হৃদয়ের কথা পর্ব-১৯; কোলেস্টেরল ও হৃদরোগ

হৃদয়ের কথা পর্ব-১৯; কোলেস্টেরল ও হৃদরোগ

হৃদয়ের কথা পর্ব-১৯; কোলেস্টেরল ও হৃদরোগ; ২২শে নভেম্বর ১৯৯৯; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
বর্তমানে হার্টের রোগী ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ কোলেস্টেরল। আমাদের খাদ্যের মধ্যে সাধারণভাবে থাকে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও জল। ফ্যাট স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে আবার কোনো কোনো সময় কার্বোহাইড্রেট প্রোটিনের সঙ্গেও মিশে থাকে। দুধ, মাংস, ডিম, বদাম এ সবেতেই ফ্যাট রয়েছে। ফ্যাট বা চর্বি আমরা দুভাবে পাই; প্রাণী, থেকে যেমন-ঘি, মাখন, পশু চর্বি; আর উদ্ভিদ খেকে যেমন-বিভিন্ন প্রকার ভোজ্য তেল, বনস্পতি।
    চর্বি পাকস্থলী ও অন্ত্রে পরিপাক হয় তারপর রক্তে মিশে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু পরিমাণ চর্বি দেহে প্রয়োজনীয় ক্যালোরি যোগায়। বাকি ভাগ শরীরের বিভিন্ন অংশে সঞ্চিত হয়। চর্বিতে বিভিন্ন প্রকার ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারল (Glyceral)  থাকে।
    কিছু কিছু ফ্যাটি অ্যাসিডের ভেতর থাকা কার্বন পরমাণুর সব যোজ্যতা বন্ধনী (Valency Bond)  হাইড্রোজেন পরমাণু দ্বারা আবদ্ধ থাকে, একে সংপৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড বা স্যাচিউরেটেড ফ্যাটি অ্যসিড ((Saturated Fatty Acid  সংক্ষেপে SAFA বা ‘সাফা’ )বলে। এই ‘সাফা’ যখন গ্লিসারল-এর সঙ্গে মেশে তখন সেটি হয় শক্ত ও আঠালো। স্যাচিউরেটেড ফ্যাটি অ্যসিডের অণুতে যত বেশি সংখ্যক কার্বন ও হাইড্রোজেনের পরমাণু থাকবে অণু শৃঙ্খল ততই দীর্ঘ হবে ও অ্যাসিড হবে শক্ত।
    আবার কিছু ফ্যাটি অ্যাসিডের কার্বন পরমাণুর সব যোজ্যতা হাইড্রোজেন পরমাণু দ্বারা সংপৃক্ত হয় না। একে বলে অসংপৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড বা অ্যানস্যাচিউরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (Unsaturated Fatty Acid)। এটি গ্লিসারালের সঙ্গে মিশে তরল চর্বি সৃষ্টি করে।
    সাধারণভাবে প্রাণীজ ফ্যাট যেমন-ঘি, মাখনে থাকে সংপৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড। সাধারণ তাপমাত্রায় এগুলি চটচটে (Viscus)  বা কঠিন অবস্থায় থাকে। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ তেল যেমন- সরষে, সূর্যমুখী সাধারণ তাপমাত্রায় থাকে তরল। তবে বেশিরভাগ স্নেহপদার্থে সংপৃক্ত ও অসংপৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড বিভিন্ন অনুপাতে মিশে থাকে।
    অ্যানস্যাচিউরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড আবার দু’প্রকার-মনো অ্যানস্যাচিউরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (Mono Unsaturated Fatty সংক্ষেপে MUFA-মুফা) আর পলি অ্যানস্যাচিউরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (Poly Unsaturated Fatty Acid সংক্ষেপে PUFAপুফা)। পুফা’র মধ্যে রয়েছে লিনোলিক অ্যাসিড। লিনোলিনিক অ্যাসিডের দু’টি প্রধান উপাদান-ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬। হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে পুফা খুবই প্রয়োজনীয়; রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। পুফা কেবলমাত্র ভোজ্য তেলেই পাওয়া যায়।
    অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভিজ্জ তেল একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গরম করে নিকেল চূর্ণ বা অন্য কোনো অনুঘটকের উপস্থিতিতে হাইড্রোজেন গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটানো হয়। ফলে সাধারণ তাপমাত্রায় তেল হয় কঠিন। বনস্পতি এ ধরনের তেল। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলি হাইড্রোজেনেটেড ফ্যাট (Hydrogeneted Fat)। যে ভোজ্য তেলে পুফা’র মাত্রা বেশি থাকবে ও সাফা’র পরিমাণ কম হবে সেই তেল হৃদরোগীর পক্ষে তত উপকারি।
   

অন্ত্র দ্বারা শোষণের পর ফ্যাট রক্তে মিশে যায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চর্বির টুকরো  হিসাবে বা প্রোটিনের সঙ্গে মিলিত অবস্থায় চর্বি রক্তে ভেসে বেড়ায়। রক্তে থাকা মুক্ত চর্বি কণাকে রসায়ণ বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ট্রাইগ্লিসারাইড (Triglyceride)। এর আকার খুবই ক্ষুদ্র। এক মিটারের দশ লক্ষ ভাগের একভাগ অর্থাৎ এক মাইক্রন। এই জন্য একে অনেকে কাইলোমাইক্রন্স (Chylomicrons) বলে। কাইলোমাইক্রন বিভিন্ন প্রোটিনের সঙ্গে মিশে লাইপো প্রোটিন তৈরি করে । এর গঠন ছোটো মার্বেলের মতো। এই মার্বেলের কেন্দ্রস্থলে থাকে ফ্যাট ও কোলেস্টেরল। তাকে ঘিরে থাকে ফসফোলিপিড। সবচেয়ে বাইরে থাকে প্রোটিনের আবরণ। চর্বির আবরণে ফসফোলিপিডের স্তর মোটা হলে তাকে বলে হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (High density lipoprotein)  সংক্ষেপে এইচ.ডি.এল. (HDL)। আর ফসপোলিপিডির স্তর পাতলা হলে তাকে বলে লো ডেনসিটিলাইপো প্রোটিন (Low density lipoprotein) বা এল.ডি.এল. (LDL)। এছাড়াও গঠন অনুসারে ভেরি হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন   (VHDL) ও ভেরি লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (VLDL)  এভাবেও কিছু লাইপো প্রোটিনের শ্রেণি বিভাগ করা হয়। গবেষণা থেকে জানা গেছে, রক্তে এল.ডি.এল.বেশি থাকলে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস জনিত হৃদরোগের সম্ভাবনা বেশি।
বিভিন্ন প্রকার স্নেহ পদার্থে মোট ফ্যাটের কত শতাংশ সাফা, মুফা ও পুফা  আছে তা একবার দেখে নেওয়া যাক -    

তেল বা ফ্যাট

সাফা %

মুফা %

পুফা %

সরষে তেল

6

48

46

নারকেল তেল

87

7

6

চিনাবাদাম তেল

26

59

15

তিল তেল

14

45

41

সায়াবিন তেল

21

25

54

পাম তেল

52

39

9

তুলবীজ তেল

24

26

50

রেপসিড তেল ৬

6

50

44

সূর্যমুখী তেল

9

29

62

ভুট্টার তেল

18

26

56

বনস্পতি

92

6

2

ঘি

64

33

3

মাখন

62

32

6

শক্ত মার্জরিন

78

14

8

নরম মার্জারিন

30

48

2

কোলেস্টেরল হলো এক ধরনের চর্বি। এটি শুধু প্রাণীজ ফ্যাটে পাওয়া যায়। দুধ, মাংস, বিভিন্ন প্রাণীর ঘিলু, ডিম প্রভৃতি খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকে। উদ্ভিজ্জ তেলে কোলেস্টেরল তেমন পাওয়া যায় না।
    আমাদের রক্তের মধ্যে কোলেস্টেরল দ্রবীভূত হয় না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় ভেসে বেড়ায়। হৃদরোগীর ক্ষেত্রে বিপত্তি ঘটালেও কোলেস্টেরল আমাদের শরীরে এক অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। আমাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন নির্দেশ তড়িৎ তরঙ্গ হিসাবে সঞ্চারিত হয়। ইলেকট্রিক তারের ওপর যেমন রবার বা প্লাসটিকের তড়িৎ অপরিবাহী আস্তরণ থাকে; ঠিক তেমনভাবে কোলেস্টরল স্নায়ুতন্তুর ওপর তড়িৎ অপরিবাহী প্রলেপ তৈরি করে। ফলে অনুভুতি নির্দেশ সঞ্চারণে সহায়তা হয়। আমাদের মস্তিস্কের অন্যতম উপাদান হলো কোলেস্টেরল। এছাড়াও মহিলাদের যৌন হরমোন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। পাখি ও সরীসৃপের ডিমের কুসুমে প্রচুর মাত্রায় কোলেস্টেরল থাকে।
    সাধারণভাবে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন ২০০ থেকে ৮০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল খাদ্যের সঙ্গে গ্রহণ করে। প্রাণীজ ফ্যাটে যেহেতু কোলেস্টেরল থাকে, তাই যারা বেশি আমিষ খাদ্য খান তারাই বেশি কোলেস্টেরল পান। এছাড়াও আমাদের দেহের ভেতরেও কোলেস্টেরল তৈরি হয়। লিভার, অন্ত্র ও বিশেষ করে ক্ষুদ্রান্ত কোলেস্টেরল তৈরি করে। শরীরের অভ্যন্তরে কোলেস্টেরল বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়। এ থেকে তৈরি হয় স্টেরয়েড হরমোন, পিত্তরস। রক্তে কোলেস্টেরলের বিভিন্ন মাত্রা নিয়ন্ত্রণে লিভার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নেয়। এখানেই কোলেস্টেরল তৈরি, সঞ্চিত ও ধ্বংস হয়।
    গবেষণা থেকে জানা গেছে, খাদ্যে বেশি পরিমাণ কোলেস্টেরল থাকলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। যারা অতি পরিমাণ চর্বি জাতীয় খাবার খান তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে । যেসব দেশের লোকেরা তেল জাতীয় খাদ্য কম খান (যেমন-আফ্রিকা), তাদের রক্তে কোলেস্টেরল কম। আবার দেখা গেছে, যাদের খাদ্যে মুফা ও পুফা বেশি থাকে তাদেরও রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কম। গ্রিনল্যান্ডের এস্কিমোদের রক্তে কোলেস্টেরলের গড় মাত্রা ইউরোপীয়দের তুলনায় নিচের দিকে। এস্কিমোদের প্রধান খাদ্য সামুদ্রিক মাছ। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণ অ্যানস্যাচিউরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে।

    বিভিন্ন দেশের অধিবাসীদের মধ্যে কোলেস্টেরল মাত্রার পার্থক্য দেখা যায়। মার্কিনীদের রক্তে কোলেস্টেরলের গড় মাত্রা ২৩০-২৬০ মি.গ্রা/১০০মি.লি., ডাচ্দের ২৪০-২৪৫ মি.গ্রা./১০০ মি.লি., ইংরেজদের ১৫০-২০০ মি.গ্রা./ ১০০মি.লি.। আমাদের দেশের কোলেস্টেরলের গড় মাত্রা ১৬০-১৮০ মি.গ্রা./ ১০০মি.লি.।
    রক্তে কোলেস্টেরল সাধারণত এল.ডি.এল. হিসাবে থাকে। এল.ডি.এল. অস্থির পর্দাথ, পরবর্তী সময়ে এটি কোলেস্টেরলকে মুক্ত করে রক্ত নালীর ভেতরের দেওয়ালে জমা করে। কোলেস্টেরল অনেকটা নরম মোমের মত।

কোলেস্টেরল সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার সারাৎসার করলে দাঁড়ায় যে-
ক). স্বাভাবিকভাবে একজন পূর্ণবয়ষ্ক ব্যক্তি প্রতিদিন ৬০-৭০০ মি.গ্রা. কোলেস্টেরল খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করে। খাদ্যে বেশি মাত্রায় ‘সাফা’ থাকলে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। আর ‘পুফা’ থাকলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে।
খ). খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ কমানো যায়। যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি তাদের ভোজ্য তেলে পুফার পরিমাণ বেশি থাকা দরকার।
গ). ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়ষ্কদের ক্ষেত্রে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ২০০ মি.গ্রা./ ১০০ মি.লি. হলে করোনারি ধমনীর রোগের সম্ভাবনা প্রায় পাঁচগুণ বেড়ে যায়।
ঘ). পঞ্চাশ বছরের কম বয়সীদের যদি কোলেস্টেরল ২০০ মি.গ্রা./১০০ মি.লি.ও ট্রাইগ্লিসারাইড ২০০ মি.গ্রা./ ১০০ মি.লি.’র বেশি থাকে তবে হৃদ্রোগের সম্ভবনা বেশি থাকে।
ঙ). মহিলাদের রক্তে এইচ.ডি.এল.-এর মাত্রা পুরুষের তুলনায় প্রায় ২২ শতাংশ বেশি থাকে ।
চ). মহিলাদের যৌন হরমোন ইস্ট্রোজেন (Estrogen)  রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় আর পুরুষ হরমোন অ্যানড্রোজেন (Androgen)  কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
    প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যে কী পরিমাণ কোলেস্টেরল আছে তা দেখা যাক- জন্তুর ঘিলুতে-২২০০ মি.গ্রা., শুকরের মেটেতে-৪২৫ মি.গ্রা., ভেড়ার মেটেতে- ৫৫০ মি.গ্রা., গরু বা ছাগলের হার্টে-২৬০ মি.গ্রা., হাঁসের ডিমের কুসুমে-৭৫০ মি.গ্রা., বাগদা চিংড়িতে-৯৫ মি.গ্রা., গলদা চিংড়িতে-৯৫ মি.গ্রা., কাঁকড়াতে-৯২ মি.গ্রা., ছাগলের মেটেতে-৪০০ মি.গ্রা.।
    আমাদের এই পার্থিব শরীরে, কোলেস্টেরলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে ঠিকই, তবে তা মাত্রাতিরিক্ত হলেই বিপদ। শুধু এ ব্যাপারে কেন; জীবনের সব ক্ষেত্রেই তো এই সত্য প্রকাশমান। প্রাচীন প্রবাদ বলে -
“ অতিদর্পে হতা লংকা
অতি মানে চ কৌরবাঃ
অতিদানে বলিবর্দ্ধঃ
    সর্বমত্যন্ত-গহির্তম্ ।। ”

Join our mailing list Never miss an update