মেদ কমাতে লাইপোসাকশন; ডাঃ পার্থপ্রতিম।
৭ আগস্ট ২০০৪; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
সবে আসর জমে উঠেছে। শ্রীমতি জ্যোৎস্না পাল তাঁর সুরেলা কন্ঠে গান ধরেছেন- চলো না দীঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউবনের ছায়ায়....। হঠাৎই বিকট চিৎকার - হেল্প হেল্প। ঘাড় ঘুড়িয়ে সবাই মিসেস রায়ের দিকে তাকিয়ে। পঁচানব্বই কেজি ওজনের স্থূলকায়া মিসেস রায় বসেছিলেন হাতলওয়ালা কেদারায়। ওঠার সময় লক্ষ্য করলেন হাতল দুটি প্রবলভাবে আটকে গেছে তাঁর সুবিপুল নিতম্বে। তাই এই আর্তনাদ। মিস্টার অতীন রায় নিদাম চা বাগিচার ম্যানেজার। কোম্পানির খরচে বাংলোতে দশ-বারোটি নোকর-চাকর। মালি, বাবুর্চি, খানসামা। শ্রীমতি রায়ের মূল কাজ হলো কেবলে বিদেশি চ্যানেল লাগিয়ে টিভি-র সামনে বসে থাকা। মোবাইলে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা মেয়েলী গল্প করা, এটা সেটা হুকুম করা। টুকটাক মুখ চালানো। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। দিনের পর দিন শরীরের গিরি- উপত্যকায় ভিড় বাড়াচ্ছে স্নেহ নামক বিষম বস্তু।
যাঁদের দেহে স্নেহ বা মেদ বেড়েই চলছে, কিন্তু শারীরিক পরিশ্রম বা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কসমেটিক সার্জেন বা সৌন্দর্য শল্য চিকিৎসকেরা। শরীর থেকে অতিরিক্ত মেদ কমাতে এনেছেন লাইপোসাকশন নামের এক আধুনিক পদ্ধতি। ট্যাঁকে মালকড়ি থাকলে এই প্রযুক্তি আপনিও ব্যবহার করতে পারেন।
বেঢপ শরীরকে দৃষ্টিনন্দন করতে ১৯৭৮ সালে ইতালির শল্য চিকিৎসক বিশেষভাবে তৈরি যন্ত্র দিয়ে চর্বির স্তর বাদ দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু এতে দেখা দিল বিভিন্ন রকমের অসুবিধে। চর্বি কমার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর রক্তপাত হতো। তারপর হঠাৎ করে দেহের কিছু অংশ থেকে মেদ উধাও হওয়ার ফলে ত্বক হয়ে যেত এবড়ো খেবড়ো খানাখন্দে ভরা রাস্তার মতো।
সৌন্দর্য বিজ্ঞানীদের প্রয়াস চলতেই থাকে। অবশেষে ১৯৮৪ সালে আধুনিক লাইপোসাকশনের জন্ম হয়। এর মাত্র দু-বছরের মধ্যে আমেরিকার প্রায় ৭০ হাজার নারী-পুরুষ মেদ কমানোর জন্য এই পদ্ধতির সাহায্য নেন। লাইপোসাকশনে শরীরের নির্দিষ্ট অংশে ছোট ফুটো করে বিশেষ সাকশন যন্ত্রের সাহায্যে অবাঞ্ছিত চর্বিস্তরকে বের করে দেওয়া হয়। এতে শরীরের অন্যান্য কোষ ও রক্তনালিকা মোটামুটি অক্ষত থাকে।
সাধারণত পেট, গলা, ঊরু, নিতম্ব, হাত, কাঁধ, চিবুকে এ ধরনের অস্ত্রোপচার করা হয়। মাংসল কানের লতি, থলথলে ঝোলানো চিবুক বা বিকৃত নিতম্বকে যথাযথ আকারে আনতে লাইপোসাকশনের জুড়ি মেলা ভার।
তরুণ-তরুণী, বুড়ো-বুড়ি যে কোনো বয়সের মানুষই লাইপোসাকশনের সাহায্য নিতে পারেন। তবে যাঁদের হার্টের রোগ, হাইব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস আছে তাঁদের ক্ষেত্রে সাবধানে এটি করতে হয়।
ড্রাই ও ওয়েট এই দুই পদ্ধতিতে লাইপোসাকশন করা হয়। এই দুয়ের মধ্যে ওয়েট মেথড-ই বেশি প্রচলিত। এতে রক্তপাত খুবই কম হয় এবং ফলও ভালো। সাধারণত চিবুক, কান বা হাতের ছোটো অপারেশনের ক্ষেত্রে আংশিক অবশ বা লোকাল অ্যানাস্থেসিয়া করা হয়। তবে পেট, থাই বা হিপের অতি চর্বি বের করার ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় রোগীকে সম্পূর্ণ অবশ করে অস্ত্রোপচার করা হয়ে থাকে।
লাইপোসাকশন মূলত যান্ত্রিক পদ্ধতি। দুটি বোতলের সঙ্গে লাগানো থাকে একটি অত্যাধুনিক সাকশন পাম্প, স্বচ্ছ ফাইবারের হোসপাইপ ও বিভিন্ন মাপের ক্যানুলা। ক্যানুলা হল এক ধরনের নল; ফোঁড়ার ভেতর থেকে রক্ত-পুঁজ বের করার কাজে এটিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জায়গা অনুযায়ী বিভিন্ন মাপের ক্যানুলা ব্যবহার করা হয়। পেট, হিপ এসব বড়ো অংশের জন্য মোটা এবং কানের লতি, চিবুকের জন্য সরু।
দেহ থেকে যে পরিমাণ চর্বি বের করা হবে, প্রথমে সেই পরিমাণ স্যালাইনের সঙ্গে কয়েকটি বিশেষ ওষুধ মিশিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ যদি পেট থেকে দু-লিটার চর্বি বাদ দিতে হয়, তাহলে পেটেই দুই থেকে আড়াই লিটার স্যালাইন দিতে হবে। এর ফলে চর্বির সেল বা টিসুগুলি অন্য কোষগুলি থেকে আলগা ও শিথিল হয়ে পড়ে। স্যালাইনের সঙ্গে মিশে থাকা ওষুধগুলি জ্বালা যন্ত্রণা ও রক্তপাত কমিয়ে দেয়। এরপর মেদবহুল অংশে সুবিধামতো জায়গায় একটি ছোট্ট ছিদ্র করে, ক্যানুলা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই ক্যানুলাটি নির্দিষ্ট দিকে টানেলিং সিস্টেমে ঘোরানো হলে তরল চর্বি পাশের সঙ্গে যুক্ত বোতল দু-টিতে জমা হতে থাকে। স্টো বা সরু নলের সাহায্যে আমরা যেভাবে তরল পানীয় পান করি অনেকটা সেরকমই।
ক্যানুলাটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টানেলিং সিস্টেমে মেদ ঝরানো হয় বলে অস্ত্রোপচারের স্থানটি অসমান বা এবড়ো খেবড়ো হয় না। ওই অঙ্গের ত্বক ঢিলেঢালা হয়ে পড়লেও কিছুদিনের মধ্যে তা টানটান হয়ে যায়।
লাইপোসাকশনে মেদ ঝরানোর পর মাস দুয়েক কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। এক থেকে দু-মাস বিশেষ ধরনের জামা কমপ্রেসিভ সাপোর্ট গারমেন্টস দিনে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা পড়ে থাকতে হয়; যাতে অপারেশনের জায়গাগুলি চাপের মধ্যে থাকে।
লাইপোসাকশন করে একবারে তিন-চার লিটার পর্যন্ত চর্বি বার করা যায়। দেহে অতিরিক্ত চর্বি থাকলে দু-তিনবার লাইপোসাকশন করতে হয়। অপারেশন করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। মাঝারি মানের নার্সিহোমে লাইপোসাকশন করতে ৫-৭ হাজার টাকার মতো খরচ হয়।
তবে মনে রাখা দরকার লাইপোসাকশন করার সঙ্গে সঙ্গে যে কারণে দেহে মেদবৃদ্ধি ঘটছে তারও চিকিৎসা করতে হবে। তা সে থাইরয়েড, অতিরিক্ত আহার বা শারীরিক পরিশ্রমের অভাব- যাই হোক না কেন। খাদ্য, ব্যায়াম এসব ব্যাপারে চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে চলতে হবে। যত খুশি চর্ব্য-চোষা, লেহ্য-পেয় চালাবো, শুয়ে বসে আরাম-আয়েশে সময় কাটাবো, আর মেদ বাড়লে লাইপোসাকশন করাবো- এ বুদ্ধি যদি কারো ঘটে থাকে তবে তার কপালে কিন্তু শনি নাচবে।