ছাত্ররা বিপাকে পড়েছে; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; কলকাতা, ১ শ্রাবণ, বৃহস্পতিবার, ১৩৯৮; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের ভৌগোলিক অবস্থান দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা হলেও ছাত্রদের মধ্যে এ জেলার ছেলের সংখ্যা খুবই কম’- কথাগুলি অকপটে স্বীকার করে বললেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের অধ্যক্ষ স্বামী সুপর্ণানন্দ। এবার এই কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হওয়ার জন্য যারা আবেদন করেছে তাদের মোট কমপক্ষে আশি শতাংশ নম্বর পেতে হয়েছে। এই মিশনের স্কুল থেকে যারা পাশ করেছে তাদের ক্ষেত্রে পচাঁত্তর শতাংশ নম্বর পেলেও গ্রহনযোগ্য। হায়ার সেকেন্ডারী কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী কিছু আসন তফশিলী জাতি ও উপজাতি ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত। সে কারণে গত বছরেও কিছু ছাত্র মোট ৬২০ নম্বর পেয়ে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজে বিভিন্ন শাখায় ভর্তির জন্য মাধ্যমিকের প্রাপ্ত নম্বরই যথেষ্ট নয়, তারপর একটি অ্যাডমিশন টেস্টে পাশ করতে হয়। এবার এমনও দেখা গেছে এক ছাত্র মাধ্যমিকে ৭৯৬ নম্বর পেয়েও অ্যাডমিশন টেস্টে ভাল ফল না করার জন্য ভর্তি হতে পারে নি। কলা বিভাগে আসন এই কলেজে খুবই কম মাত্র বাইশটি। সেদিক দিয়ে বিজ্ঞানে অনেকই বেশি- একশোটি। সৌম্য দর্শন গেরুয়াধারী স্বামী সুপর্ণানন্দ জানালেন, জেলাগত ভাবে মেদিনীপুরের ছাত্ররাই এখানে বেশি পড়তে আসে।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অদূরেই রয়েছে হরিনাভী দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ অ্যাংলো সংস্কৃত স্কুল। গত বছর এই বিদ্যালয়ের বয়স একশো পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আনন্দমোহন চ্যাটার্জি জানালেন, প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ ছাত্ররা এখানে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারে, তবে তাদের স্কুলের ফার্স্ট ডিভিসন পাওয়া ছাত্রদের সরাসরি ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় এ স্কুল থেকে ২৫ জন প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। বাণিজ্য শাখায় ভর্তির আবেদনের জন্য কমপক্ষে ৪৫০ পেতে হবে ও অঙ্কে পেতে হবে ৩০ শতাংশ নম্বর। তবে তিনি তাঁদের নিজেদের স্কুলের ছাত্রদের ক্ষেত্রে ৪৩০ পেলেই কমার্স দিচ্ছেন। তফশিলী জাতি ও উপজাতি ছাত্ররা ভর্তির বিষয়ে এ স্কুলে কোন বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে না। উপযুক্ত ল্যাবরেটরীর অভাবে ৩০ জনের বেশি ছাত্র বিজ্ঞান শাখায় পড়ার সুযোগ পায় না। বাণিজ্য ও কলা শাখার আসন সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফলে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকেই ফিরিয়ে দিতে হয়। আনন্দমোহনবাবু জানালেন, কাউন্সিলের দ্বারা নির্ধারিত ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৫০:১। কিন্তু এই স্কুলে অনেক সময় এই অনুপাত ৮০:১-এ পৌঁছে যায়। ফলস্বরূপ ঠিকমতো ক্লাস পরিচালনা করার ক্ষেত্রে শিক্ষকরা অসুবিধায় পড়ছেন। রেজাল্টও ভাল করা যাচ্ছে না।
বারুইপুরের উপকন্ঠে মদারাট পপুলার অ্যাকাডেমী। মাঝারি মাপের এই স্কুলটিতেও ছাত্র ভর্তির চাপ কম নয়। প্রধান শিক্ষক গণেশচন্দ্র সরকার জানালেন, অন্যান্যবারের তুলনায় এ বছর মাধ্যমিকে তাদের স্কুলের ছাত্ররা খুবই খারাপ ফল করেছে। ১৩০ জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র তিনজন প্রথম বিভাগে পাশ করেছে, ২৮ জন কম্পার্টমেন্টাল ২৩ জন ফেল, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগে ৭৯ জন। মোট ৫০০ ও বিজ্ঞান বিভাগে ৬০ শতাংশ নম্বর যারা পেয়েছে বিজ্ঞানে ভর্তির জন্য তারা আবেদন করতে পারে। নিজের স্কুলের ছাত্রদের তিনি কিছু সুবিধা দেবেন। কলা বিভাগে পড়ার জন্য ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরা কিছু বাড়তি সুযোগ পায়। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ছাত্রদের পক্ষে দূরের কোন স্কুল বা কলেজে যাতায়াত করে পড়াশুনা করা সম্ভব। এছাড়াও যারা বংশের প্রথম ছাত্রছাত্রী হিসাবে পড়তে আসছে, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের ছাত্রীদের তিনি সাধারণত ফেরান না। তবুও দুঃখের বিষয় ক্লাসরুম ও শিক্ষকের অভাবে বহু ছাত্র-ছাত্রীকে ফিরিয়ে দিতে হয়। ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের জাতীয় শিক্ষিকার সম্মান প্রাপ্ত রাসমণি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতী অণিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমেই জানালেন, এই স্কুলে তৃতীয় বিভাগে বা কম্পার্টমেন্টাল দিয়ে পাশ করা ছাত্রীদের কোন স্থান নেই। এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় এ বিদ্যালয়ের তিনজন স্টারমার্ক পেয়েছে। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৭ জন, দ্বিতীয় বিভাগে ৬৪ জন, তৃতীয় শ্রেণীতে ৪৮ জন। কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাশ করে সায়েন্স গ্রুপে যারা ১৮০ ও ইংরাজীতে ৪৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছে সেইসব ছাত্রী এখানে বিজ্ঞান শাখায় আবেদন করতে পারে। বারুইপুর রেল স্টেশনের খুব কাছে থাকার জন্য দূর থেকে বহু ছাত্রী এখানে পড়তে আসে। গণেশ চন্দ্র সরকারের কথার প্রতিধ্বনি তুলে শ্রীমতী অণিমা দেবী বললেন, ছাত্রী ভর্তির প্রচন্ড চাপ থাকা সত্বেও উপযুক্ত সংখ্যক ক্লাসরুম, শিক্ষিকা না থাকার জন্য অনেক ভালো ছাত্রীকে ভর্তি করে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একাদশ শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রীর ভর্তির এই সমস্যা রায়দিঘি, ক্যানিং, গোসাবা, সাগর প্রভৃতি অঞ্চলেও ব্যাপক আকার নিয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এই অসুবিধা কিছুটা দূর করা সম্ভব না হলে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত এই সব ছাত্র-ছাত্রীকে এক অনুজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।