প্রায় চার দশক আগে আকাশগঙ্গার বালুচর ধরে শুরু তার পথচলা । দিক চক্রবাল দিয়েছিল মায়াভরা ছায়া ছায়া আদুরে আলাপ। অনেক আকাশ তাদের তারকা- রবি- শশী নিয়ে আলোকময় ক’রে রেখেছে একলা পথিকের চলার পথ। সেই সূর্যস্নাত যাত্রাপথের গোধূলিবেলায়; পথিক মনের সিংহাবলোকন। আড্ডা উৎসারিত ব্যতিক্রমী জীবনের সে উপাখ্যান- আজ অক্ষরবন্দী।
সম্পাদনা- অনুপম আচার্য; আইনজীবী উচ্চন্যায়ালয়, কোলকাতা। উচ্চতম ন্যায়ালয়; নিউদিল্লী।
গ্রন্থনা- উৎপল মৈত্র; কোলকাতা।
অন্য আর দশটা বাঙালী ছেলে- ছোকরার মত তিনি কবিতা লিখেছেন কিশোর যুবক বয়স থেকেই। তবে, সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও তিনি মাঝে মধ্যে তা লিখে চলেন। তার অন্তমিল কবিতা বহু মানুষের মন জয় করেছে। কখনও অনু- কবিতা, কখনও দীর্ঘ- কবিতা ছন্দের বন্ধনে তার কলম থেকে উৎসারিত হয়েছে। তার কাব্য সাহিত্যে সবসময় ঘুরে ফিরে এসেছে পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা। তার বেশিরভাগ কবিতার পটভুমি তার ভালোবাসার ডুয়ার্স। এর পাশাপাশি বিশ্বজনীনতাও শব্দময় হয়েছে তার লেখনীতে। তিনি নিজেও কবিতার নিমগ্ন পাঠক। বহু কবির কবিতার ছন্দবদ্ধ লাইন তিনি আলাপচারিতায় যখন তখন উদ্ধৃতি দিতে পারেন। কম্পিউটার গ্রাফিক্স- এ বেশ পারদর্শী। তার অণু- কবিতাগুলির সাথে মানানসই ছবি তৈরী করে সুন্দর পোষ্ট তৈরী করেন। তার দেওয়া নাম ‘ছবিতা’। তার ছবিতা বহু মানুষের হৃদয় অনুভবে ছন্দবদ্ধ পরাগ নিয়ে আসে- ‘‘ওরে ফাগুন কেন আবার আগুন দিলি শিমূলফুলে,/ চোখটি খুলে দেখলি না তো,/ পাক ধরেছে আমার চুলে’’। বিবাহপূর্বে যুবতির মনের কথা তিনি তুলে ধরেন কী- বোর্ডের বোতাম টিপেটিপে। ‘‘বাদল বাতাস আজ ছুয়েছে তোকে,/ এমনদিনে মনটা কী আর চুপটি করে থাকে,/ ভাঙ্গল বুকে ভুঁইচাপার ওই ঘুম,/ তোর জন্য হলুদ বাটা রক্তাক্ত কুমকুম’’। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে শপথের বাণী শোনান- ‘‘বাগময় হোক না বলা, কবিতা ঘুম ভাঙ্গানিয়া গান’’। শৈশবে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি তুলে আনেন চা-বাগিচার বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি। বন্ধ বাগানের আত্মকথা। ‘‘কীরে ভাস্কর মনে পড়ে, সেই বাগানের কথা? চিমনির ধোঁয়া সাইরেনে ভোঁ শ্রমিকের ব্যস্ততা/ এখন স্তব্ধ সেই সব কিছু, বন্ধ কাঁঠালগুড়ি,/ রুজির তাগিদে মোহনের ছেলে, দক্ষিণে দেয় পাড়ি’’। ডুয়ার্সের অন্যতম বড়ো সমস্যা ইলিগ্যাল ট্র্যাফিকিং। বহু কিশোরী ও যুবতী স্বপ্নের মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে হারিয়ে যায় পঙ্কিল পাকচক্রে। নারী পাচার ডুয়ার্সের একটা জ্বলন্ত সমস্যা। পার্থপ্রতিম তার কলমে বলেন- ‘‘বধুয়ার মেয়ে গাল ভরা হাসি, এখনও মনেতে রেশ/ কোনো মায়াবী দিনের স্বপ্নে, আজও সে নিরুদ্দেশ’’। আরও লিখেছেন- ‘‘দারুর ভাটিটি আজও রমরমা, সকাল সন্ধ্যাবেলা/ মৃত্যু যেখানে জীবনের সাথে- চু-কিৎ-কিৎ খেলা’’।
তিনি লেখেন- ‘‘তোর কথাতেই নীরব কোলাহল
হলদে দুপুরে গাং- শালিকের ঠোঁটে
কাহাদের ঘাম অশ্রুর সাথে মিশে
একটি কুঁড়ি, দুটি পাতা নিয়ে ফোটে।’’
কোভিড মহামারীর সময় বহুমানুষই অবসর বিনোদনের জন্য কাব্যসাহিত্য চর্চার পথ বেছে নেন। পার্থপ্রতিমবাবু সে সময় তার ক্লিনিক নিত্যদিনের মত খোলা রেখেছেন। পরিষেবা দিয়েছেন রোগীদের। তবুও তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বিপন্নতা, কর্মহীনতা পরিযায়ী শ্রমিকের দুর্দশা তাকে বেদনাহত করেছে। সেই বেদনা কাব্যিক রূপ পেয়েছে তার লেখনীতে। সেবারও ঢাকে কাঠি পড়েছিল। তিনি লিখছেন- “এবার পূজো অন্যরকম শরতের মা হেমন্তে, পার্বতী ওই আসছে দোলায় অজানা এক ছন্দে/ অন্যরকম চারধারে সব মুখোশ আঁটা মুখ ঘিরে,/ যন্ত্রণাকে ছাঁই চাপা দিই জীবন নদীর কোন তীরে??”/ শম্ভূদাদা ফোস্কা পায়ে পথ হেঁটেছে অনন্ত/ মানুষও হয় পরিযায়ী সে কথা কী সে জানত??/ পাঁচ বাড়িতে গতর খাটা লাইন পাড়ে টেপির মা, ভাইরাসেতে ভাত কেড়েছে কী করবে আজ এই উমা??/ ছাঁটাই শ্রমিক রহিম চাচা অলস দুপুর আদুল গা, তার কানেতেও আলোকবেণু বাজায় নাকী মা দূগ্গা??/ রিনার বেটি নষ্ট মেয়ে, আঁধার গলির শেষধারে/ সাঁজবেলাতে সাজুগুজু, বাবুরা সব হাত নাড়ে,/ তার তো কোনো তল নেই আর, নামবে কোথায় কোনখানে?/ পেট ছুঁয়েছে শিরদাঁড়াটা, কাল কী হবে কে জানে??/”
সে সময় অনলাইনে কবি বন্দনা ও রবিবন্দনার চল শুরু হয়েছিল। পরিপাটি হয়ে অনেকেই বসে পড়ছিল অনলাইন অনুষ্ঠানে। এই কাব্য বিলাসিতা বিব্রত করে তাঁর পরানের কবিমনকে । তিনি লেখেন- “আমি তো এখন ব্যস্ত মগন, মহাকাব্যিক লগনে,/ তাই সেদিন দোল উৎসবে এমন চাঁদ উঠেছিল গগনে।/ পার্লার ছাড়া কবিপক্ষ, কখনো কী ভাবা যায় ! ?/ গীতাঞ্জলীর পাতাগুলি ডোবে নালা ও নর্দমায়।/ অনলাইনে রবি বন্দনা, শাড়ি- পাঞ্জাবী জেল্লা/ বড় কম দামে, তোর ঘামে ঘামে, ভিজে চাপচুপ- ঐ বুড়োটার আলখেল্লা . . .”
শুধু কী শ্রেণী সংগ্রাম, বঞ্চনার বিরুদ্ধে তার সোনার কলম সাদা কাগজে দাগ ফেলে? পুরোপুরি তা নয়। কাব্যে স্বপ্রভ তার প্রেমিক মন। তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে লেখেন-
শুকনো ডালে আজ কিশলয়, অশোক, শিমূল, পলাশ মাতে
স্বপ্নরা সব আজও সজীব, চোরাগলির মারণখাদে।
দিব্যি ছিল কনকচাঁপায়, কাটবে জীবন আলোর খোঁজে
কাকে শোনাই সেসব কথা, সব কথা কি সবাই বোঝে?
‘‘ছন্দ আসে পরাগ মেখে, হৃদকমলে শব্দখনি
যে কথা তোকে হয়নি বলা, তুইও জানিস আমিও জানি’’।
জীবনে বহু বৈচিত্রময় পথের পথিক। না পাওয়ার তালিকাও খুবই স্বল্প। বহু ধরনের রকমারী কাজ করেছেন এজীবনে। তবুও তো তার কলমে উঠে আসে-
‘‘বহু কিছু বাকি থেকে যায়
জীবনের গোধুলি বেলায়।
তবু সুরে স্বরে ছবি আঁকে মন
কে জানে কখন, কে জানে কখন’’।
♦ ♦ ♦
ডঃ শীলা দত্ত ঘটক; বিজ্ঞান অধ্যাপিকা ও সঙ্গীত শিল্পী- প্রকৃত অর্থেই তিনি যেন এক অপরাজিত মালি। সযত্নে গাছ লাগিয়ে ফুল ফুটিয়ে প্রকৃতির শোভাবর্ধন করা, মানুষের মন জয় করে সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা, আর তা রক্ষা করাই যেন তাঁর নির্মল মনের একমাত্র বাসনা।
বিগত বেশ কয়েক দশকের পরিচয়ে যতটুকু তাকে দেখেছি জনদরদী কাজপাগল একজন চিকিৎসকের থেকে মনে হয়েছে প্রকৃত অর্থেই তিনি একজন বড় মনের মানুষ। এক আলোক সন্ধানী সমাজসেবী। নিজকর্ম গুণে অন্তরের আলো জ্বালিয়ে নিজেকে ভালো রাখার সমীকরণ খুঁজে পেয়েছেন।
বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন পার্থপ্রতিম চা বাগিচার শ্রমক্লান্ত বেদনাভরা পরিস্থিতির এক বাস্তব রূপ দৃশ্যায়িত করেছেন নিজেরই লেখা গানে- “সে তো মন হারিয়েছে. . . ”
মা বাবার স্নেহছায়ায় শৈশব থেকে শান্তিনিকেতনে আশ্রম কন্যা হয়ে বড় হয়ে ওঠার সুবাদে কবিগুরুর ভাষায় ডাঃ পার্থপ্রতিমকে শুভ কামনা জানাই- “শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান/ সব দুর্বল সংশয় হোক অবসান।”
» » চা-বলয়ের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে গান বাঁধলেন ডাঃ পার্থপ্রতিম।
♦ ♦ ♦
অরুণ গৌতম; তবলিয়া ও সঙ্গীত সংগ্রাহক- আমার ভ্রাতৃপ্রতিম ডাঃ পার্থপ্রতিম, সঙ্গীতরসিক ও সমঝদার। আমার সংগৃহীত বহু ধ্রুপদী গানের ও নিমগ্নশ্রোতা। বিভিন্ন তালের ছন্দ, মাত্রা বিষয়ে বোদ্ধা। ছন্দের তালি- ফাঁকের পাটিগণিতটাও ভালোই বোঝে। ওর লেখা গানের কথা বেশ বলিষ্ঠ। অনেক গানের আমি প্রথম সমালোচক। তার বসতবাড়ি মধুবন এক কথায় ব্যতিক্রমী। ওখানে মাঝে মধ্যে ঘরোয়া গানের আসর বসে আমি তাতে বহুবার অংশ নিয়েছি। ব্যক্তিগত ভাবে আমি সঙ্গীতকে কেন্দ্র ক'রে নানা রকম কর্মকাণ্ডের সাথে খুব বেশি ভাবেই যুক্ত থাকি সবসময়। কিন্তু সেই ময়দানেও তার অবাধ গতির প্রত্যক্ষদর্শী আমি নিজে। এমনকি প্রায়শই তার নানা কর্মকান্ডের প্রয়োজনে তারই নির্দেশ মত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিশেষ বিশেষ রাগের ছোট ছোট ক্লিপিং তাকে আমার পাঠাতে হয়। আশ্চর্য্য হ'য়ে যাই তখনই, যখন দেখি যে নির্দিষ্ট কোন পরিবেশ-পরিস্থিতির জন্য সেইসময়ে সঙ্গীতের যে রাগটা যথার্থ ; ঠিক সেই রাগটিই ও চায়। এটা ছাড়াও নজরুল গীতি,ছায়াছবির গান বা অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কিংবা রজনীকান্ত সেন - এর গান সম্বন্ধেও তার যতটা পরিমাণ ধারণা র'য়েছে, সেটা অনেকেরই যে নেই- সেটা দায়িত্ব নিয়েই ব'লতে পারি। আমি নিজেও আমার সঙ্গীত সংরক্ষণের পদ্ধতি নিয়ে তার কাছ থেকে সবসময়ে সুপরামর্শ পেতেই অভ্যস্ত।
♦ ♦ ♦
স্কুলবেলায় তিনি আবৃত্তি করতেন। স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বহু পুরস্কার পেয়েছেন। নাট্যচর্চার হাতেখড়িও স্কুল জীবনে। মন্ডল স্যার ও সুভাষ স্যারের নাটকে। বিদ্যালয়ে সুবর্ণ জয়ন্তীতে নান্টু গুহরায়ের পরিচালনায় “এখানেই শেষ নয়” নাটকের সূত্রধরের ভূমিকায় অভিনয় করেন। শুধু অভিনয় নয়, তিনি নাট্য পরিচালনাও করেছেন। তার পরিচালিত ‘মরা’ নাটকে বিরাট সংখ্যক কুশীলব অংশ নেয়। বানারহাট রবীন্দ্র স্পোটিং এন্ড ক্যালচারাল ক্লাবের উদ্যোগে এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর আধারিত এই নাটক গুণীজনের প্রশংসা অর্জন করে। বহু শতাধিক মঞ্চে তিনি সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন। পাড়ার রবীন্দ্র জয়ন্তী থেকে সরকারী ও বেসরকারী অনুষ্ঠান মঞ্চ; সবেতেই তিনি সমান স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
♦ ♦ ♦
মিতালি রায়; প্রাক্তন বিধায়ক ধূপগুড়ি- আমার মামা পার্থপ্রতিম বহু ধরনের সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত। বহু অনুষ্ঠানে তাকে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। খুব সুন্দর, মার্জিতভাবে তিনি কথা বলেন। ওনার বাড়ি মধুবন আমার খুব প্রিয়। ডুয়ার্স এলাকার বিভিন্ন ভাষাভাষী ও জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে মেল-বন্ধনের লক্ষ্যে তিনি যে ডুয়ার্স দিবস পালন করেন, আমি তাতেও যুক্ত রয়েছি। মামার বিভিন্ন সামাজিক কাজ আমাকে প্রেরণা জোগায়। মামা তুমি ভালো থাকো, সুস্থ থাকো, আরো ভালো ভালো কাজ করে যাও।
♦ ♦ ♦
মুক্তামালা চ্যাটার্জী- বানারহাট উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আমি ও পার্থপ্রতিম সহপাঠী ছিলাম। আমরা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু। পার্থ বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন। আমাদের স্কুলে নানা রকমের অনুষ্ঠান হতো। যেমন- বাৎসরিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আরো বহু কিছু। সেসব অনুষ্ঠানে আমি অনেকবার ওর আবৃত্তি শুনেছি; ও খুব ভালো বাচিকশিল্পী, সুলেখক ও সমাজ সেবক। পার্থপ্রতিম আর্ত পীড়িতের সেবা কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। তোর কর্মযজ্ঞের অগ্নিতে উদ্ভাসিত হোক সমাজ, পার্থ এভাবেই তুই সাধনমার্গের উচ্চস্তরে পৌঁছে যা।
♦ ♦ ♦
তিনি ঘুরেছেন বিভিন্ন এলাকায়। ঘুরে বেড়ানো তার অন্যতম শখ। দিল্লি, কন্যাকুমারী, মেঘালয়, আগরতলা, তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধপ্রদেশ, ওড়িশা, বিহার বিভিন্ন প্রদেশে তিনি গিয়েছেন। সাধারণ ভাবে আমরা যখন কোনো জায়গায় ভ্রমণে যাই, তখন আমরা দর্শনীয় স্থান বা পয়েন্ট ভিজিট করি। যেমন- যিনি দার্জিলিং-এ যাবেন তিনি ম্যাল, টাইগার হিল, গঙ্গামাইয়া। চেন্নাইতে গেলে মেরিনা ব্রিজ, মহাবলীপুরম, ফিস- মিউজিয়াম এইসব পয়েন্ট ঘুরে আসি।
পার্থপ্রতিমের ঘোরার ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। তিনি যেখানে যান সেখানে শুধু পয়েন্ট দেখেই বিষয়টি শেষ করেন না। তিনি বলেন- যেখানে যাচ্ছি সেই এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনধারা, তাদের জীবন দর্শন, তাদের সংস্কার- কুসংস্কার, তাদের স্থানীয় খাদ্য- খাবার সবই তিনি বুঝতে চান, চেখে দেখতে চান। তিন দশক আগে যখন হোমস্টে ট্যুরিজম চালু হয়নি, সেই সময় পার্থপ্রতিম ভিন রাজ্যে অপরিচিত মানুষের বাড়িতে রাত্রিবাস শুরু করেন। এইভাবে তিনি রাত কাটিয়েছেন রায়দীঘির কাছে দ্বীপগ্রাম দেউলিতে।
কয়েক দশক আগেই তিনি কিনে ফেলেছেন ইতালীয় কোলেম্যান ক্যাম্পিং পোর্টাবেল ডোম বা ভ্রাম্যমান তাঁবু। সাড়ে তিন কেজির এই তাঁবুটি সহজেই ব্যাগে ভরে নিয়ে যাওয়া যায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেইে এই তাঁবু খুলে ঘর হয়ে যায় পুরোপুরি। সাধারণ রোদ, বৃষ্টি, ঝড়- হাওয়াতে দুজন মানুষ নিশ্চিন্তে এর ভেতর থাকতে পারে। বাইরে শিবির বা ক্যাম্পিং- এর বহু জিনিসপত্র তার ভাঁড়ারে রয়েছে। রয়েছে বেশ কয়েক রকমের সুইস নাইফ, ওয়াটার বোতল, কয়েকটি বাইনোকুলার- মনোকুলার, রুকস্যাক, ব্যাগপ্যাক, সোলার লাইট আরোও বহুকিছু। রয়েছে পোর্টাবেল টয়লেটের ব্যবস্থাও।
পার্থপ্রতিমের কথায়- কোনো জায়গায় গিয়ে শুধু পয়েন্ট দেখলেই হবেনা। জানতে হবে সেই এলাকার মানুষদের জীবনকথা। তাদের জীবনধারার সাথে কিছুটা হলেও নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। অনেককে দেখি শৈলগ্রাম, বনবস্তি ভ্রমণ করার সময় তারা প্রথমে খোঁজ করেন- এ.সি. রুম, কোমোড, গিজার আছে কী না? লাঞ্চে কী মাছ পাওয়া যাবে, হার্ডড্রিংক্স কী নিয়ে যেতে হবে? না ওখানে পাওয়া যাবে? আরোও হাজারো লিস্টি। পার্থপ্রতিমের কথায়- “দৈনন্দিন জীবনের সবকিছু উপাদান, বিলাসব্যাসন, সুযোগসুবিধা ভ্রমণে গিয়েও যদি কারো কাছে কাঙ্খিত হয়; তাদের ঘুরতে না গিয়ে নিজগৃহে এ.সি চালিয়ে বসে থাকাই ভালো। ইউটিউব বা অনলাইনে বিভিন্ন জায়গার ছবি দেখে নিলে লাভও দু’দিক থেকেই। ঘোরার কোনো ঝক্কি-ঝামেলা রইল না; পকেটের পয়সা পকেটেই থেকে গেল।”
সবক্ষেত্রেই তিনি সহজাতভাবে বিশ্বজনীন। পার্থপ্রতিম বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে স্থানীয় মানুষের সাথে মেশেন। শ্রীপেরামবুদুর বা মেঘালয়ের চাংটোংয়াতে গিয়ে বাঙালী হোটেল খোঁজেন না। যে জায়গায় তিনি যান, সেখানকার ট্রাডিশ্যানাল ফুড চেখে দেখেন। যেমন- নাগাল্যান্ডে কুকুরের মাংস দিয়ে তৈরী বুসমিট রেসিপি, রায়দীঘির জটায় গেঁড়ি- গুগলির ঝোলও খেয়েছেন। দিল্লীর হজারত নিজামুল্ক মার্গে গিয়ে বীফ কাবাব, উড়িষ্যার ভদ্রক- গঞ্জাম এলাকায় শামুক কষা, রাজবংশী পরিবারে গিয়ে ‘সিদল’ এর সাথে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত পেটপুরে সাটান। আরোও বহু কিছু . . .।
চাবাগিচার আদিবাসী মহিলাদের তৈরী ‘হাঁড়িয়া’, হাজিপুরের ‘মহুয়া’, খালাসীটোলার ‘বাংলু’, কোচিন এর ‘পাম টঁডি’, তিসওয়াদি-র ‘কাজু ফেনি’, নেপালীভাষী সুব্বা- রাই মহিলাদের তৈরী বাঁশের পাত্রে বানানো মারুয়ার মদ ‘থুম্বা’ থেকে ম্যাকালান হুইস্কি; কোনো অমৃতে তার অরুচি নেই। তবে তিনি এটাও জানেন- ‘সর্বম্ অত্যন্ত গর্হিতং’।
গ্রামেগঞ্জে যখন যান তিনি তখন ব্যাগ- প্যাকে নিয়ে যান সেলেস্ট্রোল কোম্পানীর ৮০ মি.মি. ডায়ামিটারের পোর্টাবেল টেলিস্কোপটি। সারাদিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে সূর্য ডোবার পালা শেষ হলে, তিনি গৃহস্থের বাড়ির আঙ্গিনায় বা কোনো ক্লাবের প্রাঙ্গণে এই দুরবীন লাগিয়ে দুরের আকাশকে টেনে নিয়ে আসেন চোখের সামনে। বৃহস্পতি রেড জায়েন্টস্পট, স্যাটার্ন রিং আরো বহু কিছু। সাধারণ মানুষকে বোঝান- “এই দুর আকাশের গ্রহ- নক্ষত্ররা নয়, মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয় তার আর্থ- সামাজিক অবস্থান ও কর্ম দ্বারা ।”
তার মেলামেশার ব্যাপ্তিও বেশ বিস্তৃত । সহজেই মিশে যেতে পারেন আট থেকে আশির সাথে। টোটোচালক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য-অধ্যাপক, চাবাগিচার শ্রমিক থেকে পত্রিকা সম্পাদক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে মন্ত্রী- বিধায়ক বহু মানুষের তিনি বন্ধুস্থানীয়। বলতে পারেন বেশ কয়েকটি ভাষা। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি তো আছেই। তাছাড়া সাদরী, নেপালী ও আঞ্চলিক ভাষায় তিনি সড়গড়ো। সবার সাথে হাসি- হুল্লোড়- আড্ডায় আসর মাতান। এবিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তিনি রাবীন্দ্রিক উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-
" কেশে আমার পাক ধরেছে বটে,
তাহার পানে নজর এত কেন?
পাড়ায় যত ছেলে এবং বুড়ো
সবার আমি একবয়সী জেনো।
ওষ্ঠে কারো সরল সাদা হাসি
কারো হাসি আঁখির কোণে কোণে
কারো অশ্রু উছলে পড়ে যায়
কারো অশ্রু শুকায় মনে মনে . .”
অথবা বলেন- “ এত বুড়ো কোনোকালে হব নাকো আমি
হাসি-তামাশারে যবে কব ছ্যাবলামি।
এ নিয়ে প্রবীণ যদি করে রাগারাগি
বিধাতার সাথে তারে করি ভাগাভাগি
হাসিতে হাসিতে লব মানি।”
♦ ♦ ♦
গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য; ভ্রমণ সাহিত্যিক - শিক্ষক কবি সুনীল চক্রবর্তীর মাধ্যমে বানারহাটে তাঁরই স্নেহভাজন ছাত্র পার্থপ্রতিমের সাথে পরিচয় হয়। পেশায় ডাক্তার হলেও নেশা- সাহিত্য, সমাজ-সংস্কৃতি ও অদ্যান্ত ডুয়ার্স প্রেমিক। “ডুয়ার্স ডে” পার্থের মস্তিষ্ক প্রসূত। পার্থ ও ওর স্ত্রী সুকন্যার প্রচেষ্টায় ‘মধুবনে বসন্তবাসর’ রকমারি সাহিত্যচর্চা, পেটপুরে ভোজন, সে আড্ডা ভোলার নয়। আমি বহুবার মধুবনে গিয়েছি, স্বপরিবারেও গিয়েছি। পার্থপ্রতিম ভ্রমণ রসিক। ওর ভ্রমণের মধ্যে একটি দর্শন আছে। ও শুধু স্পট বা জায়গা দেখে না। বিভিন্ন জায়গার মানুষের ভাবনা চিন্তা, জীবন দর্শন উপলব্ধি করতে চায়। ভ্রমণ নিয়েও ও বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছে। ডুয়ার্সকে বাইরের মানুষের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এগুলি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পার্থ ও সুকন্যা চিরকাল ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক।
ডাঃ পার্থপ্রতিমের বাড়িটি নাম মধুবন। বানারহাট আদর্শপল্লীর ২নং সরণীতে। ষোল কাঠা জমিতে পৈতৃক বাড়ি। কালের নিয়ম মেনে আশপাশে কংক্রিটের অট্টালিকা আকাশ পানে হাত বাড়ালেও; তিনি রয়ে গেছেন মাটির কাছাকাছি। টিনের চালের ঘর। কাঠ, বাঁশের চাটাইয়ের ওপর সিমেন্ট পালিশ। অনেক বিষয়ে প্রগতিশীল হলেও; এ বিষয়ে তিনি রক্ষণশীল। ঘরের মূল কাঠামো তিনি অক্ষুন্ন রেখেছেন। এই ঘরের কাঠের সিলিং এর ওপর মা গোবরের ঘুঁটে রাখতেন। ওখানে আমাদের শৈশব- কৈশোর আজও রাতের বেলায় আমার সাথে আড্ডা জমায়। কাজের সুত্র ধরে কোলকাতার হোটেল ইন্টার ন্যাশানাল, দিল্লীর অশোকা আরো বহু জায়গায় রাত্রিবাস করতে হয়েছে। তবে এটা আমার সেভেন স্টার। বর্ষা রাতে যখন এই টিনের চালে শ্রাবণ নামে। সেটা আমার কাছে বহু ট্রাঙ্কুলাইজারের সমান। পুরোনো বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করা ব্যয়বহুলও বটে। তবে তার কার্পণ্য নেই।
মধুবনে পুবদিকের প্রাঙ্গণে পার্থপ্রতিমের সাধের বাগান। এখানে রয়েছে সবুজ ঘাসের ছোট্ট লন। ফি বছর শীতকালে এখানে ফুলের জলসা বসে। ডালিয়া, স্যালভিয়া, পিটুনিয়া, পেনজি আরোও বহু নাম জানা ও নাম না জানা ফুল এখানে পাঁপড়ি মেলে। আশেপাশের কচি-কাঁচা, ধেড়ে- বুড়োরা রকমারি আড্ডা বসায় এই প্রাঙ্গণ জুড়ে। প্রাঙ্গণের দক্ষিণ দিকে ছোট্টো নাটমঞ্চ, কচি-কাঁচাদের মনে মঞ্চভীতি কাটানোর জন্য এখানে ছোটো ছোটো অনুষ্ঠানও হয়। আকাশবাণী শিলিগুড়ি কেন্দ্র অধিকর্তা শ্রীপদ দাস মধুবনে এসে এ মঞ্চের নাম রেখে গেছেন ‘‘সেঁজুতি’’। রবীন্দ্র কাব্যগ্রন্থের সেই ‘‘সেঁজুতি’’ বা ‘‘সাঁঝ বেলার প্রদীপ’’ এখানে সারাবেলাই দীপ্তমান। নিজস্ব পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম রয়েছে, রয়েছে কডলেস আধুনিক মাইক্রোফোন। ফুল গাছেরও অন্ত নেই। এরিকা পাম, বিভিন্ন ধরনের জবা, টগর, তার পাশাপাশি রয়েছে আরোও বহু গাছ-গাছালি।
পার্থপ্রতিম ফুল বাগিচার অভিজ্ঞ মালি। নিজের হাতে ফুলচাষ করেন। ফুলের চারা তৈরী, মাটি তৈরী, সার- জল দেওয়া, ভেষজ কীটনাশক তৈরী সবই তার নখদর্পণে। কখনো কখনো ঠিকে শ্রমিক নেন। তবে কৃষি শ্রমিকের সাথে তিনি সমান তালে কাজ করেন।
পার্থবাবু বনসাই শিল্প নিয়েও চর্চা করেন। ছাতিম, বট, পাকুড়, বাগানভেলিয়ার বনসাই রয়েছে তার এই প্রাঙ্গণ জুড়ে। কুড়ি বছরের পুরোনো বনসাই এখনও রয়েছে তার প্রাঙ্গণে। একসময় বনসাই নিয়ে তিনি বিস্তর পড়াশোনা করেছেন। বনসাই শিল্পী PETER CHAN এর THE BONSAI BEGINNER'S BIBLE, HARRY TOMLINSON এর THE COMPLETE BOOK OF BONSAI,
Christian Pessey and Rmy Samson এর Bonsai Basics: A Step-by-step Guide এর বইগুলি তিনি রাত জেগে পড়েছেন। না শুধু পড়া নয়, উত্তরবঙ্গের সর্বাধিক বিক্রিত পত্রিকা উত্তরবঙ্গ সংবাদের কৃষি পাতায় তিনি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছেন এই বনসাই নিয়ে। ‘‘ঘরের ভেতর মহীরুহ’’ শিরোনামে তার লেখাগুলি বেশ জনপ্রিয় হয়। পার্থবাবু বলেন- “নাগরিক জীবনে এখন আর- শিউলি তলায় ভোরবেলায়, কুসুম কুড়ানোর ফুরসত নেই। হোমটাস্কের চাপে কচি- কাঁচাদের এখন টাইট শিডিউল, এর পাশাপাশি নগরগুলিতে এখন স্কোয়ার ফুটের সংস্কৃতি। তাই ড্রইং রুমের এককোণে বা ব্যালকনির একপাশে সবুজ প্রাণের সাড়া নিয়ে বনসাই বিরাজমান হতে পারে।” পার্থপ্রতিমের দাবী- ‘উত্তরবঙ্গ ডুয়ার্সে সরকারি উদ্যোগে বনসাই-এর বাণিজ্যিক চাষ শুরু হোক।’
পুরোনো কাঠামো বজায় রাখাও শুধু ব্যয় সাপেক্ষ নয়, কঠিনও বটে। অনেককিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। মধুবনে কোনো এ.সি রুম নেই, মার্বেল গ্রানাইটের খুব বেশি ব্যবহার ও নেই। তার শুভাকাঙ্খীরা বহু বার তাকে পরামর্শ দিয়েছেন, সব কিছু গুঁড়িয়ে দিয়ে কংক্রিটের অট্টালিকা তৈরী করার। না, তাকে কেউ তার অনড় সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি। আরশোলা, ইঁদুর, কাঠবেড়ালী, ঢোঁড়াসাপ সবার সাথেই তিনি দিব্যি মিলে মিশে আছেন। তার বাড়ি মধুবনে বহু পাখিও বিনা পয়সার ভাড়াটে। পাখিদের জন্য বেশ কিছু দানা- পানির তিনি ব্যবস্থাও রেখেছেন। তিনি জানান- “বর্তমানে পাখিদের বাথটব বা ফুডট্রে অনলাইনে পাওয়া যায়। সুদৃশ্য তবে সেগুলি প্লাসটিক বা ধাতুর তৈরী। বনের পাখী এধরনের বাসনপত্রে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে না। শীতকালে পাখিদের পানীয় জলের জন্য বাঁশ- নারিকেল মালার তৈরী বিভিন্ন পাত্রে জল রেখে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।” তাদের মেনুতে থাকে কাউন, ভুট্টা ভাঙ্গা, বাজরা আরো বহুকিছু। খাঁচাবন্দী না হয়েও এধরনের খাবার খেয়ে টুনটুনি, চড়ুই, শালিক, বুলবুলিরা বেজায় খুশি। পড়শি মানুষদের মতোন তারাও চলে আসে ঘরের ভেতর। শালিক, চড়ুই মাঝে মাঝে তাদের মেনু পাল্টাতে মুড়ি- চিড়াও উদরস্থ করে।
বিভিন্ন সময়ে যে সকল গুণীজন বানারহাট -‘মধুবন বিতানে’ এসেছেন (নামের ক্রমানুসারে)-
১). শ্রী অতনু চৌধুরী, ঘোষক; আকাশবাণী শিলিগুড়ি
২). শ্রী অনিন্দ্য জানা; বরিষ্ট সাংবাদিক; আনন্দবাজার পত্রিকা
৩). ‘অভি’বা শ্রী মলয় মুখোপধ্যায় উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকার কার্টুনিষ্ট
৪). ডঃ অমিত কুমার দে, কবি ও প্রধান শিক্ষিক
৫). অধ্যাপক অর্ণব সেন,
৬). শ্রী অরবিন্দ কর; সম্পাদক; কিরাতভূমি পত্রিকার
৭). ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষ; উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান
৮). আনোয়ার উল ইসলাম; অধ্যাপক বাঙলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
৯). শ্রী আশীষ মুখার্জি; নৌপ্রযুক্তিবিদ ও অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমার
১০). ডাঃ উজ্জ্বল আচার্য; চিকিৎসক ও লেখক
১১). শ্রী উমেশ শর্মা; গবেষক ও প্রাবন্ধিক
১২). শ্রী কিংশুক সরকার; আকাশবাণী প্রযোজক
১৩). ডঃ কৃষ্ণ দেব; সম্পাদক; প্রবাহ তিস্তা তোর্ষা
১৪). শ্রী গোপাল মন্ডল; জেলা বাস্তকার ও কবি
১৫). কাজি গোলাম কিবরিয়া, শায়ের
১৬). শ্রী গৌরী শঙ্কর ভট্টাচার্য; ভ্রমণ সাহিত্যিক
১৭). শ্রী চিত্রভানু সরকার; কবি ও সাংবাদিক; নন্দন পত্রিকা।
১৮). ডঃ জ্যোৎস্নেন্দু চক্রবর্তী; গবেষক
১৯). শ্রী তুষার চট্টোপাধ্যায়; গল্পকার
২০). শ্রী তুষার প্রধান; সাংবাদিক; আজকাল
২১). শ্রী নিতাই মুখোপধ্যায়; সহসম্পাদক, দৈনিক বসুমতী
২২). শ্রী পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত; কবি
২৩). শ্রী প্রমোদ নাথ; জনজাতি গবেষক
২৪). ডঃ প্রেমানন্দ রায়; লোকসংস্কৃতি গবেষক
২৫). ডাঃ বিজয় ভূষণ রায়; কবি
২৬). অধ্যাপক বিমলেন্দু দাম, গবেষক
২৭). শ্রী বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়; সম্পাদক
২৮). শ্রীমতি মিতালী রায়; বিধায়িকা; ধূপগুড়ি
২৯). ডঃ রমাপ্রসাদ নাগ; গবেষক
৩০). শ্রী রমেন দে; সম্পাদক
৩১). শ্রী রাজকুমার মোদক; সাংবাদিক; আনন্দবাজার পত্রিকা
৩২). শ্রী রাজ বাসু; পর্যটন গান্ধী
৩৩). ডঃ শিপ্রা সেনধর; পত্রিকা সম্পাদক
৩৪). শ্রী শ্রীপদ দাশ; কেন্দ্র অধিকর্তা; আকাশবাণী শিলিগুড়ি
৩৫). শ্রী স্বর্ণকমল চট্যোপাধ্যায়, বাচিক শিল্পী
৩৬). শ্রী স্বপন নায়েক; চিত্রগ্রাহক; আউটলুক
৩৭). শ্রী হীতেন নাগ; সাহিত্যিক
আরো বহু গুণীজন . .
♦ ♦ ♦
একসময়ে শিশুদের মনোরাজ্য জুড়ে ছিল এদের বাস। ঠাকুরদা-ঠাকুমা বা দাদু-দিদার গল্পগাথা থাকত তাদের নিয়েই। ঘুমপাড়ানি কথাকাহিনীতে থাকত সেই দুষ্টু ছেলের কান্ডকারখানা, যে পড়শিদের নাজেহাল করতে অযথা বাঘ বাঘ চিৎকার করে সকলকে জড়ো করত। অথবা সেই দুই বন্ধু যার একজন ভালুক দেখে বন্ধুকে ফেলে একাই উঠে গিয়েছিল গাছের মগডালে। বর্তমানে শিশুদের জগতে ডোরেমন, পোকেমন, নিনজা হাথোরি ইত্যাদি ভিনদেশি সুপার হিরোর দাপটে এরা এখন প্রায় রাজ্যছাড়া।
পুরোনো দিনের নীতিমালার সেই গল্পগুলিকে শিশুমনে ফিরিয়ে আনতে এক অভিনব পন্থা নিয়েছেন ডাঃ পার্থপ্রতিম। পেশায় হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসক এই মানুষটির বাড়ি বানারহাট আদর্শপল্লীর ২ নম্বর সরণিতে। বাড়ির নাম রেখেছেন ‘মধুবন’। বাড়িটির দেয়ালজুড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন নীতিশিক্ষার সেই চিরনবীন গল্পগুলিকে। রংতুলির টানে কোথাও ফুটে উঠেছে কচ্ছপের কাহিনী যে নিরলস শ্রম ও নিষ্ঠার জোরে দৌড় প্রতিযোগিতায় হার মানিয়ে দেয় দ্রুতগামী খরগোশকে, বুদ্ধিমান সেই কাকের জলপানের গল্প, কোথাও আবার শিকারির জাল কেটে ছোট্ট ইঁদুর বাঁচিয়ে দেওয়া বলশালী সিংহকে। এমন বহু গল্প ফুটে উঠেছে সবুজ লনের চারধারে। গাছগাছালিতে ঘেরা এই বাড়িটিতে আছে রকমারি ফুলের গাছ, বনসাই, হাঁস, হরিণশিশু, নানা ধরনের পাখি ইত্যাদির বহু মডেল।
তাঁর এই প্রয়াস প্রসঙ্গে ডাঃ পার্থপ্রতিম বলেন- ‘বর্তমানে বিভিন্ন কার্টুন চ্যানেলের দাপটে শিশুদের মধ্যে আজগুবি, অবাস্তব সব চরিত্রের অন্ধ অনুকরণ শুরু হয়েছে। যার সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির কোনো যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। শৈশব, কৈশোরে নীতি ও মূল্যবোধের যে শিক্ষাগুলি গল্পচ্ছলে আমরা পেয়েছি, বর্তমান শিশুরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে নীতিহীনতা ও হতাশায় ভুগছে আমাদের অনাগত ভবিষ্যৎ। এই ফাঁকফোঁকরেই হানা দিচ্ছে ব্লু হোয়েলের মতো গেম।’
মধুবনকে ফুটিয়ে তোলার কাজে শিল্প নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছেন কোচবিহারের চিত্রশিল্পী প্রসেনজিৎ ভৌমিক। প্রসেনজিৎবাবু জানান, কয়েকটি ক্ষেত্রে আমরা ঈশপের গল্পকে নিয়েছি। তবে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে সেগুলিকে ভারতীয় ভাবনা ও বাঙালি আঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় গাথা- বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য, নির্বুদ্ধিস্য কুতঃ বলম্, খরগোশ- সিংহের সেই ছবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে ঈশপের ধূর্ত শেয়াল ও কাকের। ছবিগুলির মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত মিল রাখা হয়েছে। ছবিগুলি এঁকেছেন আদিবাসী শিল্পী গণেশ মাহালি।’
বানারহাটের মধুবনে এই অভিনব নীতিশিক্ষার পাঠশালায় মাঝেমধ্যেই ভিড় জমায় খুদে শিশুরা। আশপাশের শিশুশিক্ষাকেন্দ্র বা সরকারি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকারাও আসেন এই গল্প দেখার আসরে। ছবিগুলিতে কোনো শিরোনাম নেই। অভিভাবকেরা বা শিক্ষকেরা গল্পগুলি নিজেদের মতো বুঝিয়ে বলবেন, এটাই পরিকল্পনা করেছেন ডাঃ পার্থপ্রতিম। তিনি বলেন- ‘বর্তমানে দাদু-দিদা-পিসি-কাকা বর্জিত নিউক্লিয়ার পরিবারে এখন শিশুদের একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাণহীণ স্মার্টফোন। এক অদ্ভুত একাকীত্ব চেটেপুটে খাচ্ছে শৈশবকে। এই পাঠশালা সেই কচিকাঁচাদের মগজে নতুন ভাবনার জোগান দেবে।’
♦ ♦ ♦
শ্রীপদ দাস; প্রাক্তন কেন্দ্র অধিকর্তা, আকাশবাণী শিলিগুড়ি- পার্থপ্রতিম আমার ভ্রাতৃপ্রতিম। ওর সাথে দু-দশকের পরিচয়। ওর বাড়িতে গিয়েছি মধুবনের বসন্ত বাসরে যোগ দিতে। পার্থ নানাবিধ সৃজনশীল কাজ করে। কখনও ল্যাপটপ, প্রোজেকটর কাঁধে চা-বাগিচার পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও কুসংস্কার দূর করার প্রয়াস চালায়। কখনও আবার সাংস্কৃতিক মঞ্চে সুচারু রূপে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করে। পিছিয়ে পড়া ডুয়ার্স এলাকায় পার্থপ্রতিমের এইসব উদ্যোগ যথেষ্ট প্রয়োজনীয়। আমাদের আকাশবাণীর বহু অনুষ্ঠানে ও অংশ নিয়েছে। ওর লেখা মননশীল প্রবন্ধ, নিবন্ধ ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। গুরুজনদের প্রতি ওর শ্রদ্ধাভক্তি উল্লেখযোগ্য। ওর সুস্থ, সবল, কর্মমুখর জীবন আরও দীর্ঘায়ু হোক এই কামনাই রইল।
♦ ♦ ♦
কানাই চট্টোপাধ্যায়; নাট্যকর্মী ও বনসাই শিল্পী- ডাঃ পার্থপ্রতিম আমাদের ডুয়ার্সের গর্ব। আমার একজন প্রিয়মানুষ। তার আবাসস্থল মধুবন। ফুল ও গাছপালাতে ভরা। তিনি নিজেও ফুলের মত সদা হাস্যময়। তার বাগানে বেশ কিছু বনসাই-ও রয়েছে। বনসাই নিয়ে তার ধারাবাহিক লেখা বেশ আকর্ষণীয় ও তথ্য সমৃদ্ধ। মানুষটি নাট্য রসিকও বটে। বিবিধের মাঝে মিলনের বার্তা নিয়ে পার্থদা যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন তা এক কথায় অনবদ্য।
♦ ♦ ♦