ভিটামিন টিপস; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ২৬ মে ২০০৭ শনিবাসর; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
ভিটামিন কী?
ভিটামিন হচ্ছে খাদ্য থেকে প্রাপ্ত পুষ্টিকর পদার্থ। মানবদেহের জন্য খুব অল্প পরিমাণ ভিটামিনই যথেষ্ট। যদি খাদ্য তালিকা থেকে একটি ভিটামিনও বাদ পড়ে যায় তাহলে শরীর স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না।
ভিটামিন রাসায়নিকভাবে কার্বনসমৃদ্ধ যৌগ বা উদ্ভিজ্জ বা প্রাণীজ জীবন্ত বা একসময় জীবন্ত ছিল এরকম উৎস থেকে পাওয়া যায়।
ভিটামিন কী কাজ করে?
ভিটামিন বিভিন্ন রকম কাজ করে থাকে। প্রতিটি আলাদা ভিটামিনের আলাদা আলাদা রকমের কাজ করছে।
সামগ্রিকভাবে ভিটামিন শরীরের বৃদ্ধি, স্বাভাবিক সুস্থতা নিশ্চিত করে। শরীরের অনান্য পুষ্টিকর পদার্থ যেমন মিনারেল, ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যামাইনো অ্যাসিড এবং শক্তির উৎস যেমন শর্করা, চিনির সঠিক ব্যবহারের জন্য ভিটামিনের প্রয়োজন। এছাড়াও খাবারের স্বাভাবিক রুচি, মানসিক সুস্থতা এবং রোগজীবাণুর বিপক্ষে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ার জন্য ভিটামিন দরকার।
আমাদের শরীর কি কোনো ভিটামিন তৈরি করতে পারে?
মানবশরীরের অন্ত্রে থাকে ব্যাকটিরিয়া, যা মাইক্রোফ্লোরা নামেও পরিচিত। এ সমস্ত ব্যাকটেরিয়া নির্দিষ্ট পরিমাণ ভিটামিন কে, বি টুয়েলভ এবং বায়োটিন সংশ্লেষ বা তৈরি করতে পারে। এই ভিটামিনগুলো অন্ত্রের মাধ্যমেই শোষিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুস্থ থাকার জন্য এসব ভিটামিন পেতে আমরা খাদ্য উৎসের ওপরেই নির্ভর করে থাকি।
ভিটামিনের সংখ্যা কত?
১৩টি ভিটামিন রয়েছে। এর ভেতর ৪টি ভিটামিন চর্বিতে দ্রাব্য বা দ্রবণীয়। এগুলো হচ্ছে ভিটামিন এ, ডি, ই, কে। বাকি ভিটামিনগুলো জলে দ্রাব্য। জলে দ্রাব্য ভিটামিনগুলো হচ্ছে ভিটামিন, বি ওয়ান বা থায়ামিন, ভিটামিন বি টু বা রাইবোফ্ল্যাবিন, নিয়াসিন, বি সিক্স, বি টুয়েলভ বা কোবালামিন, ফোলিক অ্যাসিড, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড এবং বায়োটিন। এ সমস্ত ভিটামিন-বি ছাড়া ভিটামিন সিও জলে দ্রাব্য।
চর্বিতে দ্রাব্য এবং জলে দ্রাব্য ভিটামিন এই দুটোর ভেতর কোনো বিশেষত্ব আছে কি?
চর্বিতে দ্রাব্য ভিটামিনগুলো পাওয়ার জন্য খাদ্যে অল্প পরিমাণ হলেও চর্বির প্রয়োজন আছে। ভিটামিন ট্যাবলেট খাওয়ার সময়ও চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া ভালো। এতে যে পিত্তরস নিঃসৃত হবে তা চর্বিতে দ্রাব্য ভিটামিন শোষণে সহায়তা করবে। চর্বিতে দ্রাব্য ভিটামিন জলে দ্রাব্য অধিকাংশ ভিটামিনের চেয়ে বেশি সময় শরীরে থাকে।
আমরা নিয়মিত যে খাবার খেয়ে থাকি তার প্রায় সবগুলোতেই কোনো না কোনো ভিটামিন থাকে। এর মাঝে কোনো কোনো খাবার কোনো কোনো ভিটামিনের জন্য খুব ভালো উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
কিছু কিছু খাবার আছে যা স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন কলিজা, ঢেঁকিছাটা চাল, ডিম এসবে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল তথা খনিজ পদার্থ থাকে।
অনান্য খাবারের মধ্যে কিছু কিছু আছে যা কোনো কোনো নির্দিষ্ট ভিটামিনের চমৎকার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন- টকজাতীয় ফল, ব্রকোলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি এবং লংকায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে।
কিছু কিছু খাবার আছে যা শরীরের জন্য প্রচুর ক্যালোরি সরবরাহ করে কিন্তু তাতে কোন ভিটামিন নেই। যেমন চিনি, অ্যালকোহল। এ সমস্ত খাবার বিপাকের জন্য ভিটামিন বা মিনারেলের প্রয়োজন হয়। তাই প্রচুর পরিমাণে চিনি বা অ্যালকোহল গ্রহণ করলে শরীরে ভিটামিনের চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে ভিটামিনের ঘাটতি হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতেই পারে।
অতিরিক্ত ভিটামিন বা মিনারেল কি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক?
কিছু কিছু ভিটামিন বা মিনারেল আছে যা অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে শরীরের উপকার তো হয়ই না বরং অপকার হয়। যেমন শরীরে ভিটামিন বি সিক্সের দৈনিক চাহিদা হচ্ছে ২ মিলিগ্রাম। এই ভিটামিন বি সিক্স যদি দৈনিক ৫০ মিগ্রা থেকে ২০০ মিগ্রা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয় তা হলে তা স্নায়ুকোষের ক্ষতিসাধন করতে পারে। নিয়াসিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন বি ওয়ানের মতো ভিটামিন বি অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ শরীরের ক্ষতির কারণ হতে পারে। অন্যান্য ভিটামিন এবং মিনারেলের মধ্যে ভিটামিন ডি, ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, আয়রন, কপার, ক্যালসিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম এবং জিংক অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে সেগুলি শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
শরীরের পুষ্টি চাহিদা একেক জনের একেক রকম। একজনের সঙ্গে আরেকজনের মেলে না। ভিটামিন ও মিনারেলের মাল্টিতে অধিকাংশ ভিটামিন ও মিনারেলগুলোকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় সুবিধাজনকভাবে পরিবেশন করা হয়। কিন্তু একক ভিটামিন বা মিনারেল সরবরাহ করা সম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, একজন গর্ভবতী মহিলার জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে আয়রন এবং ফোলিক অ্যাসিড প্রয়োজন হতে পারে, উচ্চ রক্ত চাপের রোগী যাঁর চিকিৎসার জন্য ডাইইউরেটিক ব্যবহার করা হচ্ছে তার জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন হতে পারে কিংবা মহিলা অ্যাথলিটদের জন্য অতিরিক্ত ভিটামিন বি টুর প্রয়োজন হতে পারে।
একটি ট্যাবলেটের মধ্যে কখনোই সেই পরিমাণ ভিটামিন বা মিনারেল থাকে না যা শরীরের দৈনিক চাহিদা পূরণে সক্ষম। সমস্ত চাহিদা পূরণ করে এমন ট্যাবলেট তৈরি করলে তার আকার হবে নিদেনপক্ষে একটি গলফ বলের সমান। মাল্টি ট্যাবলেটগুলিতে কোনো কোনো উপাদান বাদ দেওয়া হয় বা প্রযোজনের তুলনায় পরিমাণে কম দেওয়া হয়। তাই কেউ যদি একটি মাল্টি ট্যাবলেট খান তাহলে তার শরীরের চাহিদা পূরণের জন্য সঙ্গে দরকারি উপাদানের একক ট্যাবলেটও পরিমাণমতো খেতে হবে।
যে ওষুধে ভিটামিন ও মিনারেল দুটোই আছে এমন ওষুধগুলোই কি খাওয়া উচিত?
আমাদেরকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে ৪০টিরও বেশি দরকারি পুষ্টিকর পদার্থ গ্রহণ করতে হয়। ভিটামিন ও মিনারেল জাতীয় এইসব পুষ্টিকর পদার্থ শরীর সুস্থভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন। আলাদা আলাদাভাবে এই সকল পু্ষ্টিকর পদার্থের গুরুত্ব তো আছেই, তাছাড়া সংঘবদ্ধভাবে কাজ করার ব্যাপারেও পুষ্টিকর পদার্থগুলোর ভূমিকা আছে। যেমন- প্রোটিন, শর্করা এবং ফ্যাট ভাঙতে এবং তা থেকে শক্তি উৎপাদন করতে ভিটামিন বি ওয়ানের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। কিন্তু প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি টু নিয়াসিন, বায়োটিন ম্যাঙ্গানিজ এবং অরো কিছু পদার্থের অনুপস্থিতিতে ভিটামিন বি ওয়ান কাজটি করতে অক্ষম। হাড়ের পুষ্টি এবং বৃদ্ধির জন্য শুধু ক্যালসিয়াম হলেই হয় না, তার সঙ্গে ভিটামিন ডি, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাসও লাগে। এই ধরনের পারস্পরিক ভূমিকার জন্য ভিটামিনের সঙ্গে মিনারেল আছে এমন ওষুধ খাওয়া উচিত।
প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিমভাবে তৈরি এই দুই রকমের ভিটামিনের ভেতর কোনটি বেশি ভালো?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিমভাবে তৈরি ভিটামিনের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য থাকে না। খাদ্যে ভিটামিন আলাদাভাবে থাকে না, যদি না তা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয় বা ল্যাবরেটরিতে খাদ্য থেকে আলাদা করা হয় এবং ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল তৈরির সময় এর ঘনত্ব যাচাই হয়। এভাবেই প্রাকৃতিক থেকে শুরু করে এই ভিটামিন শেষ হয় চূড়ান্ত পরিশোধিত পণ্যে। অনেক ক্ষেত্রে ভিটামিন, মিনারেল প্রাকৃতিকের মতোই কার্যকর। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। প্রাকৃতিক ভিটামিন এর কার্যকারিতা কৃত্রিম ভিটামিনের চেয়ে বেশি। সেলেনিয়াম এবং ক্রোমিয়ামের প্রাকৃতিক ঈষ্ট রূপটি কার্যক্ষেত্রে কৃত্রিমের চেয়ে বেশি কার্যকর এবং নিরাপদ।
টাইম রিলিজড ভিটামিন কি খাওয়া উচিত?
তাত্ত্বিকভাবে টাইম রিলিজড ভিটামিনের পেছনের সূত্র খুবই চমৎককার। কিন্তু বাস্তবে প্রচলিত ভিটামিনের চেয়ে এর কার্যকারিতা বেশি নয়।
টাইম রিলিজড ভিটামিন এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে ভিটামিনটি ধীরে ধীরে রিলিজড বা সংশ্লেষিত হয়, অধিক পরিমাণে শোষিত হয় এবং রক্তে এর পরিমাণ খুব বেশি মাত্রায় ওঠানামা না করে। যেহেতু অন্ত্রের নির্দিষ্ট অংশে ভিটামিন হজম বা পরিপাক হয় সেহেতু সেই নির্দিষ্ট অংশে পৌঁছানোর পরই ভিটামিন রিলিজড হওয়া উচিত।