হৃদয়ের কথা- ৬ পর্ব; হৃদয়ের সাড়াশব্দ

হৃদয়ের কথা- ৬ পর্ব; হৃদয়ের সাড়াশব্দ

হৃদয়ের কথা- ৬ পর্ব; হৃদয়ের সাড়াশব্দ; -ডাঃ পার্থপ্রতিম।
    সে চলেছে. . . । কান রাখুন না আপনার প্রিয়তম বা প্রিয়তমার বুকে, শুনতে পাবেন তার চলার ধ্বনি। হ্যাঁ, ডাক্তারবাবুরা যখন স্টেথোস্কোপ দিয়ে আপনার বুক পরীক্ষা করেন তখন বুকের বাঁ-দিকে শুনতে পান এই লাব্-ডুব্ ছন্দ। ভ্রূণের বয়স যখন ৯ সপ্তাহ তখন থেকেই মা অনুভব করে অনাগত অতিথির প্রাণের স্পন্দন। এ শব্দের মধ্যেই রয়েছেজীবনের সজীব ছোঁয়া। এ থেমে যাওয়া মানেই মৃত্যুর নিথর পরশ। চিকিৎসকেরা একেই বলে হৃদধ্বনি বা হার্ট সাউন্ড (Heart Sound)|।
    হৃৎপিন্ডের সংকোচন ও প্রসারণের সময় মোটামুটিভাবে চার রকমের কম্পন তৈরি হয়। হৃদয় যখন সংকুচিত হতে থাকে, সে সময়ে অলিন্দ ও নিলয়ের মধ্যে থাকা বাইকাসপিড ও ট্রাইকাসপিড ভালভ্ দু’টি সজোরে বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলেই সৃষ্টি হয় প্রথম হৃদধ্বনি বা ফার্স্ট হার্ট সাউন্ড। এই শব্দ স্থুল ও দীর্ঘ। অনেকটা ইংরেজি  L-U-B-B-এর মতো। ফার্স্ট হার্ট সাউন্ড ০.১ থেকে ০.১৭ সেকেন্ড পর্যন্ত থাকে। হৃৎপিন্ডের সংকোচনের সময় নিলয় থেকে রক্ত মহাধমনী ও ফুসফুসীয় ধমনীর ভেতরে দিয়ে দেহের বিভিন্ন প্রান্তে ছিটকে পড়ে। এই কম্পনজনিত শব্দও হৃদধ্বনির সঙ্গে মিশে যায়। ফার্স্ট হার্ট সাউন্ড থেকে হৃৎপিন্ডের মায়োকার্ডিয়াম পেশির অবস্থা বোঝা সম্ভব। মায়োকার্ডিয়াম দুর্বল হলে বা হৃৎপেশি শিথিল থাকলে (Hypertrophied Heart)। এই ধ্বনির সময় কমে আসে, সেই সঙ্গে তীব্রতাও (Pitch) হ্রাস পায়।


    হৃৎপিন্ড সংকোচনের পর প্রসারিত হয়। এ সময়ে নিলয়ের মধ্যকার চাপ কমে যায়। মহাধমনী ও ফুসফুসীয় ধমনী দিয়ে যে রক্ত বেরিয়ে গেছে তা যেন আবার সেই পথে ফিরে আসতে না পারে, এ জন্য দু’টি  ধমনীর মুখে রয়েছে দু’টি পাহারাদার। অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতির জন্য এদের নাম হয়েছে সেমিনুলার ভালভ্। সেমিলুনার ভালভ বন্ধ হওয়ার ফলে দ্বিতীয় হৃদধ্বনি তৈরি হয়। এই শব্দ হ্রাস ও তুলনামূলক তীক্ষ। অনেকটা ইংরেজি D-U-P-  এর মতো। এ ধ্বনির স্থিতিকাল ০.১ থেকে ০.১৪ সেকেন্ড। আমাদের রক্তচাপের সঙ্গে এই শব্দের তীব্রতা নির্ভর করে। তাই অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা শুধুমাত্র স্টেথোস্কোপের সাহায্যেই রোগীর ব্লাডপ্রেসার সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করতে পারেন।
    সেকেন্ড হার্ট সাউন্ডের পর তৃতীয় হৃদধ্বনি তৈরি হয়। নিলয় প্রসারণের সময় রক্ত প্রবল বেগে অলিন্দ থেকে নিলয়ে আসতে থাকে। রক্তের এই গতির জন্য হৃৎপেশিতে যে কম্পন হয় সেটাই তৃতীয় হৃদধ্বনি। সাধারণভাবে এ শব্দ স্টেথোস্কোপে শোনা যায় না। তবে ফোনোকার্ডিওগ্রাফ (Phono Cardiograph)  বা অসিলোগ্রাফে (Oscillograph)  ধরা পড়ে। থার্ড হার্ট সাউন্ড ০.০৪ সেকেন্ড পর্যন্ত থাকে। হার্ট ফেলিওর (Heart Failure) , মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন (Myocardial Infraction)  ও আরো কিছু রোগের ক্ষেত্রে এ শব্দ শোনা যায়। প্রথম হৃদধ্বনির ঠিক আগেই চতুর্থ  হৃদধ্বনি সৃষ্টি হয়। ফোর্থ হার্ট সাউন্ডও স্টেথোস্কোপে শুনতে পাওয়া যায় না।

    এসব ছাড়াও হৃদয় থেকে কোনো কোনো সময় অস্বাভাবিক কিছু শব্দ পাওয়া যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে মার্মার (Murmur) বলে। অত্যধিক ব্যায়াম, রক্তাল্পতা (Anaemia), থাইরোটক্সিকোসিস (Thyrotoxicosis)  প্রভৃতি কারণে মার্মার শোনা যায়।
    মার্মার বিভিন্ন রকমের হয়। রোগীর দেহে অতিরিক্ত রক্তাল্পতাতে তার হৃদ্যন্ত্রে যে মার্মার শোনা যায়। শোনা যায় তাকে বলে অ্যানিমিক মার্মার (Anemic Murmur)| । হৃৎপিন্ডের মহাধমনীর মুখে অর্ধচন্দ্রাকার কপাটিকা বা অ্যাওর্টিক ভাল্ভ রয়েছে। অ্যাওর্টিক ভালভ ত্রুটিপূর্ণ হলে তার মধ্যে দিয়ে রক্তপ্রবাহের সময় শোনা যায় অ্যাওর্টিক মার্মার (Aortic Murmur)। যাদের রিউম্যাটিক হার্টডিজিজ্ রয়েছে, তাদের হৃৎপিন্ড প্রসারণের সময় একরকম গুড়গুড় শব্দ সৃষ্টি করে একে বলে ক্যারিকুম্বস্ মার্মার (Carey-coombs Murrmur), অনেক রোগীর ক্ষেত্রে হৃদয়ের সংকোচন ও প্রসারণের সময় মৌমাছি গুঞ্জনের মতো একটানা শব্দ বা কনটিনিউয়াস মার্মার (Continuous Murmur) শোনা যায়। পালমোনারি হাইপারটেনশন বা ফুসফুসে উচ্চরক্তচাপ ও হৃদযন্ত্রের কপাটিকা সংকুচিত হওয়ার ফলে গ্র্যাহাম স্টিলস্ মার্মার (Graham Steel’s Murmur)  সৃষ্টি হয়। মহাধমনীর ভেতর রক্তের পরিমাণ কম থাকলে যে কর্কশ শব্দ চিকিৎসকের কানে ধরা পড়ে তাকে সিগাল মার্মার (Seagull Murmur) বলে। শিশুদের হৃদযন্ত্র সংকোচনের সময় মাঝে-মধ্যে ঘর্ঘর শব্দ শোনা যায় এর নাম স্টিলস্ মার্মার (Still’s Murmur)। এছাড়াও আরো বহুপ্রকার মার্মার রয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে হৃদরোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকেরা এসবের ওপর যথেষ্ঠ গুরত্ব দেন।
    এতক্ষণে পাঠকেরা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে, বুকের গভীর থেকে উঠে আসা ধুক্-পুক্ ছন্দ- সাধারণভাবে হৃদয়ের সংকোচন-প্রসারণের ফলে পেশির ঘর্ষণ শব্দ নয়। হৃদযন্ত্রের ভেতরে থাকা চারটি ভালভ বা কপাটিকা বন্ধ হওয়ার সংকেত। সহজভাবে বলতে গেলে ধুক্-পুক্ হ’ল হৃদয়ের বিভিন্ন ঘরের জানালা-দরজা খোলা-বন্ধের আওয়াজ। কবিগুরু তাঁর ‘সোনারতরী’ কাব্যগ্রন্থে বলেছেন-
‘‘ রাত্রি দিন ধুক ধুক হৃদয়পঞ্জর-তটে।
অন্তরের ঢেউ,
অবিশ্রাম বাজিতেছে সুগম্ভীর সমতানে
শুনিছে না কেউ।’’

    ঘটনাটি তা নয়, ডাক্তারবাবুদের সন্ধানী মনে অন্দোলন জাগায় এই অন্তরের ঢেউ। ভালো শিকারি যেমন শুনে বুঝতে পারে- বাঘ না বাঘিনী ডাকছে? জন্তুটি কত দূরে আছে? অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা সেভাবেই স্টেথোস্কোপের সাহায্যে কান পেতে রোগীর হৃদয়ের বিভিন্ন অসুখ- বিসুখের হদিস পান। তবে হ্যাঁ, এরজন্য অবশ্যই থাকতে হবে রোগী ও তার পরিবারের প্রতি মমত্ববোধ, সহানুভূতি। আর মৃত্যুকে জয় করার আমৃত্যু দুর্জয় বাসনা। তা না হলে কাগুজে মুদ্রার খসখসানিতে চাপা পড়ে যাবে হৃদয়ের সব কলতান।

Join our mailing list Never miss an update