উত্তরের বায়োস্কোপওয়ালা ডাঃ পার্থপ্রতিম;-নাসিরুদ্দীন গাজী; ৪ জানুয়ারি ২০১১, পৃষ্টা- নয়; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
নাসিরুদ্দীন গাজী, কালচিনি :- নামের সঙ্গে সংস্কারমূলক পদবি ব্যবহার করেন না ডাঃ পার্থপ্রতিম। জাতি-ধর্ম-বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এটাই তাঁর প্রথম জেহাদ। তার কথায়-‘কয়েক প্রজন্ম আগের পুরুষ কেই কাঠের কাজ করত, কেউ চুল কাটত, কেউ পৌরোহিত্য করত সেই পরিচয় নামের সঙ্গে আজীবন বয়ে বেড়ানোটা অশ্লীল-কুপ্রথা।’ তিনি বলেন-‘ভারতীয় সংবিধানের এটা একটা কালো অধ্যায়। নামের সঙ্গে জাতপাতের বিষয়টি উঠে গেলে ভারতীয় রাজনীতি সাবালক হবে।’
ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে। ১৯৮১ সালে বেঙ্গালুরুতে আয়োজিত সর্বভারতীয় বিজ্ঞানমেলায় অংশ নিয়ে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির কাছে প্রশংসিত হন। তাঁর উদ্ভাবিত ‘ওয়াটার টেলিস্কাপ’ যন্ত্রটি নজর কাড়ে কেন্দ্রীয়মন্ত্রী এস বি চ্যবন, শীলা দীক্ষিত ছাড়া আরও অনেকের। তারপর কলেজ পেরিয়ে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনকে সঠিক দিশা দিতে নিজেকে তৈরি করেছেন সুচারু ভাবে। ১৯৮৮-তে ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের আর্থিক সহায়তায় 'দি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স' থেকে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমে চর্চার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৯১ ও ১৯৯২ পর পর দু'বছর ডাঃ পার্থপ্রতিম ছিলেন সর্বভারতীয় বিজ্ঞান ক্লাব সন্মেলনের মুখ্য আহ্বায়ক। ১৯৯১ সালে নাগপুরে আয়োজিত -'ইকোলজি অ্যান্ড স্পিরিচুয়ালিটি' জাতীয় বিতর্ক সভায় পূর্বভারতের প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নেন। বিশ্ব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক গবেষক দলের সদস্য হিসাবে অসমের মানস অভয়ারণ্যে ধনেশ পাখি ও গোল্ডেন লেঙ্গুর-এর উপর বিশেষ গবেষণা চালান। অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়ারার সর্বভারতীয় ছাত্র সন্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গল্প। দূরদর্শন- আকাশবাণী কলকাতা ও শিলিগুড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন বহুবার। তিনি এক সময়ে সম্পাদনা করেছেন ‘পাসর্পোট’ পত্রিকাটি। বিজ্ঞান নিয়ে ছাপা দেয়াল পত্রিকাটি 'পাসপোর্ট' - স্বাস্থ্য, কু-সংস্কার, বিভিন্ন বিষয় সাধারণ মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস।
কলেজ শেষ করে আশির দশকের শেষ দিকে যুক্ত হয়েছিলেন ভারত সরকারের কাউন্সিল ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ পিউপিলস অ্যাকশন অ্যান্ড রুরাল টেকনোলজি প্রকল্পের সঙ্গে। গ্রামের মানুষের উপযোগী প্রযুক্তির অনুসন্ধান ও প্রয়োগের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেন। ধোঁয়াহীন চুলা, উন্নতমানের ঢেঁকি যা না কি একজন লোকেই চালকোটার কাজ করতে পারেন, ভ্যান রিকশাকে কীভাবে অ্যাম্বুলেন্স করা যায় এইসব বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি কাজ করেছেন গ্রামের মানুষের পাশে থেকে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাটিয়ে মাটির টানে পাকাপাকি ঘর বেঁধেছেন নিজের জন্মভূমি ডুয়ার্সের বানারহাটে। উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষের মন থেকে কু-সংস্কার দূর করা, জনসমাজকে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সচেতন করার লক্ষ্যে গড়ে তুলেছেন বিজ্ঞানভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান- 'ডুয়ার্স এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট রিভ্যালি' সংক্ষেপে 'ডিয়ার'। সপ্তাহে একদিন বরাদ্দ এই দেশ সেবার কাজে। বৃহস্পতিবার করে ডাঃ পার্থপ্রতিম তাঁর দলবল নিয়ে পৌঁছে যান গ্রাম-গঞ্জে, স্কুল ক্লাবে। পর্দা টাঙ্গিয়ে প্রোজেক্টারের সাহয্যে চোখের সামনে তুলে ধরেন অনেক কিছু। চার দেওয়ালের মাঝেই তৈরি করেন আকাশ ভরা সূর্য তারা। কখনো আবার মানবদেহের নাড়ি-নক্ষত্র, ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ সংক্রান্ত অনেক তথ্য, ছবি, রোগ, প্রতিকারের উপায়। ডাঃ পার্থপ্রতিমের ভাষায়- 'রোগের বিষয় সঠিক জ্ঞান, উপযুক্ত পথ্য, সংযত জীবনযাপনে রুখে দেওয়া যায় যেকোন মারণব্যাধিকে।'
শুরু করেছিলেন মহাকাশ দিয়ে। অডিয়ো ভিজুয়াল শোর নাম ছিল 'মহাবিশ্বে মহাকাশে'। তারপর ব্লাডপ্রেসার ও হৃদরোগ নিয়ে 'হৃদয়ের কথা'। ডায়াবেটিস নিয়ে 'ব্যাধির নাম ডায়াবেটিস', পতঙ্গ ও পরিবেশ নিয়ে 'নিকট প্রতিবেশী'। সব মিলিয়ে বারো-তেরোটি শিরনাম। এবছর কবির জন্মের সার্ধশতবর্ষে তৈরি করেছিলেন 'রবির আকাশ-মহাকাশ'।
১৯৯১ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। স্ত্রী সুকন্যা সরকারি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। মিয়া- বিবি দুজনের বিশ্বাস, আগামী প্রজন্মের পানের জন্য দরকার নিঃকলুষ জল, বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য দরকার নির্মল বাতাস, মানসিক বিকাশের জন্য চাই কু-সংস্কারহীন সৃজনশীল পরিবেশ। তাঁদের সন্তান 'সাম্য' বড়ো হয়ে সকল অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব হবে -এই দম্পতির বাসনা এটাই। তিনি নিজেকে ‘ডিয়ার’ অর্থাৎ বিজ্ঞান ক্লাবের সদস্য হিসাবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। ব্লাডপ্রেসার ও হৃদরোগ নিয়ে লেখা ডাঃ পার্থপ্রতিমের বই ‘হৃদয়ের কথা’ কলকাতা বইমেলা ২০০১-এ প্রকাশিত হয়। ‘হৃদয়ের কথা’-র মুখবদ্ধ লিখেছন সাহিত্যিক নারায়ন সান্যাল। মুচমুচে আলাপি ভাষায় লেখা বইটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এস এস কে এম হাসপাতালের কার্ডিয়ো থোরাসিক সার্জেন ও কবি ডাঃ শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
ডাঃ পার্থপ্রতিমের নিষ্ঠা ও প্রয়াস প্রশংসিত হয়েছে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ইতিমধ্যে ঝুলিতে পুরেছেন 'জাতীয় বিজ্ঞান দিবস পুরস্কার ২০০২', সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড, ভারত সরকারের এন সি ই আর টি দিয়েছে 'মেধা পুরস্কার', ১৯৮৬ সালে পঃ বঃ সরকারের যুব কল্যাণ দপ্তর আয়োজিত 'অল ইন্ডিয়া সায়েন্স এক্সজিবিশন'-এ অংশ নিয়ে সৃজনী পুরস্কার লাভ করেন। উত্তরবঙ্গ নাট্যজগতের গুণীজন সংবর্ধনা, ২০০৪-২০০৫ আর্ন্তজাতিক বিজ্ঞান সচেতনতা বর্ষে জলপাইগুড়ি মহকুমা পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া হয় 'বিজ্ঞান সচেতনতা স্মারক সম্মান'। ভারত সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রক তাঁকে ব্যক্তিগত বেতার যোগাযোগ কেন্দ্রের বৈধ স্বীকৃতি দিয়েছে। 'হ্যাম' রেডিয়ো মারফত তিনি কথাও বলেছেন প্রয়াত রাজীব গান্ধির সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমির পুরস্কৃত পত্রিকা 'কিরাতভূমি'-র পক্ষ থেকে ডাঃ পার্থপ্রতিমের হাতে 'কিরাতভূমি স্মারক সম্মান' তুলে দেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। 'ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন' দিয়েছে একটি শক্তিশালী নিউটোনিয়ান দূরবীণ। 'ভারতীয় জাদুঘর' তাদের পুরাতাত্ত্বিক সম্ভার নিয়ে কলকাতা থেকে ছুটে এসেছেন ডুয়ার্সে। পেয়েছেন অগণিত সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম আদর, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা-তাঁর কথায় এটাই তাঁর সেরা প্রাপ্তি।
তিনি আপদ-মস্তক যুক্তিবাদী। ঘরে শনিপূজা-সত্যনারায়ণের সিন্নি হয় না। হয় বসন্ত উৎসব, বর্ষাবরণ। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবি, সাহিত্যিক, আদিবাসী লোকশিল্পী অংশ নিতে আসেন বানারহাটের 'মধুবনে বসন্ত বাসর'-এ। তিনি সু-গভীর রবীন্দ্র অনুরাগী। কবির মতো তিনিও চান- 'উৎসব ধর্মীয় সংস্কারের বেড়াজাল ভেঙ্গে হয়ে উঠুক প্রকৃতিকেন্দ্রিক-সার্বজনীন।'
'এতবছর ধরে এভাবে কাজ করে চলেছেন, পেয়েছেন বহু মানুষের সান্নিধ্য, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। নিজেকে কি ভাবেন?' অবিন্যস্ত চুলে আঙুল চালিয়ে দূরের চা বাগিচার দিকে অপলকে চেয়ে বললেন- 'বায়েস্কোপওয়ালা।'