হৃদয়ের কথা; পর্ব-৪; উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপ সমস্যা

হৃদয়ের কথা; পর্ব-৪; উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপ সমস্যা

হৃদয়ের কথা; পর্ব-৪; উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপ সমস্যা; ডাঃ পার্থপ্রতিম।
    এর জন্য ডাক্তার হওয়ার দরকার নেই। তেমন শিক্ষিত না হলেও এ শব্দটির সঙ্গে কম-বেশি সবাই পরিচিত। তবে হ্যাঁ, ব্লাডপ্রেসার সমন্ধে ভাসা ভাসা ধারণা আবার কিছু ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনে। অনেকে মনে করেন তার উচ্চরক্তচাপ নেই; কারণ তার মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, কান-মাথা গরম এসব উপসর্গ হয় না। আসলে ব্লাডপ্রেসার হাই, লো বা নরম্যাল তা বোঝার একমাত্র উপায় স্ফিগ্মোমনোমিটারের সাহায্যে রক্তচাপ মাপা। দেখা গেছে কোনো ব্যক্তির বেশিমাত্রায় হাই-ব্লাডপ্রেসার রয়েছে কিন্তু তার কোনো শারীরিক উপসর্গ নেই। হঠাৎ কোনো রুটিন চেকআপ বা লাইফ ইনসিওরেন্স করার সময় সেটি ধরা পড়ে। যারা উচ্চরক্তচাপে ভোগে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে কারণ জানা যায় না। এই জন্য তাকে বলে কারণ বিহীন উচ্চরক্তচাপ (Essential Hypertension)।  হাই ব্লাডপ্রেসার বিভিন্ন রকমের। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় সিস্টোলিক চাপ ১৬০ মি.মি.-এর বেশি কিন্তু ডায়াস্টোলিক চাপ ৯০ মি.মি.-র কম থাকে। এ ধরণের উচ্চরক্তচাপকে বলে আইসোলেটেড সিস্টোলিক হাইপারটেনশন (Isolated Systolic Hypertension)। আবার কারো কারো বেলায় সিস্টোলিক রক্তচাপ ১৩০ মি.মি.-ও তার কম থাকে কিন্তু ডায়াস্টোলিক ১০০ মি.মি.-ও বেশি একে বলে আইসোলেটেড ডায়াস্টোলিক হাইপারটেনশন (Isolated Diastolic Hypertension)।

     সমীক্ষা থেকে জানা গেছে মোটা লোকদের উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা বেশি। তবে এটাও দেখা গেছে মোটা ব্যক্তিরা যখন বিভিন্ন চেষ্টা করে তাদের ওজন কমিয়ে ফেলেন; সেই সঙ্গে তাদের রক্তচাপ কমে আসে। হাই ব্লাডপ্রেসারের রোগীর ওজন সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।  রক্তচাপের ওপর বংশগতির প্রভাব রয়েছে। মা ও বাবা দু’জনের উচ্চরক্তচাপ থাকলে ছেলেমেয়েদের হাই ব্লাডপ্রেসার হওয়ার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ। যদি শুধু মা কিংবা বাবার হাই ব্লাডপ্রেসার থাকে তবে তাদের সন্তানের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%। অভিন্ন যমজ (Identical Twin)-এর যদি একজনের উচ্চরক্তচাপ থাকে অন্যজনের তা হওয়ার সম্ভাবনা ৫৫%।
    কালো চামড়ার মানুষের উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা শ্বেতকায়দের থেকে বেশি। শুধু তাই নয়, পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে বসবাসকারী নিগ্রোদের ব্লাডপ্রেসার শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় বেশি। ঐ সব এলাকার নিগ্রোদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হাই ব্লাডপ্রেসার। কোনো কোনো চিকিৎসা বিজ্ঞানী মনে করেন এর জন্য দায়ী বংশগতি। মানসিক টানাপোড়েন উচ্চরক্তচাপের অন্যতম কারণ। উচ্চাকাঙক্ষা, দাম্পত্য জীবনের মনোমালিন্য, প্রতিবেশীর অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ, পরীক্ষার আশানুরূপ ফল না করা- এসব বিভিন্ন কারণে মনের ওপর চাপ বাড়লে ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যায়।
    রক্ত সংবহনতন্ত্রের বাইরে যখন অন্য কোনো অসুখের লক্ষণ হিসাবে উচ্চরক্তচাপ দেখা যায় তখন তাকে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন (Secondary Hypertension) বলে। কিডনির অসুখ, হরমোন গ্রন্থির অসুখ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া- এসব বিভিন্ন কারণে ব্লাডপ্রেসার হাই হতে পারে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কিডনি এক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিডনি থেকে নিঃসৃত রেনিন (Renin) নামের হরমোন এক্ষেত্রে মূলত দায়ী। রেনিন বেশি নিঃসরণ হলে রক্ত বেশি মাত্রায় লবণ ধরে রাখে। তার ফলে প্রবাহিত রক্তের মোট পরিমাণ বেড়ে যায়-এর জন্য বাড়ে রক্তচাপ। রেনিন বেশি হলে রক্তে অ্যাঞ্জিওটেনসিন (Anjiotension) নামে আরো একটি হরমোন বাড়ে। ধমনীর দেওয়ালে যে পেশি আছে অ্যাঞ্জিওটেনসিন সেগুলির সংকোচন ঘটিয়ে রক্তচাপের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
    রক্ত সরবরাহকারী ধমনীর ভেতরের দেওয়ালে কোথাও কোথাও স্নেহবস্তু (Fat) জমে। পরে সেগুলি ভেঙ্গে পরত উঠে আসে এবং সেইসব খস্খসে জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। আমরা একে বলি অ্যাথেরোমা (Atheroma)। কিডনির ধমনীতে অ্যাথেরোমা হলে রেনিন বেশি মাত্রায় নিঃসৃত হতে থাকে। কয়েকদিনর মধ্যেই রক্তচাপ খুব বেড়ে যায়। রোগী বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই ধরনের দ্রুত বর্দ্ধনশীল বা মারাত্মক রক্তচাপকে প্রচলিত ভাষায় বলে ম্যালিগনেন্ট হাইপারটেনশন (Malignant Hypertension)। না, না নাম শুনে অতিমাত্রায় আতঙ্কিত হবেন না। ক্যানসারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। যদি একটি বা দুটি কিডনিতে বারবার জীবানু সংক্রমণ (Infection) হতে থাকে তবে সেক্ষেত্রে রেনিন বাড়তে পারে। এছাড়াও মূত্রনালী সরু (Stricture) হয়ে গেলে, কিডনির ধমনীর সংকোচনে (Renal Artery Stenosis), মূত্রথলিতে পাথর হলে, কিডনির প্রদাহ বা নেফ্রাইটিসে রক্তচাপ বাড়তে পারে। কিডনির এক্স-রে, আলট্রা সোনোগ্রাফি, ইউরিন কালচার করলে রোগ ধরা পড়ে।
    পুরুষের তুলনায় মহিলাদের উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা কম। অর্থাৎ মহিলাদের মধ্যে বিশেষত রজঃনিবৃত্তির আগে হাইব্লাডপ্রেসারের রোগী কম দেখা যায়। সে সব মহিলা কয়েকবছর ধরে গর্ভনিরোধক (Contraceptive Pill) ব্যবহার করে আসছেন তাদের কেউ কেউ উচ্চরক্তচাপের শিকার হতে পারেন। কারণ, এইসব পিলের ভেতর ইস্ট্রোজেন (Estrogen) নামের এক হরমোন থাকে। এই হরমোন শরীরে লবণ ও জল ধরে রাখে। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। যে সব মহিলা গর্ভনিরোধক বড়ি খান, তাদের উচিত নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করানো। যদি হাইব্লাডপ্রেসার দেখা দেয়, তবে ‘পিল’ ছেড়ে দিয়ে গর্ভনিরোধকের অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। গর্ভাবস্থায় বিশেষ করে শেষের কয়েকমাস প্রসূতির শরীরে জলের পরিমাণ বাড়ে। দু’পা- হাত, হাতের আঙ্গুল ফোলে। প্রস্রাবে অ্যালবুমিন (Albumin) নামের প্রোটিন পাওয়া যায়। এর সঙ্গে বেড়ে যায় রক্তচাপ। এ ঘটনাকে গর্ভকালীন রক্তদূষণ বা টক্সিমিয়া অব্ প্রেগ্ন্যানসি (Toxaemia of Pregnancy) বলে। এটি হলে গর্ভবতীর সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। লবণ খাওয়া কমাতে বা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে এ বিষয়ে অবহেলা করলে মা ও গর্ভস্থ ভ্রূণ দু’জনেরই ক্ষতি হতে পারে।

এছাড়াও আরো কিছু কারণে রক্তচাপ বাড়তে দেখা যায়-
    রক্তে লোহিত কণিকার সংখ্যা বেশি হলে রক্ত গাঢ় হয় অর্থাৎ তার সান্দ্রতা (Viscosity) বেড়ে যায়। ফলে সুষ্ঠু রক্ত সঞ্চালনের জন্য হৃৎপিন্ডকে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে হয়। এতে ধমনীর মধ্যে রক্তচাপ বাড়ে। হৃদযন্ত্রের মহাধমনী কোনো কারণে সরু হয়ে গেলে (Coarctation of Aorta)  উচ্চরক্তচাপ দেখা দেয়।
    হার্টের জন্মগত ব্যাধির ফলে হাইব্লাডপ্রেসার হতে পারে। কিডনির ওপরে থাকা অন্তঃক্ষরাগ্রন্থি থেকে কার্টিজল, অ্যাড্রিনালিন, নর অ্যাড্রিনালিন প্রভৃতি হরমোন বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ বেশিদিন ব্যবহারের ফলে হাইব্লাডপ্রেসার হতে পারে।
উচ্চরক্তচাপের লক্ষণ- অল্পস্বল্প উচ্চরক্তচাপ থাকলে সাধারণত কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। যাদের হাই-ব্লাডপ্রেসার আছে তাদের ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ থাকে না। উচ্চরক্তচাপের প্রাথমিক লক্ষণ মাথাধরা, মাথার মধ্যে দপদপ্ করা। ঘুম থেকে উঠে সকালবেলায় মাথার পেছন দিকে অনেক সময় ঘাড়ে কেমন ভারী ভাব থাকে। এটি কয়েক ঘন্টা থাকতে পারে। মাথা ব্যথার পেছনে আবার মানসিক কারণও দেখা যায়। একবার এক রোগিণীর রক্তচাপ পরীক্ষা করে তাকে বলেছিলাম তার হাই-ব্লাডপ্রেসার আছে। কথায় কথায় আমার কাছ থেকে উচ্চরক্তচাপের লক্ষণগুলি সে জেনে নেয়। তারপর থেকে সে প্রায়ই মাথাধরার ওষুধ নিতে আসতো। হাই-ব্লাডপ্রেসারের চেয়ে প্রেসার নিয়ে দুশ্চিন্তা ও উৎকন্ঠাই তার মাথাধরার অন্যতম কারণ।
    উচ্চরক্তচাপ থেকে কারো কারো ক্ষেত্রে আধকপালী অর্থাৎ মাথার ডান অথবা বাম পাশে ব্যথা হয়। যাকে প্রচলিত কথায় মাইগ্রেন (Migrain) বলে। অনেকের বেলায় হাই-ব্লাডপ্রেসারের কারণে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে দেখা যায়। এ থেকে দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতাও হতে পারে। প্রথমদিকে চোখের সামনে একটি কালো বিন্দু দেখা যায়। রক্তচাপ ১৯০/১৩০ বা তার বেশি হলে রেটিনার রক্তজালকগুলি ফেটে চোখের ভেতর রক্তক্ষরণ হতে পারে। প্রেসার বেশি থাকলে অল্প পরিশ্রমের হাঁসফাঁস লাগে। রাতে ঘুম কমে যায়। হাতে-পায়ে ঘন ঘন ঝিঁ ঝিঁ ধরে।
    উচ্চরক্তচাপ বেশিদিন ধরে থাকলে তার পরিণতি মারাত্মক। ধমনীর দেওয়াল পুরু হয়ে যায় ও ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা কমে আসে। হৃৎপিন্ড ও ফুসফুসে অতিরিক্ত চাপ পড়ার জন্য তাদের কার্যক্ষমতা  হ্রাস পায়। হাই-ব্লাডপ্রেসারের কারণে বড়ো বড়ো ধমনীতে অ্যাথেরোমা হয়। যা থেকে পরবর্তী সময়ে করোনারি থ্রম্বোসিস (Coronary Thrombosis), ব্রেন স্ট্রোক (Brain Stroke) হতে দেখা যায়। অনেক সময় অ্যাথেরোমা থেকে ধমনীর দেওয়াল দুর্বল হলে তা ফুলে ওঠে; ছোটো থলির আকার নেয়। একে বলে অ্যানিউরিজম (Aneursym)। এটি ফেটে গিয়ে বড়ো ধরনের বিপদ ডেকে আনে। তখন এই ধমনী মেরামত করতে প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

উচ্চরক্তচাপের ওষুধ- পথ্য-
উচ্চরক্তচাপ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সবার আগে নজর দিতে হবে খাদ্য-খাবারে। খাদ্য লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড (Sodium Chloride)-এর সঙ্গে রক্তচাপের সম্পর্কটা এখন অনেকেই জেনে গেছেন। এক্ষেত্রে সোডিয়াম আয়ন মূলত দায়ী। সাধারণত বাঙালির সারাদিনের খাবারে ৩-৬ গ্রাম নুন থাকে। রক্তচাপের মাত্রা অনুযায়ী সেটি কমিয়ে ৩০০ মি.গ্রা. থেকে ১ গ্রামের মধ্যে রাখতে হবে। অনেকে মনে করেন সৈন্ধব লবণে সোডিয়াম কম থাকে তাই হাইব্লাডপ্রেসারে এটি ইচ্ছে মতো খাওয়া যেতে পারে। এ ধারণা ভুল, কারণ এতে সোডিয়াম কম থাকলেও পটাসিয়াম লবণ বেশি পরিমাণে থাকে। বাজারে প্রচলিত হৃদরোগের বহু ওষুধের সঙ্গে পটাসিয়ামের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়; ফলে নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরো একটি কথা- অনেকে কাঁচা নুন না খেয়ে রান্নায় বেশি লবণ দেন। লবণের কাঁচা-পাকা হয় না। রান্নায় নুনের ব্যবহার হবে পরিমিত। স্বাভাবিক সোডিয়ামযুক্ত খাবার যেমন- মাংস, ডিম, দুধ, চিজ, মেটে, ঘিলু এসব খাওয়ার বিষয়ে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। সস, মার্জারিন ইত্যাদিতে সংরক্ষক হিসাবে সোডিয়াম দেওয়া থাকে। পালংশাকে অন্য সবজির তুলনায় নুনের ভাগ বেশি। চাইনিজ রান্নাতে যে অ্যাজিনোমোটো ব্যবহার করা হয় তাতে প্রচুর সোডিয়াম থাকে। তাই প্রিয়তমাকে নিয়ে চাইনিজ রেস্তরাঁয় যাওয়ার আগে নিজেদের হৃদয় নিয়ে একটু ভাবতে হবে। পায়খানা পরিষ্কারের ওষুধ বা ল্যাক্সেটিভ, কাফ্ সিরাপ, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টাসিড যে সব ওষুধে সোডিয়াম আছে- উচ্চরক্তচাপের রোগীরা সেগুলি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না।
    প্রত্যক্ষ কোনো কারণ না থাকলেও ধূমপানে পরোক্ষভাবে রক্তচাপ বাড়ে। তামাকের ভেতরে থাকা নিকোটিন অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ হরমোনগুলি রক্তচাপ বাড়ায়। এছাড়াও নিকোটিন থেকে করোনারি ধমনীতে অ্যাথেরোমা হতে পারে। মদ্যপান করলে রক্তচাপ সামান্য বাড়ে, পরে তা কমে আসে। তবে মদে যেহেতু টিসুক্যালোরি বেশি থাকে তাই মদ খেলে শরীরে শর্করা ও ফ্যাট বৃদ্ধি পায়। যা পরোক্ষভাবে উচ্চরক্তচাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের হাই ব্লাডপ্রেসার আছে তারা কখনই দু’পেগের বেশি মদ খাবেন না। ব্লাডপ্রেসার খুব বেশি হাই না হলে ডাক্তারবাবুরা প্রাথমিক পর্যায়ে হালকা ঘুমের ওষুধ, উত্তেজনা কমানোর ওষুধ বা সিড্যাটিভ ড্রাগ (Sedative Drug) দেন। কোনো কোনো সময় রোগীকে প্রস্রাব বেশি হওয়ার ওষুধ (Diuretic) খেতে হয়। এতে শরীর থেকে লবণ ও জল বেরিয়ে পরোক্ষভাবে রক্তচাপ কমায়। ক্লোরোথায়োজাইড (Chlorothiazide), বেনড্রোফ্লায়োজাইড (Bendrofluozide), থায়োজাইড (Thiazides) ওষুধগুলি এই গোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে। কিন্তু এ ওষুধের একটি বড়ো অসুবিধা হ’ল প্রস্রাবের সঙ্গে সোডিয়াম ছাড়া পটাসিয়াম ও দেহের প্রয়োজনীয় আরো কিছু লবণ বেরিয়ে যায়। ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে ও রোগীর খিদে কমে। তাই ডাক্তারবাবুরা ডাই-ইউরেটিক-এর সঙ্গে পটাসিয়াম ট্যাবলেট খেতে দেন।
    উচ্চরক্তচাপ একটু প্রকট হলে চিকিৎসকেরা আলফা মিথাইল ডোপা (Alpha Methayl Dopa), ক্লোনিডিন (Clonidine) যুক্ত বড়ি প্রতিদিন খেতে দেন। এইসব ওষুধে নর অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রিত হয়ে রক্তচাপ কমে যায়। হাইড্রোলাজিন (Hydrolizine), মিনক্সিডিল (Minoxidil), ডায়াক্সজাইড (Diazoxide) প্রভৃতি ওষুধ রক্তবাহী নালীকে প্রসারিত করে রক্তচাপ কমিয়ে দেয়। তাই এদের বলে নালী প্রসারক বা ভাসোডাইলেটারস্ (Vasodilators)।
    কোনো কোনো রোগীর যখন অতি উচ্চরক্তচাপ বা ম্যালিগনেন্ট হাইপারটেনশন দেখা দেয় তখন সে অবস্থা সামাল দিতে নাইট্রোপ্রুসাইড (Nitro Pruside), ডায়াজক্সাইড (Daizoxide), রিসারপিন (Reserpin) প্রভৃতি ওষুধ ইনজেকশন হিসাবে প্রয়োগ করা হয়। কোন্ রোগীর জন্য কোন্ ধরনের ওষুধ বেশি কার্যকরী হবে; তা রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর রোগীর স্বাস্থ্যের সবদিক বিবেচনা করে ডাক্তারবাবু তা ঠিক করেন। রক্তচাপ কমানোর ওষুধগুলিতে কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effect) রয়েছে। সাময়িকভাবে এগুলি দেখা যায়। যেমন- থায়োজাইডে মানসিক অবসাদ আসে, ক্লোনিডিনে অনিদ্রা, জিভ ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া, আলফা মিথাইল ডোপা পুরুষের যৌন সঙ্গমে অসুবিধা দেখা দেয়, রিসারপিনে রোগী দুঃস্বপ্ন দেখে। এ ধরনের আরো বহু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। উচ্চরক্তচাপের ওষুধ নেওয়ার সময় ওষুধ থেকে কী কী অসুবিধা দেখা দিতে পারে তা ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবেন; নতুবা অযথা আতঙ্কিত হতে পারেন।

    আয়ুর্বেদিক মতে উচ্চরক্তচাপের বেশ কিছু ওষুধ আছে। বর্তমানে এখন অনেকেই আয়ুর্বেদিক ওষুধের দিকে ঝুঁকছেন। এর অন্যতম কারণ এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই কম। উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে-
* সর্পগন্ধার রস আধা চামচ খাওয়ার পর দিনে দু/তিনবার খেতে হবে।
* গোক্ষুরচূর্ণ এক চামচ খাওয়ার আধাঘন্টা আগে দিনে দু’বার খেতে হবে।
* অরণি গাছের ছাল শুকিয়ে গুঁড়ো করে এক থেকে দেড় গ্রাম সকালবেলায় খালিপেটে খেতে হবে।
* যে সব উচ্চরক্তচাপ রোগীর ঘুম ভালো হয় না, তারা প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় এক চামচ সুষনিশাকের রস খেতে পারেন।
* কুড় ও অর্জুন গাছের ছালের নির্যাস সকালবেলায় খালি পেটে খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
* উচ্চরক্তচাপের কারণে যাদের স্মৃতিশক্তি ও ঘুম কমে গেছে তারা প্রতিদিন সকালবেলায় খালি পেটে আধা কাপ ব্রাহ্মীশাকের রস খেতে পারেন।
    হোমিওপ্যাথিতে উচ্চরক্তচাপের অনেক ওষুধ আছে। উপসর্গ অনুসারে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। রাউলোফিয়া সার্পেন্টিনা-1x (Rauwalfia), গ্লোনয়িন (Glonoin), ব্যারাইটা মিউর (Baryta Mur), অরাম মেটালিকাম (Aurum Met), স্পার্টিয়াম স্কোপ (Spartium Scop) 3x  প্রভৃতি ওষুধে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। অতি উচ্চরক্তচাপ বা ম্যালিগনেন্ট হাইপারটেনশন সামাল দিতে ক্যাকটাস. জি (Cactus), ডিজিটেলিস (Digitalis), ন্যাজা (Naja Tri), এমিল নাইট্রেট (Amyl Nitrite), প্রয়োগ করা হয়। তবে হ্যাঁ, কোন্ ওষুধ কীভাবে, কতটা পরিমাণে খেতে হবে সে বিষয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
নিম্নরক্তচাপ
    নিম্নরক্তচাপের তেমন কোনো বাঁধাধরা সীমারেখা নেই। তবে সিস্টোলিক চাপ ১০৮-এর কম ও ডায়াস্টোলিক চাপ ৬৮-এর কম হলে তাকে মোটামুটিভাবে লো-ব্লাডপ্রেসার ধরা হয়। নিম্নরক্তচাপের লক্ষণ হিসাবে মাথা ঘোরানো, চোখে অন্ধকার দেখা, সবসময় দুর্বলতা, অল্প পরিশ্রমে ক্লান্তিবোধ, বুক ধড়ফড়ানি আরো কিছু উপসর্গ দেখা যায়।
    দেহের কোন অংশ থেকে অধিক পরিমাণে রক্তপাত হলে রক্তচাপ কমে আসে। মেয়েদের সন্তান প্রসবের পর, রোগীর রক্তবমি হলে এই লক্ষণ দেখা যায়। ডাইরিয়া, কলেরা, অতিরিক্ত বমি-পায়খানা হলে শরীরে জলের অভাব দেখা দেয়। এর ফলস্বরূপ রক্তচাপ কমে যেতে পারে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের অভাব, ডায়াবিটিস মেলিটাস, হৃৎপেশির দুর্বলতা ও কার্ডিও মায়োপ্যাথি, মহাধমনীর মুখে থাকা অ্যাওর্টিক ভালভ সংকুচিত হওয়া ও করোনারি থ্রম্বোসিসের পর কিছুক্ষণের জন্য রক্তচাপ নিচে নেমে যায়। নিম্নরক্তচাপ থেকেও হার্টঅ্যার্টার্ক হতে পারে। সেক্ষেত্রে সিস্টোলিক ৭০-এর কম ও ডায়াস্টোলিক ৫০-এর কম হয়ে থাকে।
    কিছুদিন নিয়ম করে প্রাণীজ প্রোটিনযুক্ত পুষ্টিকর খাবার খেলে ও বিশ্রাম নিলে সাধারণ লো-ব্লাডপ্রেসার সেরে যায়। তবে কোন রোগের উপসর্গ হিসাবে নিম্নরক্তচাপ দেখা দিলে, কারণ অনুসারে উপযুক্ত চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে শল্য চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হতে পারে।
আয়ুর্বেদিক ভেষজ চিকিৎসায় নিম্নরক্তচাপ ঠিক করতে-
* দেড় চামচ যষ্ঠিমধু গুঁড়ো ও এক চামচ অশ্বগন্ধাচূর্ণ মিশিয়ে দিনে দু’বার খেতে হবে।
* এক চামচ ব্রাহ্মীশাক ও জটামাংসীর রস সকালবেলায় খালি পেটে খেতে পারেন।
* আলকুশি বীজ চূর্ণ আধা চামচ, তালমুকী চূর্ণ আধা চামচ, জীবন্ত আধা চামচ একসঙ্গে মিশিয়ে দিনে দু’বার খেতে হবে।
হোমিওপ্যাথিতে নিম্নরক্তচাপে লক্ষণ অনুযায়ী থাইরডিয়ান (Theridion), জেলসিমিয়ম (Gelsemium), ক্যালিফস (Kaliphos) দেওয়া হয়। তবে সব ক্ষেত্রেই মেনে চলতে হবে চিকিৎসকের নির্দেশ।
    আসলে পরিমিত খাদ্য, ব্যায়াম, বিশ্রাম, মানসিক প্রশান্তি, সঠিক ওষুধ এসব কিছুর মধ্য দিয়েই আপনাকে হয়ে উঠতে হবে ‘ম্যান অব্ গোল্ডেন হার্ট’।

Join our mailing list Never miss an update