হৃদয়ের কথা পর্ব-২৬; বাইপাস ও মিনিবাইপাস

হৃদয়ের কথা পর্ব-২৬; বাইপাস ও মিনিবাইপাস

বাইপাস ও মিনিবাইপাস; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ২৭ শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৯; পৃষ্ঠা -তিন; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
    মানুষের চলার পথে আসে বিভিন্ন ধরনের বাধা-বিপত্তি। সব বাধা টপকে  বা এড়িয়ে এগিয়ে চলাই জীবন। আমাদের প্রাণভ্রমরা হৃদযন্ত্রের রক্ত সরবরাহের ক্ষেত্রে কিছু বাধা দেখা দেয়। অ্যাথেরোসক্লেরোসিসের ফলে করোনারি ধমনীর সরু হলে বা বুজে গেলে হৃৎপেশিতে রক্ত ঠিকমতো পৌঁছাতে পারে না। ফলে হৃৎপেশিতে অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাব হয়, দেখা দেয় বহু উপসর্গ।
    করোনারি ধমনী বাইপাস অপারেশনের সময় এই রুদ্ধ পথকে এড়িয়ে অন্য পথ তৈরি করা হয়। বুকের ইন্টারন্যাল ম্যামারি ধমনী বা পায়ের শিরা কেটে এনে সূক্ষ সেলাই-এর সাহায্যে তৈরি করা হয় রক্ত চলাচলের বিকল্প রাস্তা। ব্যস্ত শহরের যানজট এড়িয়ে দ্রুত চলাচলের জন্য শহরের বাইরে দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বাইপাস রাস্তা থাকে। করোনারি ধমনীর বাইপাস অপারেশন অনেকটাই সেই রকম। আমাদের বুকের খাঁচার দু’পাশে রয়েছে ইন্টারন্যাল ম্যামারি আর্টারি। বাম দিকে রয়েছে লেফ্ট ইন্টারন্যাল ম্যামারি আর্টারি (Left Internal Mammary Artery সংক্ষেপে LIMA ) এবং ডান দিকে রয়েছে রাইট ইন্টারন্যাল ম্যামারি আর্টারি (Right Internal Mammary Artery সংক্ষেপে RIMA)। সাধারণত লিমা বা রিমা থেকে অংশ কেটে বাইপাস করা হয়। অনেক সময় পা থেকে একটি সুস্থ-সবল শিরার খানিকটা অংশ কেটে এনে এ কাজে লাগানো হয়। পায়ের স্যাফেনাস শিরা (Saphenous vein) বাইপাস নল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই শিরায় অন্তঃস্থ কপাটিকা বা ভালভ কম থাকে। এ শিরার ব্যাস করোনারি ধমনীর সঙ্গে মিলে যায়। কেটে আনা শিরার একটি প্রান্ত লাগানো হয় মহাধমনী বা অ্যাওর্টার সঙ্গে আর অপর প্রান্ত করোনারি ধমনীর সরু হয়ে যাওয়া জায়গা টপকে ধমনীর সঙ্গে লাগানো হয়। ধমনীর সঙ্গে ধমনীর জোড়া লাগানো হয় অতি সূক্ষ সেলাই বা মাইক্রোস্কোপিক স্টিচিং দ্বারা; অর্থাৎ সার্জেন মাইক্রোষ্কোপের সাহায্যে এই অপারেশন করেন ।

করোনারি ধমনী বাইপাস অপারেশন চলার সময়; শরীরের বাইরে থেকে হার্টলাঙ মেশিনের সাহায্যে হৃদযন্ত্রের কাজ চালানো হয়। কিছু সময়ের জন্য হৃৎপিন্ডের কাজ থেমে থাকে। তাই একে বলে ওপেন হার্ট সার্জারি। এই অপারেশনের সময় বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে হৃদযন্ত্রের তাপমাত্রা ৯৩º-৯৫º ফারেনহাইট-এর মধ্যে রাখা হয়। এটি হার্টের অপারেশন হলেও হৃদযন্ত্রের ভেতর ও হৃৎপেশিতে তেমন কাঁটাছেঁড়া করা হয় না। শুধু শিরার টুকরো কেটে ওপর থেকে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়। শুনতে সহজ হলেও এই অপারেশনের সময় জটিল যন্ত্রপাতি ছাড়াও অ্যানিস্থিসিস্ট (Anaesthesist), সার্জেন, সহকারি নার্স-ডাক্তারের এক ভালো টিমওর্য়াক দরকার। অপারেশনের আগে করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করে দেখে নেওয়া হয় ধমনীর কোন কোন অংশ সরু হয়েছে বা বুজে গেছে। আগে এ ধরনের অপারেশনের জন্য বিদেশে যেতে  হতো, এখন এদেশের সব বড়ো শহরেই এটি হচ্ছে।
    বাইপাস নামের দ্বারাই বোঝা যায় এটি সমস্যার সমূল সমাধান নয়। অসুখের মূল সূত্রটি অর্থাৎ করোনারি ধমনী সরু হয়ে যাওয়া অংশ যেমন ছিল তেমনই থাকে। শুধু সমস্যাটি পাশ কাটিয়ে বাইপাস করা হয়। এই অপারেশনের পর ৪০-৫০ ঘন্টা ইনটেনসিভ কার্ডিও কেয়ার ইউনিটে থাকা প্রয়োজন। তারপর পাঁচ-ছয় দিন হাসপাতালে থেকে রোগী বাড়ি ফিরে যেতে পারে। এই অপারেশনের সাফল্যের হার ৯৭-৯৯ শতাংশ। সাধারণভাবে প্রতি দু'হাজার জনের একজন রোগী অপারেশনের সময় মারা যান।
    এই অপারেশনের পর কয়েকটি বিষয়ে চিকিৎসকের নির্দেশ মতো মেনে চলতে হয়। যেমন- খাদ্য, ব্যায়াম, ধূমপান, সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা, মদ্যপান প্রভৃতি। কারো কারো ক্ষেত্রে বাইপাস সার্জারির পর কিছু অসুবিধা দেখা যায়। যেমন- কান-মাথা ভোঁ-ভোঁ, খিদে কমে যাওয়া, ঘুমের অসুবিধা, মানসিক অবসাদ, বুকে বা পায়ের যেখান থেকে শিরা কাটা হয়েছে সেখানে ব্যথা, আরো কিছু। তবে যতদিন যায় এসব ধীরে ধীরে কমে আসে ।
    রোগীর করোনারি ধমনী সরু হয়ে গেলে তাকে যে বাইপাস সার্জারি করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। অপ্রিয় হলেও এটা সত্য যে চিকিৎসা আর সেবা নেই। কিছু অর্থলোভী কুচক্রীর চক্রান্তে তা আজ পরিণত হয়েছে পণ্যে। দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে বাধা নেই যে- এই দলে সামিল হয়েছেন বেশ কিছু চিকিৎসকও। রোগী বা তার পরিবারের কাছ থেকে বিরাট পরিমাণ অর্থ উপার্জনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে তেমন প্রয়োজন না থাকলেও রোগীর করোনারি বাইপাস অপারেশন করা হয় ।
বাইপাস গ্রাফটিং করার আগে যে  বিষয়গুলি ভেবে দেখতে হবে তা হলো-
    রোগীর বয়স কত?
    রোগী যে ধরনের কাজ করতে হয় তা করতে তিনি কতটা সামর্থ্য?
    হৃদবেদনা বা অ্যানজাইনা কতটা তীব্র ও কতক্ষণ থাকে?
    রোগীর উপসর্গগুলি দিন-দিন বেড়ে যাচ্ছে কী না?
    রোগীর ওপর ওষুধ কতটা কার্যকারী (Respond to medicine) হচ্ছে?
    স্ট্রেস ই.সি.জি.বা ট্রেড মিল টেস্ট-এর ফলাফল কী ?
    রোগীর অ্যাঞ্জিওগ্রাফি পরীক্ষার ফল বা করোনারি ধমনী কতটা অবরুদ্ধ হয়েছে?

এছাড়াও রোগীর আর্থিক অবস্থা, অপারেশনের ঝুঁকি এসবও ঠিকমতো ভেবে দেখা দরকার।
    এখন নতুন এক ধরনের বাইপাস সার্জারি চালু হয়েছে যার ডাকনাম মিনিবাইপাস। ডাক্তারি নাম-মিনিম্যাললি ইনভেসিভ ডাইরেক্ট করোনারি আর্টারি বাইপাস সার্জারি (Minimally Invasive Direct Coronary Artery Bypass Surgery সংক্ষেপে MIDCAB)  এটি বাইপাসের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা যেতে পারে। হৃদযন্ত্রে যে করোনারি ধমনী রক্ত যোগান দেয় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ল্যাড আর্টারি। পুরো নাম লেফ্ট অ্যান্টিরিয়ার ডিসেন্ডিং করোনারি আর্টারি (Left anterior decending coronary)। ল্যাড আর্টারি রুদ্ধ হয়ে গেল বুকের চার নম্বর পাঁজরের নিচে সামান্য একটু কেটে ল্যাড অ্যার্টারির সঙ্গে লিমাকে জুড়ে দেওয়া হয়। শুধু  ল্যাড আর্টারি নয়, আরো কয়েকটি আর্টারিতেও মিনিবাইপাস করা যায়। যাদের আগে একবার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রে মিনিবাইপাস ভালো পদ্ধতি।


 

প্রচলিত ওপেন হার্ট বাইপাস অপারেশনের চেয়ে মিনিবাইপাসে কিছু সুবিধা আছে। যেমন -
১) ওপেন হার্ট বাইপাস সার্জারিতে বুকের হাড় কেটে বুক উন্মুক্ত করা হয়। তাই রোগীর জ্ঞান আসার পর সে খুব ব্যাথা অনুভব করে। মিডক্যাব-এ যেহেতু ছোটো ফুটো করা হয় তাই ব্যথা খুব কম হয়।
২) প্রচলিত বাইপাসে সময় লাগে ৫ থেকে ৬ ঘন্টা। কিন্তু মিনিবাইপাসে লাগে দু থেকে তিন ঘন্টা ।
৩) ওপেন হার্ট বাইপাসে যেহেতু হৃদযন্ত্রের কাজ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রেখে চালানো হয়; তাই এতে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে বেশি। মিডক্যাব যেহেতু সচল হার্টের ওপর করা হয় তাই মৃত্যুর হার অনেক কম।
৪) মিনিবাইপাস করতে হার্ট-লাঙ্ মেশিন বা এসব দামী যন্ত্রপাতির দরকার পড়ে না। বড়ো হাসপাতাল বা ছোট নার্সিংহোম যেখানে ভালো ইনটেনসিভ কার্ডিওকেয়ার ইউনিট আছে, সেখানেই এটি করা যায়।
৫) প্রচলিত বাইপাস অপারেশনের খরচ মোটামুটিভাবে দুই লক্ষ টাকা। মিনিবাইপাসের খরচ ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা।

    বাইপাস বলুন বা মিনিবাইপাস সবই হৃদয়ের ওপরে আসা দুর্যোগকে এড়িয়ে যাওয়ার সাময়িক পদ্ধতি। আসলে এ জগতে কোনো কিছুই চিরন্তর নয়, সবই অনিত্য। প্রতি মুহূর্তে আমরা এগিয়ে চলেছি মৃত্যুর শান্ত-শীতল কোলের অভিমুখে। তবুও বিজ্ঞানীদের চেষ্টার সীমা নেই। কারণ, জীবন যে অপরাজেয়।

Join our mailing list Never miss an update