‘ডিয়ার’ চিবুকে সংকল্পের কাঠিন্য- পারুল মন্ডল; জলপাইগুড়ি জেলা সার্ধশতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ (১৮৬৯-২০১৯) -এ প্রকাশিত প্রবন্ধ।
উত্তরের দিগন্তরেখা জুড়ে রয়েছে নীলাভ গিরিমালা। তারই কোল বেয়ে নেমে আসা সবুজ বনানী। কোথাও আবার সীমানা হারানো চা বাগিচার শ্যামল গালিচা। কখনো অলস পায়ে হেঁটে চলা বুনো হাতির দল, পায়ে সাদা মোজা পরা বাইসনের হুটোপুটি। জলপাইগুড়ি জেলা চা বাগিচা অধ্যুষিত ডুয়ার্স এলাকা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান সচেতনতা আরও বিভিন্ন বিষয়ে পিছিয়ে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে বিজ্ঞানভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ডুয়ার্স এক্সপ্লেরেশন অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট রিভ্যালী সংক্ষেপে ‘ডিয়ার’। ডুয়ার্স এলাকার আদিবাসী মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য - পরিবেশ সচেতনতা ও কুসংস্কার দূর করাই এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য।
সংস্থাটি সরকারী ভাবে নথিভুক্ত হয় ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখে। যদিও সংস্থাটি তারও কয়েকবছর আগে থেকে এই কাজটি শুরু করেছিল। অডিও ভিস্যুওয়াল শো, পোষ্টার ও মডেল প্রদর্শনী, প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা এইসব বিভিন্ন মাধ্যমে। ডিয়ার প্রথমে তার যাত্রা শুরু করে মহাকাশ- বিষয়ক অডিওভিসুয়্যাল শো ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’ শিরোনামে অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে। দূর আকাশের গ্রহ নক্ষত্ররা চলে আসে ডুয়ার্সের মানুষের চোখের সামনে। সপ্তাহে একদিন ডিয়ারের সৈনিকেরা চা বাগিচা গুলিতে বিজ্ঞান সচেতনতা অনুষ্ঠান করে। চা-বাগিচা, গ্রামগঞ্জের স্কুল ক্লাবে পর্দা টাঙিয়ে প্রজেক্টারের সাহায্যে চোখের সামনে তুলে ধরা হয় অনেককিছু। চার দেওয়ালের মাঝেই তৈরি হয় আকাশ ভরা সূর্যতারা। কখনও মহাকাশযানে করে দর্শকদের নিয়ে যাওয়া হয় শনির বলয়ের একদম কাছে। নেপচুনের উপগ্রহটা টাইটেন-এ। কখনও আবার মহাশূন্যে দাঁড়িয়ে দেখে নেওয়া যায় আমাদের মমতাময়ী মাটির পৃথিবীকে। শুরুতে মহাকাশ কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ডিয়ারের কর্ণধার ডাঃ পার্থপ্রতিম জানায়- “ মানুষ তার সৃষ্টি লগ্ন থেকেই তাকিয়েছে আকাশের পানে। দিনের শেষে রাত হলে সেই অন্ধকারের মাঝে প্রাচীন গুহাবাসী মানুষ একদিকে যেমন ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছে; অন্যদিকে আকাশের তারা গ্রহের আলোয় তারা খুঁজে পেয়েছে তাদের আশা, আকাঙ্খা ভুত- ভবিষ্যতের দেবতাকে। সে কারণেই প্রাচীন মানুষ ভেবেছে আকাশের গ্রহ নক্ষত্ররাই আমাদের ভাগ্যটাকে নির্ধারণ করে। আজও বহু মানুষের মধ্যে এই অন্ধবিশ্বাসটা রয়ে গেছে। রত্ন, তাবিজ, কবজ নিয়ে বছরে কয়েকশো কোটি টাকার ভন্ড ব্যবসা চলছে।”
ডিয়ার তার অডিওভিসুয়্যাল শো শুরু করেছিল ‘মহাবিশ্ব মহাকাশ’ শিরোনামে। পরবর্তীকালে পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে ‘নিকট প্রতিবেশী’, ব্লাড প্রেসার ও হৃদরোগ নিয়ে ‘হৃদয়ের কথা’, ছাত্রছাত্রীদের সঠিক দিশা দেখাতে ‘শুভ কর্মপথে’ -এখন সব মিলিয়ে বারো-তেরোটি শিরনাম। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষে কবির মহাকাশ ভাবনা নিয়ে তৈরী করেছে ‘তোমার অসীমে’। প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে নতুন নতুন বিষয়। আরো আকর্ষণীয় হয়ে চলেছে উপস্থাপনা। ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন (ডি.বি.আই.টি.এ) এর আর্থিক সহযোগিতায় ডিয়ার ১৯৯৭ সালে একটি শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে আসে। এ বিষয়ে বিশেষ সহযোগিতা করেন ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন -এর তৎকালীন সচিব সমরেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জি। এর ফলে দূর আকাশের গ্রহ- নক্ষত্ররা চলে আসে চোখের সামনে। মহাকাশ ও কুসংস্কার নিয়ে সচেতনতা বাড়ে ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।
ডিয়ারের উদ্যোগে ও ইষ্ট ক্যালকাটা সায়েন্স সেন্টারের সহযোগিতায় ডুয়ার্সের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত হয় কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান। আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটা, মড়ার খুলিকে জলপান করানো, জীবন্ত মানুষকে শূন্যে ভাসানো, বান মারা প্রভৃতি আকর্ষণীয় খেলা দেখানো হয়। ব্যাখ্যা করা হয় এর পেছনে থাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কারণগুলিকে। সাধারণ মানুষ কিভাবে বিভিন্ন ভন্ড ওঝা- গুণিন ও সাধুবাবাদের দ্বারা প্রতারিত হয় তা এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়।
ফি-বছর ডুয়ার্সে হানা দিচ্ছে বিভিন্ন মারণ ব্যাধি। এবছর ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া তো পরের বছর এনকেফেলাইটিস। রোগ হানা দেওয়ার সাথে সাথে ডিয়ারের সদস্যরা কোমর বেঁধে ফেলেন। রোগের কারণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পদ্ধতি, রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাপত্র -এসব নিয়ে করা হয় সহজবোধ্য অডিওভিসুয়্যাল প্রেজেন্টেটেশন। সাথে সাদ্রী, বাংলা, নেপালী ভাষার ভাষ্য। তারপর নিরন্তন ছুটে চলা। তখন আর দিনক্ষণ নেই। সন্ধ্যা নামার সময় হলেই চা-বাগিচার আদিবাসী পল্লী থেকে বনবস্তির আঙ্গিনায় ল্যাপটপ, প্রোজেক্টার, পর্দা ও আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে হাজির ডিয়ারের অডিওভিসুয়্যাল টিম। বিগত দিনে ডিয়ার -এর এইকাজে বিশেষভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া-র সচীব রামঅবতার শর্মা ও মালবাজার -এর মহকুমা শাসক শ্রী জ্যোতির্ময় তাঁতি।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে ডিয়ারের সদস্যরা যখন অডিওভিসুয়্যাল শো প্রথম শুরু করে তখন ডিজিটাল প্রযুক্তি পদ্ধতি বাজারে আসে নি। ম্যাজিক লন্ঠনের মত প্রোজেক্টার দিয়ে যাত্রা শুরু। প্রতিটি স্লাইড পাল্টাতে হতো হাত দিয়ে। ডুয়ার্সের গ্রামে বসে প্রোজেকশন স্লাইড পাওয়াও বেশ মুশকিলের বিষয় ছিল। দিল্লীর বিজ্ঞান প্রসার, বম্বের তেজরাজ, অনেক সময় কলকাতা বর্ন সেপার্ড ও চিত্রবাণী থেকে প্যানক্রোমাটিক ফ্লিম এনে ছবি তুলে সেটাকে স্লাইড করা হত। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি বাজারে এলে ডিয়ারের সদস্যরা কোনরকম সরকারী সাহায্য ছাড়াই নিজস্ব উদ্যোগে লক্ষাধিক টাকার প্রজেকক্টার ও ল্যাপটপ কেনেন। শুধু ডুয়ার্সের চা বাগিচা নয়। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকা মেখলিগঞ্জ, চ্যাংরাবান্ধা, আলিপুরদুয়ার, মালবাজার, ওদলাবাড়ি, মেটেলি, নাথুয়া, ধূপগুড়ি, আরও বিভিন্ন জায়গায় তারা এই শো করে চলেছে।
‘ডুয়ার্স এক্সপ্লোরেশন এন্ড অ্যাডভান্সমেন্ট রিভ্যালী (ডিয়ার)’ এই নামকরণের মধ্যে সুন্দর দ্যোতনা আছে। ফ্রেঞ্চ ‘রিভিল্জ’ শব্দ থেকে ইংরাজিতে এসেছে ‘রিভ্যালী’ শব্দটি। যার অর্থ হলো- ‘ভোরে সৈনিকদের জাগিয়ে তোলার জন্য বাজানো বিউগ্ল’ এর বিশেষ ছন্দ। এন.জি.ও নয়; ‘ডিয়ার’ নিজেকে বিজ্ঞান ক্লাব বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসে। এন.জি.ও পরিচয়ে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে। যারা সরকারী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানের টাকায় দেশ উন্নয়নের কথা বলে। দেশ সেবার নামেই যাদের আয় রোজগার হয়, সংসার চলে। শোনা যায়, অনেক এন.জি.ও সরকারী ও বিদেশী টাকা নয়ছয় করে। ডিয়ারের সব সৈনিকই প্রকৃতঅর্থে স্বেচ্ছাসেবী। আদর্শগত কারণে ডিয়ার কোন সরকারী ও বিদেশী আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করে না। তাদের কথায়- ‘‘বনের মোষ তাড়াতে গেলে তা ঘরের খেয়েই করা ভাল। তাতে সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের বিশ্বাস যোগ্যতা বজায় থাকে। এতে আত্মতৃপ্তি মেলে। নেশার উৎস যদি সামাজিক দায়বদ্ধতা হয়; সেক্ষেত্রে নেশা থেকে পেশাকে আলাদা রাখলে নেশার প্রতি সৎ থাকাটা অনেক সহজ। তাছাড়া সরকারী ও বিদেশী অনুদান পেতে গেলে বহুক্ষেত্রে কমিশন, পার্সেন্টেজ, কাটমানির বিষয়টি এসে গেছে। সামাজিক কাজ করতে এসেও নৈতিকতাকে বিসর্জন দিলে আর থাকে কী? এটা হলে ধান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীদের সাথে নিজেদের তফাৎ করাই তো মুশকিল হয়ে যাবে।”
ডিয়ারের কর্মকান্ডকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় জাদুঘর (ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম) ডিয়ার এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের পুরাতত্বের সম্ভার নিয়ে কলকাতা থেকে ছুটে এসেছে ডুয়ার্সে। ডুয়ার্স এখনও মশাবাহিত রোগপ্রবণ এলাকা। ডিয়ারের ব্যবস্থাপনায় ও ডি.বি.আই.টি.এ- এর সহযোগিতায় ২০ টি চা বাগানের স্বাস্থ্য কর্মীরা ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য কলকাতায় বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ডিয়ারের সদস্য- সদস্যরা তৈরী করেছে পতঙ্গ, পরিবেশ বিষয়ক বহু পোষ্টারসেট, চার্ট-মডেল। আদিবাসী চিত্রশিল্পী বাবলু মাহালীর তুলিতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে ইকোসিস্টেম, খাদ্য খাদকের প্রাকৃতিক সম্পর্ক, রাসায়নিক কীটনাশকের ক্ষতিকারক দিকগুলি। রাসায়নিক কীটনাশক বিষে কীভাবে নিঃশব্দে বিষিয়ে যাচ্ছে ডুর্য়াসের নদীনালা অরণ্য বনানী। রয়েছে তার সচিত্র বিবরণ। এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রহ- নক্ষত্রের ঝকঝকে রঙিন ছবি ও তার খুঁটিনাটি বিষয়। ডুয়ার্স এলাকায় যেসব কীট পতঙ্গ পাওয়া যায় তাদের দেহ সংরক্ষণ করেছে ডিয়ারের সদস্যরা।
বিভিন্ন সময় ডিয়ার করেছে বসন্তবাসর। ডিয়ারের মূল কার্যালয় বানারহাটের মধুবনে বসেছে শিল্প সংস্কৃতির আসর-‘মধুবনে বসন্তবাসর’। সহযোগিতায় ছিল নিখিলভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের জলপাইগুড়ি শাখা। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখক, সম্পাদক, কবি, উপন্যাসিক, গবেষক, লোক শিল্পী সকলে এসেছেন দল বেঁধে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষ, আকাশবাণী শিলিগুড়ির কেন্দ্র অধিকর্তা শ্রী শ্রীপদ দাশ, বাচিক শিল্পী স্বর্ণকমল চট্যোপাধ্যায়, অতনু চৌধুরী, অধ্যাপক অর্ণব সেন, জনজাতি গবেষক প্রমোদ নাথ, কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত, বিজ্ঞান লেখক ডাঃ উজ্জ্বল আচার্য, সম্পাদক বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় , লোকগবেষক প্রেমানন্দ রায়, সম্পাদক রমেন দে, সাহিত্যিক হীতেন নাগ, জেলা বাস্তকার ও কবি গোপাল মন্ডল, গবেষক ডঃ রমাপ্রসাদ নাগ, কবি সুনীল চত্রবর্তী, সম্পাদক ডঃ শিপ্রা সেনধর, গবেষক ডঃ জ্যোৎস্নেন্দু চক্রবর্তী, কিরতভূমি পত্রিকার সম্পাদক অরবিন্দ কর, ভ্রমণ লেখক গৌরী শঙ্কর ভট্টাচার্য, গল্পকার তুষার চট্টোপাধ্যায়, কবি ডঃ অমিত কুমার দে, অধ্যাপক বিমলেন্দু দাম, আকাশবাণী প্রযোজক কিংশুক সরকার, কবি ডাঃ বিজয় ভূষণ রায়, সম্পাদক ডঃ কৃষ্ণ দেব, কবি কাজি গোলাম কিবরিয়া, উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকার কার্টুনিষ্ট ‘অভি’ এর পাশাপাশি এসেছেন বাঙলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার উল ইসলাম, কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ের আইনজীবি অনুপম আচার্য ও আরো অনেকে।
ডিয়ার -এর উদ্যোগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান হয়ে চলেছে। ডিয়ার এর ব্যবস্থাপনায় বিখ্যাত তাত্ত্বিক মহাকাশ বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম স্টিফেন হকিং এর স্মরণ সভায় উপস্থিত ছিলেন ডুয়ার্স এলাকার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছেলে মেয়েরা। এ অনুষ্ঠানে বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকল্যাণ ভট্টাচার্য বলেন- “অসাড় দেহ নিয়ে স্যার হকিং যে ভাবে আমৃত্যু জটিল গবেষণার কাজ চালিয়ে গেছেন তা বিকলঙ্গ মানুষজনের কাছে চিরদিনের প্রেরণা হয়ে থাকবে।”
আপাত শান্ত ডুয়ার্স বিগত দু’-তিন দশক ধরে মাঝে মাঝেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। কখনো জাতিগত, কখনো ভাষাগত বিচারে এই ভূখন্ড নিয়ে বিভিন্ন ভাগ বাটোয়ারার দাবী উঠেছে মাঝে মাঝেই। এইসব জাতিগত, ভাষাগত আন্দোলনের ঢেউ স্বাভাবিক ভাবে আছড়ে পরেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। অদূর অতীতে ঘন ঘন বন্ধ, পথ অবরোধ, অগ্নিসংযোগ এমন কী দাঙ্গায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এই প্রেক্ষাপটে ডিয়ার -এর সদস্যরা প্রথম থেকেই সদার্থক ভূমিকা নিয়েছে। ডুয়ার্স এলাকার ইতিহাস, বর্তমানের মধ্যে থেকেই তারা খুঁজে পেতে চেয়েছে সমস্যা সমাধানের স্থায়ীপথ। এ নিয়ে আলোচনা সভা ও কর্মশালার আয়োজন করেছে ডিয়ার। ডুয়ার্সের বিভিন্ন ভাষাভাষীর শ্রমিকনেতা, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, অধ্যাপক, সমাজকর্মীরা মুক্ত মনে অংশ নিয়েছেন এইসব অনুষ্ঠানে। বানারহাটের তরুণ সংঘ ভবনে আয়োজিত “পাহাড় ও সমতলের ঐক্য- সংহতি ও প্রেক্ষাপট ডুয়ার্স” শীর্ষক কর্মশালায় আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন- ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষ, ধূপগুড়ি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ইতিহাসবিদ ডঃ নীলাংশু শেখর দাস, প্রশান্তদেব মহিলা মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা ডঃ শীলা দত্ত ঘটক, পরিমল মিত্র মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্বপন মন্ডল, চন্দন খাঁ ও আরো অনেকে।
ডিয়ার তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনন্যতার দাগ রেখেছে। তাদের অনুষ্ঠান ‘রক্তের বন্ধনে ডুয়ার্স’ বিশেষ প্রশংসার অর্জন করে। ডুয়ার্সের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ক্যারন চা বাগান থেকে অসুর, জয়ন্তী থেকে ডুপপা, লোকসান থেকে লিম্বু এছাড়াও রাভা, ওঁরাও, মেচ, সাঁওতাল, হোর, শেরপা, মুন্ডা, রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ এই রক্তদান উৎসবে অংশ নেন। এর পাশাপাশি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, শিখ, জৈন ধর্মের মানুষের উপস্থিতিতে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে উৎসব প্রাঙ্গন। এ প্রসঙ্গে কার্ত্তিক ওঁরাও হিন্দি সরকারী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রহুল মিঞা বলেন- “ডুয়ার্স ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র সংস্করণ। বহু জাতি ও ধর্মের মানুষ এখানে বাস করে। এতো ছোট ভূখন্ডে এতো বেশী ভিন্ন জাত ও ধর্মের মানুষ এদেশে আর কোথায় বাস করে বলে আমার জানা নেই। এ ধরনের ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান ডুয়ার্সের ঐক্য ও সংঘতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ”
ডিয়ার এর এইসব কর্মকান্ড সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রশংসিত হয়েছে। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর আনন্দলোক পত্রিকা সমাজ সচেতনতামূলক কাজে ব্যতিক্রমী প্রয়াস চালানোর জন্য ডিয়ারের কর্ণধার ডাঃ পার্থপ্রতিম-কে শিক্ষাক্ষেত্রে ‘সেলাম বেঙ্গল’ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন। জলপাইগুড়ি জেলার ঐতিহ্যশালী পত্রিকা কিরাতভূমির পক্ষ থেকে ডাঃ পার্থপ্রতিম-এর হাতে কিরাতভূমি স্মারক সম্মান তুলে দেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। ২০০৪-০৫ আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সচেতনতা বর্ষে জলপাইগুড়ি মহকুমা পরিষদের পক্ষ থেকে ডিয়ারে সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘বিজ্ঞান সচেতনতা স্মারক সম্মান’। এছাড়াও ‘চিকরাশি’ পত্রিকার প্রদত্ত সম্মান, কোচবিহারের ‘ছায়ানীড়’ সংস্থা, হলদিবাড়ি হাই স্কুল কমপিউটার প্রোজেক্ট, উত্তরবঙ্গ নাট্য জগৎ এর গুণীজন সংবর্ধনা আরো বহু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান সম্বর্ধিত করেছে ডিয়ার এর সদস্যদের। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলে সম্প্রসারিত হয়েছে ডিয়ার এক কর্মকান্ড। আনন্দবাজার পত্রিকার বরিষ্ঠ সাংবাদিক অনিন্দ্য জানা ডিয়ার এর কাজকারবার নিয়ে সুবিশাল প্রবন্ধ লিখেছেন ‘উত্তরের নায়ক’ শিরনামে। তবে এসব ছাড়াও ডিয়ার এর সৈনিকেরা পেয়েছে ডুয়ার্সের আদিবাসী ও বহু সম্প্রদায়ের মানুষের স্নেহ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা -এটাই তাদের চলার পথের মূল পাথেয়, তাদের আপসহীন লড়াইয়ে প্রধান রসদ। চিবুকে সংকল্প নিয়ে তারা এখনো তাদের সংকল্পে বিভোর- কুসংস্কারমুক্ত, পরিবেশ সচেতন এক দেশ গড়ার।