মৃত্যুর নিকট আত্মীয় কোমা; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১৪১৫; ডুয়ার্স সমাচার শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত
লস ভেগাসের প্রশস্ত রাজপথ ধরে দ্রুত বেগে ছুটছে ফোর্ড গাড়িটি। স্টিয়ারিং ধরে থাকা অষ্টাদশী বার্বি এখন সুখ স্বপ্নে বিভোর। দমকা হাওয়ায় তার উড়ু উড়ু চুলের মতো বলাকা মনটিও উড়ে চলেছে স্বর্গীয় কল্পলোকে। বহুদিন পর দেখা হবে প্রাণাধিক বিয়ার্ডের সাথে। এই অন্যমনস্কতার ভুলে হঠাৎই গাড়িটি রাস্তা পেভমেন্ট ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে পড়লো এক রেস্তোরাঁয়। সজোরে ধাক্কা খেল দেওয়ালে।
গত দু’মাস বার্বি রয়েছে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। সকাল-বিকাল নিয়ম করে বিয়ার্ড তাকে দেখতে আসে, আর হ্যাঙ্কিতে চোখ মোছে বারবার। নার্স-ডাক্তার কেউই বলতে পারে না কবে অবস্থার উন্নতি হবে। বার্বির নির্বাক, নিথর, সপ্রাণ দেহটি কোমায় আচ্ছন্ন।
হ্যাঁ কোমায়। শব্দটি পরিচিত হলেও, অনেকেরই সঠিক কোন ধারণা নেই। কোমা কোন অসুখ নয় এটা হল আমাদের শরীর ও মনের এক বিশেষ অবস্থা। যখন আমরা সুস্থ স্বাভাবিক থাকি তখন আমাদের মস্তিষ্কে স্নায়ুকোষগুলি পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ঘটনায় সাড়া দেয়। যেমন ধরা যাক আপনার পায়ে এখন মশা কামড়ালো, আপনি তৎক্ষণাৎ চাঁটি দিয়ে মশাটিকে মারবার চেষ্টা করবেন। আপনি যদি ঘুমিয়ে থাকেন তবে প্রতিক্রিয়া এমনটি হবে না। আর মানুষ যখন কোমায় আচ্ছন্ন হয় তখন তার অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষমতা থাকে না।
গুরুমস্তিষ্কের একদম ভেতরে থাকা কোষগুলি আমাদের চেতনার বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত করে। মস্তিষ্কের অসংখ্য স্নায়ুকোষগুলি সবসময়েই সক্রিয় থাকে। বিভিন্ন কোষের মধ্যে চলতে থাকে পারস্পারিক আদান প্রদান। কোন কারণে এই বিশেষ কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হলে চেতনা বিলুপ্ত হয়। সংজ্ঞাহীনতার বিভিন্ন স্তর আছে। তার একটি স্তর হলো কোমা। এছাড়াও হতে পারে পারসিসটেন্ট ভেজিটেটিভ স্টেট। এটি কোমার চেয়েও মারাত্মক। এসবের একদম অন্তিম পর্যায় হল ব্রেন ডেথ; যাকে এক কথায় মৃত্যু বলা যায়।
বহু কারণে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। আমাদের দেহের মোট অক্সিজেন চাহিদার এক চতুর্থাংশ প্রয়োজন হয় মস্তিষ্কে। দেহের অন্যসব অঙ্গের মতো মস্তিষ্কেও রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন পৌঁছায়। কোন কারণে মস্তিষ্কে একনাগাড়ে ছয় মিনিট অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ থাকলে স্নায়ুকোষের পাকাপাকি ক্ষতি হয়ে যায়। রোগী কোমায় চলে যেতে পারে।
যারা কোমায় আক্রান্ত হন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই হয় মস্তিস্কের অসুখে। সেরিব্রাল হেমারেজ বা মস্তিষ্কের রক্তনালী ফেটে রক্তক্ষরণ হলে অথবা সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস বা মস্তিষ্কের নালীতে রক্তজমাট বেঁধে গেলে কোমা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও ব্রেন টিউমার, সেরিব্রাল মেনিনজাইটিস, এনকেফেলাইটিস এসব অসুখের আক্রমণ মারাত্মক হলে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে। সব দুর্ঘটনা বা অন্যভাবে মস্তিষ্কের কোষে আঘাত লাগলে কোমা দেখা দিতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করে আঘাতের ধরণ ও তীব্রতার ওপর।
মস্তিষ্ক ছাড়াও অন্য অঙ্গের অসুখেও এই জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। কিডনির অসুখ বা রেনাল ফেলিওর হলে রক্তে ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড এসব পদার্থ বাড়াতে থাকে। দেখা দেয় বিষক্রিয়া। ফলস্বরূপ রোগী কোমায় আচ্ছন্ন হতে পারে। একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায় ম্যালেরিয়া, ডায়াবেটিস মেলিটার্স রোগীর ক্ষেত্রে।
আগেই বলেছি কোমা হল একটি চেতনাহীন-সংজ্ঞাহীন অবস্থা। এই থেকে মানুষকে কোনভাবেই জাগিয়ে তোলা যায় না। হ্যাঁ, আপনার মনে প্রশ্ন উঠতে পারে- অপারেশনের সময়ও তো রোগীকে সংজ্ঞাহীন করা হয়। সেক্ষেত্রে জ্ঞান ফিরিয়ে আনা তো অ্যানাসথেসিষ্ট বা সার্জেনের হাতের মধ্যেই থাকে। এক্ষেত্রে তেমনটি হবে না কেন? আসলে কেউ যখন কোমাতে চলে যায়: তখন সে চারপাশের কোন উত্তেজনাতেই সাড়া দেয় না। তার নাকের কাছে ইমিল নাইট্রেট বা অন্যকোন চেতনা ফেরানোর ওষুধ ধরা হোক না কেন সে অচেতনই থাকে। ডাক্তারী ভাষায় যাকে আমরা বলি স্টিমুলাস নন রেসপন্ডিং স্টেজ। তবে রোগী কি কিছু দেখতে বা শুনতে পায় না? না বিষয়টি তেমন নয়। ব্যাপারটা কিছুটা বিষ্ণু দে-র কবিতার মতো দূর্বোধ্য। কিছুটা দেখতে পায়; আবার কিছুটা পায় না। কিছুটা শুনতে পায়; আবার কিছুটা পায় না। আমাদের মস্তিষ্কে বিভিন্ন উত্তেজনা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আছে। কখন কী করতে হবে মস্তিষ্ক আমাদের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সঠিক সময় জানিয়ে দেয়। তা আপনি ঘুমিয়ে থাকুন বা জেগেই থাকুন। কোমাতে মস্তিষ্কের এইসব বিশ্লেষণ ক্ষমতা থাকে না। থাকে না ব্যাথা-বেদনার অনুভূতি। কোমার চেতনাহীনতার বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে। কোমার তীব্রতা বেশি না হলে রোগীর কাছ থেকে কিছু কিছু স্টিমুল্যান্টের সাড়া পাওয়া যায়।
কোমা মানেই মৃত্যু নয়। কোমা অবস্থা থেকে ফিরে এসে দিব্যি চলে ফিরে আছেন এমন মানুষের সংখ্যা এই মুহূর্তে লক্ষাধিক। যেমন মেরি কে ব্লেকলি-র কথাই ধরা যাক। মেরি একনাগাড়ে নয় দিন ডায়াবেটিক কোমায় ডুবে ছিলেন। মাত্রাধিক ইনসুলিন নেওয়ার ফলে মেরির রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা হঠাৎ কমে যায়। ডাক্তারবাবুরা ইন্টারভেনাস ডিপ দিয়ে তার দেহে গ্লুকোজ মাত্রা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পর সে ধিরে ধিরে জেগে ওঠে। হ্যাঁ, লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে ব্লেকলির নামটা মনে পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কোমায় থাকাকালীন তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেগুলি নিয়েই এই মহিলা লিখে ফেলেছেন একটি চমৎকার বই। গ্রন্থের নামটিও মজাদার- ‘ওয়েক মি হোয়েন ইটস্ ওভার’। কৌতূহলী চিকিৎসকের কাছে এক অমূল্য গ্রন্থ।
ব্লেকলি তার বইতে বলেছে- "আমার অবস্থা তখন ভাইরাজ আক্রান্ত কমপিউটারের মতো। একটু একটু বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছুই প্রকাশ করতে পারছি না। চোখ খোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু খুলতে পারলাম না। নাড়াতে পারছি না জিভও। প্রিয়জন যখন মাথায় হাত রাখলো; স্পর্শটা চেনা চেনা ঠেকছে কিন্তু চিনতে পারছি না। আশেপাশে সবকিছু মিলেমিশে এক ভৌতিক চেহারা নিয়েছে। মনে হচ্ছে আমি মহাশূণ্যে ডুবে যাচ্ছি আবার ভেসে উঠছি। কোন ব্যথা-বেদনার অনুভূতি নেই। এতো কিছু সত্ত্বেও এক প্রশান্তি ছিল; সবুজ আনন্দ। যে প্রশান্তি আমি আর কোনদিন উপভোগ করিনি......"।
আগেই বলেছি চিকিৎসা বিজ্ঞানে কোমা কোনো রোগ নয়। এ শরীর ও মনের এক বিশেষ অবস্থা মূলতঃ মস্তিষ্কের কাজ কারবার ঘিরেই তৈরি হয়। ব্যক্তির চেতনার বড়োসড়ো বিপর্যয় ঘটলে সে কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই অঘোর ভাব কবে কাটবে তা চিকিৎসক, রোগীর পরিবার কেউই জানে না।
কোমার কোনো রোগী এলে প্রথমেই তার জন্য জীবনদায়ী ব্যবস্থা বা লাইভ সাপোর্টিং সিস্টেম চালু করে দেওয়া হয়। তাকে নিয়ে দেওয়া হয় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। দেহের অক্সিজেনের অভাব যাতে না হয় তার জন্য নাকে মুখে লাগিয়ে দেওয়া হয় অক্সিজেন মাস্ক বা মুখোশ। পুষ্টির চাহিদা মেটাতে দেওয়া হয় ইন্ট্রাভেনাস ডিপ। তারপর কী কারণে রোগী এই অবস্থায় পৌঁছালো তার অনুসন্ধান শুরু হয়। যেমন-কুড়ি ছুঁই ছুঁই সিলভি প্যাটেল ভ্যালেনটাইন ডে-তে বয়ফ্রেন্ডের টু হুইলারে চেপে ঘুরতে বেরিয়েছিল। পুরুষ বন্ধুটি বাইকটি চলাচ্ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গতিতে, এই বয়সে যেমনটি হয়। দুজন কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ফলে যা হবার তাই হল। কোমায় আচ্ছন্ন সিলভিকে ভর্তি করা হয় বীচ্ ক্যান্ডি হাসপাতালে। লাইভ সাপোর্টিং সিস্টেম চালু হওয়ার পর মস্তিষ্কের সিটিস্ক্যান করে দেখা গেল একটি ধমনি থেকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। তারপর ব্রেন অপারেশন করে ক্লিপিং করে দেওয়া হল ক্ষতি গ্রস্ত ধমনীটিতে। সঙ্গে চলতে থাকলো রক্ষচাপ নিয়ন্ত্রণ ও অন্যসব প্রয়োজনীয় ওষুধ-বিষুধ। দিন পনেরো কোমায় থাকার পর সিলভি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।
ডুয়ার্সের বানারহাট চা বাগান থেকে কোমায় আচ্ছন্ন শ্যামল মিত্রকে নিয়ে আসা হয় এক বেসরকারি নার্সিংহোমে। প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছিল না; এ অবস্থার কারণ কী? ডাক্তারবাবুরা চিন্তাভাবনা করে শুরু করে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া চিকিৎসা। দশ দিনের মাথায় শ্যামলবাবু হেঁটে চলে বেড়াতে শুরু করেন। কোমায় অনেক সময় রোগী খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে, আবার অনেক ক্ষেত্রে কেটে যায় বছরের পর বছর। অনেক সময় আত্মহত্যার লক্ষ্য নিয়ে কীটনাশক বা বিষাক্ত কিছু খেলে, সেই বিষক্রিয়াতে অনেকে কোমায় চলে যেতে পারেন। বিষপান বা খাদ্যে বিষক্রিয়া যাই হোক না কেন প্রথমেই স্টমাক পরিষ্কার করা হয়। তারপর বিষয়টি শনাক্ত করা গেলে প্রয়োগ করা হয় তার প্রতিষেধক বা অ্যান্টিডোট।
কোমাতে থাকা অবস্থায় রোগীর মস্তিষ্কে কিছু কিছু মজার কাজকারবার চলতে থাকে। যেমন, স্বপ্ন দেখা। স্বপ্ন এমনিতেই ধোঁয়াসায় ভরা, মাথামুন্ডু সহজে বোঝা দায়। তবে মনোবিজ্ঞানীরা এই জট খোলার চাবিকাঠি অনেকটাই হাতিয়ে ফেলেছেন। জার্বেরা স্বপ্ন দেখে- ‘‘দিদির ছোট ছেলেটি মারা গেছে। তার শবাধারে চারদিকে সাজানো হয়েছে অনেক মোমবাতি। ধূপকাঠির ধোঁয়াগুলি বিভিন্নভাবে পাঁক খেয়ে উঠে যাচ্ছে উপরে। টমি সামনে পা দু’টির ওপর মাথা রেখে কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বাড়িটি স্তব্ধ-বিমূঢ়। মাঝে মাঝে উইলির ডুবরে ওঠা কান্নার নিস্তব্ধতা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।’’ হঠাৎই প্রচন্ড গরমে ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল জার্বেরা। পা দিয়ে তখন ঘাম ঝড়ছে। ঘামে ভেজা শ্লিপিং গাউনটা তার অষ্টাদশী শরীরের গিরি উপত্যকায় লেপ্টে আছে।
এমন স্বপ্ন কেন দেখলো জার্বেরা! সে তো কোন সময়েই তার ভাগ্নের মৃত্যু কামনা করে নি। তবে এমনটি কেন হল। অনেকে বলেন- "মানুষ অবচেতন মনে যা কামনা করে, স্বপ্ন দেখার মধ্য দিয়ে সেই অপূর্ণ ইচ্ছাই প্রকাশ পায়"। ঘটনাটি সিগমুন্ড ফ্রয়েড এর কানে গেল। ফ্রয়েড জন্মসূত্রে অষ্টীয়ান, জাতিতে ইহুদি আর পেশা চিকিৎসক; বিশেষ করে মনোরোগের চিকিৎসা। আধুনিক মনঃসমীক্ষণবাদের তিনিই প্রবক্তা।
ফ্রয়েড দীর্ঘ কয়েকদিন ধরে গাল-গল্প করলেন জার্বেরার সাথে। শেষমেশ স্বপ্ন বিশ্লেষণ করে তিনি যা আবিস্কার করলেন তা হল- জার্বেরা তার দিদির বাড়িতেই থাকতো, সেখানে থাকার সময় একটি ছেলের সাথে তার ভাব- ভালোবাসা গড়ে ওঠে। ব্যাপারটা যতটা না ছেলেটির পক্ষ থেকে ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল মেয়েটির তরফে। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে তাদের বিয়ে হয়নি। তবুও জার্বেরা তার প্রেমিকটিকে কোন সময়ই ভুলতে পারে নি। চেতন ও অবচেতনে তাকে কাছে পেতে চাইতো। দিদির বড় ছেলে মারা যাওয়ার সময় সে শোকজ্ঞাপন করতে এসেছিল। সেটাই তাদের শেষ সাক্ষাৎ। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ এক বছর । ফ্রয়েড বলেন -‘‘বড়দির ছোট ছেলের মারা যাওয়ার স্বপ্নের মধ্য দিয়ে সে তার প্রাক্তন প্রেমিকের সাক্ষাতের বাসনাই ব্যক্ত করেছে। সে ভাগ্নের মৃত্যুকামনা করে নি। প্রেমাস্পদের দেখা পেতে চেয়েছে।’’ আলোচ্য স্বপ্নটি স্বপ্নদ্রষ্টার ইচ্ছার পরোক্ষ পরিপূরণ।
হ্যাঁ, স্বপ্ন বিষয়টি এমনই গোলমেলে। সবসময় তার মাথামুন্ডু খুঁজে পাওয়া যায় না। ফ্রয়েডের দুনিয়া কাঁপানো বই ‘ইন্টারপিটেশন অব ড্রিম’ এ এমন বহু কাহিনী রয়েছে। আমরা যেমন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি, তেমন কোমা অবস্থাতেও অনেক রোগী বিভিন্ন স্বপ্ন দেখেন। আমাদের পানু কমরেড যেমন ভেবে বসে আছেন- যতদিন আকাশে সূর্য- তারা; ততদিন বঙ্গে রাজ করবে কাস্তে-হাতুরি তারা। সেটা অবশ্য তার দিবাস্বপ্ন। এসব কূচকাচালি থাক, আসল কথায় ফিরে আসি। প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক আমরা ঘুমের মধ্যে কখন, কী অবস্থায়, কী ভাবে স্বপ্ন দেখি। আমরা যখন ঘুমাই তখন আমাদের অজান্তে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে কখনো মনের অস্থিরতা বাড়তে থাকে, চোখের মণি এদিক ওদিক নাড়াচাড়া করে। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই এই ঘটনা ঘটে। আমাদের মস্তিষ্কে প্রতিমুহূর্তে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গগুলির গুণ ও মান মস্তিষ্কের অবস্থা অনুসারে বদলে যায়। ইলেকট্রো এনসিফ্যালগ্রাফ বা সংক্ষেপে ইইজি যন্ত্রের সাহায্যে তরঙ্গগুলির লেখচিত্র পাওয়া যায়। সাধারণভাবে দেখা যায় মনের অস্থিরতা প্রতি দেড়ঘন্টা পর পর তৈরী হয় ও প্রায় কুড়ি মিনিট পর্যন্ত থাকে। ঘুমের এই পর্যায়কে বলে র্যাপিড আই মুভমেন্ট স্টেজ (রিম) পর্যায়। আবার যখন গভীর আচ্ছন্ন থাকে তখন সেই পর্যায়কে বলে নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট স্টেজ (ননরিম)। ঘুম বা কোমা অবস্থাতে আমরা যে স্বপ্ন দেখি তা রিম পর্যায়ে থাকলে, কোমার তীব্রতা নির্ভর করে রোগী স্বপ্ন দেখবে কী, দেখাবে না।
যখন কোন সুস্থ ব্যক্তিকে রিম অবস্থা থেকে জাগিয়ে তোলা হয়; তখন সে বলে যে সে স্বপ্ন দেখছিল। কী স্বপ্ন দেখছিল সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারে না। তবে ননরিম অবস্থা থেকে ঘুম ভাঙলে সে স্বপ্ন সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারে না। ফ্রয়েড, ম্যাক্ ডুগাল, অ্যাডলার প্রভৃতি মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে জানা গেছে- আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে স্বপ্ন দেখি। মস্তিকের মধ্যে যে স্মৃতি কোষ বা মেমরী সেল রয়েছে, সেখানেই রয়ে গেছে স্বপ্ন দেখার চাবিকাঠি। আর দরকার বিভিন্ন স্মৃতি কোষগুলি মধ্যে থাকা সংযোগ তন্তু বা কানেক্টিং ফাইবার। কোন কারণে মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষ ও কানেকটিং ফাইবার যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে সেই রোগী কোমা অবস্থাতে আর স্বপ্ন দেখতে পারে না। কোমা অবস্থার মধ্যেও রোগীকে হাসতে, কাঁদতে, কখন বা ভুরু কুঁচকে যেতে দেখা যায়। অর্থাৎ সে সময় তার মনের ভেতর বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে।
কোমায় আমরা স্বপ্ন দেখি কেন? ঘুমের ভেতর আমরা যে কারণে স্বপ্ন দেখি, কোমা অবস্থাতেও একই ঘটনা ঘটে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চাওয়া পাওয়ার মধ্যে যা অপূর্ণ থাকে সেই না পাওয়াগুলিকে আমরা স্বপ্নের মধ্যে পাই। হ্যাঁ, তবে অনেক ক্ষেত্রেই প্রতীকের মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটে। তাছাড়া যে সব অপমানের আমরা প্রতিবাদ করতে পারি না, যে সব যন্ত্রণার সমাধান হাতের মধ্যে নেই স্বপ্নে আমরা তার প্রতিকার দেখি। আর স্বপ্ন দেখার পর সেই ঘটনা স্মৃতি কোষ থেকে মুছে যায়।
মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের স্বপ্ন নিয়ে কেনেথ রিং ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। যারা অতীতে কোন সময় কোমায় বিভোর ছিল; সেই সব মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মনস্তত্ত্বের এই অধ্যাপক। তার সেই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘হেডিং টুওয়ার্ড ওমেগা’ বইতে। জাত-ধর্ম-বর্ণ আলাদা আলাদা হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কোমা আক্রান্তদের স্বপ্নে বেশ মিল পাওয়া যাচ্ছে। স্বপ্নগুলি মোটামুটি এরকম-‘‘নিকেশ নীল অন্ধকারের মাঝে বহু দূরে এক উজ্জ্বল সাদা আলো। সেই আলোকে দেখতে পাচ্ছে না। আমি দৌড়ে তার কাছে পৌঁছাতে চাইছি, কিন্তু কোনভাবেই তা পারছি না। সাদা আলোটিকে তবুও খুব ভালো লাগছে। চারিদিকে এক অপার শান্তি।” মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন কোমায় থাকা রোগী অবচেতন মনে এই রোগ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। নিকেশ নীল অন্ধকার অসুস্থতার প্রতীক আর উজ্জ্বল সাদা আলো সংকেত করে সংকট মুক্তির।
তবে আধুনিক গবেষকদের মধ্যে কারো কারো মতে- কোমায় স্বপ্ন দেখার বিষয়টা আসলে তেমন কোন প্রতীক-টতিক নয়। এটা হল কোমার যে নানারকমের ওষুধ খাওয়া হয়ঃ তারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্টি হওয়া দৃষ্টি বিভ্রম বা হ্যালিউসিনেশন। আসলে বিজ্ঞানের অন্যসব শাখার মতো মনোবিজ্ঞানকে এখনো সঠিক ভাবে গণিতের মধ্যে বেঁধে ফেলা যায় না। কেজি-ইঞ্চি সেকেন্ড পরিমাপ করা যায় না স্বপ্নের বিষয়-আশয়। তাই এসব বিতর্কের সমাধানও এই মুহুর্তে সম্ভব নয়।
বহু কারণেই কোমায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এই মুহূর্তে এদেশের হাসপাতালগুলিতে কোমা আক্রান্ত কতজন রোগী ভর্তি আছে? তার কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া মুশকিল। বেসরকারি নার্সিং হোমের কথা ছেড়েই দিলাম, স্বাধীনতার এত বছর পরেও সরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে তেমনভাবে সমন্বয় ব্যবস্থাই গড়ে ওঠে নি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলিতে আজকে মোটামুটিভাবে সাড়ে বারো হাজার কোমা আচ্ছন্ন মানুষ রয়েছেন। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি হলেও সে তুলনায় কোমা আক্রান্তের সংখ্যা কম।
না-না এতে, আহ্লাদিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আসলে এদেশে অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের রোগীর চিকিৎসার তেমন ব্যবস্থাই নেই। রোগী মৃত না কোমা আক্রান্ত সাধারণ চিকিৎসক সে তফাৎ বুঝতে পারেন না। গ্রাম-গঞ্জের কথা ছেড়েই দিলাম, বড়ো বড়ো শহরেও একই দশা! সে কারণে, বেশিরভাগ রোগীই খুব তাড়াতাড়ি তৃষিত এ মরু ছেড়ে পৌঁছে যান তাহার রসাল নন্দনে।
আগেই বলেছি এসব রোগীকে রাখতে হয় ইনটেনটিভ ইউনিটে। এই ইউনিট থাকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। থাকে বহু রকমের যন্ত্রপাতি। হৃদযন্ত্রের গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখার জন্য থাকে কার্ডিয়াক মনিটর। চাহিদা অনুসারে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য থাকে মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন সিস্টেম। রোগীর হৃদস্পন্দন অতিমাত্রায় অনিয়মিত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায় এক্সটারনাল ডিমান্ড পেসমেকার। কোমা আচ্ছন্ন ব্যক্তির দেহে পুষ্টি ও ওষুধ প্রবেশ করানো হয় স্যালাইন বা ইন্ট্রাভেনাস ডিপ-এর সাহায্যে।
কোমার রোগীর সবচেয়ে বড়ো অসুবিধা হল বেডসোর। এইভাবে নিথর অবস্থায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকতে থাকতে পিঠ- নিতম্বতে দেখা দেয় শয্যাক্ষত। বেডসোর একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। এই ক্ষত যাতে না হয় তার জন্য প্রথম থেকেই ব্যবস্থা নিতে হয়। রোগীর বিছানায় বিশেষ কিছু ব্যবস্থা থাকে। প্রয়োজনমতো লিভার ঘুরিয়ে রোগীর মাথার দিক-পায়ের দিক ইচ্ছেমতো উঁচু-নিচু করা যায়। বিছানার উপর থাকে রিপল ম্যাট্রেস বা এয়ার ম্যাট্রেস। অনেক সময় জলভরা রবারের বিছানা বা ওয়াটার ম্যাট্রেস দেওয়া হয়। দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখার জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট দিয়ে নিয়মিত মালিশ করানো উচিত। এছাড়াও প্রস্রাব করানোর জন্য লাগানো থাকে ক্যাথিটার নল ও ইউরিন ব্যাগ।
বর্তমানে কোমা আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলি কারণ রয়েছে। আগে কোমা আক্রান্ত রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার তেমন কোনো পদ্ধতি সহজলভ্য পদ্ধতি ছিল না। এখন কিছুটা অবস্থায় উন্নতি হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ ফাইনান্স কোম্পানির দৌলতে দ্রুত গতিতে বাড়ছে গাড়ি ও হুইলারের সংখ্যা। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পথ দুর্ঘটনার হার। যান্ত্রিকতা ও ভোগবাদী মানসিকতার ফলে মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত আজ প্রায় ঘরে ঘরে। হৃদরোগ, সেরিব্রাল, থম্বাসিস বেড়ে চলেছে সমান তালে। এছাড়াও আত্মহত্যার চেষ্টা থেকেও কোমার ঘটনা মোটেই বিরল নয়।
কোমার রোগীকে চব্বিশ ঘন্টা রাখা হয় অভিজ্ঞ নার্স এবং ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে। মুহূর্তের অসতর্কতায় রোগীর প্রাণহানি ঘটতে পারে। সকলকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। কোমা রোগীর চিকিৎসার খরচও কম নয়। বেসরকারি নার্সিংহোমগুলিতে একজন রোগী রাখতে দৈনিক বেড চার্জ দেড় হাজার থেকে দু’হাজার টাকা। সরকারি হাসপাতালে এই ভাড়া পাঁচশো টাকার মতো। এছাড়াও আছে ওষুধ-ডাক্তার ও অন্যান্য খরচ।
কোমায় অর্থনৈতিক দিকটাও ভাবার বিষয়। অন্য অসুখের ক্ষেত্রে মোটামুটি সেরে ওঠার একটা সময় আছে। বাড়ির লোকজনেরা দৌড়ঝাপ করে প্রয়োজনীয় টাকা-কড়ি জোগার করেন। কিন্তু কোমার যাত্রাপথ অনিশ্চিত। কবে রোগী সুস্থ হবে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। যিনি কোমায় আছেন; তিনি তো আছেন। আর যারা সুস্থ সবল আত্মীয় পরিজন? চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে করতে তাদের অবস্থাটা কেমন হয় তা সহজ কল্পনাসাধ্য।
কোমা থেকে রোগীকে জাগ্রত করার ক্ষমতা এখনো চিকিৎসদের হাতের মুঠোয় আসে নি। তা বলে গবেষকেরা হাত গুটিয়ে বসে নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই মুহূর্তেও চলছে নিরন্তর গবেষণা। চিবুকে সংকল্পের কাঠিন্য নিয়ে বিজ্ঞানীরা রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন বিনিদ্র রজনী। আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু, মৃত্যুর আঁধার কালো বৃন্ত থেকে তাঁরা ছিঁড়ে আনবেন প্রাণময় ফুটন্ত সকাল। আমরাও জেগে আছি- তাদের প্রত্যাশা পূরণের পথ চেয়ে।