সাবধান! শিশু পড়ে গেলেই আর্নিকা নয়; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০১২, পৃষ্টা নং-১৬;উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে পাঁচবছর বয়স পর্যন্ত ভারতীয় শিশুরা যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধটি সবচেয়ে বেশী খেয়ে থাকে তা আর্নিকা মন্টেনা। মূলত: আঘাতজনিত উপসর্গে এই ওষুধটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শিশু যখন হাঁটতে চলতে শিখতে শুরু করে তখন পড়ে যাওয়া ও ছোটখাটো আঘাত পাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। পড়ে গেলেই শিশুকে কাঁদতে দেখা যায়। এটা আঘাতজনিত ব্যথা থেকে যতটা না কাঁদে; তারচেয়ে বেশী কাঁদে ভয় পেয়ে। মূলতঃ ভারসাম্য হারানো ভয় থেকেই শিশু কেঁদে ওঠে।
আমাদের দেশে আর একটা বড় মুশকিল এখানে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরামর্শ বিনামূল্যে সর্বত্র পাওয়া যায়। বাবাইয়ের কান্না শুনে শ্যামলী বৌদি ছুটে এলো। “কী গো দিদি, বাচ্চাটা পড়ে গেল, তখন থেকে কাঁদছে! এখনো কোন ওষুধ দিলে না? শ্রীপর্ণাদির অপরাধীর মতো কাচুমাচু মুখ। সুবল সাইকেল নিয়ে ছুটলো আর্নিকা আনতে। এরপর থেকেই যখনই যতবার বুবাই আছাড় খেয়েছে ততবারই শ্রীপর্ণাদি এদিক ওদিক না তাকিয়ে বুবাইয়ে মুখে ঠুসে দিয়েছে বেশ কয়েকটি আর্নিকার গ্লোবিলস।
আর্নিকা নামের যে ওষুধটি হোমিওপ্যাথিতে ব্যবহার করা হয় হয় তার স্পিসিস বা প্রজাতিগত নাম আর্নিকা মন্টেনা। আর্নিকা জেনাস বা বর্গের উদ্ভিদগুলি বহুবর্ষজীবী। উদ্ভিদবিজ্ঞানের পরিভাষায় আর্নিকার ফ্যামিলি বা পরিবার হলো অ্যাসটারসিক অর্থাৎ সূর্যমুখী ফুলের আত্মীয়। এই বর্গের নাম আর্নিকা হওয়ার পেছনে একটি কারণ রয়েছে। গ্রীক ভাষায় ‘আর্না’ শব্দের মানে হল মেষশাবক। এর রোমশ তুলতুলে নরম পাতা দেখে এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী এমন নাম রেখেছেন। উত্তর আমেরিকার পশ্চিমভাগে সাব-অ্যালপাইন পার্বত্য তৃণভূমি অঞ্চলে এই গাছটি স্বাভাবিক ভাবেই জন্মায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিনহাজার মিটার উচ্চতা পর্যন্ত পাহাড়ী এলাকায় এই উদ্ভিদটিকে দেখা যায়। মাউনটেন বা পার্বত্য অঞ্চলে পাওয়া যায় বলে এর নামের সাথে মন্টেনা শব্দটি যুক্ত হয়েছে। আর্নিকা মন্টেনার গাছগুলি আট ইঞ্চি থেকে দু’ ফুট উচুঁ হয়ে থাকে । ফুলগুলি হয় হলদে রঙের। ফুলগুলি দু ইঞ্চির মতো বড় হয়। সাধারণভাবে একটি ডালের মাথায় একটি ফুলই হয় । মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত গাছগুলি ফুলে ফুলে ভরে থাকে। বহু প্রাচীন কাল থেকে বিশেষতঃ পার্বত্য উপজাতিদের মধ্যে ব্যথা, বেদনা, ব্রুসেস বা কালশিরা দূর করার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখন এর ঔষধী গুণের জন্য বিভিন্ন এলাকায় এটি চাষ করা হচ্ছে। স্থান ও জায়গাভেদে লিওপার্ডস বেন, উল্ফস্ বেন, মাউন্টেন টোবাকো আরো কিছু নামে আর্নিকা মন্টেনাকে বলা হয়। আর্নিকা মন্টেনার নিকট আত্মীয় হলো আর্নিকা অ্যানগুসটিফোলিয়া। এটাও ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে আঘাতজনিত ব্যথা, ফোলা, কালশিরা, মচকা লাগা, পেশী বা সন্ধিতে আঘাত লাগা , পতঙ্গের দংশন এইসব বিভিন্ন উপসর্গে আর্নিকা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফার্মাকোলজিস্ট বা ঔষধবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন আর্নিকার ফুল ও পাতাতে থাইমল ও হেলিনালিন নামের দু’টি জৈবযৌগ থাকার কারণে এই উদ্ভিদটির এমন ভেষজগুণ তৈরী হয়েছে।
রাসায়নিক বিজ্ঞানের ভাষায় থাইমল একটি ফেনল জাতীয় উদ্বায়ী পদার্থ। আন্তর্জাতিক রাসায়নিক নামকরণ অনুসারে একে বলা হয় ২-আইসোপ্রোপাইল-৫- মিথাইলফেনল। এর একটা নির্দিষ্ট সুগন্ধও রয়েছে। থাইমল -এর বিভিন্ন ভেষজ গুণ রয়েছে। এটি অ্যান্টিফানগ্যাল বা ছত্রাকনাশক, অ্যান্টিমিউটাজেনিক অর্থাৎ শরীরের কোন অংশের অপ্রয়োজনীয় পরিবর্তন প্রতিরোধ করে। দেহে বিভিন্ন জীবাণুর সংক্রমণকে বাধা দেয়। তবে এসবের সাথে থাইমলের বায়োসিডাল কিছু ধর্ম রয়েছে। এরফলে এই জৈবযৌগটি জীবকোষের বিভিন্ন অংশে আঘাত হানে। বিশেষতঃ সেল মেমব্রেন বা কোষপর্দার ওপর বিষক্রিয়া তৈরী করে।
হেলিনালিন অ্যান্টি ইনফ্ল্যাম্যাটরি অর্থাৎ প্রদাহরোধী, অ্যান্টি টিউমারিক অর্থাৎ আঘাত থেকে যে স্ফীতি সৃষ্টি হয় তা আটকায়। অ্যান্টি থাইপ্যানোসোমাল অর্থাৎ রক্তের মধ্যে থাকা বিভিন্ন প্রোটোজোয়া জীবাণুর সংক্রমণ হতে দেয় না। প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিফেরাম জাতীয় জীবাণুকেও প্রতিহত করে। এরসাথে স্ট্যাফাইলোকক্কাস আউরিয়াস নামের জীবাণুর বাড়বাড়ন্ত আটকায়। হেলিনালিনের কিছু বিষাক্ত প্রভাব রয়েছে। রয়েল সোসাইটি অব্ মেডিসিন; লন্ডনের গবেষকেরা দেখেছেন। এই যৌগটি বেশী মাত্রা খেলে গ্যাস্ট্রোএনটাইসিসের লক্ষণ দেখা যায়। অনেক সময় পাকস্থলী বা ক্ষুদ্রান্ত থেকে রক্তপাত হয়ে থাকে। এই লক্ষণগুলি যে একবারে প্রবলভাবে দেখা দেবে তা নয়। দীর্ঘদিন ধরে অপ্রয়োজনে লোয়ার পোটেন্সি বা স্থুলমাত্রায় আর্নিকা মন্টেনা বারবার খেলে প্রথমে গ্যাস - অম্বল- গলাবুক জ্বালা আরো কিছু সমস্যা দেখা দেয়। পরে বড়সড় অসুবিধার সৃষ্টি হয়। শিশুর বাড়বৃদ্ধির ওপর প্রভাব পড়ে। রোগীর পরিবার বা তার চিকিৎসক বুঝে উঠতে পারেন না কোথা থেকে কী হলো। অভিভাবক বা চিকিৎসক অনেক সময় ভেবে বসে এটা বোধ হয় নতুন কোন রোগের লক্ষণ। ফলে চিকিৎসাও উল্টোপাল্টা হয়ে যায়।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধের কোন সাইড এফেক্ট বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই”-এমন একটি কথা বাজারে বেশ চালু আছে। অনেকের ধারণা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যখন-তখন হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাওয়া যায়। বিষয়টি তেমন নয়; বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল উল্টো কথাই বলছে। সম্প্রতি রাইটহেল্থ ডট কম নামের আন্তজার্তিক স্বাস্থ্য সংবাদ সংস্থা তাদের ওয়েবসাইটে যে গবেষণাতথ্য জানাচ্ছে তা অতি ভয়াবহ। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের কুফলগুলি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের মতো অতি তাড়াতাড়ি প্রকাশ পায় না। এগুলি খুব ধীরে ধীরে দেখা দেয়। কুফলের প্রভাবও চলে বহুদিন ধরে। রোগী বা তাঁর চিকিৎসক শারীরিক অসুবিধার মূল কারণগুলি সহজে বুঝে উঠতে পারেন না। ব্যচম্যান, উইলিয়াম বোরিক, ডাঃ মুর, জোনস এন্ড বার্টলেট, ডাঃ টি.এফ.অ্যালেন এইসব গবেষকদের লেখা হোমিওপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকাগুলিতে বিভিন্ন ওষুধের কুফল নিয়ে উল্লেখ আছে। ওষুধের কুফল দূর করার জন্য অ্যান্টিটোড বা দোষঘ অর্থাৎ ওষুধের খারাপ প্রভাব কাটাতে পাল্টা ওষুধের এর বিধান রয়েছে। তবে এদেশের সাধারণ মানুষ এবিষয়ে তেমন কিছু জানেন না।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধগুলির কার্যকারিতার সন্ধান করা হয় প্রুভিং পদ্ধতিতে। সুস্থু ব্যক্তিকে ওষুধের মূল আরক বা মাদার টিংচার খাইয়ে তার ওপর ওষুধের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা হয়। যেমন ধরা যাক, কোন সুস্থু ব্যাক্তিকে একোনাইটাম নেপিলস -এর মাদার টিংচার খাওয়ানো হল। তারপর সেই ব্যক্তির মধ্যে ভয়-উদ্বেগ, মৃত্যুভয়, বমি বমিভাব, হৃদপিণ্ডের অতি দ্রুত স্পন্দন, প্রস্রাব কমে যাওয়া- লালচে গরম প্রস্রাব-করতে কষ্ঠ এইসব উপসর্গ দেখা দিল। এখন কোন রোগীর মধ্যে এইসব লক্ষণ যদি দেখা যায় তবে ডাক্তারবাবু তাকে একোনাইটাম নেপিলস পোটেন্টাইস অর্থাৎ সুক্ষ মাত্রায় দিয়ে থাকেন। একইভাবে কোন শিশুকে দিনের পর দিন স্থুলমাত্রায় আর্নিকা খাওয়ালে তা অনেকটা প্রুভিং-এর মতো বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। শিশুর মধ্যে আর্নিকা মন্টেনার ওষুধ লক্ষণ ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। দেখা দেয় বিভিন্ন শারীরিক অসুবিধা। রোগী - অভিভাবক বা অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা বুঝে উঠতে পারেন না অসুবিধার প্রকৃত কারণ।
শিশু পড়ে গিয়ে কাঁদলে থাকলে তবে কী করবেন -
১) হাঁটেতে গিয়ে বা খেলতে গিয়ে সোনামণির পড়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। “বা-বা-ই পড়ে গেছে -পড়ে গে-ছে. . বলে হৈ-চৈ করে বাড়ি মাথায় করবেন না। আপনার আচরণে ভয় পেয়ে বাবাই আরো জোরে কাঁদবে; ওর কান্না শুনে আপনাদের মনে হবে ওর আঘাতটা সত্যেই গুরুতর। ব্যথা-বেদনার বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের গুরুমস্তিষ্কের থ্যালামাস অঞ্চল থেকে। সাইকোসোমাটিক বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন কান্নাকাটির বিষয়টি ৭০ শতাংশই মানসিক ও ৩০ শতাংশ শারীরিক।
২) আঘাত পাওয়া স্থানে প্রথমেই জল, বরফ বা ঠান্ডা কিছু লাগান। সাধারণতঃ এতেই অনেকটা উপশম হয়। প্রয়োজন হলে আর্নিকা মলম লাগাতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত হলে কখনই আর্নিকা মলম লাগাবেন না। সেক্ষেত্রে ক্যালেনডুলা বা অন্যকোন অ্যান্টিসেপটিক মলম ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩) আজ সকালে না বাবাই ধুম করে পড়ে গেছে.. এ গল্প বাবাইয়ের সামনে পাড়াপড়শির সাথে করবেন না। এটা শিশুর মনের মাঝে প্রভাব ফেলে। তাহলে সে মাঝে মাঝেই বলবে মা আমার ডান পা-টা না ব্যথা করছে।
৪) আর্নিকা যদি খাওয়াতেই হয় তবে তা শ্যামলী বৌদির কথা শুনে খাওয়াবেন না। ওষুধ নির্বাচনের ভার চিকিৎসকের ওপর ছেড়ে দিন। । ডাক্তারবাবু আপনার শিশুকে পরীক্ষা কোরে কোন পোটেন্সির আর্নিকা, কি পরিমানে? কত বার খাওয়াতে হবে? তা তিনি ঠিক করবেন। শিশুরা নিজেদের শারীরিক বা মানসিক অসুবিধাগুলি ঠিকমতো বুঝিয়ে বলত পারে না। সেকারণে পেশাদার হোমিওচিকিৎসকের কাছেই আপনার সোনামণির চিকিৎসা করান। যারা অন্য পেশার সাথে হোমিওডাক্তারী করেন; তাদের কাছে না যাওয়াই ভালো। তাছাড়া হিউম্যান অ্যানাটমি- ফিজিওলজি ও ফার্মাকোলজি সম্বন্ধে অনেক অপেশাদার চিকিৎসকের সঠিক জ্ঞান নেই। নিজে মাতব্বরী না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নিন। সেটাই আপনার সোনামনির ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলময় হবে।