প্লাসমোডিয়াম আছে আমাদের বিবেক বুদ্ধি চেতনায়

প্লাসমোডিয়াম আছে আমাদের বিবেক বুদ্ধি চেতনায়

প্লাসমোডিয়াম আছে আমাদের বিবেক বুদ্ধি চেতনায়; - ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১৫ নভেম্বর ২০০২ পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত।
আবার মাথাচাড়া দিয়েছে ম্যালেরিয়া। বিশেষত ডুয়ার্সের চা বাগিচা গ্রামগঞ্জে। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদ, ডি ডি টি স্প্রের ছবি। রোগ দমনের খাতে সরকারি অনুদানের জন্য চলছে তদ্বির তদারকি। খদ্দের এলে যে হোটেলের মালিককে থলি হাতে বাজারে ছুটতে হয়, আমাদের স্বাস্থ্যদপ্তরের অবস্থা তার চেয়েও করুণ। মাইক্রোস্কোপ আছে তো কর্মী নেই। কর্মী আছে তো অনুবীক্ষণ যন্ত্র বেহাল। ডিডিটি আছে তো স্প্রে করার টাকা নেই। একেবারে ল্যাজে গোবরে অবস্থা।
বর্ষাশেষে ঢাকের বাদ্যি বাজার সাথে সাথে ফি বছর যার আগমন হয়, তাকে বাগে আনতে এমন কাছাখোলা অবস্থা কেন? এটাই বড় প্রশ্ন। আসলে ম্যালেরিয়া দমনে নেই কোনো সুসংসত পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণের আন্তরিকতা। ম্যালেরিয়া যে ডুয়ার্সের অন্যতম ব্যাধি তা নতুন কিছু নয়। পরাধীন দেশে ব্রিটিশ জমানাতে এ অঞ্চলের বহু মানুষ এ রোগে ধরাধম ছেড়ে অমৃতলোকে পাড়ি দিয়েছেন, এখনো দেন।
এইসব বিভিন্ন কারণে আমাদের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী উদ্যোগী হই। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন চা বাগিচার ২৫ জন হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্টকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, কলকাতার এই পাঁচদিনের আবাসিক প্রশিক্ষণ শিবিরে যাওয়া আসা, থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যয়ভার চা বাগান কতৃপক্ষকে বহন করতে হয়নি।
পরবর্তীকালে আমরা এই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচিকে জোরদার করার লক্ষ্যে ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক এর সহায়তা প্রার্থনা করে অনুরোধ জানাই। চা বাগিচার কম্পাউন্ডার ও হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্টরা যাতে মাইক্রোস্কোপ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে তারজন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব রাখি। কারণ ম্যালেরিয়া চিহ্নিত করার অন্যতম হাতিয়ার হল মাইক্রোস্কোপ। আমাদের চিঠির উত্তরে ডি বি আই টি এর সম্পাদক জানান তাঁরা ইতিমধ্যে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ও ব্যবস্থা নিয়েছেন (পত্র সংখ্যা ১৮/২৬/১৪১২ তারিখ ৮ অক্টোবর ১৯৯৮)। চা বাগান থেকে ম্যালেরিয়া দূরীকরণে কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার, হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট এসব পদাধিকারী প্রায় সব বাগানেই আছেন, যাঁদের কাজ হওয়া উচিত চা শ্রমিক পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রসার ঘটানো। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই তাঁদের দেখা যায় চা পাতা ওজন করা ও বিভিন্ন উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে। খবরে প্রকাশ ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য ডাকা সভায় চা বাগান কর্তৃপক্ষ উল্লেখযোগ্য ভাবে অনুপস্থিত (উঃ বঃ সঃ ৩রা নভেম্বর ২০০২)।
এ বিষয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলি তাঁদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন কি? একদিনের নোটিশে যারা চলন্ত গাড়ির চাকা, বড় বড় কলখানার বলবেয়ারিং স্তদ্ধ করে দিতে পারেন, তাদের সংঘবদ্ধ প্রয়াসে প্রাণীজগতের এক ক্ষুদ্র পতঙ্গের ডানা কিছুটা হলেও অসাড় হবে না তা কী করে হয়! যেখানে পরিকল্পনামাফিক বছরে ২০ দিন নালা নর্দমা, ঝোপঝাড়ে সাফাই অভিযান চালালে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনা যায়। স্বাস্থ্য সচেতনতার কর্মসূচি চাঁদা আদায়ের ক্ষেত্রে কতটা অনুকূল প্রভাব ফেলবে? সে হিসাব আজ নাই বা করলাম। বিশেষত সমন যখন শিয়রে।
ডি ডি টি ছড়িয়ে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের মান্ধাতা আমলের পদ্ধতি এই পোড়া দেশে আর কতদিন চলবে? এই ধরনের অর্গানোক্লোরিক কীটনাশকের ব্যবহার প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে বহুদিন আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের কীটনাশকের বিষাক্ত প্রভাবে ঘরে ঘরে জন্ম নিচ্ছে রুগ্ন শিশু, দেখা দিচ্ছে ডায়াবেটিস, ক্যানসারের মতো মারণ ব্যাধি, ধ্বংস হচ্ছে ডুয়ার্সের পরিবেশ বাস্তুসংস্থান। নাকের বদলে নরুন পেয়ে আর কতদিন আমরা তাক-ডুমাডুম-ডুম নাচব? বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল, ইন্ট্রিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কবে উদ্যোগী হবেন ডুয়ার্সের মাতব্বরেরা? [আগ্রহীরা পড়তে পারেন স্যার রসেল কারসনের সাইলেন্ট স্প্রিং বইটি (Silent spring’ by sir R. Corson)]।
এসব থেকেই বোঝা যাচ্ছে-প্লাসমোডিয়াম ভাইভক্স বা ফ্যালসিপ্যারাম শুধু মশার ইন্টেস্টাইনে নেই, আছে আমাদের বিবেক বুদ্ধি চেতনায়। ম্যালেরিয়া দূরীকরণে সদিচ্ছা যদি থেকেই থাকে, তবে তারজন্য তৈরি করতে হবে সুসংহত পরিকল্পনা এবং দরকার সেই পরিকল্পনার আন্তরিক রূপায়ণ। একাজে যুক্ত করতে হবে বাগান কর্তৃপক্ষ, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, পঞ্চায়েত, ব্যবসায়ী সমিতি সকল শ্রেণীর মানুষকে। তা না হলে সোমরা, বুধনি, মোঙ্গরার বুকফাটা কান্নায় নিমতেতো হবে আমাদের ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা।

Join our mailing list Never miss an update