এ শুধু .... দিন , এ লগন রূপ দেখাবার ..

এ শুধু .... দিন , এ লগন রূপ দেখাবার ..

 “ এ শুধু .... দিন, এ লগন রূপ দেখাবার ...”; -ডাঃ পার্থ প্রতিম ।
     শেষমেশ এসে পড়ল। একেবারে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়লো । বঙ্গ জীবনের সবচেয়ে বড় অঙ্গ,  মেগা ইভেন্ট। দূগগা পূজা, শারদ উৎসব। আমাদের দিন কাটে থোড় বড়ি খাড়াতে। খানা-খন্দে ভরা পথঘাট, তাতে প্যাচপ্যাচে বৃষ্টি। বিরক্তির একেবারে চুড়ান্ত। এরই মাঝে কোন এক বর্ষা রাতের শেষে চা-বাগিচার সবুজ মখমলে আছড়ে পড়ে সোনা রোদের আভা। শরৎকাল! বুকের ভেতর ঢ্যাং কুড় কুড় বাদ্যি বাজে। বোনাস হয়, জমে ওঠে গুদরী বাজার। রাজার জামাই গান ধরে- “ আ- হা, কী আনন্দ, আকাশে বাতাসে।”
    আসলে কোন উৎসব একলা হয় না। দলবল লাগে। উৎসবের আঙ্গিনায় দিলের খিল খুলে যায়। এখানেই উৎসবের সার্থকতা। হাড় চিপ্পুস সুকল্যাণ নিজেই ফিলটার উইলস্ -এর প্যাকেট খুলে এগিয়ে দেয়। নবমী নিশিতে আমাদের টিঙ্কুদি নিজ থেকেই এগরোল খাওয়ায়। সেই কবে দাড়িওয়ালা- ছয় ফুট লম্বা ঐ লোকটি বলেছিলেন-“ আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া..”। উৎসবের দিনগুলিতে আমাদের মাঝে লুকিয়ে থাকা বিশ্বমানবটি বেড়িয়ে আসে। এখানেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে নিজেকে প্রকাশ করার। ভালবাসাকে প্রকাশ করবার। ভালবাসার অর্থ আত্মসমার্পন নয়; নিজের যাহা কিছু ভাল তাহাই সার্বজনীনতায় প্রকাশ করা।  উৎসবের দিনগুলিতে নিজের ভালকে তুলে ধরতে গেলে একটু মাজাঘষা করতে হয়। সুন্দর আঙ্গীকে উপস্থাপনা করতে হয় নিজেকে। এই সাফসুফ করার পোষাকী নাম রূপচর্চা। রূপচর্চার অনেক শাখা প্রশাখা। প্রসাধন, অলঙ্কার, সাজ-সজ্জা, সুগন্ধি আরো কত কী।  

    ঠিক কবে থেকে এই রূপচর্চা শুরু হয়েছে-  এ প্রশ্নের উত্তর দিতে ঐতিহাসিকরাও মাথা চুলকাবেন। তবে মধ্য প্রস্তর যুগে প্রসাধন ও অলঙ্কার ব্যবহারের কথা আমরা জানি। সিন্ধু সভ্যতায় যে সব নিদর্শন পাওয়া গেছে। তাতে পুরুষ মহিলা উভয়েই অলঙ্কার ব্যবহার করতো। প্রাচীন ভাষ্কর্য ও কোনারকের সূর্যমন্দিরের শিল্প থেকে একই প্রমাণ মেলে।  
    বাংলাভাষার প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শন চর্যাপদ। সেখানে উঁচু পর্বতের বাসিন্দা সবরী বালিকার গলে গুঞ্জ মালা পরার বিবরণ পাই
“ উঁচা উচাঁ পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গী পীচ্ছ পরহিন সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।। ”

    বৈষ্ণব পদাবলীতে খোঁপায় কুন্দফুলের কুঁড়ি ও গলায় মতির মালার বর্ণনা রয়েছে-
“ কুন্দ কুসুম ভরি কবরিক ভার,
হৃদয়ে বিরাজিত মোতিম হার । ”

    কালিদাসের কুমারসম্ভবে- উমা সেজেছেন শিবের গলায় মালা দেবেন বলে। লৌধ্র চূর্ণ দিয়ে দেহের মালিন্য দূর করে স্বর্ণ কলসের জল দিয়ে  পুরনারীরা স্নান করালেন উমাকে। চুল শুকানো হল ধূপতাপে। ওষ্ঠের উজ্জ্বলতা বাড়াতে লাগানো হল মৌচাকের মোম, চোখের পাতায় নীল কাজলের পরশ,সবশেষে উমাকে চন্দন পরিয়ে দিলেন হিমালয় পত্নী মেনকা।
    মহাকবির ঋতুসংহারে প্রতি ঋতু অনুযায়ী নানা বস্ত্র ও ভ’ষণের বর্ণনা রয়েছে। ঋতুসংহারের তৃতীয়সর্গে রয়েছে শরতের সাজসজ্জার বর্ণনা-
“ কাশাংশুকা বিকচ-পদ্মমনোজ্ঞবক্তা
সোন্মাদ-হংসর বনু পুরণাদরম্যা।
আপক-শালিরুচিরা তনুগাত্র ষষ্টিঃ
প্রাপ্তা শরন্নব বধূরিব রূপরম্যা।। ”
বাংলা করে বলতে পারি-
               “    শুভ্রকাশের বসন পরি’
                    সাজলে গো,
            বিকচ-কমল বয়ন তারি
                    হাসলে গো,
            মত্তমুখর হংসরবে
                    তুলছে যেন নুপুর-নাদ
            বিরলতৃণ পক্কশালী
                    তার মনোহর অঙ্গ-ছাঁদ
            এই ধরণীর হৃদয়লোভন রূপের আলো:
            নয়ান-বধূর মধুরবেশে শরৎ এলো ! ”
কালিদাসের রঘুবংশে দেখতে পাই কষায়রাগ রঞ্জিত পরিধানের কথা। কেবল পরিধেয় বসন নয়; নূপুর, হাতের অলঙ্কার, কুমকুম, লাক্ষারস, কাজল আরো বহু প্রসাধণের উল্লেখ আছে।

    শুধু দৃশ্য প্রসাধনের কথা বললে তো হবে না; প্রসাধনের জগতে কিছু রয়ে যায় চোখের আড়ালে। আপনার মন ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুন্দর আবেশে ভরিয়ে তোলে, আপনাকে করে তোলে ব্যক্তিত্বময়। সেদিক থেকে সুগন্ধি বা পারফিউম রূপচর্চার অন্যতম উপাদান। শুধু আজ নয় অতীত দিনের দলিল দস্তাবেজের ফাঁকে ফাঁকে লুকানো আছে এর গুণকীর্ত্তন। আসলে প্রতিটি মানুষের শরীরে তার ঘর্মগ্রন্থি থেকে বেরিয়ে আসে এক নির্দিষ্ট ঘ্রাণ। এটি নির্ভর করে সেবেসাস ও ঘর্মগ্রন্থি থেকে বেরিয়ে আসা ফ্যাটি অ্যাসিডের উপর। দেহের এই গন্ধ প্রত্যেকের আলাদা আলাদা। আঙ্গুলের ছাপের মতো এর সাহায্যের ব্যক্তিকে সনাক্ত করা যায়। মানুষ এই সূক্ষ পার্থক্য বুঝতে না পারলেও অনুসন্ধানী কুকুর তা বুঝতে পারে।   
    পূর্বে ধারণা ছিল ঘামের থেকে এ গন্ধ হয় পরে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ব্যাপক গবেষণা করে দেখেছেন এই ঘর্মগ্রন্থি নিঃসৃত ক্ষরণের কোন গন্ধ নেই। শরীরের ঘামে এই ধরনের বিশেষ জৈব পদার্থ থাকে। যার মধ্যে বাসা বাঁধে ব্যাকটেরিয়া। শরীরের কিছু অংশের উত্তাপ অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি থাকে। যেমন বাহুমূল। এই উত্তাপ জীবাণুর বংশ বৃদ্ধির সহায়ক। এই কারণেই অস্বস্তিকর গন্ধ তৈরী হয়।  
    বহু প্রাচীনকাল থেকে মানুষ সুরভিত পরিবেশে তৈরীর সবসময় সচেষ্ট ছিল। রূপচর্চার সঙ্গে এর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কস্তুরি, মৃগনাভি সুরভিত, চন্দনচর্চিতা নারী যার কেশে ধুনোর মিট গন্ধ, যাঁর খোঁপার গন্ধে বিবশ কুসুম, যার হাতে ধরা কমল - কোরক, যার ওষ্ঠ ভারে তাম্বুল সুরভি, যার কপোলে ফুলের রেণুর সুগন্ধি। মহাকবি কালিদাসের ঋতুসংহারের পত্রে পত্রে রয়েছে এই সুরভিত সংবাদ। যুগ যুগ ধরে নারী তার প্রসাধন কার্য সমাপন করেছে সুগন্ধি চর্চিত হয়ে।

মিশরের ক্লিওপেট্রার প্রসাধনের কথা তো সবারই জানা। বিভিন্ন গাছপালা শেকড় বাকড় থেকে প্রসাধন তৈরীর ব্যাপারে তিনি ছিলেন পারদর্শী। তার সুগন্ধির প্রস্তুতি ছিল গোপন রহস্যে ঘেরা। আমাদের এ দেশে মোঘল সাম্রাজ্য পত্তন হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয় বিভিন্ন আতর তৈরীর প্রচলন। শোনা যায় হুমায়ুন পুত্র আকবরের জন্মের সময় পিতা হুমায়ুন ছিলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত। তা সত্ত্বে আকবরের জন্ম মুহুর্তে কস্তুরি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন । শুধু বাদশা - বেগম নয়, মোঘল আমলে গোলাম বাঁদি পর্যন্ত আতর ব্যবহার করত। সাম্রাজ্ঞী নূরজাহান নিজের হাতে তৈরী করতেন তাঁর আতর। তার জন্য কত রকম ফরমায়েশ, কত রকম আয়োজন।

    গোলাপ ফুলের রস স্নানের জলে মিশিয়ে তাতে অবগাহন করার রীতিও বেশ প্রাচীন। রাজপুতদের মধ্যে হোলি খেলার প্রচলন শুরু হয়। এই হোলির আবীরে ছড়িয়ে দেওয়া হত সুগন্ধি দ্রব্য। আবীরের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া সুগন্ধে ভরপুর হয়ে যেত সকলে। আবীর, গুলাল,কুমকুমে রাঙা রঙিন বসন্ত- সেদিন মেতে উঠত গোলাপ, চাঁপা, যু্ইঁ - এর সৌরভে।
সুন্দরী হতে গেলে শুধু সুন্দর মুখশ্রী হলে চলবে না। হতে হবে সর্বাঙ্গ সুন্দর । সুন্দর মুখের সাথে ফাটা গোড়ালি, এবড়ো-খেবড়ো নখ আপনাকে অপ্রস্তুত করে দিতে পারে। রূপচর্চা সম্বন্ধে আপনার সঠিক জ্ঞানের অভাব তা প্রমাণ করবে। কবিগুরুর ‘ নিমন্ত্রণ ’ কবিতাটি মনে আছে-
“খালি হাতে যদি আস তবে তাই এসো
সে দুটি হাতেরও কিছু কম নহে দাম।”
কিংবা
“ গৌর বরণ তোমার চরণ মূলে
ফলসা বরণ শাড়িটি ঘেরিবে ভালো ”
    তাই হাত ও পায়ের জন্য বিশেষ যত্ন নিতে হবে। রূপচর্চায় যে পদ্ধতিতে হাতের যত্ন নেওয়া হয় তাকে বলে ম্যানিকিওর(হস্তচর্চা) এবং পায়ের যত্নকে বলে প্যাডিকিওর(পদচর্চা)।
    রূপচর্চার মূল কথা হয় সৌন্দর্যসচেতনতা। নিজেকে সুন্দর করে তুলতে হলে প্রথমেই জানতে হবে আপনি আসলে কেমন। আপনার গায়ের রঙ, দেহের উচ্চতা, যে অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন তার বিষয়, কোন সময় অনুষ্ঠানটি হচ্ছে এসব কিছু মিলিয়ে নির্বাচন করতে হবে আপনার পোষাক-পরিচ্ছদ, প্রসাধন, অলংকার আর সব কিছু। অনেকের গায়ের রঙ এমন যে তাকে সব রকম শাড়ি, জিনস, মিডি, সালোয়ার কামিজে মানিয়ে যায়। কিন্তু যাঁদের সে সৌভাগ্য ঘটে নি তাদের একটু ভাবতে হবে। যাদের রঙ কালো তারা তুঁতে, সবুজ, গোলাপী, হলুদ, কমলা, রাণী রঙের পোষাক এড়িয়ে চলুন।   

    অনেক কথা হল বলা, এবার শেষ কথাটি বলি। আমাদের মুখ হল মনেরই আয়না। মনের অভিব্যক্তি চেতন বা অবচেতনে ফুটে ওঠে মুখ-চোখের আর্শিতে। মুখকে লাবণ্য ও স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিতে চাইলে রূপ প্রসাধনের সাথে সাথে হৃদয়কে করে তুলতে হবে নির্মল, শান্ত ও পবিত্র।  
একথা নতুন কিছু নয়। বাইবেলে বলেছে- “There is no Cosmatic, Like Happyness”   আন্তরিক প্রশান্তিই সেরা প্রসাধন। কালিদাসের অভিজ্ঞানম্ শকুন্তলম্ - এ আশ্রমবাসী শকুন্তলার মধ্যে দেখতে পাই সেই স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের দীপ্তি। সকলের প্রতি ভালবাসা, মমত্ববোধ, সকলকে আপন করে নেবার মানসিকতা তোমার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে এক দুর্দমনীয় স্নিগ্ধতা। শিরা- ধমনিতে বইয়ে দেবে বর্ষা শেষের অনাবিল উত্তাপ।     
বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেন এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, তাঁর বিচারে- “ বিশ্বের সেরা সুন্দরী মাদার টেরেজা। ” বন্ধু এ কথার আক্ষরিক অর্থ খুঁজতে গেলে হয়তো হোঁচট খাবো। তার চেয়ে এসো দু’ চোখ বন্ধ করে কল্পনা করি- পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণকামী পরমপিতার কাছে প্রার্থনারত এক অশীতিপর বৃদ্ধার সেই ছবিটি। কী, আমাদের প্রচলিত সৌন্দর্যকে এটি ম্নান করে কী না?
    কোন্ অস্টিনজেন ব্যবহার করতেন গৌতমবুদ্ধ? কোন্ ফেসপ্যাক মাখতেন স্বামী বিবেকানন্দ? এসব আমাদের জানা নেই। তবে এটা জানি এইসব বিশ্বপথিকদের মধ্যে এমন এক সৌন্দর্য বিরাজ করতো যা তুফান তুলেছে বহু বহু সহস্র মানুষের মন-মনন-মানসিকতায়। তাই রূপচর্চার মাধ্যমে বন্দনা করতে হবে জীবনদেবতার। ভালবাসার ডাস্টার দিয়ে সাফসুফ করতে হবে অন্তরের হিংসা, ক্রোধ, মলিনতাকে। এসো এই অরুণ আলোর সোনারকাঠি ছুঁইয়ে দেও হৃদয়-তনু অনুভবে। এই শরতের বিজয়মাল্য তোমার গলাতেই দুলবে ...কথা দিলাম।

Join our mailing list Never miss an update