হৃদয়ের কথা পর্ব-৭; হৃদবেদনা বা অ্যানজাইনা; -ডাঃ পার্থপ্রতিম।
মধ্যদিনের রক্ত নয়ন এখন অন্ধ। ঈশান কোণে কালো মেঘ। পিঁপড়েরা সারি বেঁধে উঁচুতে উঠছে। কারো মুখে ডিম, কারো মুখে খাবার।
না, আর কোনো বর্ণনার প্রয়োজন নেই। পাঠক বন্ধুরা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এরপরেই নামবে ঘনঘোর বরষা। কোনো বড়ো ঘটনার আগে এমন আভাস পাওয়া যায়। হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে এই পূর্বাভাসকে বলে অ্যানজাইনা পেক্টোরিস (Angina Pectoris)। নামটা একটু খটমটে। আসলে এটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে। একে বাংলা তর্জমা করে হৃদবেদনা বলা যেতে পারে।
আমাদের বুকের গভীরে থাকা হৃদয়টি যখন প্রয়োজনের তুলনায় সঠিক পরিমাণে পুষ্টি ও অক্সিজেন পায় না তখনই তা জানিয়ে দেয়। সেদিক থেকে অ্যানজাইনা পেক্টোরিসকে হৃৎপেশীর দাবি-দাওয়ার চাটার্ড অব্ ডিমান্ড বলা যেতে পারে। হৃদযন্ত্রের মূল পেশিস্তর হ’ল মায়োকার্ডিয়াম। মায়োকার্ডিয়ামে রক্তের ঘাটতি হলে শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন উপসর্গ, অ্যানজাইনা পেক্টোরিস। তাই অনেকে অ্যানজাইনা পেক্টোরিসকে বলেন ট্র্যান্সিয়েট মায়োকার্ডিয়াল ইস্কিমিয়া (Transient Myocardial Ischaemia)। দেহের কোনো অংশে যখন রক্ত প্রবাহের ঘাটতি হয় তখন তাকে ডাক্তারি ভাষায় ইস্কিমিয়া বলে।
আপনি জামাইষষ্ঠীর ভারী বাজার করে ফিরছেন বা ধরুন অফিসের দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন, আজ আবার বোর্ড অব্ ডিরেক্টরস্-এর মিটিং। হঠাৎই বুকের ঠিক মাঝখানে কেমন দমবন্ধ হওয়া অনুভূতি, মনে হয় একটা ভারী কিছু চেপে বসেছে। শুধু বুকের মাঝখানে নয়, ব্যথা ছড়িয়ে পড়েছে বাঁ-হাতে-ঘাঁড়ে, চোয়ালে। এরপর বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন বা শুয়ে থাকলেন, দেখলেন আস্তে আস্তে ব্যথা কমে গেছে। হ্যাঁ, এ ধরনের ঘটনা যদি মাঝে মাঝে হয় তবে অযথা দেরি করা মানে পরপারের পাসপোর্ট-ভিসা তাড়াতাড়ি তৈরি করা। সময় নষ্ট না করে কার্ডিওলজিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
হাফজান্তা কিছু লোক এ সময় প্রায়ই ভুল করে বসেন। পি.ডব্লু.ডি-ও নিতাইবাবু, টু পাইস ফাদার মাদার। গিন্নিকে হাত নেড়ে জানিয়ে দেন- ডাক্তার ডাকতে হবে না। অ্যান্টাসিডের বোতল থেকে কিছুটা গলায় ঢেলে শুয়ে পড়লেন। ঘন্টা দুয়েক পরে উঠলেন। মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। ‘‘কী গো অলকা, বলেছিলাম না এটা গ্যাসের ব্যথা। তোমার বুদ্ধিতে চললে মাসের শেষে এখনই বেশ কিছু মালকড়ি বেরিয়ে যেত।’’ এরপর এ ঘটনা বেশ কয়েকবার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। অলকা এখন আর মুসুরি ডালে পেঁয়াজ সম্বরা দেয় না। আমাদের নিতাইবাবু তৃষিত এ মরু ছেড়ে এখন রসাল নন্দনের বাসিন্দা।
আসলে শুধু নিতাইবাবুরাই নন, অনেক ডাক্তারবাবুও বুঝতে পারেন না কোনটি প্রকৃত অ্যানজাইনা, কোনটি গ্যাস অম্বল বা অন্য কিছুর প্রকাশ। এসব ক্ষেত্রে ই.সি.জি. করতে হয়। তবে হ্যাঁ, এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, ই.সি.জি.-র সাহায্যে হৃদযন্ত্রের সকল ব্যাধির হদিস পাওয়া যায় না। যেমন- করোনারি ধমনী সরু হয়ে গেছে কি না বা কতটা সরু হয়েছে, সেটি জানতে হলে করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করতে হবে। এ বিষয়েও হাফজান্তাদের সাবধান হতে হবে।
যে সব কারণে হৃদযন্ত্রের মায়োকার্ডিয়াম স্তরে অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাব দেখা যায় তার মধ্যে প্রধান হ’ল-
□ হঠাৎ অতিরিক্ত পরিশ্রম করা □ রক্তে লোহিত কণার অভাব (Anaemia) □ থাইরয়েড গ্রন্থির অতিরিক্ত ক্ষরণ বা হাইপার থাইরয়ডিজম (Hyperthyriodism) □ উচ্চরক্তচাপ □ মহাধমনী সরু হয়ে যাওয়া (Aortic Stenosis) □ হৃৎপিন্ডের সংকোচনের সময় করোনারি ধমনীতে স্বল্প পরিমাণ রক্ত প্রবাহিত হওয়া □ হৃদযন্ত্রের অস্বাভাবিক দ্রুত স্পন্দন বা ট্যাকিকার্ডিয়া (Tachy Cardia) □ মহাধমনীর মুখে থাকা অ্যাওর্টিক ভালভ ঠিক মতো বন্ধ না হওয়া (Aortic regurgitation)।
সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে ওঠা, ভরপেট খাওয়ার পর, বায়ুপ্রবাহে বিপরীতের হাঁটার সময়, ঠান্ডা আবহাওয়ার এই অসুবিধা বেশি হয়ে থাকে। কোনো কোনো সময় বিশেষ ভঙ্গিতে শুলে অ্যানজাইনা দেখা দিতে পারে। একে বলে অ্যানজাইনা ডিকুবিটাস (Angina Decubitus)। এছাড়াও ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে বুক ব্যথা হয়ে ঘুম যেতে পারে। এর নাম নক্টান্যাল অ্যানজাইনা (Nocturnal Angina)।
লক্ষণ অনুযায়ী অ্যানজাইনা পেক্টোরিসকে তিনভাগে ভাগ করা হয়-
১) স্থায়ী অ্যানজাইনা (Stable Angina) : এটি শারীরিক বা মানসিক পরিশ্রমের সময় দেখা যায়। কিন্তু বিশ্রাম নিলে তা ধীরে ধীরে কমে আসে।
২) অস্থায়ী অ্যানজাইনা (Unstable Angina) : বিশ্রামের সময় এই ব্যথা বেশি দেখা যায়। এ থেকে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা ১০-১৫ শতাংশ।
৩) প্রিঞ্জ মেটাল অ্যানজাইনা (Prinze Metal Angina) :এই ব্যথা শুধুমাত্র বিশ্রাম বা ঘুমের সময় হয়। শারীরিক বা মানসিক পরিশ্রমের সময় হয়। শারীরিক বা মানসিক পরিশ্রমের সময় থাকে না। যারা বেশি বিড়ি-সিগারেট খান তাদের এ ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। তবে এ রোগীর সংখ্যা খুব কম।
হৃদবেদনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুর প্রথম পর্যায়ে রোগ লক্ষণগুলির তীব্রতা (Severity) ও বিস্তৃতি (Extent) বুঝে নেন। তারপর ওষুধ ও বিভিন্ন উপায়ে রোগীর কষ্টগুলি লাঘব করা হয়। তৃতীয় ধাপে অদূর ভবিষ্যতে যাতে হার্টঅ্যাটাক না হয় সেই চেষ্টা করেন।
অ্যানজাইনা চিকিৎসায় বিভিন্ন রকম ওষুধ ব্যবহার করা হয়। নাইট্রোগ্লিসারিন (Nitroglycerine), সরবিট্রেট (Sorbitrate), বিটা ব্লকার (Beta Blocker), ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (Calcium chanel Blocker) এসব জাতীয় বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। হোমিওপ্যাথিতে অ্যানজাইনার কিছু ভালো ওষুধ রয়েছে। হোমিও চিকিৎসা মূলত রোগলক্ষণ ভিত্তিক। বিভিন্ন লক্ষণের জন্য আলাদা আলাদা ওষুধ। ভীষণ বুক ধড়ফড়ানি তাতে যেন রোগীর দমবন্ধ হয়ে যাবে, বুকটা যেন কেউ জোরে চেপে ধরে হঠাৎ ছেড়ে দিচ্ছে- এসব ক্ষেত্রে ক্যাকটাস গ্র্যান্ডি (Cactus. G)। আবার যদি দেখা যায় হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত, বুকে খোঁচামারা ব্যথা, হৃদয়ের সংকোচন ও প্রসারণ জামার ওপর থেকেই বোঝা যাচ্ছে- সে ক্ষেত্রে স্পাইজেলিয়া (Spigelia) হতে পারে। এ রকম আরো কয়েকটি ওষুধ ন্যাজা, ল্যাকেসিস, গ্লোনয়িন, আর্সেনিক আয়োড। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ব্যবহার করলে অ্যানজাইনা পেক্টোরিসে ভালো ফল পাওয়া যায়।
হৃদবেদনা নিয়ন্ত্রণের মূল হলো- স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করা ও এ বিষয়ে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ সঠিকভাবে বুঝে নিয়ে তারপর মেনে চলা। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। এক রোগীকে পরীক্ষার পর ডাক্তার বললেন- ‘এখন দেখছি আপনি আগের চেয়ে অনেক ভালোই আছেন।’ রোগী ডাক্তারকে প্রশ্ন করলেন-‘ডাক্তারবাবু, তাহলে আমি এখন সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারি?’ ডাক্তার বললেন- ‘তা পারেন।’ রোগী হাঁফ ছেড়ে বললেন- বাঁচালেন! গত দু’মাস পাইপ বেয়ে ওঠা নামা করতাম, খুবই কষ্ট হতো।’