হৃদয়ের কথা; পর্ব-২০; মেদবৃদ্ধি ও হৃদরোগ

হৃদয়ের কথা; পর্ব-২০; মেদবৃদ্ধি ও হৃদরোগ

হৃদয়ের কথা; পর্ব-২০; মেদবৃদ্ধি ও হৃদরোগ; ডাঃ পার্থপ্রতিম।
    টাকাকড়ি বাড়লেই ভুঁড়ি বাড়ে-এমন একটি কথা প্রচলিত আছে। আসলে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য মানুষের জীবনধারাকে বদলে দেয়। হাঁটাহাঁটির পরিবর্তে বিভিন্ন যানবাহন হয়ে ওঠে চলার সাথী। দৈহিক পরিশ্রম লাঘব করতে এসে যায় লিফট, ওয়াসিং মেশিন, মাইক্রোওভেন, মিক্সিগ্রাইন্ডার আরো কত কী।
    হাঁটাচলা, দৈনন্দিন কাজকর্ম এসব করার জন্য আমাদের শক্তি বা ক্যালোরির প্রয়োজন। এই ক্যালোরি আমরা খাদ্য থেকে পাই। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ক্যালোরি চর্বি  বা মেদ হিসাবে আমাদের দেহে সঞ্চিত হয়। দেহে যদি কোনো সময় খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়, তবে চর্বির সঞ্চিত শক্তি সেই অভাব পূরণ  করে। এক্ষেত্রে দেহকে ব্যাঙ্কের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আমাদের ব্যয়ের অতিরিক্ত টাকা যেমন আমরা ব্যাঙ্কে জমা রাখি; প্রয়োজন মতো আবার টাকা তুলে খরচ করি। দেহে শক্তি সঞ্চয়ের বিষয়টিও সেরকম। ব্যাঙ্কে অতিরিক্ত টাকা জমানো ভালো কি না, এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে দেহে অতিরিক্ত মেদ জমা যে খুবই মারাত্মক সে বিষয়ে চিকিৎসকেরা একমত।

দেহে অতিরিক্ত মেদবৃদ্ধির কারণ হিসাবে যে বিষয়গুলি উল্লেখযোগ্য সেগুলি হলো-
১). প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়া।
২). যে সব খাবারে ফ্যাট বা চর্বি বেশি আছে তেমন খাবার খাওয়া।
৩).প্রয়োজনীয় দৈহিক পরিশ্রম না করা।
৪). প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুম বা বিশ্রাম।
৫). অন্তক্ষরা গ্রন্থি বা হরমোনাল গ্ল্যান্ডের গোলযোগ, যেমন হাইপা থাইরয়ডিজম বা থাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষরণ কম হলে ওজন বেড়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কুশিং সিন্ড্রোম বা অ্যাড্রিনাল কর্টেক্স বেশি ক্ষরণের ফলে মেদ বৃদ্ধি ঘটে।
৬).বংশগত ধারা।
৭).অতিরিক্ত মদ্যপান।
    কেউ ঢ্যাপসা না সুঠাম তা নির্ণয় করার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বডিমাস ইনডেক্স বা সংক্ষেপে বি.এম.আই (BMI)  পদ্ধতি অবলম্বন করেন। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে এটি প্রচলিত। ধরা যাক, আপনার ওজন ৬০ কেজি আর উচ্চতা ১.৬০মিটার, তবে বি.এম.আই হবে =       
               কেজি এককে ব্যক্তির ওজন
            (মিটার এককে ব্যক্তির উচ্চতা) ২

অর্থাৎ আপনার বডিমাস ইনডেক্স= ৬০/ ১.৬০ x ১.৬০ = ২৩.৪৩

প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে মেদ থেকে বিপত্তির সম্ভাবনার ভিত্তিতে বি.এম.আই-কে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়-
    বি.এম.আই. ২০-২৫ হলে বিপত্তির সম্ভাবনা একদম নেই।
    বি.এম.আই. ২৬-৩০ হলে বিপত্তির সম্ভাবনা একদম কম।
    বি.এম.আই. ৩১-৩৫ হলে বিপত্তির সম্ভাবনা মাঝামাঝি।
    বি.এম.আই. ৩৬-৪০ হলে বিপত্তির সম্ভাবনা বেশি।
    বি.এম.আই. ৪০এর বেশি হলে অবস্থা খুবই মারাত্মক।

    লক্ষ্য করে দেখা গেছে, শরীরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় চর্বি বেশি জমে। বুকে পেটে চর্বির জমার ধাত পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। যাকে বলে অ্যবডোমিনাল ফ্যাট (Abdominal Fat)| । কোমর ও উরুতে চর্বি জমার প্রবণতা বা গ্লুটিয়াল ফ্যাট (Gluteal Fat)  থাকে মেয়েদের মধ্যে। তুলনামূলকভাবে গ্লুটিয়াল ফ্যাট অ্যাবডোমিন্যাল ফ্যাটের চেয়ে কম মারাত্মক।
    গবেষণা করে জানা গেছে, যারা স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের অধিকারী তাদের বড়ো জোর ১২ থেকে ২০ কেজি চর্বি থাকে। আর যারা মোটাসোটা তারা ৪০ থেকে ৮০ কেজি চর্বি বয়ে বেড়ান। দেহে মোট চর্বির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। তবে চর্বিতে তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক বা আইসোটোপ প্রয়োগ করে আধুনিক পদ্ধতিতে চর্বি মাপা হয়ে থাকে।
    দেহে মেদ বা চর্বি বেশি হলে শারীরের বিপাকীয় ক্রিয়ার বিপত্তি দেখা যায়। রক্তে কোলেস্টেরল বেশি হয়ে যায় এবং ফ্যাটি অ্যাসিডের লেবেল বেড়ে যায়। একে আমরা বলি হাইপার লিপিডিটি (Hyper lipedity)| । সাধারণ ভাবে কোলেস্টেরলের মাত্রা ২০০ মি.গ্রা./১০০ মিলি। এর বেশি হলেই সতর্ক হবে হবে। এরই সঙ্গে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেশি হলে রক্তবাহী ধমনীর ভেতরের দেওয়ালে চর্বি জমে রক্ত চলাচলের পথ সরু করে দেয়, যাকে বলে অ্যাথরোসক্লেরোসিস। হৃদযন্ত্রে রক্ত সরবরাহকারী করোনীর ধমনীতে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস হলে তার ফল হয় মারাত্মক, এটি হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ। সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, মোটা লোকেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চরক্তচাপের শিকার।
    দেশ-কাল-জাতি-লিঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির উচ্চতা অনুসারে ওজন বিভিন্ন হয়। তবে ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ২৫ বছরের বেশি বয়স্ক পুরুষের উচ্চতা অনুযায়ী আদর্শ ওজন হলো-

উচ্চতা   উচ্চতা       ওজন   ওজন
ফুট ইঞ্চি সেমি.   পাউন্ড কেজি.
5 2 157.5 118-129 53.5-58.5
5 3 160.0 121-133 54.9-60.3
5 4 162.6 124-136 56.3-61.7
5 5 165.1 127-139 57.6-63.0
5 6 167.6 130-143 59.0-64.9
5 7 170.2 134-147 60.4-66.7
5 8 172.7 138-152 62.6-68.9
5 9 175.3 142-156 64.4-79.8
5 10 177.8 146-160 66.2-72.6
5 11 180.3 150-165 68.0-74.8
6 0 182.9 154-170 69.9-77.1
6 1 185.8 158-175 71.7-79.4
6 2 188.0 162-180 73.5-81.6


২৫ বছরের বেশি বয়স্ক মহিলার আদর্শ ওজন হলো-

উচ্চতা   উচ্চতা ওজন ওজন
ফুট ইঞ্চি সেমি. পাউন্ড কেজি.
4 10 147.3 96-107 43.5-48.5
4 11 149.9 98-110 44.5-49.9
5 0 152.4 101-113 45.4-51.3
5 1 154.9 104-116 47.2-52.6
5 2 157.5 107-119 48.5-54.0
5 3 160.0 110-122 49.9-55.3
5 4 162.6 113-126 51.3-57.2
5 5 165.1 116-130 52.6-59.0
5 6 167.6 120-135 54.4-61.2
5 7 170.2 124-139 56.2-63.0
5 8 172.7 128-143 58.1-64.9
5 9 175.3 132-147 59.9-66.7
5 10 177.8 136-151 61.7-68.5
5 11 180.3 140-155 63.5-70.3
6 0 182.9 144-159 65.3-72.0

ব্যক্তির ওজন স্বাভাবিক ওজন থেকে বেশি হলে হৃদরোগের প্রবণতা দেখা দেয়-
আদর্শ ওজন থেকে ১০ শতাংশ বেশি হলে হৃদরোগের সম্ভাবনা = ১৩শতাংশ।
আদর্শ ওজন থেকে ২০ শতাংশ  বেশি হলে হৃদরোগের সম্ভাবনা =২৫শতাংশ।
আদর্শ ওজন থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হলে হৃদরোগের সম্ভাবনা =৪০ শতাংশ।
আদর্শ ওজন থেকে ৪০ শতাংশ বেশি হলে হৃদরোগের সম্ভাবনা =৬২ শতাংশ।
    
    দেহে অতিরিক্ত মেদ কমানোর জন্য বহু ধরনের ব্যবস্থা আছে। তবে তার মধ্যে প্রাথমিক হলো -
    খাদ্যাভাস: দেহে মেদবৃদ্ধি হলে চর্বিযুক্ত খাবার কম খেতে হবে। ডিম, মাখন, ঘি, লাল-মাংস, আলু, ইলিশ, চিংড়ি এসব বেশি চর্বিযুক্ত মাছ খাওয়া চলবে না। আইসক্রিম, চকোলেট একেবারেই বন্ধ করতে হবে। পেটভর্তি করতে হবে প্রচুর শাকসবজি, রুটি, শশা জাতীয় ফল দিয়ে। ছোট মাছ, ছোট দেশি মুরগির মাংস খেতে পারেন।

    ব্যায়াম : দেহে মেদবৃদ্ধি রুখতে নিয়মিত ব্যায়াম-এক ধারালো হাতিয়ার। সময় করে প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করবেন। ব্যায়াম শুরু করার আগে মাপজোখ করে জেনে নিতে হবে শরীরের কোথায় কোথায় মেদ বেশি আছে। তারপর সেই অনুসারে ব্যায়াম নির্বাচন করে অভ্যাস করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়াও হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা উত্তম ব্যায়াম।

    চিকিৎসা : দেহে অতিরিক্ত চর্বি জমলে অনেক সময় তা কমাতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। ফেনফ্লুরামিন জাতীয় ওষুধ একসময় মেদ কমানোর কাজে খুব ব্যবহৃত হত। কিন্তু বর্তমানে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য সারা পৃথিবীতে এই ওষুধটি নিষিদ্ধ হয়েছে। থাইরক্সিন ওষুধ ব্যবহারে রোগা হওয়া যায়। তবে থাইরক্সিন চর্বি কমানোর সঙ্গে সঙ্গে দেহের প্রোটিনও কমিয়ে দেয়। এই কুফলের জন্য এর ব্যবহার এখন কমে গেছে।
    আধুনিক লাইপোসাকশান পদ্ধতিতে পেটে চামড়ার নিচে জমা চর্বি বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে টেনে বার করা হয়। এই প্রক্রিয়া শুরু করার আগে সার্জেন রোগীকে দাঁড় করিয়ে মেদ জমে থাকা জায়গাগুলি প্রথমে এঁকে নেন। তারপর রোগীকে শুইয়ে কয়েকটি বিশেষ বিশেষ জায়গায় ফুটো করে সেখান থেকে সরু নল ঢুকিয়ে বাড়তি চর্বি বের করে নেওয়া হয়। চামড়া ফুটো করার আগে জায়গাটি স্থানীয়ভাবে অবশ বা লোকাল অ্যানিস্থিসিয়া (Local Anaesthesia) করা হয়। লাইপোসাকশন শেষ হওয়ার কিছু পরেই রোগী বাড়ি ফিরে যেতে পারে। তবে রোগীকে বিশেষ ধরনের জামা পরে কিছুদিন থাকতে হয়, যাতে অপারেশনের জায়গাগুলি নির্দিষ্ট চাপের মধ্যে থাকে।
    যে সব মানুষের পেটে খুব চর্বি থাকে তাদের ক্ষেত্রে অ্যাডমিনোপ্লাস্টি পদ্ধতিতে চামড়া সহ চর্বি কেটে বাদ দেওয়া হয়। অপরেশনের সময় সেলাইয়ের দাগ এমনভাবে ফেলা হয় যাতে সেটি জামা কাপড়ের ভেতরে থাকে, সহজে চোখে না পড়ে।
    শুধু অ্যালোপ্যাথিক বা সার্জারিতে নয়, ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাচীনতম সম্পদ আয়ুর্বেদেও মেদ কমানোর অনেক উপায় বর্ণিত আছে। তেল-চর্বি প্রভৃতি স্নেহ দ্রব্য বেশি খেলে যে অন্নরস উৎপন্ন হয়, সেই রস ঠিকভাবে পরিপাক না হলে শরীরে তৈরি হয় মধুর রস। আয়ুর্বেদিক মতে মধুর রস থেকে মেদবৃদ্ধি ঘটে। মেদ প্রতিরোধ করতে বহু ধরনের ভেষজ বা ওষুধের উল্লেখ আছে আমাদের শাস্ত্রে-
    নিশিন্দা গাছের পাতা গুঁড়ো করে ১/২ চামচ অল্প গরম জলের সঙ্গে মিশিয়ে সকালবেলায় খালি পেটে খেতে হবে।
    আমলকী চূর্ণ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে মেদ হ্রাস হয়।
    ত্রিফলা (আমলকী, হরিতকী ও বয়ড়া) চূর্ণ, ত্রিকুট গুঁড়ো (শুট, পিপুল, মরিচ) সরষের তেল ও লবণ মিশিয়ে তিন/চার মাস খেলে মেদ কমে যায়।
    সকালবেলায় খালি পেটে এক কোয়া রসুন খেলে মেদ কমে।
    এমন আরো বহু ভেষজ আছে, যা অভিজ্ঞ কবিরাজের পরামর্শ নিয়ে খেলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

    হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাতে দেহের অতিরিক্ত মেদ কমানোর বহু ওষুধ রয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তির মানসিক অবস্থা, খিদে, তৃষ্ণা, শারীরিক কাঠামো এসব লক্ষণের ওপর নির্ভর করে ওষুধ নির্বাচন করা হয়। ফাইটোলক্কা বেরি মাদার ১০ ফোঁটা আধা কাপ জলের সঙ্গে দিনে দু’বার খেলে মাসে ২/৩ কেজি ওজন কমে। একইভাবে ফিউকাস ভেস-মাদার ব্যবহার করা যেতে পারে। লক্ষণ অনুসারে ক্যালোট্রাপিস, ক্যালকেরিয়া আর্স, গ্রাফাইটিস, থাইরয়ডিয়াম মেদ কমানোর কাজে খুব ফলপ্রদ।
    বর্তমানে নগরায়ণের প্রভাবে মেদবহুল লোকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এখন মেদবৃদ্ধি বা স্থূলতা কোনো নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এই সুযোগে শহর-নগরের পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে হেল্থ ক্লাব-স্লিমিং সেন্টার। কেউ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফ্যাট মেল্টার জাতীয় মেশিন দিয়ে কেউ বা আয়ুর্বেদিক ওষুধ দ্বারা আপনাকে ছিপছিপে তন্বী করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে অপেক্ষ্যমান। এসব পদ্ধতিতে সাময়িক কিছু ফল পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু পরবর্তী সময়ে সর্তক না থাকলে আবার ওজন বাড়ে (Weight recycling)।
    পরিমিত খাদ্য ও নিয়মিত ব্যায়ামই সবচেয়ে ভাল দাওয়াই।  এতে শরীর থাকবে ঝরঝরে আর হৃদয় হবে সবল। হ্যাঁ আপনাকেই ঠিক করতে হবে আপনি কী বিশেষণে ভূষিত হতে চান-হোঁদল কুতকুত না স্মার্ট গাই।

Join our mailing list Never miss an update