হৃদয়ের কথা পর্ব- ২৪; হৃদয়ের চক্রাবর্ত ও কিছু পরিভাষা

হৃদয়ের কথা পর্ব- ২৪; হৃদয়ের চক্রাবর্ত ও কিছু পরিভাষা

হৃদয়ের চক্রাবর্ত ও কিছু পরিভাষা; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ৭ই ফেব্রুয়ারী ২০০০; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
    ধুক্-পুক্-ধুক্-পুক্ ... এ এক অবিরাম তান। জীবনে যত কথা-প্রেম-সুর সবই তাকে ঘিরে। আমাদের হৃদয় ধুক-পুক্ সুরে প্রতি মিনিটে ৭০ থেকে ৮০ বার সংকুচিত ও প্রসারিত হচ্ছে। গড়ে হৃৎস্পন্দনের হার ৭৫ বার প্রতি মিনিট ধরলে- হৃৎপিন্ডের একবার সংকোচন ও প্রসারণের সময় লাগে ৬০ / ৭৫ = ০.৮ সেকেন্ড। একে বলে হৃদচক্রের স্থিতিকাল। হৃৎস্পন্দনের হার যত বাড়ে হৃদচক্রের স্থিতিকাল সেই অনুপাতে কমে যায়। প্রতি ০.৮ সেকেন্ডে পর পর আমাদের হৃদয় চক্রের মতো একবার সংকুচিত ও প্রসারিত হচ্ছে। পর্যায়ক্রমিক ভাবে হৃদযন্ত্রের এই যান্ত্রিক পরিবর্তনকে বলে হৃদচক্র বা কার্ডিয়াক সাইকেল (Cardiac Cycle)।
    হৃদচক্রের স্থিতিকাল অর্থাৎ ০.৮ সেকেন্ডের মধ্যে অলিন্দে যে ঘটনাগুলি ঘটে তাকে অলিন্দচক্র ((Auricular Cycle)  এবং নিলয়ের ঘটনাগুলিকে নিলয়চক্র (Ventricular Cycle)  বলে।

অলিন্দ সংকোচন (Auricular Systole) ) : আমাদের হৃৎস্পন্দনের একমাত্র উৎপত্তিস্থল সাইনো অরিকিউলার নোড যেহেতু ডান অলিন্দে রয়েছে, তাই ডান অলিন্দ বাম অলিন্দের একটু আগে সংকুচিত হয়। অলিন্দ সংকোচনের প্রথম দিকে হৃৎপেশির সংকোচন শক্তি তুলনামুলকভাবে কম থাকে। তাই প্রথম দিকের পেশি সংকোচনকে বলে গতিশীল পর্যায় (Dynamic Phase)  ও শেষের দিকের সংকোচনকে বলে স্থিতিশীল পর্যায় (Adynamic Phase)। অলিন্দ সংকোচনের সময় অলিন্দ মধ্যস্থ চাপ (Intra Auricular pressure)  নিলয়ের মধ্যস্থ চাপ (Intra Ventricular pressure)-এর চেয়ে বেশি হওয়ার জন্য অলিন্দ ও নিলয়ের মাঝে থাকা ট্রাইকাসপিড ও বাইকাসপিড ভালভ দুটি খুলে রক্ত নিলয়ে আসে। এ সময় অর্ধচন্দ্রাকার ভালভ দু’টি বন্ধ থাকে। অলিন্দ সংকোচন  হতে সময় লাগে ০.১ সেকেন্ড।
অলিন্দ প্রসারণ (Auricular Diastole) : অলিন্দের পেশি প্রসারণের ফলে অলিন্দ দু’টির ভেতরকার চাপ কমে আসে যায়। এই সময় কার্বন-ডাই অক্সাইড মেশানো রক্ত দেহের উর্ধ্বাংশ থেকে উর্ধ্বমহাশিরা (Superior Venacova) ও নিম্নাংশ হতে অধঃমহাশিরা (Inferior Venacova) দিয়ে ডান অলিন্দে আসে। একই  সময়ে ফুসফুসীয় শিরা বা পালমোনারি ভেন (Pulmonary Vein) দ্বারা অক্সিজেনযুক্ত রক্ত বাম অলিন্দে ঢোকে। অলিন্দ প্রসারণের সময় নিলয় সংকুচিত হয় বলে অর্ধচন্দ্রাকার ভালভ দু’টি খোলা অবস্থায় থাকে। অলিন্দের ডায়াস্টোল চলে ০.৭ সেকেন্ড ধরে। অলিন্দ প্রসারণ শেষ হলে আবার অলিন্দ সংকোচন শুরু হয়। এভাবেই চক্রাকারে চলতে থাকে ।
নিলয় সংকোচন (Ventricular Systole) : অলিন্দের মতো নিলয়েও একইভাবে সংকোচন ও প্রসারণ চলে। অলিন্দ সংকোচনের পরমুহূর্তেই আরম্ভ হয় নিলয় সংকোচন। সাইনো অরিকিউলার নোড থেকে আসা বৈদ্যুতিক সংকেত (Impulse) অ্যাট্রিও ভেন্ট্রিকিউলার নোড হয়ে বান্ডল অব্ হিজ ও পারকিনজি তন্তুর মাধ্যমে নিলয় পেশিকে উদ্দীপ্ত করে। এর ফলেই নিলয় স্পন্দিত হয়। নিলয় সংকোচনের ফলে অলিন্দ নিলয় কপাটিকা দুটি সজোরে বন্ধ হয়। এ কারণে সৃষ্টি হয় প্রথম হৃদধ্বনি বা ফার্স্ট হার্ট সাউন্ড (First Heart Sound)। ভালভ দু’টি বন্ধের ফলে রক্ত নিলয় থেকে অলিন্দে ফিরে যেতে পারে না। বাইকাসপিড ও ট্রাইকাসপিড ভালভ বন্ধ হওয়ার ০.০৫ সেকেন্ডে পর অর্ধচন্দ্রাকার কপাটিকা দু’টি খুলে যায়। এই ০.০৫ সেকেন্ড নিলয় দু’টি আবদ্ধ প্রকোষ্ঠের মতো সংকুচিত হয়। এই পর্যায়ে নিলয় পেশির দৈর্ঘ্য কম না হলেও তাদের পেশির টান যথেষ্ট বেড়ে যায়। এই জন্য এ দশাকে বলে সমদৈর্ঘ্য সংকোচনকাল বা আইসোমেট্রিক কনট্রাকশন পিরিয়ড (Isometric Contraction Period)। এরপর সেমুলিনার ভালভ খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডান নিলয় থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড পূর্ণ রক্ত ফুসফুসীয় ধমনীর মধ্য দিয়ে ফুসফুসে যায়। একই সময়ে অক্সিজেন পূর্ণ শুদ্ধ রক্ত বাম নিলয় থেকে মহাধমনীর মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কপাটিকা খোলার পর ০.২৫ সেকেন্ড ধরে চলে নিলয় সংকোচন। এই সময়কে বলে নিক্ষেপণ কাল বা ইজেকশান পিরিয়ড ( Ejection Period)। নিক্ষেপণ কালের প্রথম ০.১১ সেকেন্ড রক্ত খুব বেগে নিলয় থেকে নিক্ষিপ্ত হয়। একে বলে সর্বাধিক নিক্ষেপণ কাল বা ম্যাক্সিমাম ইজেকশন পিরিয়ড (Maximum Ejection Period)। এর পরবর্তী সময় প্রায় ০.১৪ সেকেন্ড ধরে রক্ত নিলয় থেকে অল্পবেগে বের হয় তাই এ সময়কে বলে মন্দীভূত নিক্ষেপণ কাল বা রিডিউসড ইজেকশন পিরিয়ড (Reduced Ejection Period) ।
নিলয় প্রসারণ (Venticular Diastole) : নিলয় সংকোচনের পরেই শুরু হয় প্রসারণ। এই প্রসারণ চলে ০.৫ সেকেন্ড ধরে। নিলয় প্রসারণ আরম্ভ হওয়ার পর অর্ধচন্দ্রাকার ভালভ দু’টি বন্ধ হতে ০.০৪ সেকেন্ড সময় লাগে। একে শৈথিল্য সূচনা কাল বা প্রোটোডায়াস্টোলিক পিরিয়ড (Protodiastolic Period)। কপাটিকা দু’টি বন্ধ হওয়ার ফলে যে কম্পন তৈরী হয় তাতে সৃষ্টি হয় দ্বিতীয় হৃদধ্বনি বা সেকেন্ড হার্ট সাউন্ড (Heart Sound)। সেমিলুনার ভালভ বন্ধ হওয়ার ০.০৮ সেকেন্ড পর অলিন্দ নিলয় কপাটিকা দুটি খুলে যায়। অর্ধচন্দ্রাকার কপাটিকা বন্ধ হওয়া ও অলিন্দ-নিলয় কপাটিকা খোলার মধ্যবর্তী সময়ে নিলয় দুটি বন্ধ প্রকোষ্ঠের মতো কাজ করে। এই ০.০৮ সেকেন্ড সময়কে বলে সমদৈর্ঘ্য প্রসারণ কাল বা আইসোমেট্রিক রিল্যাক্সেশন পিরিয়ড (Isometric Relaxation Period)। এরপরেই বাইকাসপিড ও ট্রাইকাসপিড ভালভ খুলে যায়, অলিন্দ থেকে রক্ত নিলয়ে আসতে থাকে অর্থাৎ নিলয় দু’টি রক্তে ভরে যায়। তাই এর নাম নিলয় পূর্তিদশা (Ventricular Filling Phase)। এটি চলে ০.৩৮ সেকেন্ড ধরে। ফিলিং ফেজ-এর প্রথম ০.১১৩ সেকেন্ড রক্ত অলিন্দ থেকে নিলয়ে খুব দ্রুত বেগে আসে। একে বলে প্রাথমিক ক্ষিপ্র পূর্তিদশা বা ফার্স্ট র‌্যাপিড ফিলিং ফেজ (First Rapid Filling Phase)। এরপর নিলয় প্রসারিত হতে থাকলে রক্ত প্রবেশের বেগ কমে যায়। প্রায় ০.১৬৭ সেকেন্ড ধরে ধীরে ধীরে রক্ত নিলয়ে আসে। তাই এর নাম মন্দীভূত পূর্তিদশা বা স্লো ইনফ্লো ফেজ (Slow inflow phase)। এই দশার শেষ দিকে অলিন্দ সংকুচিত হওয়ার ফলে নিলয়ে রক্ত আসার বেগ বেড়ে যায়। এই পর্যায়ের স্থিতিকাল ০.১ সেকেন্ড, নাম শেষ ক্ষিপ্র পূর্তিদশা বা লাস্ট র‌্যাপিড ফিলিং ফেজ (Last Rapid Filling Phase)। এই দশার পর মুহুর্ত থেকে অলিন্দ প্রসারণ ও নিলয় সংকোচন শুরু হয়। আবার চক্রাকারে চলতে থাকে ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

    হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনা করার জন্য ডাক্তারবাবুরা বিভিন্ন ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন। মধ্য শিক্ষিতদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, উচ্চ শিক্ষিতরাও স্বাভাবিক কারণে এসব শব্দের অর্থ বুঝতে পারেন না। মেডিকেল ডিকশনারি ছাড়া এসব শব্দের মানেও খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। অনেক চিকিৎসক আবার নিজেদের কৌলিন্য বাড়ানোর জন্য রোগীর পরিবারের কাছে এ ধরনের শব্দগুলি বেশি ব্যবহার করেন। এ রকম কয়েকটি প্রচলিত শব্দের অর্থ একটু বোঝা যাক-
কার্ডিয়াক আউটপুট বা হার্দ উৎপাদ (Cardiac Output):- হৃদযন্ত্রের নিলয় সংকোচনের সময় নিলয় থেকে যে পরিমাণ রক্ত বের হয় তার হারকে বলে কার্ডিয়াক আউটপুট বা হার্দ উৎপাদ। স্বাভাবিক অবস্থায় ডান ও বাম নিলয় থেকে একই সময়ে একই পরিমাণ রক্ত উৎক্ষিপ্ত হয়। কার্ডিয়াক আউটপুটকে দু’ভাবে মাপা হয়-ঘাত পরিমাণ ও মিনিট পরিমাণ। প্রতিবার সংকোচনের সময় প্রতিটি নিলয় থেকে যে পরিমাণ রক্ত বেরিয়ে আসে তাকে ঘাত পরিমাণ বা স্ট্রোক ভলিউম (Storke Volume) বলে। সুস্থ স্বাভাবিক একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের স্ট্রোক ভলিউম ৭০ মিলিমিটার। অর্থাৎ একবার সংকোচনে এক একটি নিলয় থেকে মোটামুটিভাবে ৭০ মিলিলিটার রক্ত বের হয়।
    প্রতি মিনিটে প্রতিটি নিলয় থেকে যে পরিমাণ রক্ত বেরিয়ে আসে তাকে মিনিট পরিমাণ বা মিনিট ভলিউম (Minute Volume) বলে। অর্থাৎ ঘাত পরিমাণকে হৃদ্স্পন্দনের হার দিয়ে গুণ করলে মিনিট পরিমাণ পাওয়া যায়। সংক্ষেপে মিনিট পরিমাণ = ঘাত পরিমাণ X হৃৎস্পন্দনের হার। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির এই পরিমাণ প্রায় ৫-৬ লিটার।
কার্ডিয়াক ইনডেক্স বা হৃৎসূচক (Cardiac Index):- আমাদের দেহের উপরিতলের প্রতি বর্গমিটার ক্ষেত্রফলের জন্য মিনিট পরিমাণকে কার্ডিয়াক ইনডেক্স বলে। অর্থাৎ মিনিট ভলিউমকে দেহের মোট তলের ক্ষেত্রফল দিয়ে ভাগ করলে হৃৎসূচক পাওয়া যায়। এর গড় মান ৩.৩ লিটার/মিনিট/বর্গমিটার।
স্ট্রোক ভলিউম ইনডেক্স (Cardiac Index):- দেহতলের প্রতি বর্গমিটার ক্ষেত্রফলের জন্য ঘাত পরিমাণকে স্ট্রোক ভলিউম ইনডেক্স বা ঘাত পরিমাণ সূচক বলে। এর গড় পরিমাণ ৪৭ মিলিলিটার।
ভেনাস রিটার্ন বা শিরার রক্তের প্রত্যাবর্তন (Venus return):- কোনো নির্দিষ্ট সময়ে যে পরিমাণ রক্ত মহাশিরার মাধ্যমে হৃৎপিন্ডের ডান অলিন্দে আসে তাকে ভেনাস রির্টান বলে। ভেনাস রিটার্ন বাড়লে আউপুট বেড়ে যায়।
পেরিফেরাল রেজিস্টেন্স বা প্রান্তীয় বাধা (Peripheral resistance):- রক্ত চলাচলের সময় রক্তনালীর ভেতরের দেওয়াল যে বাধা বা রোধ সৃষ্টি করে তাকে পেরিফেরাল রেজিস্টেন্স বলে। রক্তনালী যত মোটা হবে এই বাধা তত কম হয়। পেরিফেরাল রেজিস্টেন্স বাড়লে কার্ডিয়াক আউটপুট কমে যায়।
ফোর্স অব্ কনট্রাকশন অব্ হার্ট বা হৃদপেশির সংকোচন বল (Force of Contraction of Heart):- নিলয় সংকোচনের সময় হৃৎপেশি যে জোরে সংকুচিত হয় তাকে হৃৎপেশির সংকোচন বল বলে। এই বল বেশি হলে কার্ডিয়াক আউটপুট বেশি হয়।
    শুধু আমাদের হৃদযন্ত্র নয়, এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছুই চলছে একটি নিয়ম মেনে; সুনির্দিষ্ট তাল-ছন্দে। আর বিজ্ঞানীদের নিরবিচ্ছিন্ন প্রয়াস চলছে নেই নিয়মকে গণিতের মধ্যে বেঁধে ফেলার। তা সে গাছ থেকে আপেল পড়া হোক বা হৃদয়ের ধুক্-পুকুনি।

Join our mailing list Never miss an update