিমতো উচ্ছসিত। নিউজিল্যান্ড ওয়েলিংটনের তাপস কুমার ভাদুড়ী নিজে থেকেই প্রয়াসের সাফল্য কামনা করে প্রচার শুরু করেছেন। ডুয়ার্স ডে-র গেষ্টবুকে মতামত ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন অনেকেই।

নবীন আবেগ ঢেউ তুলেছে মনের বিলে। 'ডুয়ার্স ডে' নিয়ে অনেক গান- ছড়া- গাথা লেখা হয়েছে। স্বনামধন্য কবি ডঃ অমিত কুমার দে লিখেছেন ডুয়ার্স ডে-র থিম সং - " ডুয়ার্স দিনে শপথ নিলে আর হবে না বাতাস ভারী / ভালোবাসার বীজ বুনে দাও চোদ্দ তারিখ জানুয়ারী। " কবি গৌতমেন্দু রায়, কাজিমান গোলে, রামকুমার রানা ও আরো অনেকে বিভিন্নভাষায় কথা- সুরের জাল বুনছেন- 'সকল দ্বন্দ্ব -ভেদাভেদ ভুলে/ আমরা মিলতে পারি- / সাক্ষী রইবে ডুয়ার্স দিবসে / ১৪ই জানুয়ারী।' 'ভেদাভেদ ভুলি ১৪ই জানুয়ারী গামু এক সুরে গান/ ডুয়ার্স হামার, ডুয়ার্স তোমার, ডুয়ার্স সগারে প্রাণ।' 'দুচোখ জোড়া শ্যামল সাগর/ ঐ বুনো গন্ধে/ চা-বাগিচার এই গালিচায়/ মাতবো আনন্দে।' আরো কত কী..। প্রাসঙ্গিক ছবি আঁকার কাজে তুলি ধরেছেন চিত্রশিল্পী বাবলু মাহালী।


ডুয়ার্স এলাকার সমাজ জীবন সভ্যতা নিয়ে বহু মানুষের বিভিন্নরকম অজ্ঞতা রয়েছে। আসলে এই প্রান্তিক এলাকার বিভিন্ন বিষয় নাগরিক আলাপ আলোচনা গণমাধ্যমে উঠে আসেনা। যেমন- এই অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন স্কুল-ক্লাবে প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা হয়। সেখানে প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ কবে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন? পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত? উড়াল হ্রদ কোন দেশে অবস্থিত? এমন নানাবিধ। কিন্তু তারা জানে না কত সালে সিঞ্চুলা চুক্তি হয়েছিল। জানে না ব্রিটিশের অধিকারে আসার আগে ডুয়ার্স এলাকা কার দখলে ছিল? চা- গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম কী? পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ডুয়ার্সের কোন কেন্দ্র থেকে বিধানসভায় জিতেছিলেন? এইসব বিভিন্ন বিষয়ে ডুয়ার্সে বসবাসকারী মানুষ ও ডুয়ার্সে ঘুরতে আসা ট্যুরিস্টদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ডাঃ পার্থপ্রতিম ও সুকল্যাণ ভট্টাচার্য ডুয়ার্স নিয়ে একটি বই সংকলিত করেছেন। এই পুস্তিকা ডুয়ার্সের প্রকৃতি, ডুয়ার্সের নদনদী, ডুয়ার্সের বন্যপ্রাণী আরো বহু কিছু জানিয়ে দেয়। তাদের এই প্রয়াস ইতিমধ্যেই ডুয়ার্স এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।

দীর্ঘ এক যুগ আগে ডুয়ার্স দিবস উদযাপন শুরু হয়েছিল। তারপর বহু জল গড়িয়ে গেছে তিস্তা-তোর্ষার নদীখাতে। তথ্যপ্রযুক্তিও এগিয়েছে ভীমবেগে। সেই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সমাজমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুয়ার্স দিবস নিয়ে চলে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় আলোচনা। ফেসবুক লাইভ, জুম মিটিং, ইউটিউব ক্যাম্পেইন এখন ডুয়ার্স দিবস উদযাপন সমিতির হাতিয়ার। ‘ডুয়ার্সে হোমস্টে পর্যটন; বর্তমান ও ভবিষ্যত’ নিয়ে আলোচনায় বসেছে ওসান লেপচা, “ডুয়ার্সের চা ও চা-পর্যটন নিয়ে আলোচনা করেছেন শিক্ষক গৌতম চক্রবর্তী, ‘মেচ-বোড়োদের ভাষা- সাহিত্যচর্চা’ বিষয়ে আলোচনায় বসেছেন সমাজকর্মী বিনয় নার্জিনারী। “ডুয়ার্সের পর্যটন; সেকাল–একাল” নিয়ে আলোচনা করেছেন পর্যটন গান্ধী রাজ বাসু। “ডুয়ার্সের রাজবংশী সাহিত্যচর্চা” নিয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক দীপক কুমার রায়। “ডুয়ার্সের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র চা-শিল্প” নিয়ে আলোকপাত করেছেন সিস্টা-র সভাপতি বিজয় গোপাল চক্রবর্তী। এধরনের আরও প্রয়াস হয়েই চলেছে।

কে কাকে প্রথমে আঘাত করেছিল, সেই হিসেব- নিকেশ বা আলোচনায় যেতে রাজি নন 'ডুয়ার্স ডে'-র আয়োজকেরা। তারা বর্তমান পরিস্থিতিকে সামনে রেখে ভবিষ্যতের দিকেই পা-বাড়াতে চান। কার ব্যর্থতায় বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে? সেই রাজনৈতিক কুটকাচালিতেও তারা নেই। নজর তাদের নব প্রভাতের পানে। সংকল্পের কাঠিন্য তাদের চোখে-মুখে- আঁধারের বুক চিরে উজ্জ্বল সকাল তুলে আনতে তারা বদ্ধ পরিকর। যে সকালে নবপ্রজন্মের জন্য থাকবে শান্তি- প্রগতি আর সতেজ নিশ্বাসের আশ্বাস।

অধ্যাপক দীপক কুমার রায়; উপাচার্য; রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়- ডাঃ পার্থপ্রতিম হিমালয় সংলগ্ন ডুয়ার্সের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে দীর্ঘদিন ধরে যে কাজটি করে যাচ্ছেন তা আমাদের সকলের কাছেই পাথেয়। ‘ডুয়ার্স দিবস’ পালন, প্রান্তিক মানুষদেরকে সংগঠিত করা এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করার কাজে তিনি অদ্বিতীয়। ডুয়ার্স যেভাবে নানা ভাষা ও জনগোষ্ঠীর দরজা খুলে দেয়, মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে; ঠিক তেমনই সেই পথের অতন্দ্র প্রহরী ডাঃ পার্থপ্রতিমবাবু। তার দীর্ঘ কর্মজীবন কামনা করি।

সৈয়দ নজরুল হক; গীতিকার, লোক শিল্পী ও সাংস্কৃতিককর্মী- ডাঃ পার্থপ্রতিম আমার কাছে উত্তরবঙ্গের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। নানারকম প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বহুকাল যাবৎ নানাবিধ সামাজিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তার উদ্যোগে ডুয়ার্সের জনমানসের সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ অটুট রাখার লক্ষ্যে আমিও ওনার অনুপ্রেরণায় ডুয়ার্স দিবস নিয়ে গান বেঁধেছি। যে গান চিত্রায়িত হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছেছে। উত্তরবঙ্গের সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে পার্থপ্রতিম স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

সুদূরের পিয়াসী . . .

সুদূরের পিয়াসী এই মানুষটির দূর আকাশের প্রতি তার অদম্য টান। কোলকাতায় থাকাকালীন তিনি বহুবার স্কাইওয়াচার্স অ্যাসোশিয়েশনের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন। কোলকাতায় যে সব বিজ্ঞানীরা মহাকাশ নিয়ে গবেষণা চালাতেন সেই সব প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের সাথে তার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

কোলকাতার বিড়লা তারামন্ডলের বিজ্ঞানী রমাতোষ সরকার, পজিশান্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সেন্টারের অধিকর্তা ডঃ অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আরও অনেকের সাথে তার হৃদ্যতা হয়। আকাশ চেনার ব্যাপারে তাকে সবচেয়ে বেশি গাইড করেন কনফেডারেশন অফ অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আশীষ মুখোপাধ্যায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানোর এই নৌ-প্রযুক্তিবিদ এক ভিন্ন স্বাদের মানুষ। তার বাড়িতেই শুরু হয়েছিল কোলকাতার স্কাইওয়াচার্স অ্যাসোশিয়েশন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন বিভিন্ন মাপের দূরবীন ও বাইনোকুলার। কোলকাতা ফুলবাগানের বাড়ির ছাদে তিনি গড়ে তুলেছিলেন স্কাই অবজারভেটারি স্টেশন। পার্থপ্রতিমের সাথে আশীষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্কটা শেষমেষ গুরু শিষ্যের মতো দাঁড়ায়। আশীষ মুখোপাধ্যায় পার্থপ্রতিমের ডাকে তিন দশক আগে ডুয়ার্সের বানারহাটে ছুটে আসেন। বানারহাটের এক স্থানীয় ক্লাবে আকাশ চেনার আসর করেন। তারপরও আরো কয়েকবার আশীষ মুখোপাধ্যায় এসেছেন পার্থপ্রতিমের মধুবনে।

নব্বই দশকের শেষদিকে পার্থপ্রতিম দূরবীন কেনার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়েন। সে সময় ভালো মানের দূরবীনের দামও ছিল অনেক বেশি। তবুও তিনি চাইছিলেন ডুয়ার্সের পিছিয়ে পড়া আদিবাসী মানুষেরা দূরবীনে চোখ রাখার একটু সুযোগ পাক। পার্থবাবু চিরকালই এ ধরনের কাজে দ্বারে দ্বারে চাঁদা তুলতে আগ্রহী নন। তার ভাবনা কোনো মানুষের কাছ থেকে হঠাৎ করে চাঁদা বা সাহায্য নেওয়ার আগে মানুষকে সঠিকভাবে বিষয়টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বুঝিয়ে আত্মস্থ করাতে হবে। তা না করে হুটহাট চাঁদা তোলা রাজনৈতিক দলের তোলাবাজির মতো হয়ে দাঁড়ায়।

তার এই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে শেষমেষ এগিয়ে আসেন ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোশিয়েশন এর তৎকালীন সচিব সমরেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জি। তিনি সে সময় ৬ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য তুলে দেন ডি.বি.আই.টি.এ -এর পক্ষ থেকে। তার সাথে ব্যক্তিগত টাকা মিলিয়ে তিনি রওনা দেন কোলকাতায়। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন- গ্যালিলিয়ান নয়, তিনি নিউটোনিয়ান দূরবীন-ই কিনবেন।

গ্যালিলিয়ান দূরবীন চলে আলোক প্রতিসরণ বা রিফ্রেকশন সূত্র মেনে। আবিষ্কারক গ্যালিলিও গ্যালিলির নাম অনুসারে দূরবীণের এই নামকরণ। স্যার আইজ্যাক নিউটনের তৈরী দূরবীন আলোর প্রতিফলন বা রিফ্লেকশন সূত্রকে কাজে লাগানো হয়। নিউটোনিয়ান দূরবীন কোনো জায়গায় বসাতে বেশ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। তবে দূরবীনের বিবর্ধন ক্ষমতা বা ম্যাগনিফিকেশন পাওয়ার-এর তুল্যমূল্য বিচার করলে নিউটোনিয়ান দূরবীনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম দামে বেশি পাওয়ার-এর দূরবীন পাওয়া যায়।

দূরবীনের ক্ষেত্রে দু’ধরনের মাউন্ট বা স্ট্যান্ড প্রচলিত আছে। অর্থাৎ দূরবীনটি যে স্ট্যান্ডের ওপর বসানো হয় সেটা দু’রকম- ১). আল্টাজিমুথ মাউন্ট,  ২). ইকোয়েটোরিয়াল মাউন্ট। আল্টাজিমুথ মাউন্ট সাধারণ বিষয়- যে ভাবে লক্ষ্যবস্তুর দিকে বন্দুক তাক করি সেরকম।  আর ইকোয়েটোরিয়াল মানে হচ্ছে নিরক্ষীয়ভাবে দূরবীনটি অবস্থানে রাখা। অর্থাৎ আমাদের রাতের আকাশ যে তালে বা কৌণিকভাবে চলে আমাদের দূরবীনটাও এই ইকোয়েটোরিয়াল মাউন্টে বসালে একই তালে চলবে। অনেকক্ষেত্রে, আকাশের তালে তালে দূরবীনটিকে সরানোর জন্য যান্ত্রিক প্যাডেল বা ইলেকট্রিক্যাল মোটরের ব্যবস্থা থাকে। এতে কী হবে, ধরুন কোনো গ্রহ বা তারা আপনি দেখবেন বা ছবি তুলবেন বলে ঠিক করেছেন। আলোর পরিমাণ কম বলে এই ছবিগুলি অনেকক্ষণ ধরে তোলা হয়। এই সময়টার মধ্যে তারাটাও সরে যাবে। ইকোয়েটোরিয়াল মাউন্টের ক্ষেত্রে যেটা হয়, যে কৌণিক বেগে তারাটি সরছে ঠিক একই কৌণিক বেগে দূরবীনটি সরতে থাকবে। তার ফলে আপনি যখনই দূরবীনে চোখ রাখবেন সে সময়ে গ্রহ বা তারাকে স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারবেন।

অনেক ভাবনা চিন্তা করে ইকোয়েটোরিয়াল মাউন্ট দিয়ে একটি বড়সড় ব্যাসের পছন্দসই নিউটোনিয়ান দূরবীন তিনি কিনলেন। সবকিছু গুছিয়ে ঠিকঠাক করে সুন্দরভাবে প্যাকিং করে দোকানের পয়সা মিটিয়ে দেখলেন;  তার পকেট প্রায় খালি। তিরিশ বছর আগে  তখন আর নেট ব্যাঙ্কিং, ফোন-পে, গুগল-পে এসব ছিল না। তিনি ও তার এক সাথী কাঁধে সেই দূরবীন নিয়ে রওনা দিলেন শিয়ালদহ স্টেশনে। ট্রেনে রিজার্ভেশনও নেই। হয়তো জেনারেল কামরাতেই তাদের ফিরতে হবে। তাই হাতে কয়েকঘন্টা সময় নিয়ে স্টেশনে হাজির। 

দূরবীনের বিদঘুটে চোঙ দেখে এক আর.পি.এফ -কনস্টেবলের কেমন যেন সন্দেহ হল। আসলে দূরবীন বলতে সাধারণ মানুষ গ্যালিলিয়ান টেলিস্কোপই দেখে থাকে। নিউটোনিয়ান টেলিস্কোপগুলি আকার আয়তনে প্রচলিত দূরবীনের চেয়ে একেবারেই অন্যরকম। তাছাড়া ইকোয়েটোরিয়াল মাউন্ট টেলিস্কোপগুলির লটবহরও আলাদা ধরনের।

কনস্টেবলের সন্দেহ হওয়ায় তিনি তাকে নিয়ে গেলেন স্টেশনের আর.পি.এফ ব্যারাক অফিসে। এক সুরক্ষাকর্মী তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বললেন- এটি একটা ছোটো কামান, কাঁধে নিয়ে গোলা ছোঁড়া যায়। মর্টারসেল না, কি একটা নাম। ইংরেজি সিনেমাতেও তিনি এটা দেখেছেন। অবাঙালি  আর.পি.এফ অফিসার তাকে বারবার চাপ দিতে থাকেন চালাকি না করে; প্রকৃত সত্য কথা বলার জন্য। সাথে দূরবীন কেনাকাটার কাগজপত্র থাকলেও; সে আর তখন কে বোঝে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন কানাঘোঁসা শোনা যাচ্ছে। কয়েকজন বন্দুকধারী এসে তাদের জামাকাপড়, তাদের দেহ তল্লাশী করা শুরু করে দেয়, তারপর ব্যাগপত্র তল্লাশি করে। ইতিমধ্যে কে বা কারা; মুখে মুখে প্রচার করে দিল শিয়ালদহ ৮ নং প্ল্যাটফর্মে দুজন উগ্রপন্থী ধরা পড়েছে। আর.ডি.এক্স আর মর্টারসেল নিয়ে অসমে যাচ্ছিলো, আর পি. এফ. হাতে নাতে ধরে ফেলেছে। অফিস ফেরতাবাবু- ‘ফর্সা ছোট ছেলেটা মনে হলো পড়াশুনা জানে। চাঁদ, তারা, গ্রহ নিয়ে অফিসারকে কী সব বলছিল। বাংলা, হিন্দি, ইংরাজি বেশ ভালো বলে; তবে মালটা অসমীয়া।’ পাস থেকে আর এক বিশেষজ্ঞের মন্তব্য- ‘বড় বড় টেররিস্টরা শিক্ষিত হয়।’ কৌতূহলী মানুষের উঁকি-ঝুঁকি বাড়তে থাকল গরাদের ভেতর দিকে। দুর আকাশের নক্ষত্র- নীহারিকাকে টেনে এনে গ্রামের গরীব-গুব্বো মানুষগুলিকে দেখানো যাদের ব্রত; তারা নিজেরাই এখন দর্শনীয় বস্তু হয়ে উঠলো।

শেষমেষ এক পরিচিত মানুষের চোখে ধরা পড়ে গেল বিষয়টি। ডাক্তারবাবু এখানে কেন ! ? এগিয়ে এলেন আর্মি মেজর। বিন্নাগুড়ি মিলিটারী ক্যান্টনমেন্টে তার পোষ্টিং। এক অতিথিকে সি-অফ করতে  স্টেশনে এসেছেন। তাকে বিষয়টি বলতে তিনি নিজে গিয়ে শিয়ালদহের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন সুপারিনটেনডেন্টকে ডেকে আনেন। সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব বিষয়টি বুঝে সব কাগজপত্র ও যন্ত্রপাতি দেখে সেখানেই মুক্তি দিলেন। মেজরের সুপারিশে দূরবীন কাঁধে উঠে পড়লেন খোলামেলা আর্মি-কম্পার্টমেন্টে। লাইন ধারে মাথাতোলা লাল সিগন্যাল বাতিটি সবুজ হয়ে গেল। একগাল হেসে স্বস্তির শ্বাস ফেললো এক স্বপ্নচাষা মন। উত্তরে পাড়ি দিল ডুয়ার্সের সর্বপ্রথম নিউটোনিয়ান দূরবীন ।

আশীষ মুখোপাধ্যায়; নৌ-প্রযুক্তিবিদ ও অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমার - পার্থ আমার ভাই নয়, আমার শিষ্য। প্রচলিত ভাষায় ‘চ্যালা’ বলা চলে। প্রায় ৩৫ বছর থেকে ওর সাথে পরিচয়। ও আমার বাড়িতে বহুবার এসেছে।  আমিও গিয়েছি সপরিবারে কয়েকবার। পার্থ আমার বাড়ির লোক। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ওর অনুসন্ধিৎসা রয়েছে সেই তরুণবেলা থেকেই। সেই কবে ভন্ড জ্যোতিষীদের বুজরুকির বিরুদ্ধে শিয়ালদা স্টেশন চত্বরে ল্যাম্প পোস্টে মাইক বেঁধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিত। পাশেই বি.বি.গাঙ্গুলী স্ট্রীট। যেখানে ছিল জ্যোতিষীদের অন্যতম আখড়া।
ডুয়ার্স এলাকায় ও-ই প্রথম দূরবীন ও আকাশ চেনার উপকরণ নিয়ে যায়। যেগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল বাড়িয়েছে। অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানার ওর অদম্য ইচ্ছা আজও নিত্য বহমান।


চন্দন দাশগুপ্ত; অবসর প্রাপ্ত- অ্যাডিশন্যাল লেবার কমিশনার; প. ব. সরকার-  দ্য ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভ্যল অফ সায়েন্স-এ বিজ্ঞান সাংবাদিকতার  পাঠ নিতে গিয়ে পার্থপ্রতিমের সাথে প্রথম পরিচয়। তারপর আমরা পরস্পর সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে উঠি। আমি যখন কলকাতায় ছিলাম সে সময় আমাদের মিত্রতা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে সে ডুয়ার্সে ফিরে আসে। আমিও ডাব্লুবিসিএস করে সরকারি আধিকারিকের দায়িত্ব নিয়ে উত্তরবঙ্গে চলে আসি। মধুবনে আমার বহু রাত কেটেছে। ভাই পার্থ আমার স্ত্রী তন্দ্রার খুব ভালো বন্ধু। ও দূরবীণ দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দূরের আকাশকে টেনে আনে। পার্থ যে কত রকমের কাজ একসাথে করে সেটা আমাদের দুজনের কাছেই বিস্ময়। পার্থ আরো বহুকাল সুস্থ, সবল, কর্মঠ থাকবে। ওকে থাকতেই হবে।

অঙ্কন ও প্রচ্ছদ

ছবির প্রতি তার আকর্ষণ তো বরাবরই। কোলকাতা থাকাকালীন গভঃ কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট-এর একদল সিনিয়র ছাত্রছাত্রীর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। তাদের সান্নিধ্যে ইউরোপের চিত্রকলার পাঠ নিতে শুরু করেন। অষ্টাদশ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর চিত্রকলার যে বিবর্তনের ধারা তা নিয়ে পড়াশুনা করতে থাকেন। ইমপ্রেশনিজম, পোস্ট-ইমপ্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, দাদাইজম, ফিউচারিজম, সুপ্র্যামান্টিজম, সুররিয়ালিজম প্রভৃতি চিত্রধারা ও ঘরানার বিষয়গুলি বুঝতে চেষ্টা করেন। শিল্পী এডওয়ার্ড মুঙ্খ (EDWARD MUNKH)-এর আঁকা এক্সপ্রেশনিজম ধারার ছবি ‘দ্য স্ক্রীম’ বা ‘চিৎকার’, পাবলো পিকাসোর আঁকা মৃত্যু ও ধ্বংসের ভয়াবহতা তুলে ধরার চিত্র ‘গ্যের্নিকা’, সালভাদোর দালির সুররিয়ালিজম ধারার ছবি ‘পারসিসটেন্স অফ মেমোরি (PERSISTANCE OF MEMORY)’ এমনই আরো বহু মাস্টারপিস নিয়ে তিনি ভাবেন। এর পাশাপাশি যামিনী রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন মজুমদার, বাসুদেও এস গাইতোন্ডের, ফ্রান্সিস নিউটন সুজা, এম.এফ. হুসেন এদের ছবিও তিনি অধ্যয়ন করেন। মনোযোগ সহকারে দেখেন সুদীপ রায়, আমান সিং গুলাতি, রাজা রবি বর্মা, রামকিঙ্কর বেইজ, তায়েব মেহতার, অমৃতা শের-গিল এর ছবি।  সাম্প্রতিককালে যারা বিশ্ববাজারে তাদের আঁকা ছবি বিক্রি করছেন- সুবোধ গুপ্ত, অতুল দোদিয়া, দেবজ্যোতি রায়, বোস কৃষ্ণমাচারী, জিতিশ কাল্লাট তাদের ছবি সম্বন্ধেও পার্থপ্রতিম ওয়াকিবহাল।

ফটোশপ ও কোরেল ড্র নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তার স্বরচিত অনুকবিতার সাথে মানানসই ছবি যোগ করে তিনি “ছবিতা” তৈরী করেন। এর পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকায় অঙ্কন ও প্রচ্ছদ তৈরীর কাজও করেছেন। বানারহাট সার্বজনীন দুর্গাপূজা ডুয়ার্স এলাকার অন্যতম প্রাচীন পূজোগুলির একটি। এই পূজো উপলক্ষ্যে ১৫দিন ব্যাপী মেলা বসে বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ জুড়ে। বানারহাট সার্বজনীন দুর্গাপূজার ৭৫ বছর উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ স্মরণিকা। এই স্মরণিকার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন ডাঃ পার্থপ্রতিম ও বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকল্যাণ ভট্টাচার্য। ‘অরুণ আলোর অঞ্জলী’- নামের এই বিশেষ স্মরণিকার জন্য কলম ধরেছেন উত্তরবঙ্গের স্বনামধন্য বহু ব্যক্তি। অধ্যাপক ডঃ আনন্দ গোপাল ঘোষ, উত্তরের বামপন্থী আন্দোলনের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব অশোক ভট্টাচার্য, মানিক সান্যালের পাশাপাশি বিধায়ক দেবপ্রসাদ রায়, চা-শিল্প বিশেষজ্ঞ রাম অবতার শর্মা, উমেশ শর্মা আরো অনেকে। ‘অরুণ আলোর অঞ্জলি’ -র প্রচ্ছদ শিল্পী ডাঃ পার্থপ্রতিম। চা বাগিচার এক খেটে খাওয়া সন্তানব্রতী মা-কে তিনি রূপ দিয়েছেন মা দুর্গার।


স্কুলগামী গ্রাম্য কিশোরী তার ডিজিটাল তুলিতে মূ্র্ত হয়েছে মা দুর্গার নব সংস্করণে। প্রবাহতিস্তা তোরষা পত্রিকার ২০১৯ সালের শারদীয় সংখ্যাটি আত্মপ্রকাশ করেছে তার তৈরী প্রচ্ছদে।  তার লেখার সাথে সাথে, তার এই কী বোর্ড আর মাউসের খেলা সমালোচিত হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। আসলে, ডাঃ পার্থপ্রতিম যখনই যেটা মনে করেছেন শিল্পের সেই অলিন্দে সহজেই সাবলীলভাবে ঢুকে গিয়েছেন। সুবাসিত করেছেন শিল্পপ্রেমিক মনের সৌরভ। ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের সহযোগিতায় কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ‘বিজ্ঞানমেলা’ পত্রিকাটি। এই পত্রিকাতে তিনি আলংকারিকের কাজও করেছেন। স্থানীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট ও প্রচার ফ্লেক্সে তারই ভাবনার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে।
তার রচিত পুস্তকগুলির সিংহভাগ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ তারই করা। স্থানীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট ও প্রচার ফ্লেক্সে তারই ভাবনার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে।
পার্থপ্রতিম বিভিন্ন সংস্থার বা উৎসবের লোগো তৈরী করে দিয়েছেন। তার তৈরী লোগো বিভিন্ন জায়গায় সাধুবাদ পেয়েছে। ‘ডুয়ার্স দিবস’, ‘রক্তের বন্ধনে ডুয়ার্স’, ‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি’, ‘ডুয়ার্সের দুর্গোৎসব’- এসব বিভিন্ন লোগো তার তৈরী করা।

ডঃ কৃষ্ণ দেব; অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও সংগ্রাহক - ডাঃ পার্থপ্রতিম উত্তরবাংলার এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। ডুয়ার্সের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক তিনি। পেশায় চিকিৎসক হলেও নেশায় তিনি মানবপ্রেমী। তিনি বিভিন্ন রকম কাজ একসাথে করেন। বিজ্ঞান বিষয়ক বহু প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছেন। আমার পত্রিকা ‘প্রবাহ তিস্তা তোর্ষা’ -তে তার স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ক বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকায় শারদীয়া সংখ্যা তার আঁকা প্রচ্ছদে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমার গড়ে তোলা ‘যামিনী ‍কুমার সংগ্রহালয়’-এ তিনি বহুবার এসেছেন।  
ডুয়ার্সের বিভিন্ন ভাষাভাষী ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সংহতি, মৈত্রী ও প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখতে ডাঃ পার্থপ্রতিম একজন অক্লান্ত যোদ্ধার  ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ডাঃ পার্থপ্রতিম এভাবেই সক্রিয় থাকুন মানুষের মাঝে, প্রকৃতির মাঝে।

প্রসেনজিৎ ভৌমিক; চিত্রশিল্পী - ছবি ও চিত্র সম্বন্ধে মামার ধারণা বেশ স্বচ্ছ। আসলে মামা বহু দিকপাল শিল্পীদের চিত্রকলা গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। বহু চিত্রকলার ধারা বা ঘরানা তার জানা থাকার কারণে, তার তৈরী করা ডিজিটাল পোট্রেট বা ল্যান্ডস্কেপগুলি ভিন্ন মাত্রা পায়। মামার এই চিত্র ভাবনাগুলি আমাকে অনুপ্রাণিত করে।  মামার কয়েকটি ই-বুকে আমি অলংকরণের কাজ করেছি। যখন নীতিকথার গল্পকে চিত্রায়িত করে আমার মামা বাড়ি ‘মধুবন’ সাজিয়েছিল; সে সময় তার পাশে থেকে বহুকিছু শিখেছি।

আলোকচিত্রচর্চা

কিছু কিছু প্রতিভাবানদের মধ্যে দেখা যায় তারা কোনো একটি বিষয় নিয়ে সারাজীবন কাটান না। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে যান। পার্থপ্রতিমবাবুর কথায়- “আজ যখন ধরার বুকে মানব শিশু হিসাবে ধরা দিয়েছি, তখন কেন একটা বিষয় আঁকড়ে জিন্দেগি বিতানা ইয়ে উম্মিদ নেহি হ্যাঁয়। যতটা পারা যায় ভিন্ন ভিন্ন বিষয় শিখে নেওয়া”।

তিনি ফটোগ্রাফি নিয়ে চর্চা শুরু করলেন। ডুয়ার্স এলাকার অন্যতম প্রবীণ ফটোগ্রাফি শিল্পী ছিলেন জিতেন্দ্র নাথ ঘোষ। সবাই তাকে মাস্টারদা বলেই ডাকতেন। গয়েরকাটা বাজারে তার একটি স্টুডিও বা ফটোগ্রাফি সামগ্রীর দোকান ছিল। ডুয়ার্স এলাকার বহু ফটোগ্রাফারের হাতেখড়ি তাঁর কাছেই। পার্থবাবু নাড়া বাঁধলেন মাস্টারদার কাছে। সেটা ফিল্ম ক্যামেরার যুগ। ইয়াসিকা এম.এফ ২ সুপার ডি.এক্স. দিয়ে তার পথ চলা শুরু। টি.এল.আর থেকে এস.এল.আর - এইভাবে চলতে লাগল। মাস্টারদা খুব নিষ্ঠার সাথে শেখাতে লাগলেন। অ্যাপারচার, সাটার্স স্পিড, ফিল্ম স্পিড, পার্সপেকটিভ, কম্পোজিশন এইসব নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চলত গুরু শিষ্যের আলোচনা আর চর্চা।

ফটোগ্রাফিক বিষয়ে তার এই জ্ঞান পরবর্তীকালে কাজে লেগেছে- থাম্বনেইল তৈরী, পোস্টার তৈরী, পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড তৈরীতে। কালের নিয়ম মেনে মাস্টারদা এখন আর এই ধরার মাঝে নেই, তবে পার্থপ্রতিমের মনের মণিকোঠায় তিনি আজও বিরাজমান।

অনিরুদ্ধ ঘোষ (বিজু)- আমরা তখন ছোটো। পার্থদাকে দেখতাম একটি এম-৮০ মফেড চেপে বাবার কাছে আসতেন। বাবার সাথে ফটোগ্রাফি, ক্যামেরা এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলত। তিনি কাগজ কলমে বিভিন্ন বিষয়ে লিপিবদ্ধ করতেন। একেবারে অনুগত ছাত্রের মতোন। পার্থদা সেই সময় উত্তরবঙ্গ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। বাবাকে নিয়েও একটি ফিচার লিখেছিলেন। পার্থদা আজ নানাবিধ কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত। এখন বুঝতে পারি, গুরু শিষ্যের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা নতুন সৃজনশীল ধারা সৃষ্টি করে। পার্থদা জাতীয়স্তরেও পুরস্কৃত হয়েছেন। তবুও তার সেই নির্লোভ, রসিক, নিরহংকারী স্বভাব আজও অমলিন।

তবুও দুজনে

বৈশাখে না ফাগুনে ? প্রথম দেখা হয়েছিল দুজনে ? -সে সালতামামি আজ মনে নেই। বেশ রোমাঞ্চ ভরা জীবনের সেই অলিগলি। মিঞা তখন কলকাতার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ- নিবন্ধ লিখে চলেছেন, কুসংস্কারমুক্ত, সমাজসচেতন দেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভোর। আর হবু বিবি কোলকাতার লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজের চুড়ান্ত বর্ষের ছাত্রী। দুজনেই আকাশবাণী কোলকাতাতে অনুষ্ঠান করেন। একজনের বিষয় বিজ্ঞান, প্রকৃতি, পরিবেশ সংরক্ষণ। আরেকজনের ভাষা শিক্ষার আসর। দেখা থেকে পরিচয়, পরিচয় থেকে প্রেম। যেমন করে জীবন গড়ায় ইতিমধ্যেও অনুচ্চারিত ভাষায় একজন বলছে- ‘তুমি আমার সকালবেলার ফুল।’ আরেকজন- ‘তোমারি সঙ্গে বেঁধেছি আমারি তান . . .’। তারপর নলবনের নৌকা বোটিং, পার্কে বসে বাদাম খাওয়া, অনাগত দিনগুলি নিয়ে স্বপ্নমেদুর আলাপচারিতা আর ঘাসের ডগা চেবানো। বঙ্গ সিনেমার প্রেম যেমন হয়। যা আছে তা পারস্পরিক জীবনদর্শনের আদান-প্রদান। ইতিমধ্যে পার্থপ্রতিম পাকাপাকি ভাবে কলকাতা থেকে চলে আসেন নিজের মাতৃভূমি ডুয়ার্সে। তারপর শুরু হয় অন্য সংগ্রাম।

ডুয়ার্সে বসে শুধু সাংবাদিকতা করে সৎভাবে জীবন চালানো খুব মুশকিল। তাই পার্থপ্রতিম শুরু করলেন ডাক্তারী চর্চা। এদিকে দুজনে পার্থপ্রতিম ও সুকন্যা ঠিক করে ফেলেছেন তারা দুজনে অনাগত দিনগুলিতে জীবনতরী সহযাত্রী হবেন। আজ ইঞ্জিনিয়ার, কাল সাংবাদিক, পরশু চিকিৎসক এমন ছন্নছাড়া, আধপাগলা ছেলের সাথে স্বাভাবিক ভাবে মেয়ে দিতে রাজী হলেন না কন্যাপক্ষ। চলল অন্য টানাপোড়োন। এদিকে পাত্র-পাত্রী নিজেরা ঠিক করে নিয়েছে তাদের যুগল প্রয়াসেই অনাগত দিনগুলি কাটবে। তারা আইনতভাবে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হল।

১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট; এই দিনটি মানব সভ্যতার এক কলঙ্কিত অধ্যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক অমানবিক প্রয়োগ। এশিয়ারই এক দ্বীপরাষ্ট্রে নেমে এল মৃত্যুর করাল ধাবা। তখনও সবাই সেভাবে দিন শুরু করেনি। আকাশ নীলিমায় মেশা মার্কিন বি- টুয়েন্টি নাইন বোমার বিমান ‘এনোলা গ্রে’। সেই রূপকথার আগুনমুখো ড্রাগনের মতো হিরোশিমার একটি হাসপাতালে নেমে এল বিশ্বের প্রথম আণবিক বোমা “লিটিল বয়”। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আণবিক বোমার বিষাক্ত ছোবলে মারা গেল ৮০ হাজার মানুষ। আহত হল প্রায় ৩৫ হাজার। যারা বেঁচে রইলেন তারাও তেজস্ক্রিয়তার বিষাক্ত ছোবলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আণবিক বোমা হামলার এত বছর পরেও শহরে জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু। ক্যানসারসহ দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে বহু মানুষ।
তাই, এক নারী এক নর শপথ নিল যুদ্ধবিরোধী মানবতার পক্ষে। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য এই দিনটিকেই বেছে নিলেন তারা। সে প্রয়াস আজও জারী। বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে কেক কাটা, হাসি হুল্লোড়, ফেসবুকে দাঁত ক্যালানো ছবি নেই।
তার জীবনতরীর সহযাত্রী সুকন্যা আচার্য সঙ্গীত অনুরাগী। অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত, ডি.এল.রায় এর গান গেয়েছেন বিভিন্ন মঞ্চে। প্রথমে রবীন্দ্রভারতীর পাখোয়াজের অধ্যাপক বিশ্বম্ভর দাস। পরবর্তীতে  নিশীথ সাধুর কাছে তালিম নিয়েছেন। লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজের প্রাক্তণী। কোলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বৌদ্ধ ভাষা সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত। গবেষণা ধর্মী বই লিখেছেন। শিরোনাম- ‘ বিষয়ঃ ধম্মপদ’। সংস্কৃত সাহিত্যে যেখানে গীতা; পালি সাহিত্যে ধম্মপদ সেই স্থানে। এই বইটির ভূমিকা লিখেছেন অধ্যাপক রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় আর কথামুখ লিখেছেন রবীন্দ্রভারতী বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ কানন বিহারী গোস্বামী। দু’টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর। বি.এড –এ প্রথম শ্রেণী।  UGC-NATIONAL ELIGIBILITY TEST উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও; কলেজ- ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার জন্য পা বাড়াননি। স্থানীয় সরকারী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসাবেই রয়ে গেছেন। সুকন্যার কথায়- ‘এই পাগলাকে একা ছেড়ে, কোথায় আর শান্তি পাবো।’

তাদের যৌথজীবন অনেকটা লিভ-টুগেদারের মতোন। দুজনেই যে যার কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। আসলে এই যে বিবাহ প্রথা বা যৌথভাবে জীবন কাটানোর বিষয়টি তেমন কোনো ঐশ্বরিক মহিমায় মহিমান্বিত নয়। ঘটনাচক্রে একজন নারী ও পুরুষ পরস্পরের কাছে এসে পড়ে। এর মধ্যে প্রজাপতি বন্ধন, ঈশ্বরের ইচ্ছা, গত জন্মের পাপ-পুণ্যের ফল এমন কোনো বিষয় নেই। এটা প্রচলিত সামাজিক চুক্তি। কাউকে একবার ভালো লাগলে, তাকেই যে সারাজীবনে একইভাবে ভালোবেসে যেতে হবে তেমন কোনো কথা নেই; থাকতেও পারে না। মিথ্যেভাবনায় সবকিছুকে জাপটে জড়িয়ে ধরার বিষয় হয়ে দাঁড়ালে, জীবনটা বিষময় হয়ে ওঠে। তাদের কথায়- স্বামী বা স্ত্রী সম্পত্তি নয়; এরা পরস্পরের সম্পদ। সম্পত্তি ব্যবহার করতে হয়; আর সম্পদ সংরক্ষণ করতে হয়। এই বোধগুলি ঠিক মতো গড়ে না ওঠার কারণে বর্তমানে ঘরে ঘরে দাম্পত্য কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ।
তারা কেউ কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে তেমন দখল আন্দাজি করে না। এমন কী কেউ কারো ফেসবুক ফ্রেন্ডও নয়। কার বন্ধু বা বান্ধবী কার পোষ্টে কী কমেন্টস করছে তা নিয়ে কারো আগ্রহ নেই। তবে প্রয়োজন হলেই পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করে। তারা বিশ্বাস করেন প্রতিটা মানুষের জীবনে খোলামেলা দিক থাকা দরকার; যেটা তার একান্ত আপন, একান্ত নিজস্ব। ব্যক্তিগত ভালোলাগা, মন্দলাগায় সবসময় দাম্পত্য সম্পর্কে বাধাপ্রাপ্ত হলে জীবনটা বিষময় হয়ে ওঠে। “যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং তব”। অর্থাৎ ‘আমার হৃদয় তোমার হোক, তোমার হৃদয় আমার হোক’ -এই বৈদিক শ্লোকে তাদের ঘোর আপত্তি। এটা ডাহা মিথ্যা। ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী। যাক এই হালকাভাবেই তারা জীবনের ৩০টি বছর কাটিয়ে দিল টক, ঝাল, মিষ্টি সবকিছু মিলিয়ে।

সুকন্যা আচার্য- আসলে পার্থপ্রতিমকে আমার ভালো লাগার অন্যতম কারণ সে ব্যতিক্রমী। তার ভাবনা, চিন্তা, কাজকর্ম অনেকটাই আলাদা। বেশিরভাগ মানুষই প্রচলিত পরিকাঠামোর মধ্যে ঢুকে মনের ডানা ছেঁটে সেটিং হয়ে যায়। চেহারায় ছোটোখাটো হলেও এই মানুষটি ভিড়ে হারিয়ে যায় না। সে যখন আজ থেকে দু-দশক আগে আমার বাড়ি মধুবনের উঠোনে বসন্ত বাসরের আয়োজন করেছিল। তখন এই এলাকার কারোর মাথাতেই এমন বিষয় যে হতে পারে, তা ভাবনাতেই ছিল না। আমাদের বহু প্রিয়জন বারবার পরামর্শ দিয়েছে এখানে ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে বড় বিল্ডিং তুলে ভাড়া দিলে অনেক আয় রোজগার হবে। পার্থপ্রতিম নিজের সিদ্ধান্তেই অবিচল।
সাধারণত কর্তার আয়- রোজগার বেশী হলে গৃহকর্ত্রীর গয়না তৈরী হয়, তিনি দামী শাড়ী পান। ঘটা করে বিবাহ বার্ষিকী বা ছেলের জন্মদিন পালন হয়। পার্থপ্রতিমের ট্যাঁকে পয়সা জমলে সেটা হয়ে যায় সামাজিক বিষয়। শনি- বৃহস্পতি আসলে কেমন ? গ্রামের যে মানুষটির  এ জীবনে দেখার কথাই নয়; পার্থপ্রতিমের অর্থ উপার্জন হলে সেই লোকটার চোখের সামনে ফুটে ওঠে শুক্র গ্রহের মেঘলা আকাশ বা বুধ-শুক্রে পরিক্রমণ। তিনি কেনেন বাইনোকুলার, বিজ্ঞানের মোটামোটা বই। আদিবাসী মেয়েদের গ্রাফিক্স ডিজাইন শেখানোর জন্য তিনি কিনে ফেলেন আরো ভালো কনফিগারেশনের ডেস্কটপ।
যে জায়গা থেকে পার্থপ্রতিম যে ধরনের কাজ ও ভাবনা-চিন্তা করে, মহানগরীর অনেকের মাথাতেই তা আসবে না। অর্থের প্রতি নির্মোহ এবং তার যে ভাবনা- ‘ব্যয় বুঝে আয় করা’ সেটা আমার খুব মজাদার বলে মনে হয়েছে।

♦  ♦  ♦

 

♦  ♦  ♦

অঞ্জু আচার্য- আমার জামাইকে আমার গ্রামের সবাই চেনে। বিয়ের পর পরই আমাদের মূল বাসভূমি পূর্ব মেদিনীপুরের কালিন্দী গ্রামে পার্থপ্রতিম তার লটবহর নিয়ে হাজির। পর্দা টাঙিয়ে প্রোজেক্টর দিয়ে অডিও ভিস্যুয়াল শো দেখায়। গ্রামের ছেলে-মেয়েদের কাছে সেটা তখন খুবই নতুন ব্যাপার ছিল। মহিলারাও এভাবে আকাশ চেনার সুযোগ কোনো দিন পায়নি। গ্রামের কচি-কাঁচা, দিদি, বৌদি, কাকা, জেঠা সবাই ওর বন্ধু। পার্থপ্রতিম কমপিউটারের বহু কিছু রপ্ত করেছে। আমার স্বামী অধ্যাপক ডঃ রামজীবন আচার্যের একটি কবিতার বই ও ই-বুকে রূপান্তরিত করেছে। ওর বৈষয়িক-পারিবারিক ভাবনা চিন্তা অনেকটা কম। তাই মাঝে মাঝে ওর প্রতি রাগও হয়। তবে পরক্ষণেই মনে হয় আমার জামাই সৎ, নির্লোভ ও ব্যতিক্রমী।

» » দোঁহারে দেখেছি দোঁহে- ডঃ রামজীবন আচার্য।

আজ যত যুদ্ধবাজ . . .

১৯৯৩ সালে ৬ই আগষ্ট তাদের যে যুদ্ধবিরোধী মনোমিছিল শুরু হয়েছিল তা আজও প্রবাহমান। তাদের এই মানবতার কন্ঠ আজও উদাত্ত। মধুবন বিতানে ফুলের জলসায় বসে যুদ্ধবিরোধী পাঠশালা। পাড়ার কচি-কাঁচা থেকে গৃহবধূ অনেকেই অংশ নেয় এই পাঠশালায়। লিও টলস্টয়-এর উদ্ধৃতি দিয়ে তারা বলেন- “এ জগতে যুদ্ধ যারা বাধায়, তারা নিজেরা যুদ্ধ করে না; আর যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে প্রাণ বাজি রেখে লড়ে যারা, তারা যুদ্ধ চায় না।” যুদ্ধ শুধু ইমারত ভাঙ্গে না বহু মানুষের বহুদিনের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দেয়। তাই সব দেশের জনগণকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সবসময় সরব থাকতে হবে। যুদ্ধমানবতা- সভ্যতার পরিপন্থী। পার্থপ্রতিমের উদ্যোগে ডুয়ার্স দিবস উদযাপন সমিতির পতাকাতলে সোচ্চার হয়েছিল বহু মানুষ; রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে। তার লেখনী থেকে উৎসারিত যুদ্ধবিরোধী কবিতায় ইতিমধ্যেই গলা মিলিয়েছে অনেকে। উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত বাচিকশিল্পী দেবাশিষ ভট্টাচার্য, নাট্যকর্মী কানাই চট্টোপাধ্যায়, সমাজকর্মী স্নেহাশিষ চক্রবর্তী, শিক্ষিকা কেয়া ব্যানার্জী আরোও অনেকে। পার্থপ্রতিম লিখেছেন-
যে ছেলেটির হাত উড়ে গেছে আজ বোমে,
মায়ের শরীরে আগুনের ঝলকানি।
যার বাবা আজ গণ কবরেতে শোয়,
দেখা না হলেও, আমি তো তাদের জানি।
এই ধরাতেই তাদের বসতবাড়ি,
একই সূর্যে রাঙা হয় পুব কোণ,
যে সেনার খুনে আজ; ভিজে গেছে মাটি,
সেও তো ছিল কারোও আপনজন ?
তিনি যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কদের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন- সভ্যতা ? যদি এটাই সংজ্ঞা হয় ? শ্বেত কপোতের ডানায় গভীর ক্ষত! / মানবতা? যদি শুধু থাকো অভিধানে ? নতজানু আমি, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, তথাগত/।

► ►খবরে প্রকাশ

দেবাশিষ ভট্টাচার্য; বাচিক শিল্পী ও কবি- আমার কাছে পার্থদা এমন একজন মানুষ, যিনি আশার বিচ্ছুরণ। সহজ, সরল, প্রাণ চঞ্চল। সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে তার অবাধ যাতায়াত। পার্থদার লেখা কবিতা আমার কন্ঠে বাঙ্ময় হয়েছে। আবৃত্তির বিষয়ে পার্থদা বেশ পারফেক্সনিস্ট। তার এই খুঁতখুতে ভাবে আমি কখনো কখনো বিরক্ত হয়েছি। তবে মনান্তর হয় নি। পরিপূর্ণ সৃষ্টিশীল মানুষ আমার পার্থদা।

» » একলা পথিক, অনেক আকাশ - পর্ব -৪

একলা পথিক, অনেক আকাশ - পর্ব -২ « «

Join our mailing list Never miss an update