হৃদয়ের কথা পর্ব-২১; হৃদরোগে হোমিওপ্যাথি; ডাঃপার্থপ্রতিম।
অ্যালোপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক পদ্ধতির মতো হোমিওপ্যাথিতে হৃদরোগের অনেক ভালো ভালো ওষুধ রয়েছে। অনেকের ধারণা হোমিও ওষুধ খুব ধীরে কাজ করে; তাই হার্ট ডিজিজের ক্ষেত্রে এর ওপর ভরসা করা যায় না। ঘটনাটি আসলে তা নয়, সঠিক মাত্রায় ঠিক ওষুধটি প্রয়োগ করতে পারলে অল্পসময়ের মধ্যেই তার কার্যকারিতা বোঝা যায়।
হোমিও চিকিৎসা মূলত লক্ষণভিত্তিক। অর্থাৎ রোগের কারণ যাই হোক না কেন-রোগের প্রকাশিত লক্ষণের ওপর নির্ভর করে ওষুধ নির্বাচন করা হয়। হৃদব্যাধির ক্ষেত্রে কার্যকারী কয়েকটি ওষুধ নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক-
ডিজিটেলিস (Digitalis):- ১X, ৬, ৩০-এটি হার্ট ডিজিজের একটি টনিক ওষুধ। প্রবল হৃৎস্পন্দন এই ওষুধে কমে যায়। হৃৎপেশির সংকোচন শক্তি বাড়িয়ে দেয়, ফলে রক্ত চলাচলের ক্ষমতা বাড়ে। মাইট্রাল ভালভের ত্রুটিতে যখন নাড়ির স্পন্দন অনিয়মিত (Irregular) হয়ে পড়ে। তখন ডিজিটেলিস ভালো করে কাজ করে। হৃদযন্ত্রের শোথ (Cardiac) থাকলেও ওষুধ প্রয়োগ করা যায়। মাইট্রাল কপাটিকার সংকোচনে (Mitral Stenosis) যখন প্রস্রাবের পরিমাণ কমে আসে সে সময় ডিজিটেলিস প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে রোগীকে সুস্থ করে তোলে। এটি গভীর ক্রিয়াশীল তাই রোগীর উন্নতি দেখা দিলে ডিজিটেলিস বন্ধ করে দিতে হবে।
আর্সেনিক অ্যাল্ব (Arsenic Alb):- ৩০, ২০০-হৃদযন্ত্রের স্পন্দন খুব ধীরে, হৃৎপিন্ডে শোথ হয়েছে বা শোথ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, অস্থিরতা, উদ্বেগ, একটু চলাফেরাতেই বুক ধড়ফড় করে, রোগীর মনে হয় তার হৃদযন্ত্রটি দুলছে-এ সব লক্ষণে আর্সেনিক প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়াও যে সব রোগে ভোরবেলায় হার্টবিট্ বাড়ে, বুকের সঙ্গে মাথার পেছনে ও ঘাড়ে ব্যথা, সায়ানোটিক হার্ট ডিজিজ বা রোগী নীলচে হয়ে যাওয়াতে এটি ব্যবহৃত হয়।
গ্লোনয়িন (Glonoin):- ৬, ৩০- হৃৎস্পন্দনের হার খুব বেশি। রোগী মনে হয় যেন তার হৃদযন্ত্রটি ফেটে যাবে। হৃৎপিন্ডের স্পন্দন হাতের আঙুলেও রোগী অনুভব করে। সারা শরীরে হৃদযন্ত্রের ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। রোগী কাঁপে ও অজ্ঞানের মতো হয়। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে গেলেই শ্বাসকষ্ট। এছাড়াও গর্ভবতীর হার্টডিজিজে এটি ভালো কাজ করে।
স্পাইজেলিয়া (Spigelia):- ৬, ৩০-হৃদযন্ত্রের অনিয়মিত স্পন্দন, কোনো কোনো সময় দ্রুত হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে হৃৎপিন্ডে খোঁচামারা ব্যথা, সঙ্গে দুর্বলতা, হৃদয়ের সংকোচন ও প্রসারণ এমন ভাবে হয় যে তা জামা বা কাপড়ের ওপর থেকেও চোখে পড়ে। রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজেও ওষুধটি কার্যকরী।
ক্যাকটাস (Cactus.G.):- ৩X, ৩০-বুকে ভীষণ ধড়ফড়ানি, এতে রোগীর যেন দম বন্ধ হয়ে যাবে, মনে হয় কেউ তার হৃৎপিন্ডটি ধরে দু'হাতে মুঠো করছে ও আবার ছেড়ে দিচ্ছে। বুকে যেন পাথর চেপে আছে। রোগীর ব্লাডপ্রেসার খুব কম। হৃদযন্ত্রের শিথিলতায় (Cardiac hypertrophy) এটি ভালো কাজ দেয়। এন্ডোকার্ডাইটিস, মাইট্রাল ভাল্ভের ত্রুটি ও করোনারি থ্রম্বোসিসে এটি ব্যবহৃত হয়। যারা একসময় খুব সিগারেট খেতেন তাদের হার্ট ডিজিজে ক্যাকটাস একটি ভালো ওষুধ।
ক্র্যাটিগাস (Crataegus):- Q, ৬X হৃদযন্ত্রের টনিকের মতো কাজ করে। ঘুম হয় না, রোগী বদমেজাজী, রাগী, সামান্য কাজ করলেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বাম কণ্ঠাস্থি (Collar Bone) র নিচে ব্যথা। হার্টের প্রথম ধ্বনি (First heart sound) খুবই ক্ষীণ। রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজের প্রাথমিক অবস্থা এটি নিয়মিত খেলে রোগী উপকার পাবে। কোনো কোনো সময় শারীরবৃত্তীয় কারণে ধমনীর মধ্যে চর্বি জাতীয় পদার্থ জমার জন্য রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস (Atherosclerosis) । অনেক গবেষক মনে করেন করোনারি ধমনীর অ্যাথেরোসক্লেরোসিসে নিয়মিত ক্র্যাটিগাস খেলে তা গলে যায়। পুরনো হৃদরোগের সঙ্গে দুর্বলতা, হাইব্লাডপ্রেসার থাকলে এ ওষুধে ভালো ফল পাবেন।
এপোসাইনাম ক্যান (Apocynum Can):- Q, ৩X-শরীরের বিভিন্ন অংশে শোথ, উদরীরোগ, হৃদবেদনা, হার্টবিট খুব কম ও অনিয়মিত, গলার শিরা দপদপ-এ ওষুধের লক্ষণ। এই ওষুধটি মূত্রকারক তাই হৃদযন্ত্রের যেসব রোগে প্রস্রাব কমে আসে সেখানে এটি খুব কার্যকরী। তন্দ্রার সঙ্গে বমি-বমি ভাব থাকলে এটি প্রয়োগ করা চলে। এপোসাইনাম হৃদযন্ত্রের মাইট্রাল ও ট্রাইকাসপিড ভালভের ত্রুটিতে ভালো কাজ করে।
এডনিস ভার্ন্যালিস (Adonis Vernalis):- Q, ৩X-রোগী অত্যন্ত দুর্বল, হৃৎস্পন্দন খুব ধীরে, মাথার ব্যথা চাঁদি থেকে চোখ পর্যন্ত আসে, থেকে থেকে হঠাৎ করে বুকে ব্যথা, বুক ধড়ফড়ানি, রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, হৃদরোগ থেকে উৎপন্ন হাঁপানিতে (Cardiac Asthama) এ ওষুধ প্রয়োগে শ্বাসকষ্ট কমে আসে। মহাধমনীর মুখে থাকা অ্যাওর্টিক ভালভ সরু হয়ে যাওয়া (Aortic Stenosis) ও মাইট্রাল ভালভ ঠিকমতো বন্ধ না হলে (Mitral Regurgitation) এই ওষুধটি সুন্দর কাজ করে। এছাড়াও রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজে এডোনিস ভার্ন্যালিস প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া গেছে।
কনভেলেরিয়া মেজালিস (Convallaria Majalis):- ৩X-এ ওষুধটি মহিলাদের ওপর ভালো কাজ করে। রোগিণীর মনে হয় যেন সারা বুক জুড়ে হৃৎস্পন্দন হচ্ছে। সামান্য পরিশ্রমে রোগিণীর বুক কাঁপে, মুখ লাল হয়ে ওঠে । মনে হয় হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল এবং পরক্ষণেই আবার চলতে শুরু করলো। হার্টের টনিক হিসাবেও ওষুধটি ব্যবহৃত হয়।
স্ট্রোফেন্থাস হিস্পি (Strophanthus. Hip):- Q, ৩X-এই ওষুধটি হৃদপিন্ডের সংকোচন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। দ্রুত হৃৎস্পন্দন হ্রাস করে। যারা দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান ও মদ্যপান করেছে, তাদের হদব্যাধিতে এটি প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায়। মোটা থলথলে ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উপকারী। বিশেষত মেদসঞ্চলের ফলে তৈরি হওয়া হৃদরোগে (Fatty Heart)-এ ওষুধটি ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে। ডিজিটেলিস ব্যবহারে আশানুরূপ ফল না পাওয়া গেলে এটি প্রয়োগ করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধদের ওপর ডিজিটেলিস প্রয়োগের অসুবিধা দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে স্ট্রোফেন্থাস নির্ভয়ে দেওয়া যেতে পারে।
অ্যাড্রিনেলিন (Adrenalin):- ২X, ৬X হৃদরোগের জন্য নাক, কান, মুখ, গলা, লেরিংস, মলদ্বার থেকে রক্তপাত হলে এ ওষুধে তা কমে আসে। হৃদযন্ত্রের সংকোচন ও প্রসারণের হার নিয়ন্ত্রণে সিমপ্যাথেটিক নার্ভ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যাড্রিনেলিন সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুকে উত্তেজিত রাখে। হৃদবেদনা (Angina Pectoris) ও খুব লো ব্লাড প্রেসারে এটি ভালো কাজ করে। অ্যাড্রিনেলিন খুব দ্রুত ক্রিয়াশীল। তাই ভালোভাবে বিবেচনা না করে এটি প্রয়োগ করা উচিত নয়।
ক্যালি ফসফরিকাম (Kali Phasphorieum):- ৬X, ১২X-মূলত বায়োকেমিক ওষুধ, তবে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তাররা এটি ব্যবহার করেন। স্নায়ুতন্ত্রের (Nervous System) পক্ষে ক্যালিফস একটি ভালো ওষুধ। অবসাদ, ঘুম কমে যাওয়া, মানসিক উৎকণ্ঠা, স্মৃতিশক্তি কমে আসা, সামান্য কাজও বেশ কঠিন বলে মনে হওয়া, রাগ-ক্রোধ বেশি-এসব লক্ষণে এ ওষুধটি ভালো কাজ করে। হৃদরোগীরা কোনো উপসর্গ ছাড়াই অন্য ওষুধের সঙ্গে মাঝে মধ্যে এটি খেতে পারেন, তাতে ঘুম ভালো হবে ও মানসিক উত্তেজনা কমবে।
অর্জ্জুনা (Terminalia Arjuna):- Q, ৩X-এই আয়ুর্বেদিক ভেষজ ওষুধটি হোমিওপ্যাথিতেও ব্যবহৃত হয়। বুক ধড়ফড় করা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, মাথাঘোরা, নিম্নরক্তচাপে ভালো কাজ করে। তবে হৃদযন্ত্রের ভাল্ভে কোনো ত্রুটি থাকলে সেক্ষেত্রে ওষুধটি তেমন কাজ করে না।
এছাড়াও ল্যাকেসিস, ন্যাজা, আর্সেনিক আয়োড, ক্যালমিয়া প্রভৃতি আরো বেশ কিছু ওষুধ আছে-যা লক্ষণ বুঝে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। যদিও হোমিওপ্যাথি মূলত লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা; তবুও আর্থিক সঙ্গতি থাকলে রক্ত পরীক্ষা, ই.সি.জি., ইকোকার্ডিওগ্রাফি করে রোগের প্রকৃত স্বরূপ জেনে নেওয়া ভালো। তাতে রোগের তীব্রতা ও নিরাময়ের সম্ভাবনা সম্বন্ধে জানা যাবে।
এবার একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ- বর্তমানে পাড়ায় পাড়ায় বহু হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার গজিয়ে উঠেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার অন্য কোনো পেশার সঙ্গে হোমিও ডাক্তারিও করেন। যাদের অনেকেরই মানুষের অঙ্গসংস্থান (Anatomy) ও শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ (Physiology) ঠিকমতো জানা নেই। হৃদরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে এদের দ্বারস্থ হলে, "যমরাজ পুলকিত হতে পারে।"