হরিনাভি স্কুল; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১ আগস্ট,১৯৯১; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে পিচঢালা কালো পথ ধরে বারুইপুরের দিকে কিছুদুর গেলেই চোখে পড়বে হরনাভি হাইস্কুল। কলকাতার এত কাছে গাছগাছালি ঘেরা এই রাজপুর অঞ্চল অনন্যতার দাবি রাখে। নরেন্দ্রপুর পাখি-রায়ল এ স্কুল থেকে খুব দূরে নয়। উত্তরের হিমেল হাওয়ায় সাথে সাথে দূর-দূরান্ত থেকে নাম জানা অজানা বহু পাখি উড়ে আসে এই সবুজ দেশে। শ্যামলা গাঁয়ের এ স্কুলটির বয়েস একশো পঁচিশ পেরিয়ে গেছে। তখন অখন্ডিত বাংলার গাঙ্গেয় সমভূমিতে নবজাগরণের উত্তাল জোয়ার। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ও আরও অনেকে হলেন এই জাগরণের তূর্য বাদক। নবজাগরণ আর এক অর্থে আধুনিকতা। সনাতন সংস্কৃত টোলের সংস্কারের বাঁধন ছিড়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে দেশের আগামী প্রজন্মকে-এ দৃঢ়তা নিয়ে অন্য আর সকলের সাথে এগিয়ে চললেন বিদ্যাভূষণ। পন্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন হরিনাভি স্কুল। ১৮৬৯-এ সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা উমেশ-চন্দ্র দত্ত হলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
১৮৭০ সালে স্কুলটি কিছু সরকারী অর্থ সাহায্য পেল। সে সময়ে স্কুলের নাম রাখা হলো হরিনাভি এডেড স্কুল। নামের আবার পরিবর্তন ঘটলো ১৮৭২-এ। স্কুলের নাম হল হরিনাভি অ্যাঙলো সংস্কৃত স্কুল। ১৯৮৬ সালে শতবার্ষিকী উৎসবেব সময় বিদ্যালয়ের নামের মধ্যে নতুন সংযোগ হলো- হরিনাভি দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ অ্যাঙলো সংস্কৃত স্কুল। উমেশচন্দ্রের আগে প্রধান শিক্ষক ছিলেন দেবেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ। পরবর্তীকালে যিনি হয়েছিলেন কলকাতার খ্যাতিমান আইনজীবী। ১৯০৯ -এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন রবীন্দ্রনাথের ইংরাজি শিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য। কবি তার কথা জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলা বইতে লিখে গেছেন। বর্তমান প্রধান শিক্ষক আনন্দমোহন চট্টোপাধ্যায় ১৯৪৭ সালে কাজ শুরু করেন। ১২৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে বহু মনীষী এখানে এসেছেন শিক্ষকতা করতে-শিবনাথ শাস্ত্রী থেকে শুরু করে প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের পিতা প্রকাশচন্দ্র রায়, বিজ্ঞানী পুলিন বিহারী বসু ও আরও অনেকে। ছাত্রদের মধ্যে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের পিতা জানকীনাথ বসু, বিজ্ঞানী চারুলতা ভট্টাচার্য, বিপ্লবী মানবেন্দ্র রায়, ভারতশ্রী কমল ভান্ডারী, ফুটবলার অতনু ভট্টাচার্য, অমিত ভদ্র ছাড়াও রয়েছে গীতকার- সুরকার সলিল চৌধুরি।
বিভিন্ন সময়ে যাঁরা স্কুলে এসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, নোবেলজয়ী চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরমণ, আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। স্কুলের সুচনা সতেরোজন ছাত্র নিয়ে। মাদুরে বসে চলত লেখাপড়া। আজ তার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পূর্বসূরীদের নিশান বয়ে নিয়ে চলেছে বর্তমান কিশোর-যুবকেরা। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র আন্তভ চ্যাটার্জি সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমির সর্বভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন। যোগব্যায়ামে জাতীয় চ্যাম্পিয়ান হয়েছেন পার্থ সেন। ক্রিকেট খেলাতেও নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে এ স্কুলের ছাত্ররা। দেশের বনজসম্পদের সুসংরক্ষণের জন্য সরকারী সাহায্য চেয়ে প্রাক্তন পরিবেশমন্ত্রী মেনকা গান্ধীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন এই সবুজ দ্বীপের ছোট্ট রাজারা।