চাই দীপঙ্কর রায়ের পূর্ণাঙ্গ জীবনী; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ফেব্রুয়ারী ২০০৩ সংখ্যা; জ্ঞান বিচিত্রা (ত্রিপুরা) পত্রিকায় প্রকাশিত
জ্ঞান বিচিত্রা পত্রিকার এপ্রিল-মে ২০০২ সংখ্যাটি হাতে পেলাম। দীপক কুমার দাঁ-র লেখা ‘দীপঙ্কর রায় ও বিজ্ঞান ক্লাব আন্দোলন’ লেখাটি ভালো লাগলো। ডঃ দীপঙ্কর রায়কে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল।
কলকাতার সেন্ট পল ক্যাথিড্রাল চার্চের মাঠে বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করত জহর শিশুভবন ও NCERT। চার্চের মাঠ জুড়ে তৈরি হতো প্রদর্শনীর প্যান্ডেল। আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ছাড়াও এই মেলায় আসতো বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা।
আমি তখন একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। ডুয়ার্সের এক গ্রামীণ স্কুল থেকে এই মেলায় মডেল নিয়ে গিয়েছি। বাদামি রঙ্গের আটপৌরে খদ্দরের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, পায়ে, আদ্যিকালের চামড়ার চটি পরে এক ভদ্রলোক ডুয়ার্সের বিজ্ঞান সংগঠন সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি ঘুরে বেড়াতেন মেলা প্রাঙ্গণে আপনি কী করেন? জিজ্ঞাসা করতে তিনি বলেছিলেন- “আমি এই আর কী... শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথেই যুক্ত।” তাঁর পোশাক- আশাক হাবভাব দেখে আমরা ধরে নিয়েছিলাম, তিনি নিশ্চয়ই কোনো ইস্কুলের দপ্তরী বা অশিক্ষক কর্মী। তাছাড়া যদি টিচারই হন; তবে তো সগর্বে নিজের পরিচয় দিতেন।
পরে অন্য সূত্রে জানতে পারি তিনি ডঃ দীপঙ্কর রায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক। এরপর বিজ্ঞান ক্লাব আন্দেলনের সূত্র ধরে বহুবার দীপঙ্করদার বাড়িতে গেছি। দেখছি বাড়িতে কাজের মাসি ছাড়া আর সকলেই ডক্টরেট।
দীপঙ্করদার সাথে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি, বোস ইনস্টিটিউট, সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক, ন্যাশনাল ইনস্ট্রুমেন্টস, আরো বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিজ্ঞানীদের কাজকর্ম-গবেষণার ধরন ধারন খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
১৯৮৭ সালে ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের আর্থিক সহায়তায় ‘দি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এ বিজ্ঞান সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম চর্চার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। সে সময় দীপঙ্করদার যাদবপুর-এর বাড়িতে নিয়মিত যেতাম। তখন দেখছি বহু স্কুলের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দীপঙ্করদার তত্ত্বাবধানে পি এইচ ডি করছেন। তারই পাশাপাশি পাড়ার ছোট্ট ছেলেটি পিতা পুত্রের বয়সের সমষ্টি সংক্রান্ত পাটিগণিতের অঙ্ক দীপঙ্করদার কাছ থেকে বুঝে নিচ্ছে। ছেলে-বুড়ো-গবেষক-অজ্ঞ সকলেই সমান মনোযোগ দিয়ে পড়াতেন। দীপঙ্করদা ইসকা(Eastern India Science Club Association)-কে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসতেন। বিভিন্ন বিজ্ঞান ক্লাবগুলির মধ্যে পারস্পরিক মত বিনিময় ও সহযোগিতার আদানপ্রদানের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৩ সালে গড়ে তোলা হয় ইসকা। ইসকার সদস্য ক্লাবগুলি তাদের নিজস্ব পরিচিতি (Identity) বজায় রাখতে পারবে। বৃহৎ সংগঠন কোনো ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র ক্লাবগুলিকে গ্রাস করবে না। বিষয়টি বিভিন্ন ফুলে গাঁথা মালার মতো হবে। স্থানীয় প্রয়োজন, সমস্যা, উপলদ্ধি অনুসারে বিজ্ঞান ক্লাবগুলি কাজ করবে এটাই হল ইসকার লক্ষ্য। ডঃ রায় এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই ইসকায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৯১ ও ১৯৯২-তে ইসকার সাধারণ সম্পাদক হয়ে আমি বিজ্ঞানক্লাবগুলির মধ্যে সমন্বয়ের কাজে আগ্রহী হই। সে সময় রায়দীঘি, ক্যানিং, ঠাকুরনগর, কিষানগজ্ঞ, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। সব জায়গায় দেখেছি দীপঙ্করদার আপনজন ছড়ানো। সে সময় ইসকার সভানেত্রী ছিলেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজির ডেপুটি ডিরেক্টর ডঃ অনিতা পাকড়াসী।
পদ্ধতিগত কারণে আমাদের সাথে আমাদের সাথে দীপঙ্করদার বহুবার মতভেদ ও মতান্তর হয়েছে। তবে কোন ক্ষেত্রেই মনান্তর হয়নি, দীপঙ্করদা সবসময় সহযোগিতা করেছেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ ডি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি এস সি ছাড়াও গবেষণার কাজে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গেছেন। সান্নিধ্যে এসেছেন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীদের। শুধু গণিত নয়, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল সব বিষয়েই ডঃ রায়ের অগাধ পান্ডিত্য। প্রসঙ্গ তুললেই হল, যে কোনো বিষয়ে তিনি নির্বিকারে বলতে পারেন।
এরপর কর্মসূত্রে ও পারিবারিক কারণে আমি উত্তরবঙ্গে চলে আসি। দীপঙ্করদা এখনো যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০২ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সভাগৃহে আমাকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস পুরস্কার দেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখি দীপঙ্করদা অনেক আগে থেকেই সেখানে দাড়িঁয়ে আছেন। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন- ‘পার্থপ্রতিম আমি খুব খুশি হয়েছি।’
জীবনে চলার পথে বহু লোক দেখেছি। তবে ডঃ দীপঙ্কর রায়ের মতো নিরহঙ্কারী, প্রচার বিমুখ, গদির লোভহীন, নিরলস মানুষ তেমন কেউ চোখে পড়েনি। এমন ব্যক্তির ছবিসহ পূর্ণাঙ্গ জীবনী ‘জ্ঞান বিচিত্রা’র পাতায় প্রকাশিত হওয়া উচিত। বাঙালির চিরাচরিত প্রথা ভেঙ্গে এটা করতে হবে ডঃ রায়ের জীবদ্দশাতেই। এই দায়িত্ব আমাদের শ্রদ্ধেয় দীপকদা (শ্রীদীপককুমার দাঁ) স্বচ্ছন্দে পালন করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
ডাঃ পার্থপ্রতিম। বানারহাট; জলপাইগুড়ি