সাগরজলে তেলদূষণ রোধ; -ডাঃ পার্থপ্রতিম। ১৩ মে ১৯৯২; ওভারল্যান্ড পত্রিকাতে প্রকাশিত
তখনও পুবের আকাশে ভালভাবে রঙ ধরেনি। ভোররাত। স্থানীয় অধিবাসীদের ঘুম ভাঙতে কিছু সময় বাকি। এরমধ্যে কানফাটা বিকট শব্দ, তারপর কয়েকঘন্টার মধ্যে ৭০০ হাজার গ্যালন অপরিশোধিত তেল ছড়িয়ে পড়ল সমুদ্রের জলে। উপকূল ধরে মাইলের পর মাইল নীল সমুদ্রের জল কালো হয়ে উঠল। বিপন্ন হল ১০ হাজার প্রজাতির পাখি ছাড়াও ৯৪টি সামুদ্রিক প্রজাতি। তেলে ভিজে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি হল কয়েকটি বিরল প্রজাতির প্রাণী। অন্ধ হয়ে গেল কিছু ডলফিন, সামুদ্রিক ভোঁদড়।
না, এ বুশ-সাদ্দাম লড়াইয়ের বা ভারত মহাসাগরে মোজাম্বিক উপকূলে স্পেনের তেলবাহী জাহাজের দুর্ঘটনার বর্ণনা নয়। আজ থেকে একুশ বছর আগের ঘটনা। ১৯৭১ সাল, আমেরিকার স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির দুটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার জাহাজ সানফ্রানসিসকো উপসাগরে ঢোকার সময় গোল্ডেন ব্রিজের কাছে পরস্পরকে ধাক্কা মারে, ফলে এ দুর্ঘটনা। সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের ভারসাম্যের ওপর এই ব্যাপক আঘাত আসায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৩০ মাইল দূরেই রয়েছে আমেরিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পাখিরালয় ‘আউডুবন ক্যানন রেঞ্জ’। সাইবেরিয়া, আলাস্কা থেকে আসা হাজার হাজার পাখি এখানে আশ্রয় নেয়, বংশবৃদ্ধি করে। এরমধ্যে রয়েছে জায়ান্টক্রেনের মতো বিরল প্রজাতির পাখিও।
ক্যানন রেঞ্জের বিখ্যাত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মি ক্লিরিন জ্যামওল্ট স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির সদরদপ্তর ক্যালিফোর্নিয়াতে যোগাযোগ করে আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে তেল পরিষ্কার করার পরিকল্পনা তৈরি করলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনাকে কাজে রূপ দেওয়া অনেক খরচের ব্যাপার। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা কোমর বেঁধে এগিয়ে এল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলতে লাগল। নিউইয়র্কের একটি পরিবার তাদের জমানো টাকা থেকে ৩০,০০০ ডলার দান করলেন এই উদ্ধার কাজে।
সানফ্রানসিসকো শহরের দশ বছরের মেয়ে ‘মারিনা’ জন্মদিনে দিদিমার কাছ থেকে পাওয়া হীরার নেকলেসটি তুলে দিলো স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে। সাহায্য এল আরও বহুদিক থেকে। অসুস্থ প্রাণীদের শুশ্রুষার জন্য খোলা হল সাময়িক হাসপাতাল। স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানির কর্মীরা দিন-রাত জেগে অমানুষিক পরিশ্রম করে তৈরি করলেন ভাসমান ঝাড়ু। অনেকটা দুধ থেকে মাখন তোলার হাতার মতো, লম্বা রবারের পদার্কে খাড়াভাবে ঝোলানোর জন্য ওপরে রয়েছে হাওয়াভরা বিশেষ ধরনের বেলুন ও নিচে আছে ভারী শিকল। ভাটার সময় জলের টানে তেল যাতে সমুদ্রের ভেতর না যেতে পারে তারজন্য আবিষ্কৃত হল এক অভিনব পদ্ধতি। সছিদ্র নলের মধ্য দিয়ে জোরে বাতাস পাঠিয়ে সৃষ্টি করা হল কৃত্রিম ঢেউ। এই ঢেউ প্রতিহত করল ভাটার টানকে। ঝাড়ু লঞ্চের সঙ্গে লাগিয়ে তেলের স্তরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এক জায়গায়, তারপর তা পাম্পের সাহায়্যে নিয়ে যাওয়া হল অয়েল রিফাইনারিতে। তিনমাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর পরিষ্কার হল ভাসমান তেল। আবার প্রমাণিত হল- আন্তরিক উদ্যম ও অদম্য কর্মপ্রচেষ্টার সাহায্যে মানুষ যে-কোনও বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে পারে। বছর ঘুরতেই আউডুবন ক্যানন রেঞ্জে আবার সারস, ফেমিঙ্গো, হর্নবিল পাখিরা ভিড় জমাল। সেই ছোটমেয়ে ‘মারিনা’ এখন একত্রিশ বছরের মহিলা; আজও তিনি আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়েন যখন দেখেন উপকূলে খেলে বেড়াচ্ছে নাম জানা, না- জানা কত প্রাণী আর পাখি।
গত ২৯ এপ্রিল ভারত মহাসাগরে মোজাম্বিকের উপকূলে স্পেনের তেলবাহী জাহাজ ‘কাতিনা’ দু-টুকরো হয়ে ডুবে গেছে। ডোবার আগে মোট ৪৮ লক্ষ গ্যালন অপরিশোধিত তেল ছড়িয়ে পড়ে সাগর জলে। বাকি ১ কোটি ৪৬ লক্ষ গ্যালন তেল জাহাজের সঙ্গে তলিয়েছে। ইতিমধ্যে মারা গেছে এক হাজারের বেশি সামুদ্রিক প্রাণী। ৭৫২ টির বেশি প্রজাতি আজ বিপন্ন। মানুষ কি আবার হাতে হাত মিলিয়ে সচেষ্ট হবে এই বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে; না কি আমাদের কাজকর্মের বলি হতে থাকবে নিরপরাধ পশু-পাখিরা?