হৃদয়ের কথা পর্ব-৩১; হৃদরোগ দেশে দেশান্তরে

হৃদয়ের কথা পর্ব-৩১; হৃদরোগ দেশে দেশান্তরে

হৃদরোগ দেশে দেশান্তরে; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ২৯শে নভেম্বর ১৯৯৯; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
    ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভেতর সবার সমান রাঙা।’ হ্যাঁ, বাইরে দেখার ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে যতই প্রভেদ থাকুক না কেন, অন্তরে সবার মধ্যে এক অদ্ভুত মিল রয়েছে। বসুন্ধরা জুড়ে এই যে এত মানুষের সমাবেশ; একে হৃদয়ের মেলাও বলা যায়। কারণ সবার জীবনের জীয়নকাঠি লুকিয়ে আছে হৃদযন্ত্রের সচলতার মাঝে। তাই হৃদরোগ আছে দেশে, আছে দেশান্তরে।
    সত্তর দশক পর্যন্ত ভারতের ঘাতক তালিকায় হৃদরোগ ছিল সাত নম্বরে। কিন্তু বর্তমানে এর স্থান তৃতীয়। ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন কনসেনসাস কার্ডিওলজি অ্যান্ড ইকোকার্ডিওগ্রাফির সহসভাপতি ডাঃ কে কে অগ্রওয়ালের মতে, 'আগামী বছর পাঁচেকের মধ্যে ঘাতক তালিকায় প্রথম স্থানটি দখল করবে কার্ডিও ভ্যাসকুলার ডিজিজ।' বর্তমানে প্রতি বছর সাড়ে তিন লক্ষ ভারতীয় হৃদয় ব্যাধির কারণে এই ধরাতল থেকে  পাড়ি দেন পরপারে। এখন দেশে অন্তত ৮০ লক্ষ হৃদরোগী রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৯ সালের মধ্যে সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ১ কোটির বেশি। তেমন সঠিক ভাবে কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, হার্ট ডিজিজে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ডের পরেই আছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। হৃদরোগজনিত মৃত্যুর প্রবণতা সুইডেনে সবচেয়ে কম।
    হার্ট ডিজিজে অসুস্থতার ঘটনা শুধু যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আলাদা, তাই নয়, একই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে বেশ কিছু রকমফের চোখে পড়ে। করোনারি হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়েছে সেই সঙ্গে এর প্রকৃতিগত বেশ পরিবর্তন হয়েছে। আজ থেকে বিশ-পচিঁশ বছর আগে কোনো যুবক বা যুবতীর  বুকে ব্যথা হলে ডাক্তারবাবুদের মাথায় কখনই হৃদরোগের কথা আসতো না। এখন ঘটনা অন্যরকম। তাছাড়া হার্ট ডিজিজের এত রকমফের আগে তেমন চোখে পড়তো না। যদিও এক্ষেত্রে অনেকে বলেন উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তি না থাকার ফলে সে সময় ব্যাধি প্রকৃতরূপে শনাক্ত হতো না।

    আগে রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজকে মনে করা হতো গ্রীষ্ম ও আর্দ্র অঞ্চলের রোগ। কিন্তু বর্তমানে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে মুম্বাই-এর হাসপাতালগুলিতে যত সংখ্যক হৃদরোগী প্রতিদিন ভর্তি হয়, তার প্রায় ২৫ শতাংশই হৃদয়ের বাত রোগের শিকার। এটি আগ্রায় ২৮ শতাংশ, লক্ষ্মৌতে ৩২ শতাংশ, দিল্লিতে ৩৬ শতাংশ, কোলকাতায় ৪১ শতাংশ, মাদ্রাজে ৪৩ শতাংশ। এসব অসুখের পেছনে শুধু জলবায়ু নয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও দারিদ্র্য অন্যতম কারণ।
    জন্মগত হৃদরোগের প্রবণতা সারা পৃথিবী জুড়ে বাড়ছে। তবে একদল চিকিৎসক বলেন- ‘আগেও এ রোগ ছিল, তবে তখন এত সঠিকভাবে রোগ শনাক্ত হতো না; চিকিৎসা প্রযুক্তি ছিল অনুন্নত।’ ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় ৩ লক্ষ শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে এই ধরিত্রীতে আসে। অনেকেই এর কারণ হিসাবে পারমাণবিক বিস্ফোরণ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, শব্দ দূষণকে দায়ী করেছেন। গত পাঁচ বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরের হাসপাতালগুলিতে কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে দশগুণ।
    ফুসফুসের গোলযোগের কারণে অনেক সময় হৃদযন্ত্রের রোগ দেখা যায়। ডাক্তারি ভাষায় একে বলি করপালমোনেলি হার্ট ট্রাবল (Corpulmonale Heart Trouble)। ঠান্ডা ও ভেজা জায়গায় বেশি দেখা যেত। এখন দেখা গেছে মুম্বাইতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এমন হৃদরোগীর ১৫ শতাংশ, দিল্লিতে ১৮ শতাংশ, কানপুরে ১৯ শতাংশ ও রাজস্থানে ৩২ শতাংশ এ রোগে আক্রান্ত। করপালমোনেলি এর পেছনে যে কারণগুলিকে কার্ডিওলজিস্টরা চিহ্নিত করেছেন- সেগুলি হলো; দিন ও রাতের তাপমাত্রার খুব বেশি পার্থক্য, বদ্ধ ঘরে ধুমপান, বাতাসে বেশি পরিমাণে ধোঁয়া ও ধূলিকণা; বিশেষত খনি বা কারখানার চুল্লিতে বেশি সময় ধরে কাজ করা।
    মোটামুটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, সারা বিশ্বে বছর প্রায় ৯৪ লক্ষ মানুষ করোনারি হার্ট ডিজিজে মারা যান। প্রায় ৬ লক্ষ লোক ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা (Elasticity) নষ্ট হয়ে যাওয়ার শিকার। টেক্সস ইননিভারসিটির সাউথ ওয়ের্স্টান মেডিকেল সেন্টারের গবেষক ডঃ ভেঙ্কট এস রাম-এর মতে-‘ভারতের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ জনিত অসুবিধায় আক্রান্ত। শহরে বসবাসকারী ৩০ বছরের বয়স্ক লোকের ৪০ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপের শিকার।’
    লন্ডনের থ্রম্বোসিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বিজয় কে কক্কার এক বিজ্ঞান সভায় জানিয়েছেন, ইউরোপীয়দের তুলনায় ভারতীয়, বিশেষত উত্তর-পশ্চিম ভারতীয়দের মধ্যে বংশগত হৃদরোগের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এই তালিকার শীর্ষে আছে গুজরাটি। এরপর রয়েছে পাঞ্জাবী।
    ভারতে হৃদরোগীর আয়ুষ্কাল পশ্চিমী দেশবাসীর তুলনায় প্রায় পাঁচ বছর কম। পাশ্চাত্যের দেশগুলির অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি হৃদরোগীর জীবনকাল অনেকাংশেই বাড়িয়ে দেয়।
    হৃদরোগে মৃতের সংখ্যা সারা বিশ্বজুড়েই ক্রমবর্ধমান। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩০ সালে প্রতি এক লক্ষ মৃত্যুর মধ্যে হৃদরোগে মৃতের সংখ্যা ছিল মাত্র ৮ জন। ১৯৪০ সালে এটি হয় ৭১,১৯৬৩- তে ২৯০ জন।
    গ্রিনল্যান্ডের এক্সিমোদের মধ্যে হৃদরোগ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এক্সিমোদের প্রধান খাদ্য সামুদ্রিক মাছ। সামুদ্রিক মাছে যে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড আছে তা হার্টের রক্ষা কবজের কাজ করে।
    পশ্চিমী দেশগুলিতে হৃদরোগের প্রবণতা বেশি দেখা যায় উচ্চ উপার্জনশীল গোষ্ঠীর মধ্যে। আমাদের দেশে অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। ২০১৪ সালে বিহারে এক সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে প্রায় ৪০.৮ শতাংশ হার্ট অ্যাটাকের রোগী নিম্ন মধ্যবিত্ত বা দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। এর মধ্যে কৃষক ও দিনমজুর রয়েছে। ২০১৫ সালে গুজরাটে এক গবেষণা থেকে জানা যায়-বিভিন্ন পেশায় যুক্ত মোট হৃদরোগীর ২৯ শতাংশ উচ্চপদস্থ বা এক্সিকিউটিভ, ২৩.৫ শতাংশ শিক্ষক বা কেরানি, ২৫.৬ শতাংশ শ্রমজীবী, ১৫.৫ শতাংশ দোকানদার বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ও ৭.৫ শতাংশ হৃদরোগী হলো অবসর প্রাপ্ত বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। এখানে একটি কথা মাথায় রাখতে হবে যে, আমাদের দেশে জনসংখ্যার সিংহভাগ দখল করে আছে শ্রমিক, কৃষক ও নিম্ন মধ্যবিত্ত।
    লন্ডনে করোনারি হার্ট ডিজিজে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাস ড্রাইভারের মধ্যে। আমেরিকার রেল দপ্তরে দেখা গেছে প্রতি ১,০০০ কেরানির মধ্যে ৫.৭ জন মারা গেছে হার্ট অ্যাটাকে। এই সংখ্যা সুইচম্যানদের মধ্যে ৩.৯ জন। সেকশনম্যানদের ক্ষেত্রে প্রতি হাজার মৃতের মধ্যে ২.৮ জন।
    শিল্প উন্নত দেশগুলিতে মহিলা হৃদরোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। প্রথম বিশ্বের দেশে রজঃনিবৃত্তির (Monopause) আগে যে সব মহিলা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তাদের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশ দায়িত্বশীল পদে কর্মরতা।
    বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে নগরায়ণ। জীবিকা, শিক্ষা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মোহে প্রতিদিন বহু সহস্র গ্রাম্য মানুষের পদচিহ্নে ধূসরিত হচ্ছে নগরের রাজপথ। নগর মানেই সীমাহীন ভোগ্যপণ্যের হাতছানি, যন্ত্রের কলতান। নগর মানেই আরো ওপরে ওঠার অতৃপ্ত বাসনা। হ্যাঁ, এই উত্তেজনা, মানসিক চাপ হৃদরোগ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। নাগরিক সংস্কৃতির তীক্ষ্ম নখ নিঃশব্দে বিদীর্ণ করছে আপনার কোমল হৃদয়কে -হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে মোটামুটি একমত।  

 

Join our mailing list Never miss an update