পায়ে-পায়ে ১ শো (১৯০৫-২০০৫); ডাঃ পার্থপ্রতিম। চামুর্চী হাটের শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায়
সে অনেক কালের কথা। পূর্ব হিমালয়ের শিবালিক পর্বতমালা থেকে শৈল তটিনী বয়ে আনছে পলি, নুড়ি, বালি। পাহাড়ের পাদদেশে তিল তিল জমে তৈরী হয়েছে আধপাহাড়ী ভূখন্ড। তখনো দেশভাগের লকলকে আগুন ছুঁতে পারেনি এই দেশটাকে। ভুটানের লাগোয়া সীমান্ত গ্রাম চামুর্চী। চড়াই উৎড়াই পাকদণ্ডী বেয়ে সোনালী কমলা, ধূসর সাদা, তুষারশুভ্র মাখন- সূরপী নিয়ে নেমে আসছে মানুষজন। বোঝা পিঠে দুলকি চালে আসছে ঘোড়া– খচ্চরের দল। বাঁশের ডৌকা ভরে স্কোয়াশ, সবজি আরো কত কী। সমতলের ব্যাপারিরা আনতো ধান, চাল, খৈ, মুড়ি, বেড়ি হাতা থেকে শীতের র্যাপার নক্সা কাটা। হপ্তা শেষে ক্রেতা- বিক্রেতার কলহাস্য গীতে মুখরিত বিপণন প্রাঙ্গন। ক্রেতা- হাটুয়া দিনের শেষে বাড়ি ফিরতো এক গাল হাসি নিয়ে। হাটের চত্তর ঘিরে গড়ে উঠেছে জনবসতি। সদা সরগরম। ১৯৫১- সালে প্রকাশিত এ.কে. মিত্র সম্পাদিত West Bengal District Hand Book এ দেখা যাচ্ছে জলপাইগুড়ি মহকুমাতে চারটি বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮০০ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে। ১৮০৪ সালে বৈকুন্ঠ-পুরের রাজা জলপাইগুড়ি দিনবাজার প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় বাজারটি তৈরী হয় মালবাজারে ১৮৭৫ সালে। তৃতীয় নাম চামুর্চী ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে। তারপর লোকসান বাজার। শেষ দুটি বাজার ভূটান সীমান্ত ঘেসা।
১৯৬২ সালের পর থেকে ধীরে– ধীরে কমতে থাকে এই পাহাড়ী রূপসীর সাজসজ্জা। সরকারী উদাসীনতা ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বিবর্ণ হতে থাকে সব কিছু। সংস্কারের অভাবে নষ্ট হতে থাকে চারচালা- দোচালা। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ঠিক মতো পৌঁছায়নি নাগরিক পরিষেবাও।
ক্ষয়ে গেছে অনেক কিছুই; তবে এখনো রয়ে গেছে অনেক। উত্তর-পূর্বে মাথা তোলা মৌন হিমালয়। সবুজ শ্যামল মাখা মোহময়ী হাতছানি। কুলকুল শব্দে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনীর শাব্দিক- মাদকতা। দূরে নগ গায়ে মহাকাল গুহা। প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়ালে পাহাড়ের গুহার ভেতর নেমে এসেছে পাথরের তৈরী লম্বা লম্বা শিবের জটা। জটা থেকে অবিরাম টুপটাপ ঝরে পড়েছে জলবিন্দু। এই জলে রয়েছে দুরারোগ্য চর্মরোগ আরোগ্য করার ক্ষমতা। ভূ-বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় এই গুহাকে বলে স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাগমাইট কেভ। চুনাপাথর বা ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের সঙ্গে পাহাড়ি আম্লিক জলের রাসায়নিক ভাঙ্গাগড়ার খেলা চলে এই আঁধার ঘেরা কন্দরে।
চামুর্চির অদূরেই রয়েছে ভুটানের জেলা শহর সামসি। রাজকীয় সিংহদুয়ার দিয়ে ঢুকলেই এক সব পেয়েছির দেশ। আকাশপানে হাত বাড়ানো বৌদ্ধ, প্যাগোডার চূড়া, নাম জানা না জানা জংলি ফুলের ঝাড়; ভিনসেন্ট ভ্যান গগের ‘দ্য আইরিসেস’-কেও হার মানায়।
চামুর্চীতে পাওয়া যাবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর এক মিংশ্রসংস্কৃতি। বাঙ্গালী-বিহারী-মারোয়ারী আদিবাসী-গোর্খা ও হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রীষ্টান বিভিন্ন জাতি-ধর্মের এক শান্তিপূর্ণ-সহাবস্থান। মহামানবের মিলন তীর্থ। আজানের সুরে জাগা, আর শাঁখের ডাকে সন্ধ্যা নামা। সবকিছুকে সঠিক সুরে বাঁধলে চামুর্চী হয়ে উঠতে পারে পর্যটন শিল্পের স্বর্গরাজ্য।
ছোট্টজনপদের এক বিবাগী হাটের শতবর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে আমরা সংকল্পের সেই দৃঢ়তাই ব্যক্ত করতে চাই আপনার সহযোগিতার হাত . . .