‘তোমার অসীমে’ এক ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা; সুব্রত রায়; ২৭ মে, ২০১১; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
‘জবাকুসুম সংকাশং কাশ্যপিয়ম মহা দ্রুতিম...’। সূর্যদেব ধীরে ধীরে অস্ত চলেছেন পশ্চিম পটে। নিকষ কালো আকাশের চাঁদোয়ায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে তারা, গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা আরও কত আলোর রোশনাই। যন্ত্রসংগীতের আবহে ভেসে আসছে-‘মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগন মাঝে, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছে চির সংকট হরণে...’। পর্দার আলোছায়ার মাঝে দেখা দিচ্ছে কবিগুরুর নীলাভ অবয়ব।
হ্যাঁ, এভাবেই শুরু হচ্ছে ‘ডিয়ার’ পরিবেশিত অডিয়ো ভিজ্যুয়াল শো ‘তোমার অসীমে...’। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে সারা দেশজুড়ে শুরু হয়েছে কবিকে ঘিরে নানা কর্মযজ্ঞ। বানারহাটের বিজ্ঞানভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ডিয়ার’ রবীন্দ্রজীবনের এক অনালোচিত বিষয় নিয়ে এক ব্যতিক্রমী কাজ করেছে। মাত্র সাড়ে বারো বছর বয়সে ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’ এই নাম তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধ লেখেন। লেখাটি প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনীর বাংলা ১২৮০ সালের পৌষ সংখ্যায় অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ। এখন এটা মোটামুটি স্বীকৃত যে সেটাই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত গদ্যরচনা। আসলে এটা ছিল একটি ধারাবাহিক রচনার অংশ বিশেষ; কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক পরবর্তীকালে তা আর ছাপা হয়নি।
এর অনেক পরে জীবনসায়াহ্নে এসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ ‘বিশ্ব পরিচয়’। অসীম আকাশ ও মহাকাশের সঙ্গে কবি মননের আজীবন সংম্পৃক্তির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে ‘তোমার অসীমে. . .’-তে। ডিজিটাল লাইট প্রসেসিং প্রজেকটার ও ল্যাপটপের সাহায্যে চোখের সামনে মেলে ধরা হয় এক মোহময়ীজগৎ; যার সবকিছু রাবীন্দ্রিক সুষমায় ভরা। বিরল তথ্য ও দলিল-দস্তাবেজে ঠাসা এই ষাট মিনিটের অনুষ্ঠান। কবিগুরু ‘বিশ্ব পরিচয়’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন তার প্রিয় মানুষ বিজ্ঞানী সত্যেন বোস-কে। সত্যেন বোস ততদিনে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করে আন্তজার্তিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার নাম অনুসারে একটি পারমাণবিক কণার নাম হয়েছে ‘বোসন’। উৎসর্গ পত্রে রবীন্দ্রনাথ কী লিখেছেন দেখা যাবে সেটাও।
উনিশশো ত্রিশের দশকে বিশ্বভারতীর শিক্ষাভবনকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ইন্টার মিডিয়েট পর্যায়ে স্বীকৃতি দেবার প্রস্তাব ওঠে। সেসময় ডক্টরেট হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় একটি দূরবিন কেনা হয়। এই হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় পরে স্বাধীন ভারতে, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হন। সেসময় শান্তিনিকেতনে আর্থিক টানাটানি চলছে; তবুও তার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের একান্ত আগ্রহে দূরবিনটি কেনা হয়। ১৯৩৩ সালে লন্ডনের টি এইচ স্টুয়ার্টের ঘরে তৈরি দূরবিনটি বেশ শক্তিশালী ছিল। কবিগুরু নিজে তো মাঝে মাঝে দেখতেনই। তাছাড়া আকাশ পরিষ্কার থাকলে ছেলেমেয়েদের চাঁদের পাহাড়, শনির বলয় দেখাতেন। সেই ঐতিহাসিক দূরবিনের প্রতিকৃতি দেখা যাবে এই অডিও ভিজ্যুয়াল শোতে। জানা যাবে তার নেপথ্য কাহিনী। ষাট মিনিটের এই শোতে দেখানো হয়েছে কবির জীবনের বহু দূর্লভ ছবি। আইনস্টাইনের পরিবারের সঙ্গে কবি, শৈশবের রবীন্দ্রনাথ, আলমোড়া পাহাড়ে কবি, জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে লেখার পান্ডুলিপি, রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রার দৃশ্য থেকে সেই শ্মশানের ছবি যেখানে রবীন্দ্রনাথের নশ্বর দেহ অগ্নিস্পর্শে লীন হয়ে যাচ্ছে।
‘তোমার অসীমে’- এর পরিকল্পনা ও পরিচালনায় রয়েছেন ‘ডিয়ার’ -এর সভাপতি ডাঃ পার্থপ্রতিম। বিজ্ঞানচেতনা প্রসার, কুসংস্কার দূরীকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে বিগত কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন ডাঃ পার্থপ্রতিম। এই ব্যতিক্রমী মানুষটি একাই বহুবচন। চিকিৎসক জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে তিনি ফুল বাগানের অভিজ্ঞ মালি, ছবি তোলেন, ছবি আঁকেন, দাদরা-কাহারবায় ভালোই তাল মেলান তবলা-খোলে, দূরবিন দিয়ে আকাশের গ্রহ-তারা দেখান স্কুলপড়ুয়াদের। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক দু-খানি বই লিখে প্রশংসিত হয়েছেন গুণীজন মহলে। সপ্তাহে একদিন বরাদ্দ এই সমাজসচেতনতামূলক কাজের জন্য। বিশেষতঃ প্রোজেকশনের সাহায্যে স্বাস্থ্য, পরিবেশ, কুসংস্কার- এইসব বিভিন্ন বিষয় তিনি এমনভাবে তুলে ধরেন যা দর্শকের মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে যায়। এই ‘তোমার অসীমে’ -তে নেপথ্যে কন্ঠ দিয়েছেন আকাশবাণী শিলিগুড়ির বাচনিক শিল্পী অতনু চৌধুরী ও সোমনাথ দাস, বিপ্লব পাল, অরবিন্দু বসু। চিত্রনাট্য সম্পাদনার কাজ করেছেন প্রলয় দেসরকার। এই প্রকল্পের মুখ্য উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষ। বিভিন্ন তথ্য সংকলন করেছেন ডঃ অমিত কুমার দে, সুনীল কুমার চক্রবর্তী, রঞ্জু মিত্র, শৈবাল কুমার ভট্টাচার্য। ইতিমধ্যেই ডুয়ার্সের বিভিন্ন স্কুল-ক্লাবে প্রদর্শিত হচ্ছে এই অডিয়ো ভিজ্যুয়াল শো। ‘ডিয়ার’ এর সৈনিকেরা বিনা পারিশ্রমিকেই এই অনুষ্ঠানটি করে চলেছেন।
আকাশ ও মহাকাশ বিষয়ক বিভিন্ন রবীন্দ্রসংগীতকে চিত্রায়িত করে ব্যবহার করা হয়েছে ভিডিও ক্লিপিং হিসেবে। এই অনুষ্ঠানে শব্দ সংযোজনার কাজ করেছেন সুকল্যাণ ভট্টাচার্য। সুকল্যাণবাবু বলেন- ‘সুর ও সংগীতের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কোনো ছুৎমার্গ ছিল না। বিভিন্ন প্রদেশের, বিভিন্ন দেশের সুর ছন্দ তিনি নিয়ে এসেছেন বাংলা ভাষায়। সে বিষয়কে মাথায় রেখে ‘তোমার অসীমে’- এর নেপথ্যে সংগীত হিসাবে রবীন্দ্রসংগীতের সুরের পাশাপাশি ব্যবহার করেছি পাশ্চাত্যের উচ্চাঙ্গ সংগীত। কেনেজি, হ্যারিসন বার্টউসেল, ম্যাগনাস লিন্ডবার্গ, টমাস এডই আরও বহু শিল্পীর মর্মমূর্ছনা শোনা যাবে এই অনুষ্ঠানে।
আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ আলাপ হয় ১৯২৬ সালে। এর আগে থেকেই দু-জনে দু-জনার গুণগ্রাহী। কবির সঙ্গে বিজ্ঞানীর প্রথম সাক্ষাতের তেমন লিখিত বিবরণ পাওয়া যায়নি। তবে কবি সম্বন্ধে বিজ্ঞানীর মনে যে যথেষ্ট শ্রদ্ধা জেগেছিল তার প্রমাণ একটি চিঠি রয়েছে। বার্লিনের বাইরে পটসডামের কাছে কাপুথ নামের ছোটো শহর থেকে ১৯২৬ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে প্রথম চিঠিটি লেখেন। জার্মান ভাষায় লেখা সেই চিঠির প্রতিকৃতি দেখা যাবে পর্দায়। শোনা যাবে সেই ঐতিহাসিক পত্রের বাংলা অনুবাদ।
যে কোনো দেশের ডাকটিকিট প্রকাশ করে সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার; বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। রবীন্দ্রনাথ যে প্রকৃত অর্থেই বিশ্বকবি তা বোঝাতেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত ডাক টিকিটগুলি দেখানো হয়েছে প্রতীকী ব্যঞ্জনায়।
সার্ধশতবর্ষে রবিঠাকুরকে নিয়ে অনেক কিছু শুরু হয়েছে। বড়ো বড়ো প্যান্ডেল, মূর্তিস্থাপন, বড়ো সেমিনার আরও কত কী। ‘তোমার অসীমে’- এর কুশীলবদের ভাবনাটা একটু অন্যরকম। প্রলয় দে সরকারের কথায় রবীন্দ্রনাথ ভগবান ছিলেন না। ভগবান বলে বাস্তবে কেউ আছে কী না; তা আমাদের জানা নেই। তার আদর্শ অনুসরণযোগ্য; তবে তিনি পুজো করার বিগ্রহ নন। আর একথা ভুলে গেলে চলবে না; রবীন্দ্রনাথ নিজেই পৌত্তলিকতা- মূর্তিপূজো ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাই ঠাকুর নমো করো! এটা তোমার পুজোর ছলে তোমায় ভুলে থাকা।’ আমরা যে কথাটি বিশ্বাস করি ও গলা ছেড়ে বলতে চাই - দেশপ্রেম, সততা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া কেউ রবীন্দ্র অনুরাগী হতে পারে না।’
কবি জাগতিক আলো-কে শুধু চোখের আলো হিসেবে দেখেননি। আলোর পরশে মনের আঁধার-কালিমা দূর করার কথা বারবার বলেছেন। ডাঃ পার্থপ্রতিমের কথায়- ‘আকাশের বিশালতা ধ্বংস করতে পারে আমাদের মনের কোণের সব দীনতা, মলিনতা, লোভ, লালসাকে, কবির এই ভাবনাকে হাতিয়ার করে আমরা পদানত করতে চাই- আত্মপ্রেমকেন্দ্রিক মানসিকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, বিভেদকামী সকল অশুভশক্তিকে।’
সাড়ম্বরে সার্ধশতবর্ষ উদযাপনের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রদর্শন সাধারণ মানুষের কাছে কতটা অর্থবহ হয়ে উঠবে যে প্রশ্ন তো থাকবেই। তবে কোনোরকম সরকারি-বেসরকারি অনুদান ছাড়া ডুয়ার্সের এক গ্রামে বসে এ ধরনের ব্যতিক্রমী গবেষণামূলক কাজ করাও যে সম্ভব সে কথাই এখন আলোচিত হচ্ছে গুণীজন মহলে।