মহামারি মোকাবিলায় বাজি পোড়ানো নতুন নয়

মহামারি মোকাবিলায় বাজি পোড়ানো নতুন নয়

মহামারি মোকাবিলায় বাজি পোড়ানো নতুন নয়; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ২১ এপ্রিল ২০২০; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
বিশ্বজুড়ে করোনা সংকট অব্যাহত। এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের ঐক্য এবং সংহতি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে আলোকবার্তা উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। পুড়ছে বহু আতশবাজি, উড়ছে ফানুস। ৫ এপ্রিলের রাত অনেকটা দীপাবলির মতোই ছিল। বাজি বিক্রেতা সংগঠনের হিসেব অনুসারে ওই রাতে এই রাজ্যের প্রায় ছয় কোটি টাকার বাজি পুড়ছে, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক চাপানউতোর চলছে। চলবেও। তবে রোগব্যাধি মোকাবিলায় বাজি পোড়ানোর ইতিহাস নতুন নয়।
দু’হাজার বছর আগেকার কথা। চিনে রাজ করছে হ্যান বংশ। সেই সময় চিনাদের ধারণা ছিল, অপদেবতার কান্ডকারখানা ফলে বন্যা, ভূমিকম্প, অনাবৃষ্টি হয়। তাই বাজি-পটকা ফাটিয়ে তারা ভয় দেখাত। এই বিশ্বাস তাদের মধ্যে বহু বছর বজায় ছিল। ১২৩২ সালে যখন প্রবল পরাক্রমী মোঙ্গলরা চিন আক্রমণ করে, তখন হাউইবাজির সাহায্যে তাদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়।
পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে বাজি-পটকা লড়াই-যুদ্ধের কাজেই ব্যবহার করা হত। হিস্ট্রি অব দ্য ইউরোপিয়ান ওয়ার্ল্ড বই থেকে জানা যায়, ১৫০৯ সালে ইতালিতে প্রথম আনন্দ-উৎসবে বাজি পোড়ানো হয়। তারপর ১৫৭২ সালে ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথ ওভারবিচ শহরে বিরাট বাজি উৎসব করেন। ১৬১৩ সালে প্রথম জেমসের মেয়ের বিয়েতে টেমস নদীর বুকে নৌকা থেকে বাজির ভেল্কি দেখানো হয়। অষ্টাদশ শতকে পঞ্চদশ লুইয়ের উৎসাহে ফ্রান্সে নতুন বাজি পটকা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়।
প্রথমদিকে বাজি তৈরির কলাকৌশল খুব গোপন ছিল। এই বিদ্যা ছিল পরিবারকেন্দ্রিক। বাবা তাঁর ছেলেকে শেখাতেন, ছেলে আবার তার ছেলেকে। এভাবে বংশপরম্পরায় বাজি তৈরির ধারাবাহিকতা চলত। প্রতিটি পরিবারের বাজির বৈশিষ্ট্য ছিল স্বতন্ত্র। বাজি তৈরির জন্য রোমের রুজ্জিয়ারি পরিবারের সুনাম প্রায় ১৫০ বছর বজায় ছিল।
১৭৪৯ সালে একটি শান্তি চুক্তির বর্ষপূর্তি উৎসবে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বাজি পোড়ানো হয়। এজন্য ইতালি থেকে লন্ডনে বেশ কয়েকজন বাজি-বিশেষজ্ঞ এসেছিলেন। এরপর ইংল্যান্ডের ব্রুক পরিবারের অনুপ্রেরণায় অনেকেই বাজি- পটকা তৈরি করে বিক্রি করতে থাকেন। ১৮৬৫ সালে লন্ডন শহরের ক্রিস্টাল প্রাসাদে চার্লস টমাস ব্রুক বাজি প্রদর্শনী শুরু করেন। এই উৎসব ১৯২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর হত।

আমাদের দেশেও বাজির প্রচলন নতুন নয়। সম্ভবত ১৬৩৫ সালে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এর কলাকৌশল চিন থেকে ভারতে নিয়ে আসেন। শোনা যায়, ১৭৮৩ সালে টিপু সুলতান ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় খবর পাঠানোর কাজে সংকেত হিসাবে হাউইবাজি ব্যবহার করেছিলেন।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজি পটকার ব্যবহার শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চালু রয়েছে। জার্মানি ভারতবর্ষ থেকে অনেকটাই দূরে। এখানে শীতের প্রকোপ খুব তীব্র। হাড়কাঁপানো শীত গিয়ে যখন উষ্ণ বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, তখন বার্লিনে উৎসাহের ধুম লেগে যায়। হরেকরকম আতশবাজি পোড়ানো হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে রয়েছে মেক্সিকো। এখানকার শতকরা ৯০ ভাগ লোকই রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষ। ধর্মীয় মতে, ২ নভেম্বর ‘ডে অব ডেড’ বা ‘মৃতের দিন’। তাই বলে এই দিনে মেক্সিকানরা শোকবিহ্বল হয়ে কেঁদে ভাসান না, বরং আনন্দে বাজি-পটকা ফাটান। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ফ্রান্সে শুরু হয় গণতান্ত্রিক মানুষের সংগ্রাম। অত্যাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই হাজার হাজার মানুষ রাজকীয় দুর্গ ও বাস্তিল কারাগার দখল করেন। এখন ফরাসিরা বাজি পোড়ানোর মধ্য দিয়ে বাস্তিল যে স্মরণ করে।
খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলোউন ৩১ অক্টোবর উদযাপন করা হয়। এই অনুষ্ঠান এখন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। পাদরি বিশপের তত্ত্বাবধানে, বিধিনিষেধের বেড়াজাল টপকে সেটি বাচ্চাদের হাতে চলে এসেছে। এই দিনে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ধর্মীয় আচার বিচারের চেয়ে আনন্দ-স্ফুর্তিই বেশি হয়। পোড়ানো হয় বাজি পটকা। দীর্ঘ আট বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে ইংল্যান্ডের শাসন থেকে মুক্ত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৭৮৩ সালের ৪ জুলাই তারা স্বাধীনতা লাভ করে। তাই প্রতি বছর এই দিনে ওয়াশিংটনে বাজি পোড়ানোর আসর বসে।
খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষজন বিশ্বাস করেন, ক্রুশবিদ্ধ করে যিশুখ্রিষ্টকে কবর দেওয়ার পর ঈশ্বরপুত্রের আবার পুনরুত্থান ঘটে। তিনি সকল জীবের মঙ্গলের জন্য তাঁর দেহে পুনরায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। এই দিনটি ইস্টার ডে হিসাবে উদযাপন করা হয়। গুড ফ্রাইডের পরের রবিবার ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়াতে বাজি-পটকা ফাটিয়ে ইস্টার ডে উদযাপন করা হয়।
অর্থাৎ বাজি পুড়িয়ে ভূত  বা অপদেবতা তাড়ানোর বিষয়টি নতুন নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে বাজি পোড়ানোর ভূত অনেকের মাথা থেকে নামাতে পারলে ভালো হয়।
-ডাঃ পার্থপ্রতিম, বানারহাট, জলপাইগুড়ি।

Join our mailing list Never miss an update