প্যারালিসিস; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ৬ আগস্ট ২০০৫; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
প্যারালিসিস বা পক্ষাঘাত মূলত স্নায়বিক রোগ। বিভিন্ন কারণে স্নায়ু বা নার্ভের কাজ কারবার বাধাপ্রাপ্ত হলে প্যারালিসিস হতে দেখা যায়। আমাদের দেহের প্রায় সবরকম কাজকর্মই নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্ক থেকে। ধরা যাক, এই মুহূর্তের কথা। আপনার মস্তিষ্ক ঠিক করল, আপনি এই পত্রিকার ‘সুস্থ থাকুন’ পাতাটি পড়বেন । মুখের পেশি ও জিভ নড়েচড়ে শব্দ তৈরি করল- ওগো শুনছো আমাকে শনিবাসর পাতাটা দাও তো। এরপর আপনি দু-হাত দিয়ে পাতাটি ধরলেন আপনার চোখের দৃষ্টি পেরিয়ে চলল একের পর এক কালো অক্ষরগুলি। অপটিক নার্ভের মধ্য দিয়ে গুরু মস্তিষ্কে পৌঁছে যেতে লাগল দুরারোগ্য প্যারালিসিস সম্বন্ধে বহু মূল্যবান তথ্য। আর বোঝার খাতিরে ধরা যাক, আপনি প্যারালিসিসে আক্রান্ত। কথা বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু জিভটি ইচ্ছেমতো নাড়াতে পারছেন না। দু-হাত দিয়ে পেপারটি ধরার চেষ্টা করছেন, কিন্তু হাতের পেশিগুলি অসাড় হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, প্যারালিসিসে এমনটি হয়ে থাকে। আমাদের শরীরের এক বা একগুচ্ছ স্নায়ু দেহের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবরাখবর মস্তিষ্কে নিয়ে যায়। আবার মস্তিষ্ক থেকে সবরকম নির্দেশ এই নার্ভগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন পেশি ও কলায় পৌঁছায়। স্নায়ুতন্ত্রগুলির এই শরীর জোড়া জাল, কোনও জায়গায় অবরুদ্ধ হলে পক্ষাঘাত বা প্যারালিসিস দেখা দেয়। পক্ষাঘাত কখনও শরীর জুড়ে হতে পারে। কখনও দেখা যায় দেহের ডান অথবা বাঁ-দিকে হয়েছে। কখনও আবার নিম্নাঙ্গ জুড়ে হয়। এছাড়া জিভ, হাত, পা, ঠোঁট এসব অঙ্গেও প্যারালিসিস হতে পারে।
আমাদের মস্তিষ্ক দুটি অর্ধগোলাকার অংশে বা হিমোস্ফিয়ারে বিভক্ত। ডানদিকে থাকা অংশটি রাইট লোব এবং বাঁ-দিকের লেফট লোব নামে চিহ্নিত। দেহের ডানদিকের ক্রিয়াকলাপগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় বাম মস্তিষ্ক থেকে। আর বাঁ দিকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চলে ডান মস্তিষ্কের নির্দেশে। এছাড়াও মগজ নামক পার্লামেন্টে রয়েছে বারোটি পৃথক মন্ত্রক। এদের বলে ক্রেনিয়াল নার্ভ। এই নার্ভগুলির কেউ চোখ, কেউ নাক, কেউ কান, কেউ কথা বলার বিষয়গুলি দেখভাল করে। বিভিন্ন ক্রেনিয়াল নার্ভের মধ্যে সবরকম সুষ্ঠু সমন্বয় বাজয় রাখাও মগজের কাজ। যেমন এন বি এস টি সি নিয়ে পরিবহন মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের বিরোধ হলে মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেন। অনেকটাই সেরকম।
মস্তিষ্ক থেকে মেরুদন্ডের ভেতর দিকে মোটা স্নায়ুরজ্জু নেমে এসেছে দেহের নিম্নপ্রান্ত পর্যন্ত। এই রজ্জু থেকে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে হাত-পা সহ দেহের বিভিন্ন অংশে। প্রচলিত কথায় একে বলে সুষুম্না কান্ড। স্নায়ুতন্ত্র আবার দু-রকমের। একদল পরিবেশের বিভিন্ন অনুভূতি বহন করে মস্তিষ্কে নিয়ে যায়, এদের সেন্সরি নার্ভ বলে। আবার একদল মস্তিষ্ক থেকে বিভিন্ন নির্দেশ পেশি ও কলায় ও পৌঁছে দেয়। এদের নাম মোটর নার্ভ বা সংজ্ঞাবহ স্নায়ু। এই দুই প্রকার নার্ভের কোনও একটি বা দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেই প্যারালিসিস হয়ে থাকে।
ডাক্তারি শাস্ত্রে লক্ষণ অনুসারে প্যারালিসিস-কে আমরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ করি। মস্তিষ্কের বাঁ-দিকে আঘাত লাগলে ডানদিক আক্রান্ত হয়। আর ডান দিক ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাঁ-দিকে প্যারালিসিস দেখা দেয়। মোটরনার্ভ আক্রান্ত হলে রোগী তাঁর হাত, পা বা সংশ্লিষ্ট অঙ্গ নড়াচড়া করতে পারে না। এর সঙ্গে সেন্সর নার্ভের কার্যক্ষমতা যদি নষ্ট হয়, তবে সেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ঠান্ডা গরম, ব্যথা-বেদনা, স্পর্শ এইসব অনুভূতি লোপ পায়। একে আমরা বলি হেমিপ্লেজিয়া।
মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসা সুষুম্নাকান্ডের উপরিভাগ বা মেডুলা অবলংটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে চার হাত, পা অর্থাৎ পুরো দেহে প্যারালিসিস দেখা যায়। একে কোয়াড্রিপ্লেজিয়া বলে। দেহের নিম্নাংশে যেমন দুটি পায়ে পক্ষাঘাত হলে তাকে প্যারাপ্লেজিয়া বলা হয়। এছাড়াও জিভের ক্ষেত্রে টাঙ পালসি, মুখের ক্ষেত্রে ফেসিয়াল পালসি, এরকম আরও বহুরকম।
বিভিন্ন কারণে পক্ষাঘাত হতে পারে। বেশি বয়সে যে প্যারালিসিস দেখা দেয় তা হয় মূলত মস্তিষ্কে স্ট্রোক থেকে। মগজের ভেতর অসংখ্য রক্তনালি আছে। এই নালিগুলি স্নায়ু কোষগুলিতে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে । কোনও কারণে মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বাধা পেলে স্নায়ু কোষগুলি নষ্ট হতে থাকে। প্রচলিত কথায় একে বলে ব্রেন স্ট্রোক। ফলে মগজের গোলযোগ থেকে পক্ষাঘাত দেখা যায়। গোলযোগ দুধরনের হতে পারে। মস্তিষ্কের ধমনিতে রক্তজমাট বেঁধে গেলে তাকে বলে সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস। আর ধমনির দেওয়াল কেটে রক্তক্ষরণ হলে তাকে বলে সেরিব্রাল হেমোরেজ। ধমনি বা শিরার মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে সেই রক্তের দলা বা জমাট রক্ত সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকে। এরা মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র এইসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পৌঁছে বিপত্তি ঘটায়। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে এম্বোলিজম। অনেক ক্ষেত্রে এই এম্বোলিজম ব্রেন স্ট্রোকের কারণ হয়। শুধু প্যারালিসিস নয়, উন্নয়নশীল দেশে ঘাতকের তালিকায় সেরিব্রাল স্ট্রোক তৃতীয় স্থান দখল করে আছে। পুরুষদের মধ্যে এর প্রবণতা মহিলাদের তুলনায় দেড়গুণ বেশি। ৭৫-৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস এবং ১৫-২০ শতাংশ ক্ষেত্রে সেরিব্রাল হেমারেজ থেকে ব্রেন স্ট্রোক হতে দেখা যায়।
নার্ভ ফাইবার বা স্নায়ুতন্তুতে আঘাত লাগার ফলেও প্যারালিসিস হতে পারে। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে ট্রমাটিক ইনজুরি। অনেক সময় দেখা যায় কোনও দুর্ঘটনায় আপনি আঘাত পেলেন, ধীরে ধীরে সুস্থও হয়ে উঠলেন। ক্ষত শুকিয়ে গেল, তারপর দেখা দিল পক্ষাঘাত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ অসাড় হয়ে পড়ে ও কিছুদিন পর আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যায়। তবে সব কিছু নির্ভর করে আঘাতের তীব্রতা এবং কোন নার্ভে কীভাবে আঘাত লেগেছে তার উপর।
বাত থেকেও অনেক ক্ষেত্রে প্যারালিসিস দেখা যায়। বিশেষত, ভেজা আর্দ্র পরিবেশে যাঁরা বাস করেন। মূলত বিটা হেমোলাইটিক স্ট্রেপটোককাস জীবাণু এর জন্য দায়ী।