হৃদয়ের কথা; পর্ব-১৭; ইকোকার্ডিওগ্রাফি; ডাঃ পার্থপ্রতিম।
নিথরতা যেমন মৃত্যু, তেমনি স্পন্দন বা কম্পন হলো সজীবতার প্রকাশ। হৃৎপিন্ড যেহেতু মানবজীবনের প্রাণস্পন্দনের জীয়নকাঠি, তাই হৃদযন্ত্রের আনাচে-কানাচের সঠিক খোঁজখবর পেতে স্বাস্থ্য-প্রযুক্তিবিদদের মাথা ঘামানোর অন্ত নেই। হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরতে ইকোকার্ডিওগ্রাফি এক আধুনিক ব্যবস্থা। ইকোকার্ডিওগ্রাফি হলো হৃদয়ের বিভিন্ন অংশের মানচিত্র (Map) আঁকার পদ্ধতি।
শব্দসৃষ্টির মূলকথা হলো কম্পন। শব্দ সৃষ্টিকারী বস্তুটি প্রতি সেকেন্ডে যত বার কাঁপে তাকে বলে কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সি (Frequency)। সাধারণভাবে ২০ থেকে ২০,০০০ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ আমাদের কান শুনতে পায়। শব্দের কম্পাঙ্ক ২০,০০০-এর বেশি হলে তাকে বলে শব্দোত্তর তরঙ্গ বা আলট্রা সাউন্ড (Ultra sound) এই তরঙ্গ মোটামুটি সরলরেখায় চলাফেরা করে। ইকোকার্ডিওগ্রাফি করার কাজে এই আলট্রা সাউন্ডকে ব্যবহার করা হয়। ইকো (Echo)-এই গ্রিক শব্দকে বাংলায় প্রতিধ্বনি বলা যায়। শব্দ বা ধ্বনি যখন কোনো বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে তাকেই বলে প্রতিধ্বনি।
ইকোকার্ডিওগ্রাম যন্ত্র দিয়ে হার্টের দিকে পাঠানো হয় শব্দোত্তর তরঙ্গ। সেই শব্দ যখন হৃৎপিন্ডের বিভিন্ন অংশে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে, তখন তাকে প্রথমে বৈদ্যুতিক তরঙ্গে পরিণত করা হয়। তারপর বিশেষ চিত্রে রূপান্তরিত করে হার্টের কাজ-কারবার বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
আমাদের হৃদয় হলো চার-কামরাওয়ালা ছোট্ট বাড়ি। এই বাড়ির বিভিন্ন ঘরে যাওয়া-আসার জন্য রয়েছে কয়েকটি বিশেষ দরজা বা ভালভ। এই দরজাগুলি আবার একদিকে খোলে। অর্থাৎ এক ঘর থেকে শুধু অন্য ঘরে যাওয়া যায়, ফিরে আসতে গেলেই দরজা বন্ধ। ইকোকার্ডিওগ্রফির সাহায্যে হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ ও ভালভের কার্যকলাপ, রক্ত চলাচলের গতিপ্রকৃতি জানা যায়। এছাড়াও হৃদয়ের সংকোচন-প্রসারণের সময় হৃৎপিন্ডে কী পরিমাণ রক্ত ঢুকেছে ও বের হচ্ছে তাও ইকোকার্ডিওগ্রাফিতে ধরা পড়ে। এসব কারণে হৃদবিশেষজ্ঞ বা কার্ডিওলজিস্টরা রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রচলিত ই.সি.জি’র চেয়ে ইকোকার্ডিওগ্রাফির ওপর বেশি ভরসা করেন।
ইকোকার্ডিওগ্রাফি বিভিন্ন রকমের হয়। এম-মোড ইকোকার্ডিওগ্রাফি (M-mode Echo Cardiography), ক্রস সেকশনাল বা রিয়েলটাইম ইকোকার্ডিওগ্রাফি (Cross sectional or Real time echocardiography), ডপলার কার্ডিওগ্রাফি (Doppler cardiography) খুবই ব্যবহৃত হয়।
এম-মোড ইকোকার্ডিওগ্রাফি’র ক্ষেত্রে সূক্ষ শব্দোত্তর তরঙ্গ হৃৎপিন্ডের দিকে তাক্ করে পাঠানো হয়। বুকের ছাতি ভেদ করে এই তরঙ্গ হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন পেশিতে প্রতিফলিত হয়ে গ্রাহক যন্ত্রে ফিরে আসে। তারপর কাগজে বা অসিলোস্কোপে আঁকাবাঁকা রেখায় হৃৎপিন্ডের বিভিন্ন অংশের অবস্থা জানিয়ে দেয়। এম-মোড কার্ডিওগ্রাফি থেকে মাইট্রাল স্টেনসিস (Mitral Stenosis) বা হৃদয়ের দ্বিকপাটিয় ভালভ সরু হয়ে যাওয়া, পেরিকার্ডিয়াল এফিউশন (Pericardial Effusion) বা হৃদপিন্ড আবৃতপর্দা পেরিকার্ডিয়ামের দু’দেওয়ালের মাঝে রস জমা প্রভৃতি অসুখ সহজেই ধরা পড়ে। এছাড়াও এ ধরনের ইকোকার্ডিওগ্রাফি থেকে হৃদযন্ত্রের সঠিক আকার ও আয়তন মাপা সম্ভব।
ক্রস সেকশনাল বা রিয়েল টাইম ইকোকার্ডিওগ্রাফি’র ক্ষেত্রে আলট্রা সাউন্ড বিম একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল জুড়ে দুলতে থাকে। এই দোদুল্যমান রশ্মিটি হৃৎপিন্ডে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে তার গ্রাহক যন্ত্রে। তারপর টিভি ডিসপ্লে স্ক্রিনে এঁকে যায় বিভিন্ন লেখচিত্র। এই কার্ডিওগ্রাফির সাহায্যে আমরা হৃদযন্ত্রের ঠিক যে অঞ্চলের সম্বন্ধে জানতে চাই সেই স্থানটিকে টুকরো টুকরো (Slice) অবস্থায় দেখতে পারি। হৃদয়ের অলিন্দ-নিলয় ঠিক কোন্ তালে নড়াচড়া করছে তা দেখা যায় এই পদ্ধতিতে। সে কারণে একে রিয়েল টাইম ইকোকার্ডিওগ্রাফি বলে।
এই কার্ডিওগ্রাফির সাহায্যে এন্ডোকার্ডাইটিস বা হৃদযন্ত্রের ভেতরের পেশির রোগ, হৃৎপিন্ডের মধ্যে থাকা ধমনী-শিরায় রক্ত জমাট বাঁধা, হৃৎপেশির টিউমার সহজে সনাক্ত করা যায়। তাছাড়া শিশুর জন্মগত হৃদরোগ (Congenital Heart Disease) ধরার ক্ষেত্রে ক্রস সেকশনাল ইকোকার্ডিওগ্রাফি সঠিক উপায়।
ডপলার কার্ডিওগ্রাফি- শব্দের উৎস বা প্রতিফলক যত দ্রুত বেগে গ্রাহকের কাছে আসে ততই তার তীব্রতা (Pitch) বেড়ে যায়। যেমন-ট্রেন যখন হুইসেল দিতে দিতে স্টেশনে আসতে থাকে, তখন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের কাছে ট্রেনের শব্দ যতটা তীব্র লাগে, আবার যখন স্টেশন ছেড়ে ট্রেনটি চলে যেতে থাকে তখন তার তীব্রতা অনেক কমে যায়। একেই বিজ্ঞানের পরিভাষা বলে ডপলার এফেক্ট। অস্ট্রীয় গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ ক্রিস্টিয়ান জেহান ডপলার (Christian Johanan Doppler) তরঙ্গের এই বিশেষ ধর্মকে প্রথম ব্যাখ্যা করেন। শুধু শব্দের ক্ষেত্রেই নয়, পরবর্তীকালে দেখা গেছে আলো, এক্স-রশ্মি, গামা-রশ্মি বিভিন্ন তরঙ্গের ক্ষেত্রে ডপলার সাহেবের প্রভাব রয়েছে।
ডপলার কার্ডিওগ্রাফির সময় ডপলার প্রভাবকে কাজে লাগানো হয়। আলট্রা সাউন্ড বিম একটি নির্দিষ্ট ছন্দে হৃদযন্ত্রের কাছে আসে আবার দূরে চলে যায়। অলিন্দ-নিলয়-ধমনী-শিরার মধ্যে চলমান রক্তকণিকার ও পেশির ওপর প্রতিফলিত হয়ে গ্রাহক যন্ত্রে ফিরে আসে ও ছবি আঁকে। কালার ডপলার কার্ডিওগ্রাফিতে রঙ-বেরঙের ছবি পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে রক্তের অস্বাভাবিক প্রবাহ, অ্যাওর্টিক বা মাইট্রাল রিফ্লাক্স (Aortic or Mitral reflux) অর্থাৎ মহাধমনীর ও মাইট্রাল কপাটিকা থেকে রক্ত পেছনে ফিরে আসা প্রভৃতি জানা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এম-মোড ইকোকার্ডিওগ্রাফি ও রিয়েলটাইম ইকোকার্ডিওগ্রাফির পর রোগ সম্বন্ধে আরো নিশ্চিত হতে ডপলার কার্ডিওগ্রাফি করা হয়।
মানব শরীরে হৃদযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। দেহকে সুস্থ-নীরোগ রাখতে হৃদয়ের বিভিন্ন অংশের সুলুক-সন্ধান তাই অত্যন্ত জরুরি। এ কাজে ইকোকার্ডিওগ্রাফির জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান।