একলা পথিক; অনেক আকাশ . . .পর্ব- ৬

একলা পথিক; অনেক আকাশ . . .পর্ব- ৬

প্রায় চার দশক আগে আকাশগঙ্গার বালুচর ধরে শুরু তার পথচলা । দিক্চক্রবাল দিয়েছিল মায়াভরা ছায়া ছায়া আদুরে আলাপ। অনেক আকাশ তাদের তারকা- রবি- শশী নিয়ে আলোকময় ক’রে রেখেছে একলা পথিকের চলার পথ। সেই সূর্যস্নাত যাত্রাপথের গোধূলিবেলায়; পথিক মনের সিংহাবলোকন। আড্ডা উৎসারিত ব্যতিক্রমী জীবনের সে উপাখ্যান- আজ অক্ষরবন্দী।

সম্পাদনা- অনুপম আচার্য; আইনজীবী উচ্চন্যায়ালয়, কোলকাতা। উচ্চতম ন্যায়ালয়; নিউদিল্লী।
গ্রন্থনা- উৎপল মৈত্র; কোলকাতা।

ঈর্ষা

তার চলার পথ সবটাই কি পুষ্পদল আবৃত! বিষয়টি তা নয়। গ্রাম্য ঈর্ষার শাণিত সায়ক বিভিন্নভাবে ধেয়ে গেছে তার দিকে। প্রাদেশিক ও জাতীয় স্তরে  বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেলেও কিছু মানুষের কাছে সেটা চক্ষুশূল। তিনি যে সেবামূলক কাজ করেন; তার জন্য কোনো চাঁদা বা অনুদানের তোয়াক্কা করেন না। ডাক্তারবাবু ও তার শিক্ষিকা বিবি তাদের নিজস্ব বিলাস বৈভবে না গিয়ে নিজের খরচে এই ধরনের কাজ করেন। তাঁর চিকিৎসালয়ে দু’ তিনজন স্বাস্থ্যসেবিকা থাকেন। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের চেম্বারে কেন নার্স লাগে ? এটাও অনেকের কাছে ‘চৌধুরীদের সামিয়ানা’। এটা নিয়ে বহু মানুষের রাগ, অভিযোগ কম নয়। কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন এন.জি.ও. বা নন-গভর্নমেন্ট অরগানাইজেশন ডুয়ার্স এলাকাতে কাজ শুরু করেছে। তাদের মধ্যে কিছু কিছু ব্যক্তি গ্রামীণ উন্নয়ন, আদিবাসী উন্নয়নের নামে দেশী-বিদেশী অনুদান এনে সেটা দিয়ে তাদের ঘর সংসারও চালান।  অনেকে আবার, এই করেই গাড়ি-বাড়ি হাঁকিয়ে চলে।
স্বাভাবিকভাবেই পার্থপ্রতিমের কর্মকান্ড তাদের দু’চোখের বিষ। তাকে অপদস্থ করার চেষ্টাও হয়েছে বিভিন্নভাবে। ডুয়ার্স এলাকায় তিনি সম্ভবত প্রথম অরাজনৈতিক ব্যক্তি; যার কুশপুতুল তৈরী করা হয়। যদিও পরবর্তীকালে এই পুতুল নির্মাণকারীরা তাদের ভুল বুঝতে পারেন।
ডাঃ পার্থপ্রতিমের কথায়- হিংসার মূলে রয়েছে ক্রোধ বা রাগ। ব্যাপারটি ঘটে পরোক্ষ ভাবে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করা মানুষের অন্যতম প্রবৃত্তি। তাই আশেপাশের পরিচিত মহলে তেমন সমকক্ষ থাকলে তার উপর রাগ বা ক্রোধ জন্মে; সেটাই ঈর্ষা রূপে প্রকাশ পায়। ঈর্ষা সব সময় আসে পরিচিত বলয় থেকে। উত্তরবঙ্গ সংবাদের সাময়িকীতে আপনার গল্প প্রকাশিত হলে তাতে বিকাশ সরকারের কিছু এসে যায়না। অন্যভাবে বলা যায় উত্তরবঙ্গ সংবাদের প্রথম পাতার শ্রী নওয়াংগোম্বুর ছবি ছাপা হলে আপনার গাত্রদাহ হয় না। আত্মীয় স্বজন, সহকর্মী, প্রতিবেশী, বন্ধুমহল এখান থেকেই আসে ঈর্ষার শাণিত সায়ক। কবিগুরুর ‘গান্ধারীর আবেদন’ এর সেই সংলাপ মনে আছে? ". . .  যদি হত দূরবর্তী পর/  নাহি ছিল ক্ষোভ; শর্বরীর শশধর/ মধ্যাহ্নের তপনেরে দ্বেষ নাহি করে, /কিন্তু প্রাতে এক পূর্ব-উদয়শিখরে / দুই ভ্রাতৃসূর্যলোক কিছুতে না ধরে।/
মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখছেন-যিনি যে কাজ করতে চান বা কাজ করবেন বলে ভাবেন, সেই কাজ যে করে ঈর্ষা বা হিংসা তার দিকেই ধেয়ে যায়। মৃগাঙ্ক রায়ের খুব ইচ্ছা তিনি কুসংস্কার দূরীকারক হিসাবে একটু নাম করবেন। কিন্তু তার না আছে মাইক্রোফোনে বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস, না আছে দু’কলম লেখার ক্ষমতা। তাই বিধিবাম। প্রসূন এসব কাজে বেশ তৎপর। সামাজিক কু-সংস্কার নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ও লিখে বেশ নাম করেছে। মৃগাঙ্ক রায় প্রসূনের নামে দু’গ্রাস ভাত বেশি খায়।
ঈর্ষার প্রকাশ বিভিন্ন রকম হতে পারে। তবে তার মধ্যে সচরাচর দেখা যায়-স্বীকৃতি না দেওয়া, না চেনার ভান, এড়িয়ে যাওয়া, কটুক্তি, নিন্দা, দলপাকানো, হুমকি দেওয়া কখনো বা হত্যা। মহাকবি শেক্সপিয়ার সতর্ক করে বলেছেন- " . . .O, BEWARE, MY LORD, OF JEALOUSY; IT IS THE GREEN-EYED MONSTER WHICH DOTH MOCK THE MEAT IT FEELS ON."    
‘‘ঈর্ষা হল সবুজ চোখওয়ালা সেই দানব, ব্যঙ্গ, উপহাস, বিদ্রুপ, যার পেট ভরে’’। স্বীকৃতি না দেওয়া নিয়ে এক সুন্দর ঘটনা শুনেছিলাম [জেলা শহর থেকে ঘুরে এসে]
দেবদাস-'জানিস জমির কেসে কোর্টে গিয়ে দেখি জগুবাবুর ছেলে অমিত সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে।' অধীর-'না তুই ভুল দেখেছিস। ও ম্যাজিস্ট্রেট না, ও মুহুরী।' দেবদাস-'না আমি নিজের চোখে দেখলাম ও সাদাচুল মাথায় দিয়ে উঁচু আসনে বসে উকিলদের কথা শুনছে'। অধীর-'না, না, ওর বিচার কেউই মানে না'। দেবদাস-'নারে আমি নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম সবাই ওকে ধর্মাবতার বলে সম্বোধন করছে'। অধীর-'ও তাহলে মাইনে পায়না, বিনা বেতনে কাজ করে'। না চেনার ভান বিভিন্ন রকম হতে পারে -নবীন- 'জানিস কালকের উত্তরবঙ্গ সংবাদে নিশীথের একটা ফিচার ছেপেছে'। দীপঙ্করের তৎক্ষণাৎ উত্তর-"আমি তো 'THE STATESMAN'  পড়ি।"
পার্থপ্রতিমকে যারা ঈর্ষা করেন তাদের প্রতি তার কোনো অভিযোগ বা রাগ নেই। তিনি জানেন এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। এটা ব্যক্তির নিজস্ব মানসিক গঠন। তাই তিনি ক্ষমা সুন্দর চোখে বিষয়টি দেখেন।তার কথায়- বর্তমান সমাজে বেশীরভাগ মানুষই নিজের লাভ লোকসান নিয়ে ব্যস্ত। এর মধ্যে কেউ যে আমাকে নিয়ে ভাবছে; তা  সে পজিটিভ বা নেগেটিভ যাই হোক- সেটাও আমার পরম প্রাপ্তি।

♦  ♦  ♦  

তপন রায়; চলচ্চিত্র পরিচালক- সবার সেবামূলক কাজে ডাঃ পার্থপ্রতিম এক পরিচিত নাম। সদা হাস্যময়।  দাদার লেখা ও চিত্রায়িত গানগুলি দেখেছি। চলচ্চিত্র সম্বন্ধে তার স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। আমার দু-একটি কাজেও পার্থপ্রতিমদাকে পাশে পেয়েছি। আমার প্রিয়জনদের মধ্যে পার্থপ্রতিমদা একজন। তিনি আরও বহুকাল আমাদের পাশে থাকবেন এটাই কামনা করি।

♦  ♦  ♦

তার জীবন, তার মরণ . . .

আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি বছর আগে এক মহাজাগতিক বিস্ফোরণে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি হয়। তার আগে এই বিশ্বের সকল ভর বা মাস একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল। মহাবিস্ফোরণের ফলে সেই বস্তুকণা চারিদিকে ছিটকে পড়ে। সেখান থেকেই তৈরী হয় আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা ইউনিভার্স।  
বিশ্বসৃষ্টির এই বহুমান্য তত্ত্বটি বিগ-ব্যাং থিওরি নামে পরিচিত। বর্তমানে সর্বাধিক মান্যতা পাওয়া এই বিগ-ব্যাং থিওরি অনুসারে আজ থেকে ১৫০০ কোটি বছর আগে আমাদের এই সৌরজগৎ তৈরী হয়। আর ৪৫০ কোটি বছর আগে তৈরী হয় আমাদের মমতাময়ী পৃথিবী। সেই অগ্নিপিণ্ড ধীরে ধীরে শীতল হয়। বসুন্ধরা হয়ে ওঠে প্রাণ সৃষ্টির উপযোগী।
জীববিজ্ঞানীদের মতে, আজ থেকে প্রায় ১৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বুকে প্রাণের আবির্ভাব। সেই এককোষী প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণী। তারপর বিবর্তনের সিঁড়ি বেয়ে পৃথিবীর বুকে আসে- মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী সবশেষে মানুষ। এ ঘটনা জীববিদ্যার বই থেকে আমাদের অনেকেরই জানা।
প্রাচীন গুহবাসী সেই মানুষ; আজ গগনচুম্বী অট্টালিকাবাসী। পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে চন্দ্রগামী।
আমরা ধরার বুকে ধরা দিই অর্থাৎ এই  আমরা পৃথিবীতে আসি মায়ের কোলে ছোট্ট শিশু হিসেবে। তখন আমাদের কোনো সেভাবে ব্যক্তি পরিচয় থাকে না। সুশীলবাবুর ছেলে, গায়ত্রীর ভাই- এটাই আমাদের পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। তারপর বড় হওয়ার সাথে সাথে, চারপাশের বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত হতে হতে আমরা হয়ে যাই আদর্শপল্লীর পার্থপ্রতিম, ডুয়ার্সের পার্থপ্রতিম। এইভাবে আমাদের পরিচিতির ব্যাপ্তি ঘটতে থাকে।
এভাবেই অনামি এক চা-ওয়ালা শিশু হয়ে যায় নরেন্দ্র দামোদর ভাই মোদী। অর্থাৎ, আমাদের সকলেরই যাত্রা মায়ের কোল থেকে অসীমের পানে। কেউ কেউ কিছু বংশগত পরিচয় নিয়ে জন্মায়। যেমন- ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে রাজীব গান্ধী, রাজীব গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধী। এরা বেশ কিছুটা সামাজিক সুবিধা পায় ঠিকই। তবে এর বাইরেও বহু সহস্র মানুষ রয়েছে। যারা নিজের শ্রম, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় দিয়ে আপন পরিচিতি তৈরী করেছে। তাদের কাজ, তাদের ভাবনা, তাদের নিষ্ঠা স্মরণ করে পরবর্তী প্রজন্ম।
আমাদের এই মানবজীবনের এই যাত্রা শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে বার্ধ্যক্য। তারপর মৃত্যুর শান্তি শীতল কোলের অভিমুখে। জীবনের এই যে পথ চলা এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্ভর করে  সুষ্ঠু আর্থসামাজিক পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণের মধ্য দিয়ে। কোনো এক ব্যক্তির সাফল্য বা ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করতে গেলে, তার আর্থসামাজিক অবস্থান, তার কর্ম ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেটাকে বিশ্লেষণ করতে হবে। মানুষের সাফল্যের পেছনে যে তার শ্রম, নিষ্ঠা রয়েছে সেগুলো আমরা সাধারণভাবে বুঝে উঠতে পারিনা। তার ব্যর্থতার পেছনে যে ভুল সিদ্ধান্তগুলি রয়েছে সেটাও আমরা অনেকক্ষেত্রে এড়িয়ে যাই। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে কপালের দোহাই দিয়ে সবকিছু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়। কোনো একটা বিষয়ে ব্যর্থ হলে আমরা বলি তার কপাল খারাপ, আর সফল হলে বলে বলি ‘বরাত ভালো’। আসলে, যারা সংকল্পে স্থির ও কর্তব্যে অবিচল। বড় কিছু দুর্ঘটনা না ঘটলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সাফল্য তাদের করতলগত হয়। এখানে ভাগ্যের অজুহাত দিয়ে দায়সারা যায় ঠিকই; তবে প্রকৃত সত্যের কাছে পৌঁছানো যায়না।
যারা ভাগ্য বিশ্বাস করেন বা ভাবেন ওই দুর আকাশের গ্রহ নক্ষত্ররা আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা অনেকেই ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তাবিচ, কবচ, মাদুলি এগুলি পরে চলাফেরা করে। তাই আমাদের দেশে জ্যোতিষ, বশীকরণ, ভাগ্য পরিবর্তন এইসব বিষয়গুলি নিয়ে বছরে কোটি কোটি টাকার ভন্ড ব্যবসা চলে।
বেশীরভাগ মানুষ বাই ডিফল্ট ধার্মিক(ঈশ্বর বিশ্বাসী)। নাস্তিক বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে অবিশ্বাসী হতে গেলে বিশেষ পড়াশুনো, মৌলিক চিন্তাভাবনা ও ব্যক্তিগত বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা থাকতে হবে।
মায়ের কোলে যে জীবনযাত্রা শুরু হয় তা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। জীবনের নিশ্চিত নির্ধারিত সমাপ্তি হল মৃত্যু বা মরণ। এই যে জীবনের থেমে যাওয়া, কার যে কখন আসবে তাও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। অনেকক্ষেত্রে অসুখ বিসুখ, প্রাকৃতিক বা সামাজিক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু হতে পারে। আবার কেউ বা আত্মবিষাদে আত্মহত্যাও করতে পারেন। জীবন থেকে মৃত্যুর মাঝে এই সময়টুকুতেই সকল মানুষের একটাই কাজ; সীমা থেকে অসীমের পানে যাওয়া। এ জন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যাওয়া, কিছু সম্পদ সৃষ্টি করা। রবীন্দ্রনাথের “সোনার তরী” কাব্যগ্রন্থে কালের মাঝি যেমন কৃষকের ধান বা সৃজন কালের তরণী বেয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ফসল পৌঁছে দেয়। ঠিক সেভাবেই আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু প্রভাব এ সমাজের বুকে রেখে এই পৃথিবী ছেড়ে যাই। এই প্রভাব কতটা সুগভীর হবে বা কতটা ব্যাপ্তি পাবে তা নির্ভর করে ব্যক্তির কাজের গভীরতার ওপর।
আমাদের এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যাওয়াটা একটা নিশ্চিত ঘটনা। আমরা জন্মের পরমুহূর্ত থেকেই এগিয়ে চলি মৃত্যুর দিকে। মৃত্যুটা জীবনের আল্টিমেট ডেস্টিনেশন বা আখরি মনজিল। তবে জীবিত অবস্থায় আমরা বেশিরভাগ মানুষই অনাগত নিশ্চিত এই পরিণতির কথা ভুলে যাই।
তাই আমরা আমৃত্যু গার্হস্থ্য জীবন আঁকড়ে ধরে থাকি। বিপদটা এখানে। সে কারণে কোনো মন্ত্রীর বান্ধবীর খাটের তলা থেকে কোটি কোটি টাকার নোট পাওয়া যায়। কেউ বা জীবন সায়াহ্নে এসে প্রতারণা ও জালিয়াতির কান্ড ঘটিয়ে বসেন। প্রাচীন এক দোঁহা আছে- “পুত্র কুপুত্র তো কা ধন সঞ্চয়, পুত্র সুপুত্র তো কা ধন সঞ্চয়।”   পুত্র যদি কুপুত্র হয় তার জন্য কাঁড়ি-কাঁড়ি ধন সঞ্চয়ের প্রয়োজন নেই।  আপনি যত কিছুই রাখুন না কেন; সে আপনার কষ্টার্জিত টাকা মোজ-মস্তি করে উড়িয়ে দেবে। আর সন্তান যদি সুসন্তান হয় তার জন্য আপনার বেশী সঞ্চয় করার দরকার নেই; সেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অনেক সম্পদ সৃষ্টি করবে। পার্থপ্রতিমের দর্শনে- “আর্থিকভাবে সৎ হতে গেলে; ব্যক্তিকে তার চাহিদার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কোনটা আমার প্রয়োজন? কোনটা আমার বিলাস ব্যাসন?  সেই তফাৎটা বুঝতে হবে। অর্থনীতিতে ‘ফেল্ট নিড’ বলে একটি শব্দ আছে। আজ এই পুঁজিবাদের যুগে বহুজাতিক সংস্থা বিজ্ঞাপনকে হাতিয়ার করে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের প্রতি আমাদের ‘অনুভূত চাহিদা বা আকর্ষণ’ সৃষ্ট করে চলেছে। সে বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।” স্থানীয় ব্যাঙ্কের লোন ম্যানেজার বহু চেষ্টা করেও তাকে চারচাকার গাড়ি কেনাতে পারেন নি।

প্রাচীন ভারতের সমাজ জীবন চারটি আশ্রম বা পর্বে বিভক্ত ছিল। এই চারটি আশ্রম চতুরাশ্রম নামে পরিচিত। এগুলি হল ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। শৈশব পেরোলেই শুরু হত  ব্রহ্মচর্য,  তারপর গার্হস্থ্য। গার্হস্থ্য জীবনের এক সীমানা ছিল। তারপর সাংসারিক জীবনের দায়-দায়িত্ব, বিষয়-আশয় পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে মানুষ চলে যেত বানপ্রস্থে ও সন্ন্যাস জীবনে।
এখন আর সে নিয়ম নেই। এখন আমৃত্যু গার্হস্থ্য। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সব বিষয়-আশয়, অধিকার, সম্পত্তি সবকিছু কুক্ষিগত করে রাখার প্রয়াস। এতেই বাড়ছে সংঘাত নবীনের সাথে প্রবীণের। যে সম্পর্ক হওয়া উচিত ছিল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার মেদুরতায় ভরা, তা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে রাগ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, পারস্পরিক দোষারোপের। মৃত্যুর নিশ্চয়তা সম্বন্ধে সঠিক চেতনার অভাবই এর অন্যতম কারণ। 
মরণ নিয়ে পার্থপ্রতিমবাবুর এই ভাবনার ব্যাপ্তি শুধু পড়াশোনাতেই সীমাবদ্ধ নয়। উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় রবিবাসরীয়তে পাতাভরা বড়সড় প্রবন্ধ লিখেছেন- ‘মরণ রে . . .’ শিরোনামে। যার সমালোচনা ও প্রশংসা পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে আকাশবাণী শিলিগুড়ির তৎকালীন কেন্দ্রীয় অধিকর্তা শ্রীপদ দাসের কলমে।
পার্থবাবু, তার মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়টাও, একটু পরিকল্পিত ঢং-এ করতে চান। বহু দশক আগেই মরণোত্তর চক্ষু দান করেছেন। তারপর দেহদান। সেকারণেই শবদাহ, শ্রাদ্ধ-শান্তির বিষয়টি আর থাকছে না। তার প্রিয়তমা, যেন তার অবর্তমানে মুসুরি ডালে পেঁয়াজ সম্বরা দিতে পারেন। নিঃসংশয়ে, প্রফুল্লচিত্তে খেতে পারেন তার প্রিয় রেসিপি সর্ষে-ইলিশ ভাপা। তবে একটি স্মরণসভা করা হবে। সেখানে খাওয়া-দাওয়ারও ব্যবস্থা থাকবে। তার উত্তরাধিকারীদের কেউ কৃপণ বা কঞ্জুস বলে পিছনে গালিগালাজ দেবে; এটা তার কাম্য নয়। স্মরণসভার মঞ্চের পেছনে কোন্ ছবিটা থাকবে সেটাও তিনি ইতিমধ্যে তৈরী করে রেখেছেন। বস্তুবাদী দর্শনকে ভিত্তি করে স্মরণ সভায় অতিথিদের আমন্ত্রন পত্র  তিনি তৈরী করে ফেলেছেন।

তিনি জানেন- আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু আমরা পৌঁছে যাব মৃত্যুর শান্ত শীতল কোলে। মৃত্যু জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জীবনের ধারক ও বাহক। তাই হয়তো ছয় ফুট লম্বা, আলখাল্লা পরা, দাড়িওয়ালা ওই মানুষটি ছন্দে ছন্দে জীবনের সারকথা বলেছেন-
মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’, রাত বলেছে যাই. . .  
ভুবন বলে, ‘তোমার তরে আছে বরণমালা।’
গগন বলে, ‘তোমার তরে লক্ষ প্রদীপ জ্বালা।’
প্রেম বলে যে, ‘যুগে যুগে তোমার লাগি আছি জেগে।’
মরণ বলে, ‘আমি তোমার জীবন তরী বাই।’

♦  ♦  ♦

 

राजेश प्रधान; शिक्षक तथा पत्रकार- डुवर्स विभिन्न भाषा, संस्कृति, धर्म र समुदायका मानिसहरूका मिलन मञ्च हो। टिस्तादेखि सुनकोशसम्म विभिन्न जातजाति, समुदाय र धर्मका मानिस विविधतामा एकता देखाउँदै यहाँ वर्षौंदेखि बसोबास गर्दै आइरहेका छन् । सबै धर्म, जात, सम्प्रदाय, भाषा, संस्कृतिमा आस्था र चासो राख्ने मिलनसार डा पार्थ प्रतिम बहुमुखी प्रतिभा सम्पन्न व्यक्ति हुन्। डा. पार्थ प्रतिम, मेरा जेठा दाजुले मलाई एउटै परिवारको सदस्य जस्तै व्यवहार गर्नुहुन्छ। यो उनको शालिनता र वृहत् हृदयका घोतक हो। विभिन्न भाषा, धर्म र डुवर्सका सम्प्रदायको लोक संस्कृतिप्रतिको प्रेम , भक्ति र आग्रहले मलाई सधैं प्रेरित गरिरहेको हुन्छ। विभिन्न जातजातिको परम्परागत खाद्य परिकारमा उनको विशेष चासो छ । सबै प्रकारका खाद्य परिकार  जिब्रो पड्काउदै उहाँले ग्रहण गर्नु हुन्छ। डा. पार्थ प्रतिम मेरो दृष्टिकोणबाट डुवर्सका लागि आइकन हुन्। उहाँका धेरै गुणहरूले मलाई सधैं प्रेरणा दिईरहेको हुन्छ। उनको बारेमा धेरै भन्नु भनेको सूर्यको अगाडी दीयो जलाउनु जस्तै हो। मैले विगत २० वर्षदेखि डा. पार्थ प्रतिमलाई राम्ररी चिनेको छु। पेशाले डाक्टर हुनुका साथै मेहनती समाजसेवी डा. पार्थ प्रतिम सधैं समाजको उत्थानको बारेमा सोच्ने व्यक्ति हुन् । डा. पार्थ प्रतिम, धेरै हृदयस्पर्शी, मृदुभाषी र डुवर्सलाई धेरै माया गर्ने व्यक्ति हुन्। सधैं आफ्नो पेशा बाहेक केहि सामाजिक काम गर्न उद्दत रहन्छन्। समाजका पिछडिएका वर्गको उत्थानका निम्ति केही गर्ने इच्छा उनमा छन्। वर्षौंदेखि हामीले सामाजिक कुरीति, अन्धविश्वास, जनचेतना, वन उपनिवेश तथा चिया बगानका दुर्गम क्षेत्रलगायत विभिन्न किसिमका रोगबारे जनचेतनामूलक कार्यक्रम गरी जनचेतना जगाउने काम गर्दै आईरहेका छन् । उनका महान कार्यको लागि, उहाँले धेरै संघसंस्थाबाट प्रशंसा पत्र प्राप्त गरिसकेका छन्। डा. पार्थ प्रतिम सदैव नयाँ नयाँ तकनीक र जीवनमा कसरी लोक सेवा गर्नु सदैव तत्पर रहन्छन्। डुवर्समा शान्ति, भाइचारा र साम्प्रदायिक सद्भावको वातावरण सिर्जना गर्न सन् २०११ देखि 'डुवर्स डे' ( Dooars Day) पालन गर्ने उनको सोचले आज वृहत् रुप लिईसकेको छ ।सबैलाई यसले वर पिपलले  जस्तै शितलता प्रदान गरिरहेको छ। बानरहाट मखमली समाजले उनले गरेको महत कार्यलाई हृदयबाटै कृतज्ञता प्रकट गर्दछ।
डा. पार्थ प्रतिम समाजप्रतिको निष्ठा र सामाजिक कार्यमा सधैं अगाडि बढिरहोस् भन्ने कामना गर्दछु ।

(রাজেশ প্রধান; শিক্ষক ও সাংবাদিক) - ডুয়ার্স হল বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মিলনস্থল। তিস্তা থেকে সংকোশ নদী পর্যন্ত বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও ধর্মের মানুষ বছরের পর বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বিরল নিদর্শন। বন্ধু ডাঃ পার্থ প্রতিম একজন বহু-প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি যিনি সকল ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বাস ও আগ্রহ রাখেন। তিনি আমার বড় ভাই; আমার সাথে পারিবারিক সদস্যের মতো আচরণ করেন। এটি তার শালীনতা এবং বড় হৃদয়ের পরিচয়। ডুয়ার্সের বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকসংস্কৃতির প্রতি তাঁর ভালবাসা, ভক্তি এবং তাগিদ আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করে। বিভিন্ন জাতি-বর্ণের প্রচলিত খাবারের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। সে তার রসনা দিয়ে সব ধরনের খাবারের রসাস্বাদন করেন। আমার দৃষ্টিকোণে ডাঃ পার্থপ্রতিম ডুয়ার্সের আইকন। তার নানাবিধ গুণ আমাকে সবসময় উৎসাহিত করে। তার সম্পর্কে কিছু বলা মানে- সূর্যের সামনে প্রদীপ জ্বালানোর মতো। বিগত ২০ বছরের বেশী সময় ধরে আমি তাঁকে দেখে আসছি। পেশায় চিকিৎসক হওয়ার পাশাপাশি তিনি এমন একজন ব্যক্তি যে সবসময় সমাজের উন্নয়ণের কথা ভাবেন। ডাঃ পার্থপ্রতিম খুব মৃদুভাষী, বিনীত কথা বলেন ও ডুয়ার্সকে খুব ভালবাসেন। তিনি তার পেশার পাশাপাশি সবসময় কিছু না কিছু সামাজিক কাজ করতে আগ্রহী।
তাঁর মহান কাজের জন্য, নানান সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ডাঃ পার্থ প্রতিম নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সদা প্রস্তুত। ডুয়ার্সে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করতে ২০১১ সাল থেকে তার ভাবনার 'ডুয়ার্স ডে' পালন; আজ বড় আকার ধারণ করেছে।
তিনি যেন বটবৃক্ষের মতো। সকলকে শীতল ছায়া প্রদান করে চলেছেন। ‘বানারহাট মখমালী সমাজ’ তার এই মহান কাজের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। অনাগত দিনগুলিতে ডাঃ পার্থপ্রতিম সমাজের প্রতি আনুগত্য ও সমাজসেবা নিয়ে সর্বদা এগিয়ে যাবেন এই কামনা করি।

 

♦  ♦  ♦

তার রাজনীতি তার দেশ

উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় থেকে তার মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার উন্মেষ ঘটতে থাকে। সে সময় তার ইংরেজি শিক্ষাগুরুর সান্নিধ্যে কংগ্রেসী রাজনীতির প্রতি আস্থা জন্মে। স্যারের মুখেই শোনেন, চীন-রাশিয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লবের অমানবিক পদক্ষেপগুলি। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে নরহত্যা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ধ্বংসের ভয়াবহ ঘটনা।
পরবর্তীকালে জোর কদমে শুরু করেন মার্কসীয় শাস্ত্রের পড়াশুনো। স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে মার্কসীয় দর্শনের বিভিন্ন বই এনে তিনি পড়তে থাকেন দিনের পর দিন। সে সময় সোভিয়েত দেশ, প্রগতি ও মীর পাবলিকেশেনের বিভিন্ন বই-পুস্তক খুব অল্প দামে এদেশে পাওয়া যেত। সু্ন্দর কাগজ ও ঝকঝকে ছাপা এই বইগুলি ছিল বেশ আকর্ষণীয়। দেশের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত এই বইগুলি অনেকের কাছে সহজলভ্য হয়ে ওঠে। তাই মার্কসীয় দর্শন পড়া বা বোঝার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা সে সময় ছিল। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া পার্থপ্রতিম স্বাভাবিকভাবেই অনুরক্ত হয়ে পড়ে এই দর্শনের প্রতি। ‘বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা’, লি-সাউচির- ‘হাও টু এ বি গুড কমিউনিস্ট’ ( HOW TO BE A GOOD COMMUNIST) (সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে গেলে) -এই বইগুলিকে আত্মস্থ করে। প্রিমেটিভ কমিউনিজম থেকে সামন্ততন্ত্র। সেখান থেকে ক্যাপিট্যালিজম-এর উত্থান। এই বিষয়গুলি তার কাছে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়।
পরবর্তীকালে, কলকাতায় থাকাকালীন অধ্যাপক শিব নারায়ণ রায়ের সান্নিধ্যে তিনি  ‌র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট-এর রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি অনুরাগী হন। তারপর ব্রেক থ্রু সায়েন্স সোসাইটির সদস্যদের সান্নিধ্যে কমরেড শিবদাস ঘোষের দর্শন ও ভাবনা নিয়ে পড়াশোনা করেন। যৌবনের মাঝামাঝি সময়ে তিনি মনে প্রাণে মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী হন।
দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও তার আচরণ তার অন্য সব কাজের মতোই বাঁধনমুক্ত। আমাদের দেশের দলীয় রাজনীতিতে অন্ধ আনুগত্য বেশ কদর পায়। অর্থাৎ, কোনো একজন দলীয় নেতার চ্যালা হয়ে নিরলস কাজ করতে হবে। তার ঠিককে ঠিক, ভুলকে ঠিক বলতে হবে। তারপরে সুযোগ বুঝে আরো বলশালী, ক্ষমতাশালী অর্থবান নেতার চ্যালা হয়ে যেতে হবে। ‘গুরু কৃপাহি কেবলম্’ -সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী হওয়া যায়।
ঠিককে ঠিক বলতে তার আপত্তি নেই। তবে ভুলকে ঠিক বলতে তার ঘোর অনীহা। এসব বিভিন্ন কারণেই দলীয় রাজনীতির ময়দানে তিনি ব্যর্থ মানুষ। তিনি মনে করেন কেউ- মার্কসীয় দলের তথাকথিত নেতা- মাতব্বর হলেই সে মার্কসবাদী হয়না। তার জীবনযাপনের মান, জীবনদর্শন, আন্তরিক প্রয়াস ও সামাজিক শ্রেণীচেতনা না থাকলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে শুধু দলীয় রাজনীতি করার সুবাদে মার্কসবাদী হয়ে উঠতে পারেনা। সেকারণেই, তিনি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ময়দানে হোঁচট খেয়েছেন। যদিও সেভাবে কোনোদিনই কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হননি। তবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তিনি অংশ নিয়েছেন। তবে, চোখ-কান বন্ধ করে দলদাস হতে পারেন নি।
ধরি মাছ, না ছুঁই পানি নয়। তিনি তার চিন্তা ভাবনা বারবার প্রকাশ্যে এনেছেন। তাঁর চেতনায় যা কিছু মঙ্গলময় কল্যাণকর, তাকেই তিনি আন্তরিকভাবে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। বেশ কয়েক দশক আগে বাম যুব সম্মেলনের জন্য তিনি গান বেঁধেছিলেন- “বৈশাখে ফাগুনে, চেতনার আগুনে; যুক্তিটা আরো হোক ধারালো।/ সাদা ঐ পতাকায় লাল তারা চমকায় শপথের এই হাত বাড়ানো. . ./।”
ঠিক একইভাবে তিনি লিখেছেন- সবুজ সাথীর শুভকামনার গান।
ত্রিপুরায় যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তন হয়, বাম সরকারের বিদায়ের পর লেনিনের মূর্তি ভাঙা হয়। তার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে তার কলম। সামাজিক মাধ্যমগুলিতে তাঁর এই লেখামালা প্রশংসিত, নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছে। তিনি মনে করেন, ভালো কাজ করার জন্য কোনো রাজনৈতিক দলের দলদাস হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং দলের অতি অনুগত হলে বহু জায়গায় অচেনা আপোস করতে হয়। তার মতে- ভারতীয় মুসলমান রমনীদের জন্য তিন তালাক প্রথা উঠিয়ে দেওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ। এর পাশাপাশি লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী এই প্রয়াসগুলো শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনের দাবি রাখে।
অনেককে বলতে শোনা যায়- আমি বাবা কংগ্রেস ছিলাম, কংগ্রেস আছি। বা সিপিআইএম ছিলাম সিপিআইএম ই আছি। অনেকে এটা নিয়ে গর্ববোধও করেন। এই রক্ষণশীল মানসিকতা পার্থপ্রতিমের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিন্দনীয়। তিনি বলেন- জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতার প্রেক্ষাপটে বিষয়গুলিকে ভাবতে হবে। ‘বাবাকেও খেতে দেখেছি’ জনপ্রিয় হেল্থড্রিঙ্কসের বিজ্ঞাপনের সাথে বিষয়টি গুলিয়ে ফেললে চলবে না। দেশ- কাল- প্রগতির সাথে সাথে নতুনভাবে বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা রাখতে হবে। তা না হলে সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহের মতো কুপ্রথাগুলি ও ক্ষয়িষ্ণু দলীয় মতাদর্শগুলি সমাজে টিকে থাকবে।
দলীয় পদে না থাকলেও তিনি বিভিন্ন সময়ে সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মতে- ‘সৎ, যোগ্যব্যক্তি যদি সরকারের সহযোগিতার কাজে দায়িত্ব এড়িয়ে যান; তাহলে সরকারী কাজে অসৎ, অযোগ্য ব্যক্তিদের মাতব্বরী বাড়বে।’ এভাবে উচ্চমাধ্যমিক সরকারি স্কুলে পরিচালন সমিতিতে সরকার মনোনীত সদস্য হয়েছেন। সরকার পোষিত তরুণ সংঘ গ্রন্থাগারের তিনি ছিলেন সরকারী প্রতিনিধি। তবে ভালো কাজের সহযোগিতা ও খারাপ কাজের নিন্দা করার স্বভাব তিনি কখনোই ছাড়তে পারেননি।

♦  ♦  ♦

তাঁর ঈশ্বর

আমরা যদি একটু ইতিহাসের পাতা উল্টাই, তাহলেই দেখতে পাবো এককালে ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি এইসব দেবদেবতার পূজো হত। প্রাচীন গুহাবাসী মানুষদের জানা সম্ভব ছিল না, কী কারণে আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বারিধারা নেমে আসে। কেনই বা আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করা আলোক ঝলকানিতে বজ্রপাত হয়। কেনই বা দাবানলের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ খাক করে দেয় ঝরাপাতার অরণ্য বনানীকে। সীমিত জ্ঞানের মধ্যে আদিম মানুষেরা ভেবেছে এই সব প্রাকৃতিক কর্মকান্ডের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো শক্তির প্রভাব লুকিয়ে রয়েছে। সেকারণেই, তারা তাদের এই কাল্পনিক শক্তিকে শয়তান বা ভগবান, দেব বা দেবীর কাল্পনিক রূপ দিয়ে পূজা-পাঠ শুরু করেন। এই ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি এই সব বিভিন্ন দেব দেবতার জন্ম হয়।
তবে বর্তমানে, এইসব প্রাকৃতিক কান্ড কারখানা ছেলে বুড়োদের সাথে কচি-কাঁচারাও জেনে গেছে। তাই তাদের আর মন্ত্রীত্বও নেই ও বিরোধী দলের মধ্যেও নেই।
তবে হ্যাঁ, সময়ের সাথে সাথে ব্যাপক ভাবে ব্যাপ্তি পেয়েছে আমাদের জ্ঞানের পরিধি। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে এসেছে নতুন নতুন সমস্যা ও সংকট। যা সবসময় আমাদের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে নেই। বিবাহযোগ্য মেয়ের বয়সটা বেড়েই চলেছে। ছেলে চাকরিযোগ্য, কিন্তু ভালো জীবিকা বেছে নিতে পারেনি। ফ্ল্যাটের EMI টা এবার কীভাবে দেওয়া হবে সেটাই মস্ত চিন্তা। এইসব নতুন সমস্যার জন্য দরকার নতুন ঈশ্বরের। তাই রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন সন্তোষী মা। সারাদেশ জুড়ে হঠাৎ-ই পাথরের গণেশ দুধ খায়, করোনা দানব কে ভাগাতে বেজে ওঠে অজুত-নিযুত থালা, বাটি, কাঁশর, ঘন্টা, শব্দবাজি।
পার্থবাবুর কথায়- “আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী নই, একথাটি আমি বলতে চাই না। এই কথাটির সরল অর্থ হল ঈশ্বর আছেন, কিন্তু আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি না। যেমন- দেশের উন্নয়ন- এর অগ্রণী হিসেবে আমি মোদী বা মমতা কে বিশ্বাস করি না। আমার ভাবনায় ঈশ্বর বলে কিছুই নেই। তাই বিশ্বাস করা বা না করার কোনো প্রশ্নই এখানে আসছে না।” মানুষের, মৃত্যুকে ঘিরে অর্থাৎ মৃত্যুর পরবর্তীকালে কী হয় সেটা স্বাভাবিকভাবেই আমরা জানি না।

ধর্মের সংজ্ঞা তার কাছে অন্যরকম। তবে, যারা ধর্মে বিশ্বাসী তাদের প্রতি তার কোনো রাগ, বিদ্বেষ নেই। তিনি তাদের শ্রেণীশত্রুও ভাবেন না। পড়েছেন বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্র। বিভিন্ন ধর্মের ধর্মস্থানগুলিতে তিনি গিয়েছেন; বৌদ্ধ মনাস্ট্রি থেকে চার্চ, হরিসভার আখড়া থেকে মসজিদ। আরও বহু জায়গায় রাত কাটিয়েছেন তাদের মত করে। সুলতানগঞ্জে গঙ্গা থেকে জল ভরে বা বাবাধাম পর্যন্ত ১১৪ কিমি. পথ কাঁধে বাঁক নিয়ে হেঁটে গিয়েছেন। খোলা মন নিয়ে বুঝতে চেয়েছেন তাদের ভাবনা- চিন্তা।

মানুষ সাধারণভাবে বাই ডিফল্ট ধার্মিক (ঈশ্বর বিশ্বাসী)। নাস্তিক বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে অবিশ্বাসী হতে গেলে বিশেষ পড়াশোনা, মৌলিক চিন্তাভাবনা ও ব্যক্তিগত বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা থাকতে হবে। এটা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। আমাদের পারিবারিক পরিমন্ডল ঈশ্বর বিশ্বাসী গড়ে তোলে। আমাদের অনেকেরই বাড়ির এক কোণে বা পৃথক কোনো ছোটো ঘরে ঠাকুর ঘর থাকে। যারা ঈশ্বর ধর্মাবলম্বী, তারা সপ্তাহের বিশেষ দিনে নামাজ পড়তে যান। ইসাইরা যান চার্চে। ছোটোবেলা থেকেই এসব দেখে দেখে আমরা বড় হই। তাই আমরা স্বাভাবিকভাবেই ঈশ্বর, আল্লা বা গড-এর বিশ্বাসী হয়ে উঠি। এ আজ নয়, মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই এ ধারা চলছে। আমাদের ইতিহাস, আমাদের পরম্পরা, আমাদের পারিবারিক পরিমন্ডল; আমাদের ঈশ্বর বিশ্বাসী হতে সিংহভাগ বাধ্য করে।
ঈশ্বর উৎসারিত ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের মূল তফাতটা হচ্ছে- বিজ্ঞানমূলতঃ পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তের ওপরেই নির্ভরশীল। পরীক্ষা করা, নিবিড়ভাবে দেখা তারপরে সিদ্ধান্তে আসা। এভাবেই বিজ্ঞানের তত্ত্ব প্রকাশ পায়। তাই বিজ্ঞানের তত্ত্ব বা তথ্যগুলি সতত পরিবর্তনশীল। যেমন নিউটন সাহেব বলতেন- আলোক সরলরেখায় চলে। পরবর্তীকালে আইনস্টাইন জানালেন- আলোক চলে আঁকা-বাঁকা পথে তরঙ্গ গতিতে। ধর্মের ক্ষেত্রে কথা হল- বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
পার্থপ্রতিম এই বিষয়টি আত্মস্থ করেছেন বলে তিনি সেই অর্থে ঈশ্বর বিশ্বাসী নন। তবে যারা আল্লা, ভগবান বা গড-এ বিশ্বাসী; তাদের সঙ্গে কোনো ব্যক্তি সংঘাত নেই।

নিতাই চন্দ্র দাস; সম্পাদক; বানারহাট শীতলাবাড়ি উন্নয়ন কমিটি - কৈশোর থেকেই পার্থপ্রতিমকে দেখে আসছি। ঈশ্বর, পূজা-পার্বণে তার কোনো বিশ্বাস নেই। এমনকি তার মা চলে যাওয়ার পরেও লোকজনকে খাইয়েছেন ঠিকই, তিনি শ্রাদ্ধশান্তি, মাথান্যাড়া এইসব পারলৌকিক কাজকর্ম করেননি। তবে আমাদের শীতলা মন্দিরে উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন চিঠিচাপাটি, আনুসাঙ্গিক লেখালেখির সব কাজ, অতিথিশালা তৈরীর উদ্যোগ এগুলি নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে করে থাকেন। ওর ব্যাপারস্যাপার বোঝাটা বেশ মুশকিল। তবে মানুষটি সৎ ও কাজের মানুষ।

ডঃ নিরুপম আচার্য; অধ্যাপক; ভাঙড় মহাবিদ্যালয় - সে সময়ে,  বয়সে কেউ প্রাক-যুবক, কেউ পূর্ণ-যুবক, আবার কেউ বা প্রান্ত যুবক। সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে সল্টলেকে একটি আবাসনে বাস করছিলাম। আমরাও পার্থদার মতো  গ্রাম থেকে তখন কল্লোলিনী কলকাতায়। লোকমুখে শুনেছিলাম তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রশংসিত একজন। বয়সের ব্যাবধানে ঘনিষ্ঠতায় আড়ষ্টতা ছিল। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে এক সঙ্গে কাজ করার সুবাদে অচিরেই তা কেটে গেল। নাটকের অভিনয় থেকে গীতি আলেখ্য রচনা ও পাঠ, নানা বিষয়ে তর্ক বিতর্ক লেগেই থাকত । পার্থপ্রতিম- যে সংস্কারমূলক পদবীতে বিশ্বাস করেন না, মনুষ্যত্বে আস্থা রাখেন, এটা জেনেছিলাম। নিন্দুকেরা বলে তর্কপ্রিয়; আসলে হার না মানা একটা জেদি মানসিকতা ছিল তাঁর। ছোটোখাটো চেহারার মানুষটাকে মাঝেমাঝেই মনে হত দৃঢ়চেতা বলশালী একটি পূর্ণমর্যাদার মানুষ। আকাশ যার বড় বন্ধু, সে তো চাইবে আকাশ ছুঁতে।  আজ অনেক কথা মনের মাঝে ভিড় করে আসে। কিছু কথা ঝাপসা হয়েও যায়।  আজ একটা কথাই বলবো , এ পথিক আরো পথ হাঁটুক; মানুষের মনের আকাশ জুড়ে। ডুয়ার্সের চা-বাগিচার মতো চিরসবুজ থাকুক তার হৃদয়-তনু- মন।

» » একলা পথিক, অনেক আকাশ- পর্ব - ৭

একলা পথিক, অনেক আকাশ- পর্ব - ৫ « «

Join our mailing list Never miss an update