মনের অসুখে হোমিওপ্যাথি;- ডাঃ পার্থপ্রতিম; ২ ডিসেম্বর ২০০৬; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
মন হল আমাদের দেহ জোড়া সুবিশাল স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার ফল। জন্মের পর ধীরে ধীরে আমাদের দেহের বৃদ্ধি হয়। তৈরি হয় নতুন নতুন দেহকোষ। অবশেষে শরীর পূর্ণতা লাভ করে। সেভাবেই পার্শ্ববর্তী পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে ঘাত- প্রতিঘাত, আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের মনোজগৎ। আশা-আকাঙ্খা, প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তি, আর্থসামাজিক অবস্থা, চারপাশের মানুষজনের আচার- আচরণের মাধ্যমে তৈরি হয় মনোভূমি। মনই হলো আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক কাজকারবারের চালিকাশক্তি। ঐ যে ডায়না পাড়ের কাশবন মাথা চাড়া দিলে আমাদের বিকাশবাবু রশিদ হাতে দৌড়-ঝাপ শুরু করে দেন, স্বপ্নাদি ব্যস্ত হয়ে পড়েন লেখা সংগ্রহের কাজে- এ সবেরই প্রেরণা আসে এক বিশেষ মানসিক গঠন থেকে। পাঠকবন্ধু, এই যে লেখাটি পড়ছেন এত আমার মনের ভাবনার সাথে মিশেল ঘটছে আপনার কৌতুহলী মনের। এতো কিছুর পরেও আমাদের এই পোড়া দেশে মনোবিজ্ঞানটাই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। পুষ্টির অভাব ও বাইরের জীবাণুর আক্রমণে যেমন আমাদের দেহে বিভিন্ন ব্যাধি দেখা দেয়; সেভাবেই মানসিক চাপ, স্নেহ ভালোবাসার অভাব, বৈষম্য ও কার্যকারণ অসঙ্গতির ফলে সৃষ্টি হয় মনোরোগ।
শারীরিক ব্যাধির ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই ডাক্তারবাবুদের কাছে ছুটে যাই। মানসিক রোগের বেলায় তেমন তৎপরতা দেখাই যায় না। প্রথমতঃ এটা যে পেটখারাপ, জ্বর, সর্দ্দিকাশির মতোই একটা অসুখ সে কথা রোগী ও তার পরিবারের লোকজনেরা বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না। কেউ কেউ আবার বলেন -“ তোমরা কী আমায় পাগল ভেবেছো; যে ঐ সব ফালতু ডাক্তার- ফাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।”
হ্যাঁ, এটাও এক মস্ত বড় অসুবিধা। আপনার অম্বল হলে আপনি নিজেই টের পান যে শারীরিক গোলযোগ দেখা দিয়েছে। নিজে থেকেই ওষুধের খোঁজ করেন। কিন্তু মনোরোগের ক্ষেত্রে রোগী বুঝতে পারেন না যে তিনি অসুস্থ। তাছাড়া মন তো আর চোখে দেখা যায় না, হাতেও ধরা যায় না। আশেপাশের মানুষজন অসঙ্গতি টের পেলেও, তাকে সহজে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন না। বরং রোগীর আচার- আচরণে বিরক্ত হয়ে তাকে এড়িয়ে চলেন।
এসবের পেছনে অন্য এক কারণও আছে। তা হল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়ায় গলদ। মাধ্যমিকস্তর পর্যন্ত পড়াশুনা করলে একজন ছাত্র বা ছাত্রী তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ- তন্ত্র- যন্ত্রের কাজকারবার সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা পেতে পারে। কিন্তু মন শরীরের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও এই মনোবিদ্যা নিয়ে কোন আলোচনাই আমাদের পাঠ্যসূচীতে নেই। এরজন্য সাইকোলজি নিয়ে আলাদাভাবে পড়াশুনা করতে হবে। ফলে মনোরোগের ধরন-ধারণ অশিক্ষিত মানুষ তো ছাড়; অনেক শিক্ষিত লোকেই বুঝতে পারে না। এর সাথে আছে কয়েক হাজার বছরের কুসংস্কার ও ভ্রান্তধারণা। মনোরোগীদের লক্ষণ দেখে নিকটজনেরা মনে করেন তার বোধ হয় বাতাস লেগেছে, কেউ বা তাকে বান মেরেছে, সবটাই অশুভ আত্মার কান্ডকারখানা। ডাক্তারের কাছে নয়; তা ছোটেন মায়ের থানে অথবা ভন্ড মাতাজি- বাবাজিদের পদতলে। জলপড়া, তেলপড়া, কবজ, তাবিজ, মাদুলির রমরমা কারবার চলে। বেশ টু পাইস ইনকাম হয় স্বঘোষিত দৈব পুরুষদের।
অন্যসব রোগ- ব্যাধির মতো মানসিকরোগের ক্ষেত্রেও হোমিওপ্যাথিতে বেশ ভালো ভালো ওষুধ রয়েছে। মনোরোগের ক্ষেত্রে হোমিও ওষুধ ব্যবহারের বেশ কিছু সুবিধা আছে। প্রথমতঃ ওয়ুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা সাইড এফেক্ট খুবই কম। দ্বিতীয়তঃ ওষুধের দাম তুলনামূলকভাবে কম। তৃতীয়তঃ হোমিওপ্যাথিতে সাইক্রিয়াটিক বা মনোরোগ চিকিৎসক বলে আলাদা ডাক্তার তেমনভাবে নেই। সকলেই প্রায় জেনারেল ফিজিসিয়ান। ফলে রোগিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি সহজে বুঝতে পারবেন না যে তাকে মনোরোগের চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছে। হোমিওপ্যাথি মূলতঃ লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি। অর্থাৎ রোগের নাম যাই হোক না কেন রোগীর মধ্যে প্রকাশিত লক্ষণের ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচন করা হয়। একটি ওষুধের সব লক্ষণ যে একজন রোগীর মধ্যে প্রকাশ পাবে এমন কোন কথা নেই; তবে বিশেষ কিছু উপসর্গ মিলে গেলে ওষুধটি প্রয়োগ করা যেতে চলে।
রোগী নির্জনে থাকতে ভালোবাসে। বিমর্ষ, জ্ঞানবুদ্ধি কম। মনে করে তার দেহ আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সে কোন এক স্বর্গীয় শক্তিদ্বারা পরিচালিত। মাঝে মাঝে আপন মনে কাঁদে। মনে করে উচ্চ সংসর্গে থাকবার পক্ষে সে অযোগ্য। এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে থুজা অক্সিডেন্টালিস (Thuja Occidentalis) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
শান্ত স্বভাবের স্ত্রী, কিন্তু হঠাৎই নিজের সন্তান- স্বামী, প্রিয়জনের প্রতি উদাসীন। সাংসারিক কাজকর্মে অনিচ্ছা। পরিবারের লোকজনের ওপর অকারণে বিরক্ত। অল্পতেই অপমানিত বোধ করে। কোথাও একা থাকতে ভয় পায়। কৃপণ স্বভাব, সহজে পয়সা খরচ করতে চায় না। সন্ধ্যাবেলায় মানসিক লক্ষণগুলি বেশি প্রকাশ পায়। এসব ক্ষেত্রে সিপিয়া (Sepia) প্রয়োগ করবেন। এই ওষুধটি মহিলাদের রোগে যতটা কার্যকরী পুরুষদের ক্ষেত্রে ততটা নয়।
একলা থাকতে পারে না, অথচ কারো সাথে বিশেষ কথাও বলে না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে লক্ষ্যহীনভাবে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। চিৎকার করে, অভিশাপ দেয়। রোগীর মধ্যে জিনিসপত্র কাটবার বা ছিঁড়বার প্রবণতা দেখা দেয়। প্রেম ও ধর্মের বিষয়ে বেশি বকবক করে। রাতের বেলায় উৎপাত বাড়ে। এই ধরনের রোগীর ওপর ভিরেট্রাম এলবাম (Veratrum Album) ভালো ফল দেয়।
রোগী আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে মাঝে মাঝে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আবার এর সাথে মৃত্যু ভয়ও থাকে। মনে করে সে যেন বড় পাপ করেছে। জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা। কারো সাথে কথা বলার সময় প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করতে থাকে; উত্তরের অপেক্ষা করে না। তার মতের সামান্য প্রতিবাদ করলেই সে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। অচেনা মানুষের সাথে মিশতে ভয় পায়। এসব রোগীর অনেক ক্ষেত্রে হাই ব্লাড প্রেসার থাকে। অরম মেটালিকাম (Arum Metallicum) এই লক্ষণগুলিতে খুব কার্যকর। এই ওষুধে বহু ক্ষেত্রে আত্মহত্যা প্রবণ রোগীর মানসিকতা পাল্টে দেওয়া যায়।
স্মৃতিশক্তি দুর্বল। কথাবার্তার খেই হারিয়ে যায়। নিজের অসুবিধার কথা বলতে কাঁদতে থাকে। রোগীর মনে হয় সময় যেন ধীরে ধীরে চলছে। বেলা কাটতেই চায় না। আবার সব কিছুতেই তাড়াহুড়ো করে। ট্রেন আসার একঘন্টা আগেই স্টেশনে হাজির হয়। কোনো কিছুতে গভীর ভাবে মনঃসংযোগ করতে পারে না। অন্ধকারে থাকতে খুব ভয়; মনে করে কে যেন পেছনে পেছনে আছে। মাঝে মাঝে ভাবে সে যেন পাগল হয়ে যাবে। আত্মহত্যার কথা ভাবে। এইসব রোগীকে মেডোরিনাম (Medorrhinum) দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
অত্যন্ত ভয় ও উদ্বেগ। রোগী বিশ্বাস করে সে শীঘ্রই মরবে, এমন কী মৃত্যুর তারিখ ও সময় বলে দেয়। ভাবে সে দিব্য দৃষ্টি লাভ করছে। ভবিষ্যতের জন্য ভয়, লোকসমাজে যেতে চায় না। রাস্তা পার হতে বারবার এপাশ ওপাশ দেখতে থাকে। মাঝে মাঝে চমকে ওঠে, গান-বাজনা অসহ্য লাগে। রোগী বিমর্ষ। নিজের হাত-পা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিজের কাছে ভারী মনে হয়। মনে করে সে যা করছে তা যেন স্বপ্নের ঘোরেই করছে। এসব ক্ষেত্রে একোনাইটাম নেপিলস (Aconite Nap) দেবেন।
রোগী কাজে, অঙ্গভঙ্গিতে এবং কথাবার্তায় অশ্লীল ইতর হয়ে পড়ে। অত্যন্ত বাচাল, কাপড় - চোপড় খুলে ফেলে। জননেন্দ্রিয় বের করে দেখায়। অত্যন্ত হিংসুটে। সন্দেহ করে কেউ যেন তার ক্ষতি করতে সবসময় চেষ্টা করছে। প্রলাপে রোগী ছুটে বাইরে যেতে চায়। বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করার প্রবণতা। আশেপাশের অনেক মানুষের কাজকর্ম সন্দেহের চোখে দ্যাখে। দাঁত দিয়ে কাপড় কাটে বা হাত দিয়ে কিছু না কিছু খুঁটতে থাকে। এই রোগ লক্ষণে হায়াসায়ামস (Hyoscyamus) দেবেন। বদ্ধ উন্মাদের ক্ষেত্রে হায়াসায়ামস ভালো ফল দেয়।
ঝড়- বৃষ্টি হলে খুব ভয় পায়। ঘরের মধ্যে জড়সড় হয়ে থাকে। মনে করে যেন ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে কিছু বের হয়ে তার দিকে আসছে। মাঝে মাঝে চমকে চমকে ওঠে। একা থাকলে মনে করে সে মারা যাবে। স্মৃতিশক্তি কমে যায়। এইসব মানসিক লক্ষণে ফসফরাস (Phosphorus)।
লোককে কাছে পেলেই নিজের অসুবিধার কথা বলতে শুরু করে। কথা বলার জন্য সবসময় লোক খুঁজে বেড়ায়। তার একনাগাড় বকবকে লোকে যে বিরক্ত হয়; তা সে বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে ভাবে লোকে তাকে ঠিকমতো বুঝতে পারছে না বা এরা সবাই মহামূর্খ। তাকে যোগ্য মূল্যায়ন করার মতো মানুষ এ তল্লাটে নেই। রোগীকে বয়সের তুলনায় বেশি বুড়ো বুড়ো দেখতে লাগে। এসব ক্ষেত্রে আর্জেন্টাম নাইট্রিকাম (Argentum Nitricum) দেবেন।
এমন আরো বহু ওষুধ রয়েছে যেগুলি মানসিকরোগীর ওপর প্রয়োগ করে আশ্চর্যজনক উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। হোমিওপ্যাথিতে মনোরোগ চিকিৎসার জন্য সেন্টিসিমাল পোটেন্সির পরিবর্তে মিলিসিমাল পাওয়ারের ওষুধ ব্যবহার বিশেষ উপযোগী। এই ওষুধগুলির শক্তি লেখা হয় ০/১, ০/২, ০/৩..... এইভাবে। এতে ওষুধজনিত রোগবৃদ্ধির সম্ভাবনা কম । প্রচলিত সেন্টিসিমাল পোটেন্সি যদি দিতেই হয় তবে তা নিম্নমাত্রায় দেবেন। উচ্চমাত্রার ওষুধ মনোরোগীদের না দেওয়াই ভালো। কতদিন ধরে মানসিক অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে? রোগীর বয়স কত? স্ত্রী না পুরুষ? মোটা না রোগা? লক্ষণের তীব্রতা কতখানি? আরো বহু কিছু বিচার করে অভিজ্ঞ ডাক্তারবাবুরা ওষুধ ও তার মাত্রা নির্ধারণ করেন। নিজে থেকে কখনই ডাক্তারি করতে যাবেন না। তাতে হীতে বিপরীত হতে পারে। আমরা বাঙ্গালীরা সবাই ডাক্তার। সামান্য কয়েকজন পড়ে; বাকীরা না পড়েই এম.আর.সি.পি(লন্ডন) এফ.আর.সি.এস(এডিনবরা)। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোন সমস্যা শুনতে পারলেই হলো; বিনামূল্যে টক টক করে পরামর্শ দিয়ে দেবেন। যেমন সেদিন আমাদের অজিত মাস্টার- “ বুঝলেন দাদা, আমার খুড় শাশুড়ির বড় ননদের ছোটমেয়ের ঠিক এমনটাই হয়েছিল। দু’বেলা খালি পেটে ঢেঁকি শাকের রস খেয়ে এখন দিব্যি টন- টনা.. ইত্যাদি.. ইত্যাদি..।” খবরদার! এনাদের পাল্লায় পড়বেন না।। তা হলে সম্মুখে শমন।
মানসিক রোগের চিকিৎসা করার জন্য চিকিৎসকের কাছে আগে গিয়েই রোগীর প্রকাশিত লক্ষণগুলি বলে আসতে হবে। পরে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো রোগীকে নিয়ে যেতে হবে। এ ধরনের রোগীর আরোগ্যের ক্ষেত্রে চিকিৎসক- ওষুধ ছাড়াও রোগীর বাড়ির লোকজনের এক বিরাট ভূমিকা থাকে। ডাক্তারবাবুর নির্দেশ অনুসারে চলতে হবে সকলকেই। কারো কোনো ছোট্ট ভুলে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। মনে রাখবেন মনোরোগী হল কাচের বাসনের মতো ‘হ্যান্ডেল উইদ কেয়ার ’।