ক্যালোরিই তো এনার্জি - ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৩ শনিবাসর; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
তা সে ম্যাট্রিকে হ্যাটট্রিক করা শ্যামলীই হোক বা ক্ষুদিরাম পল্লীর প্যাটকা সঞ্জয়- কাগজ-দূরদর্শনের দৌলতে ক্যালোরি এখন সবার কাছে পরিচিত শব্দ। তবে হ্যাঁ, শব্দটি জানা শোনা হলেও অনেকেরই ক্যালোরি সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা নেই।
আসলে আমরা প্রতিদিন যে খাবার খাই তা পরিপাকের পর খাদ্যের সারপদার্থ রক্তের মধ্যে দিয়ে দেহের বিভিন্ন কোষে পৌঁছে যায়। এই সারপদার্থ দেহের ক্ষয়পুরণ, নতুন কোষ বৃদ্ধির কাজ যেমন করে তেমনই অক্সিজেনের মাধ্যমে জারিত হয়ে উৎপন্ন করে শক্তি বা এনার্জি। এই এনার্জিকে মাপা হয় ক্যালোরি একক দিয়ে। যে খাদ্য যতটা শক্তি উৎপাদন করার ক্ষমতা থাকে তাকে তত ক্যালোরি যুক্ত খাদ্য বলে। বিজ্ঞানে ক্যালোরি মূলত তাপ শক্তির একক। ১০০ ক্যালেরি তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। এই তাপশক্তিকে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত করে আমরা হাঁটাচলা করি, শচীন-সৌরভ ব্যাট হাঁকিয়ে ছক্কা মারেন। আমার পাড়ার পানু কমরেড যখন নিরাপদ দূরত্বে দাড়িয়ে মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে বক্তৃতা দেন তখন গতিশক্তি শব্দশক্তিকে রূপান্তরিত হয়।
আমরা যখন কোনো কাজ করি না বিশ্রাম নেই বা ঘুমাই তখনও আমাদের দেহের বিভিন্ন শরীর-যন্ত্রের (যেমর-হৃদপিন্ড, ফুসফুস, কিডনি)-র কাজ চালানোর জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়। কোনো গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে তাঁকে দাঁড় করিয়ে রাখলে যেমন কিছুটা হলেও তেল খরচ হয়, ব্যাপারটা সে রকম। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে মৌল বিপাক হার বা বেসাল মেটাবলিক রেট। এই বি এম আরের মান নির্ভর করে আপনার ওজন পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া, বয়স, আপনি মহিলা না পুরুষ এইসব বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। যেমন-
বয়স : কম বয়সে মৌল বিপাক হার বেশি থাকে, তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কমে আসে।
লিঙ্গ : মহিলাদের তুলনায় পুরুষের বি এম আর বেশি।
জলবায়ু : শীতপ্রধান দেশে মৌল বিপাক হার বেশি। অন্যদিকে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে তা কম হয়।
খাদ্য : উপবাসে থাকলে বিপাক হার কমে যায়।
অভ্যাস : যাঁরা কায়িক পরিশ্রম করেন বা খেলাধুলা যাঁদের পেশা তাদের বি এম আর সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি।
গর্ভাবস্থায় : মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভবস্থায় প্রথম ছয় মাস মৌল বিপাক হার বেড়ে যায়।
হর্মোন : অ্যাড্রিনাল কর্টেক্স ও মেডালা, থাইরয়েড এবং অ্যান্টিবিয়র পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে মাত্রাতিরিক্ত হর্মোন নি:সৃত হলে মৌল বিপাক হার বৃদ্ধি পায়।
তাপমাত্রা : জ্বর হলে বা কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বি এম আর বেড়ে যায়।
জাতিগত তফাত : এষ্কিমোদের মৌল বিপাক হার তুলনামূলকভাবে বোশি। আবার পাশ্চাত্য দেশের মধ্যে চিনাদের বিপাক হার কিছুটা কম।
ওষুধের প্রভাব : ক্যাফিন, বেনজোড্রিন-এরকম কয়েকটি ওষুধ বি এম আর বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে বিভিন্ন চেতনানাশক বা অ্যানাসথেকি ওষুধে তা কমে আসে।
এই সব জটিল হিসেব নিকেশে না গিয়ে মোটামুটিভাবে বলা যায়-একজন পূর্ণ বয়স্ক বাঙালি পুরুষের ক্ষেত্রে ২৪ ঘন্টায় মৌল বিপাক হার ১৬৮০ ক্যালোরি এবং মহিলার ক্ষেত্রে ১৪৪০ ক্যালোরি।
আমরা প্রতিদিন যে বিভিন্ন রকমের কাজ করি তার প্রকৃতি অনুসারে শক্তিক্ষয়ের মাত্রাও বিভিন্ন হয়। যেমন- সাঁতার কাটা, দৌঁড়ানো এসব ভারি কাজে বেশি শক্তি লাগে। আবার জামা-কাপড় পরা, কথা বলা, দাঁত মাজা এসব হালকা কাজে শক্তিক্ষয়ের পরিমাণ কম।
বিভিন্ন কাজে প্রতি ঘন্টায় কত ক্যালোরি শাক্তি প্রয়োজন হয় তার মোটামুটি হিসেব হল :
বসে থাকা অবস্থায় ১৫
দাঁড়ানো অবস্থায় ২০
জামা কাপড় পড়া ও ছাড়া ৩৫
মুখ ধোয়া ও স্নান করা ৩৫
ঘর মোছা ও ঝাঁটা দেওয়া ১০০
সাইকেল চালানো ১৩০
সেলাই করা ৭০
দাঁত মাজলে ও চুল আঁচড়ালে ৪০
ঘরে আসবাব-
সিলিং ঝাঁড়পোছ করলে ১৫০
রান্নার কাজে ১২০
বাসন ধুলে ৭৫
ছবি আঁকলে (দাঁড়িয়ে) ৮০
বই পড়লে ২৫
কম্পিউটারে কাজ করলে ৬০
টাইপ করলে ৭০
ছোটখাটো সাংসারিক কাজে ৬০
লেখার সময় ৩৫
ইস্ত্রি করলে ১১০
হাঁটার সময় ১৪০
(৪ কিমি প্রতি ঘন্টা বেগে)
হাঁটার সময়
(৬ কিমি প্রতি ঘন্টা বেগে)
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা ১০০০
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামা ৩৫০
রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে নাচার সময় ২৬০
সাঁতার কাটলে ৫০০
হালকা ব্যায়াম করলে ৫০০
হালকা খেলাধুলায় ২৮০
আপনাদের দেহের কাঠামো, পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া, দৈনিক কাজকর্মের ধরন-এসব বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ক্যালোরি চাহিদা নির্ভর করে। যেমন-ধরুন আপনার ওজন ৫০ কেজি। অফিসে কেরানির কাজ করেন। আপনার জন্য দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালোরি হবে-
২৪ ঘন্টার নূন্যতম বিপাকক্রিয়া ১৬৮০
১ ঘন্টা ঘরোয়া কাজ ১x৩০ ৩০
১ ঘন্টা হাঁটা-চলা ১x১১৫ ১১৫
৮ ঘন্টা লেখা/ ফাইল নাড়ানো/ টাইপ ইত্যাদি ৮x৭০ ৫৬০
২ ঘন্টা বিশ্রাম ২x১৫ ৩০
মোট প্রয়োজনীয় ক্যালোরি ২৩১৫
আপনি যদি প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালি গৃহবধূ হন, তবে আপনার দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালোরি হবে-
২৪ ঘন্টার ন্যূনতম বিপাকক্রিয়া ১৪৪০
২ ঘন্টা রান্নার কাজ ১২০x২ ২৪০
আধা ঘন্টা ঘরমোছা ও
ঝাড় দেওয়া ১৫০x.৫ ৭৫
৩ ঘন্টা সাংসারিক কাজ ৪০x৩ ১২০
২ ঘন্টা হাঁটাচলা ৩৫x২ ৭০
৩ ঘন্টা বিশ্রাম ২০x৩ ৬০
মোট প্রয়োজনীয় ক্যালোরি ২০০৫
ওপরের এই হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে বিভিন্ন পেশার মানুষের ক্যালোরির প্রয়োজন বিভিন্ন হয়। তাছাড়া গরম থেকে শীতকালে বিপাকক্রিয়ার হার বেশি থাকে বলে ক্যালোরির চাহিদা বেশি।