শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করতে ডুয়ার্সের রোগ সারাতে চান এক ডাক্তারবাবু

শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করতে ডুয়ার্সের রোগ সারাতে চান এক ডাক্তারবাবু

শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করতে ডুয়ার্সের রোগ সারাতে চান এক ডাক্তারবাবু; মোস্তাক মোরশেদ হোসেন;১০ নভেম্বর ২০১১ পৃষ্ঠা নয়;উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
মোস্তাক মোরশেদ হোসেন, রাঙালিবাজনা :- একটা সুন্দর অথচ নানা রোগে আক্রান্ত, ক্লিষ্ট শরীর নিয়ে বেজায় সমস্যায় পড়েছেন ডাক্তারবাবু। বেশ তো ছিল কুমার গ্রাম থেকে ওদলাবাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত শরীরটা। কিন্তু গত কয়েক বছরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে ওই শরীরে। তাই চিকিৎসায় হাত দিয়েছেন বানারহাটের ডাক্তারবাবু। কাঁটাছেড়ায় তার ঘোরতর আপত্তি। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ নামের জটিল রোগে আক্রান্ত শরীরটার চিকিৎসা না করেও তো উপায় নেই। তাই অনেক ভেবেচিন্তে একটাই দাওয়াই ঠিক করেছেন ডাক্তারবাবু। তা হল ডুয়ার্সের জন্য পৃথক একটা দিন উদ্যাপন করা। সাম্প্রদায়িকতার ভাইরাস ধ্বংস করতে, বিচ্ছিন্নতাবাদ নামের ক্যানসারের মারণ কোষগুলি ধ্বংস করতে আলিপুরদুয়ার থেকে ওদলাবাড়ি পর্যন্ত একদল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে নিয়ে ‘ডুর্য়াস ডে উদ্যাপন কমিটি’ নামে একটা ভিন্ন প্রকৃতির ‘মেডিকেল টিম’ তৈরি করেছেন ডাক্তারবাবু।

    ডাক্তারবাবুর নাম পার্থপ্রতিম। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। পেশায় হোমিয়োপ্যাথির চিকিৎসক। ডাঃ পার্থপ্রতিমের এখন একটাই ধ্যান-জ্ঞান, ডুয়ার্সকে বিচ্ছিন্নতাবাদকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা থেকে মুক্ত করা। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, রাজবংশী, আদিবাসী, নেপালি সকল সম্প্রদায়ের বাসভূমি ডুয়ার্সে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করতে ‘ডুয়ার্স ডে’ পালন করার আহ্বান জানিয়ে সারা বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি।
    ২০১০ সালের আগস্ট মাস। ডুয়ার্সের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশ তখন ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, আদিবাসী বিকাশ পরিষদ ইত্যাদি সংগঠনগুলির আন্দোলন, দাবি, প্রতিবাদ, বন্ধ আর বন্ধের ডাকা পালটা বন্ধে ডুয়ার্সের জনজীবন তখন বিপর্যস্ত। একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছেন। স্কুল জীবনে যে দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের বন্ধু এক থালায় ভাত খেত, তারা সাম্প্রদায়িক উসকানিতে একে অন্যের মুখ দেখেন না।  এহেন অস্থির পরিস্থিতিতে ডাঃ পার্থপ্রতিম ভাবলেন ‘যদি সবাইকে নিয়ে ডুয়ার্সের জন্য আলাদাভাবে একটা দিন উদ্যাপন করা যায় তাহলে কেমন হয়!’ যেমনি ভাবা তেমনি কাজ! ডাক্তারবাবুর আহ্বানে সাড়া দিলেন আলিপুরদুয়ার থেকে ওদলাবাড়ির সর্বস্তরের মানুষ। অকুন্ঠ সহযোগিতা করলেন ওদলাবাড়ির জীবন মিত্র, চালসার হেমা গাঙ্গুলি, কামাখ্যাগুড়ির দেবাশিস ভট্টাচার্য, আলিপুরদুয়ারের অরুণ গৌতম, হ্যামিল্টনগঞ্জের বরুণ মিত্র, কুমারদীপ চৌধুরি, ধূপগুড়ির ডঃ কৃষ্ণ দেব, ডঃ অমিতকুমার দে সহ অনেকেই। গঠিত হল ডুয়ার্স ডে উপযাপন কমিটি। সর্বসম্মতিক্রমে সম্পাদক মনোনীত হলেন ডাঃ পার্থপ্রতিম। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে দেখা গেল বানারহাটের এক বেসরকারি বিদ্যালয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের সঙ্গে ডুয়ার্স ডে-র বৈঠকে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, ডুয়ার্স মিল্লাতে ইসলামিয়ার নেতাদেরও হাজির হতে। সবাই সেদিন শপথ নিলেন, ডুয়ার্সে অশান্তি হতে দেব না।
 

   গত ১৪ জানুয়ারি ডুয়ার্সের বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয়েছে ‘ডুয়ার্স ডে’। কিন্তু মোর্চার ডাকা বনধে বিঘ্ন ঘটেছে অনেকটাই। কিন্তু ডুয়ার্সের স্বতন্ত্র সত্তার আনুষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সেদিন। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, শোভাযাত্রায় ডুয়ার্স যেন বুঝিয়ে দিয়েছে, উসকানিতে অশান্তির আগুন যতই জ্বলে উঠুক, ডুয়ার্সের একটা পৃথক সত্তা রয়েছে।
    ওদলাবাড়ি উন্নয়ন সমিতির পক্ষে জীবন মিত্র বলেন, ‘ডুয়ার্সে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যারা চিন্তাভাবনা করেন তাদের মধ্যে ডাঃ পার্থপ্রতিম অন্যতম। আমরা সবাই তার সঙ্গে আছি। ডুর্য়াসকে আমরা কিছুতেই ভাগ হতে দেব না।’ ধূপগুড়ির বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক ডঃ কৃষ্ণ দেব বলেন, ‘ডুয়ার্সের বিভিন্ন জনজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ডাঃ পার্থপ্রতিম যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, ডুয়ার্সে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে ডুয়ার্স ডে পালন করা ভীষণভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ডুয়ার্স-তরাই নাগরিক মঞ্চের কার্যকরী সভাপতি ল্যারি বোস বলেন, ‘সমাজকে শুভ বার্তা দিয়েছে ডুয়ার্স ডে। বিভিন্ন জনজাতি নিয়ে গঠিত ডুয়ার্স যেন ‘মিনি ইন্ডিয়া।’ ডুয়ার্সের ঐক্য রক্ষা করতেই হবে।’
 

   ডাঃ পার্থপ্রতিম অবশ্য পুরো কৃতিত্ব দিয়েছেন ডুয়ার্সের আপামর জনগণকে। তিনি বলেন, ডুয়ার্সের মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে সাড়া দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন তারা বিচ্ছিন্নতাবাদ বিরোধী। আগামী ১৪ জানুয়ারি দ্বিতীয়বার ডুয়ার্স ডে পালিত হবে। কমিটির সূত্রে জানা গেছে, ডুয়ার্স ডে পালনের পন্থা কিছুটা পালটেছে। পার্থবাবু বলেন, সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে এবার ওই দিনটি পালন করতে চলেছি আমরা। এবার ১৪ জানুয়ারি প্রতিটি বাড়িতে ডুয়ার্সে সম্প্রীতির জন্য প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোক দিবস পালনের আহ্বান জানানো হবে। এছাড়া, কর্মসূত্রে বা বিবাহসূত্রে যারা ডুয়ার্সের বাইরে রয়েছেন তাদের ১৪ জানুয়ারি ডুয়ার্সে কাটানোর আমন্ত্রণ জানানো হবে।
    সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেও চলছে ডুয়ার্স ডে নিয়ে জোরদার প্রচার। ফেসবুকের মাধ্যমে এক হাজারেরও বেশি সদস্য হয়েছেন, জানান পার্থবাবু। গত ডিসেম্বর মাসে খোলা হয়েছে ডুয়ার্স ডে পালন কমিটির নিজস্ব ওয়েবসাইট। www.dooarsday.hpage.com  ক্লিক করলেই ভেসে উঠছে ডুর্য়াস সম্পর্কিত নানা তথ্য। দীর্ঘদিন চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ডাক্তারবাবু এবার একটু অন্যরকম রোগের চিকিৎসা করতে চান। তিনি কতটা সফল হন সেটাই এখন দেখার।

Join our mailing list Never miss an update