প্রায় চার দশক আগে আকাশগঙ্গার বালুচর ধরে শুরু তার পথচলা । দিক চক্রবাল দিয়েছিল মায়াভরা ছায়া ছায়া আদুরে আলাপ। অনেক আকাশ তাদের তারকা- রবি- শশী নিয়ে আলোকময় ক’রে রেখেছে একলা পথিকের চলার পথ। সেই সূর্যস্নাত যাত্রাপথের গোধূলিবেলায়; পথিক মনের সিংহাবলোকন। আড্ডা উৎসারিত ব্যতিক্রমী জীবনের সে উপাখ্যান- আজ অক্ষরবন্দী।
সম্পাদনা- অনুপম আচার্য; আইনজীবী উচ্চন্যায়ালয়, কোলকাতা। উচ্চতম ন্যায়ালয়; নিউদিল্লী।
গ্রন্থনা- উৎপল মৈত্র; কোলকাতা।
ডুয়ার্সের বানারহাট নিবাসী চিকিৎসক ডাঃ পার্থপ্রতিম বৃহস্পতিবার শিলিগুড়ি বেঙ্গল সাফারি থেকে একটি শকুন দত্তক নিলেন। বাড়িতে তিনজন সদস্য। শিক্ষিকা মা ও চিকিৎসক বাবার সাথে রয়েছে পুত্র সন্তান সাম্য। সে পরিবারে এবার আরেকজন যুক্ত হল- জটায়ু বসু। জটায়ুকে পেয়ে খুশির হাওয়া পরিবারের সকল সদস্য ও সদস্যাদের মধ্যে। জটায়ু সে অর্থে মানব শিশু নয়। হিমালয়ান গ্রিফান ভালচার, অর্থাৎ হিমালয়ান শকুন। এটি প্রধানত হিমালয় ও তিব্বতীয় মালভূমি অঞ্চলে দেখা যায়। শকুনের মধ্যে যেসব প্রজাতি বহু আগে এই পৃথিবীতে এসেছে হিমালয়ান গ্রিফান তাদের মধ্যে অন্যতম। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার অনুসারে এটি লাল তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ এটি বিলুপ্তির পথে চলেছে। উত্তরবঙ্গ বন্যপ্রাণী উদ্যান বেঙ্গল সাফারি থেকে পার্থপ্রতিমবাবু এই পাখিটি দত্তক নেন। বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন্যপ্রাণী দপ্তরের পক্ষ থেকে তাঁর হাতে দত্তক সংক্রান্ত নথিপত্র ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য সৌজন্যমূলক উদ্যান প্রবেশ পাশ তুলে দেন। ভারত ছাড়াও নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান প্রভৃতি দেশে এর এক সময় অবাধ বিচরণ ছিল। বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাপক হারে এই প্রজাতির পাখির মৃত্যু হয়। বিশেষত গবাদি পশুর মাংস খাওয়াই এর মৃত্যুর কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন। গবাদি পশুর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ড্রাই ক্লোরোফিন ঔষধ-ই এর মৃত্যুর কারণ।
শকুন পাখিটিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক কুসংস্কার রয়েছে। হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ দেবতা শনি মহারাজের বাহন হলেও পাখিটি সেভাবে মান্যতা পায়নি। বিশেষত মহাভারতের চতুর শকুনিমামার কল্যাণে এই পাখিটি অনেক ক্ষেত্রেই গালিগালাজের স্তরে স্থান পেয়েছে। তবে রামায়ণের সেই পাখিটি; যে কিনা নিশ্চিত পরাজয় জেনেও মহাবীর রাবণের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে জীবন দিয়ে লড়েছিল জটায়ু। ভারতীয় জনমানসে আজও স্মরণীয়। পৌরাণিক গবেষকদের মতে জটায়ু শকুন বা মতান্তরে বাজপাখির শ্রেণীভুক্ত। দত্তকপিতা পার্থপ্রতিম বলেন- ‘বর্তমানে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক আকাশে নৈতিকতাহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের অবাধ বিচরণ। তাদের ন্যক্কারজনক কান্ডকারখানা নিত্যদিন সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জটায়ুর মতো সংগ্রামী যুবসমাজের বিশেষ প্রয়োজন। তাই নতুন সদস্যের নাম রাখা হয়েছে ‘জটায়ু’। পার্থপ্রতিম ডুয়ার্সে জনমানুষের চিকিৎসার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান সাংবাদিকতা ও বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্ম করে চলেছেন। এই বিষয়ে তিনি জাতীয় স্তরেও পুরস্কৃত হয়েছেন। জটায়ুর বর্তমান মা বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সুকন্যা বসু বলেন, আমি নতুনভাবে মা হতে পেরে খুবই আপ্লুত। শকুন ঘিরে অনেক কুসংস্কার রয়েছে, যদিও এই পাখিটি আমাদের বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেমে টার্সিয়ারি কনজিউমার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাত্র সাম্য বসু জানান- ‘আমি এক ব্যতিক্রমী দাদা হয়েছি। আমার খুশির সীমা নেই। আমার বন্ধুবান্ধবদের এমন সুযোগ নেওয়ার জন্য অনুরোধ রাখব।’ এর প্রসঙ্গে এই বন্য উদ্যানের আধিকারিক মৌসুমী মুখার্জি ও এডুকেশন অফিসার সঙ্গীতা জানান, শকুন দত্তক নেওয়ার উদ্যোগ বন্য প্রাণ ও মানুষের মধ্যে মেল বন্ধনকে সুদৃঢ় করবে। চোরাশিকার ও বন্যপ্রাণীর দেহের বিভিন্ন অংশ নিয়ে যে চোরা কারবার চলছে তা বন্ধ করার ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রয়াস ফলপ্রসূ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
♦ ♦ ♦
ডঃ অমিত কুমার দে; কবি- গবেষক, প্রধান শিক্ষক - দাদা তো এমনই হওয়া উচিত! দূর থেকেও আগলে রাখার একটা পাহাড়ি ছায়া! ভাই কথা না শুনলেও সুযোগ হলেই বুকে টেনে নেওয়া! আর অপরিসীম স্নেহে আদরে অনুজের সৃষ্টিকে নিজের করে নেওয়া! ডুয়ার্সে আমার তিন দশকের বসতির প্রায় পুরোটা জুড়েই এই ব্যতিক্রমী মানুষটি। আমার দাদা পার্থপ্রতিম। সেই পার্থদা আমার কাছে একটা আলো, সত্যিকারের আলো, যিনি প্রজেক্টর আর সহযাত্রীদের নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন মানুষকে বিজ্ঞান বোঝাতে, কুসংস্কার দূর করতে। নিতান্ত সাধারণের কাছে কত জটিল কথা, জলের মতো সহজ করে বলে দিচ্ছেন। আমি বারবার মনে মনে নতজানু হয়েছি তাঁর কাছে। পথ বদলের কত আঁকবাঁক যে তিনি হাঁটলেন। কখনো কখনো আমার তাঁকে বড্ড অচেনাও লাগে! কিন্তু খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর যান্ত্রিক জগত থেকে চলে এলেন চিকিৎসায়। বাগবাগিচার দেহাতি মানুষেরা তাঁর রোগী। তিনি সেবা করেন। তাদের পরমাত্মীয় হন। পার্থদা আমার কাছে এক আধুনিকতম মানুষও বটে। যখন কম্পিউটার এলো, তিনি কত অনায়াসে তা আয়ত্ত করে নিলেন। ডিজিটাল ভুবনকেও মুঠোয় ধরে ফেললেন নিমেষে। আর মন খুলে ভালোবাসেন ডুয়ার্স, তাঁর জন্মমাটিকে। ‘ডুয়ার্স দিবস’ তাঁর ভাবনার ফসল। আমাকে দিয়ে তার থিম সং লিখিয়েছেন। আমার ডুয়ার্সে, আমাদের ডুয়ার্সে তিনি এক বিরল মানুষ। তিনি শকুন পাখিকে দত্তক নিয়ে প্রাণ খুলে জানাতে পারেন। অনুজের কবিতা কন্ঠে নিয়ে উদাত্ত আবৃত্তি করতে পারেন। আর অবিরাম খুঁজে যেতে পারেন নতুন নতুন পথ। আমার গর্ব হয়, আমি ডাক্তার পার্থপ্রতিমের ভাই।
♦ ♦ ♦
তিনি যেমন একদিকে জীবন্ত প্রাণীকে দত্তক নিয়েছেন, সেভাবেই তিনি মনে মনে দত্তক নিয়েছেন প্রাণহীন পার্থিব বিষয়কে। ডায়নার একটি শাখানদীর নাম রাঙাতি। শীর্ণধারা ঘন শ্রাবণে কুলু-কুলু ধ্বনি তোলে। বানারহাট ব্লক এলাকার চা- বাগিচায় ও পল্লীগাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যায় এই ‘‘আমাদের ছোটো নদী’’- টি। সেই রাঙাতিকে তিনি মনে মনে দত্তক নিয়েছেন। ছুটি-ছাটার দিনে তিনি দু-একজন সঙ্গী সাথী নিয়ে পৌঁছে যান রাঙাতির তীরে। তার দলবল পরিষ্কার করে রাঙাতির পাড়ের পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী। কুড়কুড়ে, চিপ্সের প্যাকেট, শীতল পানীয় ও বিয়ারের বোতল। রাঙাতি নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। ইতিমধ্যেই এই শাখানদীর প্রকৃত দৈর্ঘ্য, বার্ষিক জলপ্রবাহের গড়মাত্রা, নদীর ওপরে থাকা ব্রিজ বা সাঁকোগুলির সমীক্ষা, রাঙ্গাতির বিভিন্ন মানচিত্র, স্যাটালাইট ম্যাপ, অ্যালুভিয়াল ফ্যান, ভূগর্ভস্থ জলের ধারা এসব বহু তথ্য জোগাড় করে ফেলেছেন। তিনি চাইছেন রাঙাতিকে ঘিরে পল্লী সমবায় ভিত্তিতে ওয়াটার পার্ক, নৌকাবিহার আরো বহু কিছু গড়ে তুলতে। যেখানে স্থানীয় যুবক-যুবতীদের জন্য থাকবে কর্মসংস্থান ও জলাশয়কে ঘিরে গড়ে উঠবে সুন্দর বাস্তুসংস্থান। আশেপাশের মানুষদের সাথে সে বিষয়ে আলাপ- আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই তার কাব্য জগতে বহুভাবে ফিরে এসেছে তার কন্যা রাঙাতি। তার প্রিয় বন্ধু অপু পালের বিয়োগে তিনি শোক কাব্যে লেখেন-
‘‘অপুরে হয়তো এখন তারার দেশেতে তুই
রাঙাতির তীরে ধূসর সন্ধ্যা নামে,
ফেলে আসা সব আড়ি ভাব খুনসুটি
বন্দি হয়েছে কালরাত্রির খামে’’।
চা-বাগিচার কর্মসংস্হান সংকটের বেদনা কখন যেন মিশে যায় রাঙ্গাতির বুকে। গীতিকার পার্থপ্রতিম লেখেন-
‘‘রাঙাতির বুকে নামে কালো আসমান
বুধনির কোন দরদ্ হইগেলাক গান
প্রিয়জন দক্ষিণে রুটির খোঁজে,
তার ব্যথা বিরহিণী শালিক বোঝে।’’
বহু ভারতীয়ের দিনটি শুরু হয় ধূমায়িত চায়ের পেয়ালায়। কিন্তু সেই পেয়ালার পেছনে যে বেদনা- বঞ্চনা রয়েছে। তার খবরই বা কে রাখে ? তাই তার কলমে উঠে আসে- ‘‘
বৃষ্টি ধারায়, তার কান্না হারায়
একটি কুঁড়ি আর দুইটি পাতায়
কার দায় কে বা সেই অশ্রু মাপে
ধূমায়িত নাগরিক চায়ের কাপে’’।
আবার কবি লেখেন- চা বাগিচার শ্রমিক পরিবারের শিশুর অস্ফুট কথা। সেখানেও বয়ে যায় রাঙাতি –
‘‘তোর কথাতেই শব্দের আঁকিবুকি
রাঙাতির ধারে জল ছপছপ সুর,
সব রং লাগে সামসীর ঐ মেঘে,
কাছে এসে পড়ে বহুদূর, বহুদূর’’।
♦ ♦ ♦
সুব্রত গুহ; অধ্যক্ষ; আইবি প্রসেস অ্যান্ড টেকনোলজি সলিউশনস; মানাসাস, ভার্জিনিয়া; ইউ.এস.এ- পার্থপ্রতিম আক্ষরিক অর্থেই আমার ছোট-ভাই। ওর দিদি গায়েত্রী আমার স্কুলের সহপাঠী। আমি যখন স্কুল শেষ করে বানারহাট ছাড়ি, পার্থ তখন নেহাত বালক। সেদিনের ছোট্টো পার্থ ধীরে ধীরে বড় হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে একজন বহুমুখি প্রতিভা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে। নিজের পেশার বাইরে যুক্ত আছে সাহিত্য চর্চায় ও বিভিন্ন জনকল্যাণমুলক কাজে। তাই এক কথায় ওকে বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। প্রত্যন্ত ডুয়ার্স অঞ্চলের বাসিন্দা হয়েও ওর পরিচিতি আজ ছড়িয়ে পড়েছে জেলা, রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে। দেশের বহু দূরে থেকেও আমি ওর ব্যাপক কর্মকান্ডের আঁচ পাই। ডুয়ার্সে আমাদের আরো কয়েকজন পার্থপ্রতিম দরকার। এলাকার উন্নয়নের জন্য। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইলো পার্থপ্রতিমের জন্য।
♦ ♦ ♦
পর্ণপ্রতিম- আমার বাবা অন্যরকম এক মানুষ। যদিও আমায় বকাবকি করে, আমি মনে মনে বলি- আমায় জ্ঞান দেয়। ছোটোবেলায় আমি বাবার সাথে বাজারে যেতাম। দেখতাম- বিক্রেতারা হাঁক দিয়ে বাবাকে ডাকছে। বাবা মাছ, মাংস, সবজি নিচ্ছে; কিন্তু পয়সা দিচ্ছে না। আমি এসে বন্ধুদের বলতাম বাবা কে ওরা ফ্রি তে সব দেয়। পরে জানলাম এরা অন্য সময় ক্লিনিকে গিয়ে পয়সা নেয়। বাবা চেম্বার করার ফাঁকে গার্ডেনিং করে, হেল্থ-এনভায়রনমেন্টাল অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম করে। আরও অনেক কিছু। জটায়ুকে (শকুন) দত্তক নিয়েছে। এটা আমার বেশ মজা লেগেছে। বাবা যা -ই করে ১০০% দিয়ে করে। ছোটোবেলা থেকে ফুটবল -এর প্রতি আমার ভীষণ ভালোলাগা। বাবা যদিও এই লাইনের মানুষ নয়, তবু আমায় নিয়ে, আমার ভালোলাগাকে গুরুত্ব দিয়ে বহু কোচের কাছে ছুটে গেছে। বাবার অনেক কাজের ফাঁকে আমার ইচ্ছে কে এভাবে সাপোর্ট করা আমার মনে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিয়েছে।
♦ ♦ ♦
তিনি পেয়েছেন বহু শুভেচ্ছা- সম্মাননা- পুরস্কার। আনন্দলোক পত্রিকার পক্ষ থেকে জনশিক্ষার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ‘সালামবেঙ্গল’ পুরস্কারে তাকে সম্মানিত করে। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বিজ্ঞান পুরস্কার, ভারত সরকারের এন.সি.ই.আর.টি থেকে মেধাপুরস্কার লাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুব কল্যাণ দপ্তরের পক্ষ থেকে সম্মানিত হন। এছাড়াও জাতীয় বিজ্ঞান দিবস ২০০২, জলপাইগুড়ি মহকুমা পরিষদের পক্ষ থেকে বিজ্ঞান সচেতনতা স্মারক সম্মান, নর্থ বেঙ্গল সিনে অ্যাওয়ার্ড ২০১৯, শিলিগুড়ি উত্তরবঙ্গ নাট্যজগৎ এর পক্ষ থেকে গুণীজন সম্মর্ধনা, কিরাতভূমি ও চিকরাশি পত্রিকার স্মারক সম্মান। ৩১তম জলপাইগুড়ি জেলা বইমেলার আমন্ত্রিত বক্তা হিসাবে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় স্মারক ও উত্তরীয়। ২০১৯ এ নভেম্বরে দিল্লীর ঐতিহ্যপূর্ণ কনস্টিটিউশন ক্লাবে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় এপিজে আব্দুল কালাম এক্সিলেন্ট অ্যাওয়ার্ড। এছাড়াও বহু সংবর্ধনা সম্মাননা পেয়েছেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় তাকে নিয়ে ‘উত্তরের নায়ক’ শিরোনামে সুবিশাল প্রবন্ধ লিখেছে সাংবাদিক অনিন্দ্য জানা। বহু সাংবাদিক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার কর্মকান্ড নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। পেয়েছেন বহু মানুষের স্নেহ- শ্রদ্ধা- ভালোবাসা। সেটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় বিষয়। এটাই তার জীবনের পরম প্রাপ্তি।
বিশ্ব মহামারী কোভিডের সময় বহু চিকিৎসকই ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’- এই মন্ত্র মেনে রোগী দেখা বন্ধ করেছিলেন। সেই মহামারীর সময় যখন সারা বিশ্বের জনমানসে আতঙ্ক, দিশেহারা আট থেকে আশি; সেই বিশ্বসংকটকালে ডাঃ পার্থপ্রতিম তার চিকিৎসালয় একদিনের জন্যও বন্ধ রাখেননি। হাসিমুখে পরিষেবা দিয়েছেন সাধারণ মানুষকে। নিজের জীবনকে বাজি রেখে। তার এই প্রয়াস প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন স্তরে। তার এই মানব দরদী- নির্ভীক হৃদয়কে সম্মান জানাতে কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে, তার হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘বঙ্গ-গৌরব সম্মান।’
সম্মান বা পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতিতেও তিনি ব্যতিক্রমী। এই প্রাপ্তি তাকে আনন্দে উদ্বেল করে নি। বরং তার বাস্তববাদী মনের অকপট প্রকাশ ঘটেছে সেক্ষেত্রেও। এই সম্মান গ্রহণের প্রাক্কালে তিনি তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে যে অনুভূতি প্রকাশ করেন-
পুরস্কার নিতে যাচ্ছি মহানগরে। ইতিপূর্বেও বহু পুরস্কার ও সম্মাননা জুটেছে। জীবনের গোধূলিবেলায় এসে উপলদ্ধি করতে পারছি- বাইরে থেকে পাওয়া এইসব পুরস্কারে তেমন কোন আন্তরিকতা মেশানো থাকে না। থাকে না, আমার কাজের প্রতি তাদের হৃার্দিক সমর্থন। যে সব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান পুরস্কার দেন হয়তো সেটাই তাদের প্রথা, দায় বা সোস্যাল কর্পোরেট রেসপন্সসিবিলিটি। পুরস্কার প্রদান করে তারা হয়তো দায় মুক্ত হন। অনেক ক্ষেত্রে স্পনসর সংস্থা বা ফান্ডিং এজেন্সির পক্ষ থেকে হয়তো তাদের কিছু প্রাপ্তিও ঘটে। তাদের দেওয়া স্বনাম খচিত ধাতু ও স্ফটিকের উজ্জ্বল ফলক, মানপত্র ঘরের আলমারির এক কোণে অব্যবহার্য উপকরণ হিসাবে স্থান পায়। এইসব অনুষ্ঠানে পাঁচতারা হোটেলে এখন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর ধোপদুরস্ত, সুন্দরী ললনাদের বলিষ্ঠ যান্ত্রিক পদচারণা। যা আমার মতো গাঁইয়া অনভ্যস্ত মানুষের পক্ষে বেশ অসুবিধাজনক।
তবুও যেতে হয় এইসব মঞ্চে। ধূমায়িত চায়ের পেয়ালায় মিশে থাকা আদিবাসী মানুষগুলির ব্যথা- কান্নার উপাখ্যানকে নাগরিক জনমানসে পৌঁছে দেওয়ার সামান্য সুযোগ; হাত ছাড়া করতে মন চায় না।
তা সে যাই হোক। আমার এই পুরস্কার প্রাপ্তির খবর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর বহু মানুষ বিভিন্ন ভাবে আমাকে আন্তরিক অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানিয়েছেন। তারা কেউ অগ্রজ বয়োজ্যেষ্ঠ, কেউ বা সমবয়সী, কেউ বা অনুজ। আমিও চেষ্টা করেছি সকলকে সাধ্যমতো প্রত্যুত্তর দেওয়ার।
কারণ আপনারা যারা শুভকাঙ্খী রয়েছেন তাদের স্নেহ, ভালোবাসা, আর্শীবাদ, শুভাশিস আমার কাছে বজ্র-মাণিক দিয়ে গাঁথা বিশ্বজয়মাল্য। আপনারা প্রতি নিয়ত আমায় প্রাণিত করেন। তাই আপনাদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা- ভালোবাসা- শুভকামনা। ভালো থাকবেন সকলে . . .
♦ ♦ ♦
ডঃ চন্দন খাঁ; কবি ও অধ্যাপক – ছেলেবেলা থেকেই ভালোবেসেছি প্রকৃতি আর ভানহীন সহজ, সরল এবং সৃজনশীল মানুষদের। পার্থপ্রতিমদাকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই বড় আপন মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল এই মানুষটি আমার বহু দিনের চেনা। মালবাজারে আমার আরেক প্রিয় বন্ধু ইসরাইল স্যারের একটি অনুষ্ঠানে পার্থপ্রতিমদা ও সুকল্যাণদা এসেছিলেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে স্বামী বিবেকানন্দের ভাবনাগত কিছু দিক তুলে ধরবার জন্য। সে উপস্থাপনাটি ছিল আন্তরিক এবং অন্যরকম। তখন থেকেই মানুষটি সম্পর্কে আবেগ ও আগ্রহ গাঢ়তর হতে থাকে। তিনি ডুয়ার্সের প্রকৃতির মতই সবুজ ও প্রাণময়। তিনি এমন এক স্বচ্ছসলিলা পাহাড়ি নদী, যেখানে অবগাহন করতে বারবার মন চায়। আজকের দিনে সবাই যখন একটুখানি কাজ করেন, কিন্তু প্রচার চান অনেকখানি; সেখানে পার্থপ্রতিমদার মত মানুষেরা ঠিক তার উল্টোটা করেন। অর্থাৎ কাজ করেন অনেকখানি এবং অনেক রকম। কিন্তু প্রচারের সার্চ লাইট থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। মনে আর মুখে এক থাকা মানুষেরা দিন দিন চারপাশ থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন। এরকম একজন সদানন্দময়, বহু গুণান্বিত ও বর্ণময় মানুষ আমার দাদা, আমাদের পড়শি তথা মনের মানুষ।
♦ ♦ ♦
আমি তার নিমগ্ন পাঠক। তার লেখা ‘বিশ্বাসঘাতক’ অনেকের মতো আমার কাছেও বাংলা সাহিত্যের এক বিরল সৃষ্টি। আমার বই “হৃদয়ের কথা”-র তিনি মুখবন্ধ লিখেছেন, সাথে ছবিও এঁকে দিয়েছেন। সেই সূত্রে, তার সাথে দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কলকাতায় গেলে তার চক্রবেড়িয়া রোডের বাড়িতে মাঝে মধ্যে যেতাম। একবার নারায়ণ দা বললেন- ‘তুমি তো চায়ের দেশের লোক। আমাকে তোমাদের ওখানকার চা খাইও তো।’ আমি কথা দিলাম এর পরের বার যখন জানুয়ারীতে আসবো, তখন আপনার জন্য চা-পাতা নিয়ে আসবো।
আমার একটা বদ-স্বভাব আছে। ঘর গৃহস্থালির নানান প্রয়োজনীয় কথা আমি ভুলে যাই। যথারীতি কলকাতায় পৌঁছে আমার মনে পড়ল নারায়ণদা চা নিয়ে আসতে বলছিলেন। আমি তো ভুলে গেছি চা নিয়ে যাওয়ার কথা। কী করা যায় ? কী করা যায় ? শিয়ালদাতে টস-টি কোম্পানীর একটি ভালো দোকান ছিল। আমি সেখান থেকে এক কেজি ডুয়ার্স সিটিসি চা কিনে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে প্যাক করি। তারপর আমার ব্যাগের মধ্যে থাকা উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকা দিয়ে ভালো করে মুড়ে নারায়ণদার বাড়িতে গিয়ে তাকে দিই।
দিন পাঁচেক পরেই টেলিফোনে তার সাথে কথা হলো। তিনি জানালেন- “চা টা খুব ভালো ছিল। আসলে বাগানের ফ্রেস চায়ের টেস্ট-ই আলাদা। আমি আমার কয়েকজন আত্মীয়কেও খাইয়েছি। তারাও খুব প্রশংসা করেছে। এরকম চা কোলকাতায় পাওয়া যায় না।”
নারায়ণদা আজ আমাদের মাঝে নেই। হয়তো তিনি নিপাট ভালো মানুষ ছিলেন বলে আমার চা খেয়ে তার এমন অনুভূতি হয়েছে। তবে তার মতো সৃজনশীল ভালো মানুষের সাথে যে মিথ্যাচার আমি করেছি, তার জন্য মাঝে মাঝে আত্মগ্লানি অনুভব করি। এটা তারই স্বীকারোক্তি।
♦ ♦ ♦
কোন এক বর্ষা রাতের শেষে চা- বাগিচার সবুজ গালিচায় আছড়ে পড়ে সোনা রোদের আভা। আকাশে তুলো মেঘের ভেলা, বুকের ভেতর ঢ্যাং-কু-রাকুর বাদ্যি বাজে। শরৎকালে !
আসলে ডুয়ার্সের অর্থনীতির সাথে শরৎ- এর এক বিশেষ যোগ রয়েছে। এটা প্রায় চা- বাগিচার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই। দুর্গাপূজোর প্রাক্কালে চা- বাগিচাগুলোতে বোনাস দেওয়া হয়। অর্থাৎ, সারাবছর যে পরিমাণ টাকা কোম্পানী থেকে কোনো চা শ্রমিক বেতন হিসেবে পেয়েছে, সেই বেতন থেকে শতাংশ হারে বোনাস চা বাগান কর্মীদের বাড়তি পাওয়া হয়। তাই, পূজো মানেই এক ঝকঝকে সুন্দর আমোদ- মুখর উৎসব। আসলে আনন্দ বা উৎসবের সাথে বাণিজ্য-অর্থনীতির একটা সম্পর্ক চিরকালই রয়েছে। আগে বিভিন্ন ভাবে অপ্রকাশিত ছিল এই সম্পর্কগুলি। এখন ব্যাপারটা অনেকটাই খোলামেলা। যে কোনো উৎসব মঞ্চে গেলেই দেখা যায় বিভিন্ন স্পন্সারে কোম্পানীর ফ্লেক্স- ফেস্টুন- ডিসপ্লে বোর্ড।
এমনই এক শরৎ দিনে মা-বাবা তার বাচ্চা নিয়ে আমার চেম্বারে হাজির। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমার মুখোমুখি চেয়ারে চলে এল মা- বাবা আর বছর চারেকের একটা ছেলে। মায়ের মুখটা চেনা চেনা লাগছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম- কারে, বাবুকর চিঠা কাহা (বাচ্চাটির প্রেসক্রিপশনটি কোথায়)? আসলে, আমরা যখন কোনো রোগী দেখি, তখন রোগের বিস্তারিত বিবরণ– জ্বর, ওজন, বয়স, কার্ডিওরেসপিয় রেসিয়ো আরোও কিছু তথ্য প্রেসক্রিপশনে নথিভুক্ত করে প্রেসক্রিপশনটি রোগীকে দেওয়া হয়। পরের বার আসলে ঐ প্রেসক্রিপশনটি দেখা হয়। তাতে কি হয়, আমরা যখন আবার দ্বিতীয়বার দেখি তখন রোগীর বিভিন্ন শারীরিক হিসেব নিকেশ বা হেল্থ প্যারামিটারগুলির তুলনামূলক বিচার করতে পারি। এর আরও একটা সুবিধা রয়েছে। আমাদের ওষুধে যদি কোনো রোগী সুস্হ না হয়ে ও অন্য কোনো চিকিৎসকের দ্বারস্হ হয়, সেক্ষেত্রে ওই চিকিৎসক সহজেই বুঝে ফেলবেন রোগীর আগে কী ধরনের চিকিৎসা হয়েছে। রোগীর শারীরিক বিষয়গুলি কেমন, কী উন্নতি হয়েছে বা অবনতি ঘটছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কারে, বাবুকর চিঠা কাহারে ? (কী হয়েছে, বাচ্চাটির প্রেসক্রিপশনটি কোথাও?)
মা জবাব দিল – ইকর চিঠা তো নখে, (এর প্রেসক্রিপশন তো নেই )। ইকে তো ময় নি দিখালো, ( এই বাচ্চাকে আমি দেখাইনি )
আমি আবার বললাম- তোকে দেখল জেইসন লাগি, (তোমাকে দেখা দেখা লাগছে) ।
মা বললেন –হা, হা, ময় আইরহ, দুসরা বাচ্চা কে লেইকে (হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি এসেছিলাম, অন্য বাচ্চাকে নিয়ে)।
আমি আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম- উ বাচ্চাঠো কেসন আহে এখান? (সেই বাচ্চাটি কেমন আছে এখন?)
মা বলল- তোর সে দবাই লেইকে গেল না ময়, উকর দো দিন বাদ উ বাবু শিরাই গেলাক্ (তোমার কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে যাওয়ার দুই দিন পর সেই বাচ্চাটি মারা গেছে)।
আসলে সে তার এক বাচ্চাকে নিয়ে এসেছিল আমার কাছে। আমার ওষুধ খাওয়ার পর দু’দিন পরে সে বাচ্চাটি মারা যায়। তারপর কোনো রাগ, অভিমান, অভিযোগ না জানিয়ে আবার পরের বাচ্চাটিকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে. . .।
♦ ♦ ♦
এতোয়া মুন্ডা। রেডব্যাঙ্ক চা- বাগিচায় তাদের বাড়ি। দুপুর বেলা লাঞ্চ ব্রেকের সময় হয়ে গেছে, যাওয়ারও তাড়া। এইসময় বড়সড় এক বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাজির এতোয়া। ব্যাগটা রাখল আমার টেবিলের পাশে। আমার চেম্বারে মাঝে মাঝেই আসে বউ- বাচ্চাকে নিয়ে। তবে ব্যাগ এনে পাশে রাখার ব্যাপারটা আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। ব্যাগের ভেতর হাত চালিয়ে আসামী লতা এক একটা করে বের করে আমার চেম্বারে রাখতে শুরু করল। ওর ওই কান্ড কারখানা দেখে বিরক্তি থেকে আমার রাগও উঠে গেল। আমার এক গুরুদেব বলেছিলেন- রাগ এলে একটা শব্দকে মনে করতে হবে ‘ওয়েট’। আমি সচরাচর তা মেনে চলি । যাই হোক, রাগের সময় এই ‘ওয়েট’ কথাটি মনে রাখি এবং এতোয়ার কান্ডকারখানাটি ‘ওয়েট’ বা অপেক্ষা নিয়ে দেখছি। ব্যাগের বা থলের মাঝামাঝি অংশ থেকে মুরগির ডিম এনে এনে সযত্নে আমার টেবিলে রাখা শুরু করল। গোটা নয়েক ডিম আমার টেবিলে রাখল।
সে বলল- ডাক্টার, বহত দিন সে সোচতরাহো (ডাক্তার, অনেকদিন থেকে ভাবছিলাম আমি),
কি ময় তোকে মোর ঘরকর মুরগিকার আন্ডা খিয়াবু (তোমাকে আমার ঘরের মুরগীর ডিম খাওয়াবো)।
কা করবু ময় (কি করবো আমি)?
মোর যে নাতিন আহে (আমার যে নাতিন আছে),
উ মোর বড়কা বেটা কার বেটা (সে আমার বড় ছেলের ছেলে),
উকার উমর চাইর সাল (তার বয়স চার বছর),
উকে আন্ডা ইতনা আচ্ছা লাগেলা, কি জাহাভি উকে মুরগি কর আন্ডা দিসেইলা ( ওর ডিম এত ভালো লাগে যে ও যেখানেই মুরগীর ডিম দেখে),
খাইয়েকলে উছলেলা (খাওয়ার জন্য লাফায়)।
ব্যাগ কর ভিতরে পাতাই সে লুকাইকে এতনা বুদ্ধি কইরকে তোরলে আন্ডা লাইনহো (ব্যাগের ভেতর পাতা দিয়ে লুকিয়ে অনেক বুদ্ধি করে তোমার জন্য ডিম নিয়ে এসেছি)।
ওর নাতি ডিম ভালোবাসে। ও ওর নাতিকে বড্ডো ভালোবাসে। তবুও এতোয়া সেখান থেকে বাঁচিয়ে আমার জন্য নিয়ে এসেছে। আমার রাগ, বিরক্তি কেমন যেন পাল্টে গেল। মনে হলো- টেবিলের ওপরে রাখা লালচে সাদা ডিমগুলি আমার দিকে দাঁত বের করে হাসছে।
♦ ♦ ♦
আমার চেম্বারটা বানারহাট মূল সড়কের গা ঘেঁষেই। রেলের ক্রসিং গেটে ওঠার আগে একটা রাস্তা চলে গেছে রেল স্টেশনের দিকে। রাস্তাটির নাম স্টেশন রোড। স্টেশন রোডে ঢোকার মুখেই আমার ক্লিনিকটি। রেলগেট পার করে পুবপানে গেলেই চামুর্চী মোড়। আর পশ্চিমে জাতীয় সড়ক লাগোয়া এল.আর. পি মোড়।
সে বছর বিশেক আগের কথা। তখন টোটোর দৌরাত্ম্য ছিল না। এদিক ওদিক যাওয়ার ক্ষেত্রে রিকশাই ছিল ভরসা। সেদিন সকাল থেকেই হঠাৎ করে বৃষ্টি পড়ছে। রেইনকোটটাও দীর্ঘদিনের অনাদরে মলিন বিবর্ণ। আমি আমার এই এম-৮০ বাইকটি না এনে ছাতা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম চেম্বারে। বর্ষাও বিদায় নিল কয়েক ঘন্টার মধ্যে। আমি ছাতা রেখে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছি দুপুরের দিকে। হঠাৎ শুক্রার সাথে দেখা। শুক্রা রিক্সা চালায়। অসুখ বিশুখ হলে ছেলে মেয়েদের নিয়ে আমার চেম্বারে আসে, শুক্রা রিক্সা নিয়ে আমার কাছে দাঁড়াল। রিক্সায় দুজন সাওয়ারি। মনে হল নব বিবাহিত স্বামী- স্ত্রী। তাদের কিছু ব্যাগ-পত্রও আছে। স্কুল গেটের কাছে এসে শুক্রা আমাকে দাঁড়াতে বলল।
সে বলল- রুক, তোকে ময় লেইকে যাবু (দাঁড়াও, আমি তোমাকে নিয়ে যাবো)।
শুক্রা ওই দম্পতিদের জানিয়ে দিলেন- ময় হাইরোড অউর নি যাবু (আমি আর হাইরোড যাবোনা)। তোকে অউর পয়সা দেওয়েক নি পড়ি (তোমাকে পয়সা দিতে হবেনা)।
দম্পতিরা ভ্যাবাচ্যাকা। মুখ দেখে আমারও চেনা চেনা মনে হচ্ছেনা। শুক্রার বক্তব্য- মোর ডাকটার প্যায়দল যাথে (আমার ডাক্তার পায়ে হেঁটে যাচ্ছে)। ময় তোকে লেইকে যাইকে কা করবু (আমি তোমাকে নিয়ে গিয়ে কী করব) ? তয় প্যায়দল চইল যা, নইতো দুসরা রিক্সা পকইড়কে চইল যা ( তোমরা পায়ে হেঁটে চলে যাও, আর নয়তো তুমি অন্য রিক্সা ধরে চলে যাও)।
আমি শুক্রাকে কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করলাম স্কুল মাঠের ভেতর দিয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে যাবো। শুক্রা কিছুতেই মানল না। ডেলি কিস্তির রিক্সা, মাঝ রাস্তায় রেখে হাঁটা দেওয়ার উপক্রম। অনেক অনুনয়- বিনয় করে একটা শর্তে ওকে রাজী করানো গেল। শুক্রা আগে ওই ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাকে হাইরোডে পৌঁছে দিয়ে আসবে, তারপর আমি ওর রিক্সা চড়ে বাড়িতে যাবো। ততক্ষণ আমি হাইস্কুলের গেটে আছি। যাক্ কিছুক্ষণের মধ্যেই শুক্রা তাদের হাইরোডে দিয়ে আবার ফিরে আসল। তারপর আমায় বাড়িতে পৌঁছে দিল। মুখে তার যুদ্ধ জয়ের হাসি। কুচকুচে কালো, পাকমারা নিগ্রোয়েড অবয়বের মধ্যে তার ওই স্যাঁতলা পড়া দাঁতগুলি ছড়িয়ে দিল সহস্রাধিক হাসিভেজা ফুল ।
♦ ♦ ♦
দিল্লীতে যাচ্ছি, এ.পি.জে আবদুল কলাম গোল্ড স্টার এক্সিলেন্ট অ্যাওয়ার্ড আনতে। নিউ দিল্লীর ঐতিহ্যবাহী কনস্টিটিউশন ক্লাবে আমার হাতে তুলে দেওয়া হবে এই সম্মান। উদ্যোক্তারা আমার যাওয়া আসা, থাকা-খাওয়া, সকল ব্যয়ই বহন করবে। বাগডোগরা থেকে দুপুর ১টা ১৫মিনিটে ফ্লাইট। তাই ভাবলাম শুধু শুধু বেশি পয়সা খরচ করে লাভ কী। এখান থেকে গাড়ি না নিয়ে; শিলিগুড়ি পর্যন্ত ট্রেনে চলে যাবো।
জিতুয়া তার ছেলেকে নিয়ে এসেছিল তার একদিন আগে। ওকে ওষুধ দিয়ে বললাম- আমি কিছুদিন থাকবো না।
ও জানতে চাইল- কাহা যাবে (কোথায় যাবে)? কা লাগিন যাবে (কীসের জন্য যাবে)?
ওকে সংক্ষেপে কিছুটা বললাম- আগামীকাল দিল্লী যাচ্ছি। সকালের ইন্টারসিটিতে যাবো।
অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেছে। লেভেল ক্রসিং পার করে ট্রেন স্টেশনে ঢুকবে ঢুকবে। দূর থেকে দেখছি কে একজন ছুটে আসছে। কাছে এল চিনতে পারলাম- জিতুয়া না ? আমাকে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে কাছে এসে গেল। আমার তখন ট্রেনে ওঠার তাড়া। হাতের মধ্যে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল- ইতনা লাম্বা রাস্তা আহে, ভুক তো লাগবে কারি (এত দূরের রাস্তা, খিদে তো লাগবে)। আমি তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠে পড়লাম। জিতুয়াকে পেছনে ফেলে ট্রেন ছুটতে লাগল শ্যামল চা বাগিচার বুক চিরে। ট্রেনে আরাম করে বসে ওর দেওয়া প্যাকেট খুলে দেখি- কয়েকটা লাড্ডু, গোপো ও দুটো বন্ডরুটি রয়েছে। তার একটু ভেঙ্গে মুখে চালান করলাম। অকৃত্রিম ভালোবাসার সস-এ মোড়া এ খাবার অমৃত বলে মনে হল।
আসলে, জিতুয়া তো জানে না, হয়তো কোনোদিন জানবেও না। আকাশপথে দিল্লী মাত্র ঘন্টা খানেক দূর।
♦ ♦ ♦
সে প্রায় বছর পনেরো আগের কথা। ছায়ানীড় সংস্থার ডাকে কোচবিহার গিয়েছি। হার্টের রোগের অডিও ভিস্যুয়াল শো করতে। এর আগেও কোচবিহারে গিয়েছিলাম মহাকাশ নিয়ে অনুষ্ঠান করতে। অনুষ্ঠান শুরু হতে কিছু সময় বাকি। হঠাৎ করে একজন এসে আমায় নমস্কার করলেন। বয়সে অনেকটাই বড় হবেন। বগলে তার একগাদা লিফলেট। বললেন, ডাক্তারবাবু চিনতে পারলেন? ঐ যে অতিথি নিবাসে আপনি প্রোগ্রাম করতে এসেছিলেন। আপনার বলার স্টাইলটা আমার খুব ভালো লাগে, মনে হয় ঘরে বসে গল্প করছি। সে সময় কথা হয়েছিল। আমি তাকে চিনতে না পারলেও একগাল হেসে বললাম- কেমন আছেন? বলল- এই তো, প্রেস থেকে আসছি। আপনাকে নিয়ে আমি একটা কবিতা লিখেছি। ভাবলাম ছাপিয়ে সবাইকে দিই। এক বন্ধুর কাছে ধার চাইলাম, সেও না করল না। তাই আর কি। কোচবিহারের টাকাগাছের নিম্নমধ্যবিত্ত অমল চক্রবর্তীর সেই লিফলেট আমার আজও রয়েছে। ছন্দোবদ্ধ তার লেখা দীর্ঘ কবিতার কয়েকটি লাইন-
“বিশেষ রোগ- ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার,
বাধিলে বাসা ঘটিবে অসুখের প্রসার।/
স্বাস্থ্য সম্বন্ধে প্রয়োজন অধিক সচেতনতা,
রোগমুক্ত জীবন উপভোগ করবে জনতা।/
অসুখ থেকে আরোগ্য লাভের কি উপায় আছে?
এসব জানব ডাক্তার পার্থপ্রতিম বাবুর কাছে।”/
♦ ♦ ♦
আমাদের বাড়ি বানারহাট আদর্শপল্লীতে। বাড়িতে কাকু, দিদি, ভাই, দাদা নিয়ে বিরাট যৌথ পরিবার। অশীতিপর ঠাম্মা পরিবারের মাথা। ২২টি চা বাগানের বন্দর মফস্বল বানারহাট। আমি তখন ক্লাস সেভেন বা এইটের ছাত্র। আমাদের বাড়ির সামান্য দূরে রেল লাইনের ওপারে বানারহাট চা-বাগান। সেখানে থাকত সঞ্চরিয়া ভগত। আমার বাল্যসখী। ডাগর কালো মায়াবী চোখের সাথে, মাথায় এক রাশ বাবরি চুল। সারাবেলা ওদের সাথে চলতো হরেক খেলা। দাড়িয়াবান্ধা, পিট্টু, উঁসিকুসি আরো কত কী। আমি ওকে ডাকতাম ‘সঞ্চি’ বলে। সে সময় বানারহাট বাগানের চিকিৎসক ছিলেন ডাঃ বীরেন্দ্র মোহন রায়নাথ। আমার কাকাবাবু ডাঃ এ. কে. বোস এই এলাকার পরিচিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। ডাঃ রায়নাথ প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। সেই সূত্র ধরে আমরা তাকে রায়নাথ কাকু বলে ডাকতাম। তার সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। একদিন সঞ্চি অসুখে পড়ল। ক’দিন পরে হঠাৎ শুনলাম ওর অবস্থা খুবই খারাপ। স্কুল থেকে এসে হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই ভাঁটিবন, রেললাইন টপকে হাজির হলাম সঞ্চিদের বাড়িতে। গিয়ে দেখি ওর বাড়ির লোকজন বিভিন্ন রকম ধূপধুনো জ্বালিয়েছে, ঝাড়ফুঁক করছে। ওর অবস্থা এমনই খারাপ যে; সঞ্চি আমাকেও চিনতে পারছে না। চোখ দুটি স্থির। আমি ছুটলাম রায়নাথ কাকুর বাড়ি। কাকুকে কোনমতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। অনেক জোরাজুরির পর কাকু নিমরাজী হলেন। আমি কাকুর ব্যাগ নিয়ে আগে আগে ছুটছি। কাকু পেছনে সাইকেলে আসছেন। শেষে কাকু সঞ্চির বাড়িতে পৌঁছালেন। সব দেখেশুনে কাকু একটা ইনজেকশন দিয়ে বললেন- “এখানে আর কিছু করার নেই। বড্ডো দেরী হয়ে গেছে।”
আজ যখন কুসংস্কার, স্বাস্থ্য, পরিবেশ নিয়ে কোন অনুষ্ঠান করি; তখন মনে হয় আমার সঞ্চি, আমার পাশেই . . .
(শেষের কথাগুলি সেভাবে শোনা গেল না। গলাটা কেমন বুজে এলো . . . অপলকে দূরের আকাশ পানে চেয়ে রইল, এক চিরহরিৎ মনোপথের পথিক . . .)
♦ ♦ ♦