“গানে বাগানের মহিলাদের যন্ত্রণা”- শুভজিৎ দত্ত; ১০ জুলাই ২০২২; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
নাগরাকাটা. ৯ জুলাই:- বৃষ্টিধারায় তাঁর কান্না হারায়। একটি কুঁড়ি, ওই দুইটি পাতায়। কার দায়! কে বা সেই অশ্রু মাপে? ধূমায়িত নাগরিক চায়ের কাপে।
কোনও আঞ্চলিক ভাষায় নয়, আরও বৃহত্তর স্বার্থে বংলা ভাষায় ভর করে সিমরন- শিবাদের চেষ্টায় উত্তরের চা বাগানের বুধনিদের যন্ত্রণা দিকবিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সকালের ধূমায়িত চায়ের কাপে বাগান মহিলাদের যে কত যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকে তা এই গানেই পরিষ্কার। বাগানের স্থানীয় যুবক-যুবতীদের উদ্যোগে তৈরি এই গান ইতিমধ্যেই ইউটিউবে আত্মপ্রকাশ করে ফেলেছে। এমন উদ্যোগ এই প্রথম বলেই সংশ্লিষ্ট মহল জানাচ্ছে।
এই গানে সুর-ছন্দ-তাল-লয় সবই আছে। তবে চা বাগানের পারিবারিক ভারসাম্য ধীরে ধীরে নষ্ট হতে বসার মর্মকথা সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এর মূলে থাকা রুটিরুজির খোঁজে দলকে দল পুরুষের ভিনরাজ্যে পাড়ির আখ্যান; সুনিপুন ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। একা কুম্ভ হয়ে মহিলাদের ঘরকন্না থেকে শুরু করে পেট চালানোর সংগ্রামের ইতিবৃত্তও উঠে এসেছে।
চা বাগানের আদিবাসী শ্রমিকদের মূল কথা সাদরি। সেটাতে না করে বাংলায় গান তৈরির কারণ যে রাজ্যের বৃহত্তর পরিসরে মহিলা শ্রমিকদের জীবনকথা তুলে ধরা তা সিমরণ মুন্ডা খোলাখুলিই জানাচ্ছে। বানারহাট চা বাগানের থানা লাইনের এই অষ্টাদশীর কথায়, ‘বেশিরভাগ শ্রমিক পরিবারেই পুরুষরা এখন আর বাড়ি থাকেন না। কেরল, দিল্লী বা বেঙ্গালুরুই তাঁদের আস্তানা। এদিকে বাড়ির মহিলারা যে কীভাবে সংসার চালান একমাত্র তাঁরা ছাড়া সেকথা আর কেউ বুঝতেই পারবে না।’ দ্বাদশ শ্রেণির ওই ছাত্রী বলে চলে, ‘আমার ১২ বছর বয়সে বাবা বাইরে চলে গিয়েছিলেন। এরপর চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে অসুস্থ মা কীভাবে যে দিন কাটিয়েছেন তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত।’
বাগানের প্রতিটি পরিবারেই এমন অবস্থা। গানের শুটিংয়ে ক্যামেরার পেছনে থাকা বানারহাট চা বাগানেরই ফ্যাক্টরি লাইনের শিবা বড়াইক বলছেন ‘হাজার কথা খরচ করে খুব একটা লাভ হয় না। বরঞ্চ কয়েক কলির গানের মাধ্যমে সহজেই মানুষের কাছে মূল বার্তাটা পৌঁছে দেওয়া যায়। সেজন্যই সুরকে হাতিয়ার করার এমন ভাবনা।’
গানের সিনেমাটোগ্রাফির মুখ্য চরিত্র বুধনির ভূমিকায় সিমরন নিজেই অভিনয় করেছে। এখানে সে সন্তানসম্ভবা। ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখার প্রত্যাশায় তার কাছের পুরুষ বাড়ি ছেড়েছে। এক বৈশাখে মন হারানো বুধনি আষাঢ়ের বৃষ্টিধারায় স্নাত হয়ে গানে গানে বেদনার কথা বলছে। আকুতি আর বিরহের মিশেলে সেই গান চা পাতার সবুজ গালিচায় যেন মূর্ত হয়ে ঝরে পড়ে। গানের ছত্রে ছত্রে চা সমাজকে তুলে ধরার মরিয়া প্রচেষ্টা রয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত থেকে সীমিততর হওয়ার নেপথ্য ভাষ্যও রয়েছে। এর দায় কার? সেই প্রশ্নও সুরের জাদুতে তোলা হয়েছে।
সিমরনদের অনুরোধে বানারহাটের চিকিৎসক পার্থপ্রতিম বাংলায় গানটি লিখে দিয়েছেন। জলপাইগুড়ির দীপঙ্কর সেনগুপ্ত সুর দিয়েছেন। তাঁর সহধর্মিণী প্রিয়া সেনগুপ্ত গেয়েছেন। ফালাকাটার সুমন সাহা সম্পাদনার কাজটি করেছেন। পার্থপ্রতিম বললেন, ‘বাগানে এখন মায়েদের ওপরই যাবতীয় সাংসারিক দায়িত্ব। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে চা শিল্পের অনুসারী হিসেবে আর কোন শিল্প বা বিকল্প কর্মসংস্থানের কোনও উপায় তৈরি না হওয়ার কারণেই এখন এখানকার সংকট ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। সিমরনদের ভাবনাকেই কলমের মাধ্যমে যতটুকু পেরেছি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি।’ তাঁদের তৈরি গান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সিমরন, শিবারা জানাচ্ছেন। বিশেষ করে কলকাতার নানা গ্রুপে তা দেওয়ার লক্ষ্য হাতে নেওয়া হয়েছে। উত্তরের তথাকথিত বঞ্চনার কথাই কি নিজেদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে গঙ্গাপারে পৌঁছে দিতে চাইছেন তাঁরা ? সিমরনদের তা জানা নেই। হয়তো তাঁরা ভেবেও দেখে নি।