বর্ষার জলবাহিত রোগ

বর্ষার জলবাহিত রোগ

বর্ষার জলবাহিত রোগ; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১৪ জুলাই ২০০২ পৃষ্ঠা-১২; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
বর্ষা মানেই পেটের অসুখের ঋতু। বাচ্চা-বুড়ো কমবেশি সবাই ভোগেন। এ সময় যেসব রোগ বিশেষভাবে দেখা দেয় তারমধ্যে অন্যতম হল জিয়ার্ডিয়াসিস।লিখেছেন-ডাঃ পার্থপ্রতিম।
জিয়ার্ডিয়াসিস কেন হয়?
    জিয়ার্ডিয়া ল্যাম্বলিয়া (Girdia Lamblia) নামের এককোষী প্রাণী এই রোগের কারণ। পানীয় জল বা খাবারের সঙ্গে মিশে পেটে ঢুকে যায়। তারপর ক্ষুদ্রান্ত্র বা ইনটেস্টিন -এর ডিওডিনাম বা জেজুনামে বাসা বাঁধে। এরজন্য এই জীবাণুর এক নাম হল জিয়ার্ডিয়া ইনটেস্টিনালিস।
    অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে একে দেখতে খুবই মজার। পান পাতার মতো দেহের গায়ে আঁকা থাকে চোখের মত ছাপ। দেহের সঙ্গে লেগে থাকে সরু সরু শুঁড়ের মত ফ্ল্যাজেলা। ফ্ল্যাজেলাগুলি আবার নড়াচড়া করে। এগুলিই ওদের গমন অঙ্গ।
    জিয়ার্ডিয়া ক্ষুদ্রান্ত্রে বাসা বেঁধে বংশবিস্তার করতে থাকে। পরিপাক হওয়ার পর খাদ্যের সার অংশটুকু ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যে দিয়ে শোষিত হয়ে রক্তে মিশে যায়। রক্ত তারপর দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দেয়। জিয়ার্ডিয়াসিস হলে চর্বি ও শর্করা জাতীয় খাদ্য ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে শোষিত হতে পারে না। ফলে মলের সঙ্গে চর্বি বা শর্করা বেরিয়ে যায়।
    আগে ধারণা ছিল জিয়ার্ডিয়া স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের শরীরে থাকে, তেমন কোনো ক্ষতি করে না। প্রায় পঁচিশ বছর আগে এ ধারণা পুরোপুরি পাল্টে যায়। গবেষণা থেকে জানা যায় জীবাণুটি মোটেই দেহের ভেতর থাকে না। বাইরে থেকে সংক্রামিত হয়ে দেহের অনেক ক্ষতি করে।
রোগের প্রাথমিক লক্ষণ  
    জিয়ার্ডিয়াসিসের প্রাথমিক লক্ষণ-দিনে ৫ থেকে ৮ বার পায়খানা হয়। পাতলা সাদা মলের সঙ্গে শ্লেষ্মা বা চর্বিযুক্ত থাকে। পেটে প্রায় চিনচিনে ব্যাথা বাড়ে।
    এরসঙ্গে খিদে কমে আসে, দেহে ক্লান্তিভাব দেখা দেয়। খাদ্যের স্নেহ ও শর্করা শরীরের কোনো কাজে লাগে না বলে দেহ দুর্বল হয়ে পড়ে। কারো কারো ক্ষেত্রে খাবার দেখলে বমি আসে, প্রথম অবস্থায় তিন থেকে পাঁচদিন এই উপসর্গ থাকে। ঠিকমত চিকিৎসা না করলে রোগ ক্রনিক হয়ে দাড়ায়। তখন রোগীর সবসময় পায়খানা হবে হবে ভাব থাকে, ঠিকমত মলত্যাগ হয় না।
 কী করে ছড়ায়?
    সাধারণত জল ও খাবারের মাধ্যমে এই জীবাণু শরীরে ঢোকে। গ্রামাঞ্চলে যারা পুকুরের জল ব্যবহার করে তাদের ক্ষেত্রে এই প্রকোপ বেশি। একই পুকুরে স্নান, কাপড় কাচা, বাসন ধোয়া, বাচ্চার কাঁথা ধোয়া এসব করলে তো কথাই নেই। শহরাঞ্চলে যে জল সাপ্লাই হয় তাতে সঠিক পরিমাণে ক্লোরিন না মেশালে জীবাণু মরে না। তরাই ও ডুয়ার্সে যারা পাহাড়ি নদী বা ঝোরার জল ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে এ অসুখ বেশি দেখা যায়। কারণ ঠান্ডা জলে জিয়ার্ডিয়া ল্যাম্বলিয়া প্রায় তিন চারমাসে বেঁচে থাকতে পারে।  
রোগ ধরা যায় কীভাবে?     
    রোগীর মল পরীক্ষা (স্টুল রুটিন এগজ্যামিন) করলে এইরোগ শনাক্ত করা যায়। তবে মলত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে এ পরীক্ষা করলে জীবাণু ভালোভাবে ধরা পড়ে। অনেক সময় ক্রনিক রোগের জন্য ডিওডিনাম থেকে সরাসরি রস সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে।
চিকিৎসা  
    জিয়ার্ডিয়াসিসের চিকিৎসার জন্য ফুরাজোলিডন (Furazalidone), টিনিডাজোল (Tinidazole), মেট্রোনিডাজোল (Metronidazole), এই তিন ধরনের ওষুধ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। ডাক্তারবাবুরা রোগীর অবস্থা বুঝে ওষুধ নির্বাচন করেন। এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে কারো ক্ষেত্রে বমি বমি ভাব, খাবারে অনীহা দেখা দিতে পারে। তবে তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ব্যাপারটা খুবই সাময়িক, ওষুধ বন্ধ করলে উপসর্গগুলি চলে যায়।
হোমিওপ্যাথিতে নিরাময়  
    হোমিওপ্যাথিতে এ অসুখের চিকিৎসায় লক্ষণ অনুসারে মার্কুরিয়াস সল (Mers. Sol), ইপিকাক (Ipecac), নাক্সভমিকা (Nux vom), কলোসিন্থ (Colocynth) প্রভৃতি ওষুধ খুবই ব্যবহৃত হয়। এছাড়া কুর্চ্চি (Kurchi) ) ও ভ্যাক্সিনিয়াম মার্ট (Vaccinium Myrt)-র মাদার টিংচার প্রয়োগ করে অনেক সময় বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
সর্তকতা   
    কথায় বলে ‘prevention is better then cure’ রোগ হলে চিকিৎসা করার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করাই সবচেয়ে ভালো উপায়। এ ব্যাপারে বাড়ির সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষত বাড়ির বাচ্চার এই ব্যাধি হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা তো করাবেনই সেইসঙ্গে তাকে বাড়ির ও পাড়ার অন্যান্য শিশুদের থেকে আলাদাভাবে রাখার চেষ্টা করবেন। আক্রান্ত বাচ্চার জামাকাপড় যিনি ধোবেন তার হাতে জীবাণু লেগে থাকা স্বাভাবিক। এ অবস্থায় খাবার, বাসন এমনকী অন্যের জামাকাপড়ে হাত দিলে রোগ সংক্রামিত হতে পারে। জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে তারপর অন্য কাজ করা উচিত।
    এ রোগ প্রতিরোধে সামাজিকভাবে উদ্যাগী হতে হবে। বর্ষার জল যাতে পানীয় জলের সঙ্গে মিশতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। প্রয়োজনমত পানীয় জলে সঠিক মাত্রায় ক্লোরিন মেশাতে হবে। পুকুরে বা কলপাড়ে কাপড় কাচা, বাসন মাজা, স্নান করা বন্ধ করতে হবে। একোজ এগিয়ে আসতে হবে স্থানীয় পঞ্চায়েত, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষকে।
                       চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ:-বানারহাট,জেলা জলপাইগুড়ি, ফোন-(০৩৫৬৩) ৫২৪৯৩  

Join our mailing list Never miss an update