ই.সি.জি.-হৃদয়ের লেখচিত্র; ডাঃ পার্থ প্রতিম। ১৭ই আগষ্ট ১৯৯৮; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
লাব্-ডুব্-লাব্-ডুব। আপনার বুকের গভীর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে উঠে আসছে জীবনের সা-রে-গা। সোনালী প্রভাত থেকে উষ্ণ দুপুর পেরিয়ে গোধূলি। গোধূলি থেকে রাতের আঁধার বৃন্ত ছেঁড়া ফুটন্ত সকাল। এর কোন বিরাম নেই। মাতৃজঠর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কাজ করে যাওয়া হৃদয়ের মূল চাবিকাঠিটি লুকিয়ে আছে বৈশিষ্ট্যময় হৃৎপেশির মাঝে।
হৃদযন্ত্রের ভেতরে আছে কতগুলি বিশেষ কোষ যার নাম পেসমেকার কোষ (Pacemaker Cell) । এদের কোষ না বলে বৈদ্যুতিক সেল বা ব্যাটারি বলা যায়। পেসমেকার থেকে তৈরী হয় বৈদ্যুতিক তরঙ্গ। হৃৎপিন্ডের ডান অলিন্দের প্রাচীরে থাকা সাইনো অরিকুলার পর্ব (Sino Auricular Node) থেকে ঋণাত্মক তড়িৎ তরঙ্গ (Negative Electrical Wave) অলিন্দের প্রাচীরে প্রবাহিত হয়। এই তড়িৎ তরঙ্গ নিয়মিত ভাবে এক নির্দিষ্ট মাত্রায় হার্টের অলিন্দ ও নিলয় দুটিকে সংকুচিত ও প্রসারিত করে। আসলে আমাদের ‘দিল কি ধড়কনের’র মূল উৎস হল সুনির্দিষ্ট তালে বয়ে যাওয়া এই তড়িৎ প্রবাহ।
হৃৎপিন্ডের ভেতরে চলা এই তড়িৎ স্পন্দন শরীরের ওপরকার চামড়াতেও অনুভব করা যায়। ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম বা সংক্ষেপে ই.সি.জি (E.C.G.) যন্ত্রের সাহায্যে আঁকাবাঁকা রেখায় আঁকা হয় এই তড়িৎ তরঙ্গ। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের জানা হয়ে যায় হৃদযন্ত্রের ঐ বৈদ্যুতিক কাজ-কারবার। তারপরেই চলতে থাকে এই তড়িৎ তরঙ্গকে যন্ত্রবন্দী করার প্রয়াস। অনেক প্রচেষ্টার পর বিজ্ঞানী ওয়েলার (Waller) ১৮৮৭ সালে তৈরি করেন পৃথিবীর প্রথম ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম যন্ত্র। তবে এটি ব্যবহারের ক্ষেত্র ছিল অনেকটাই গোদা ধরনের। তড়িৎ প্রবাহের হেরফের বোঝার কাজে ওয়েলার সাহেব ব্যবহার করেন স্থূল ক্যাপিলারী ইলেকট্রোমিটার ।
বিজ্ঞানী ওয়েলারের এই আবিষ্কারের পর থেকে ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম যন্ত্রকে উন্নত করার কাজে শুরু হয় ব্যাপক গবেষণা। উইলিয়াম ইনথোভেন (William Einthoven) ১৯০৩-এ তৈরি করেন চিকিৎসা কাজে ব্যবহারের উপযোগী ই.সি.জি. মেশিন। ইনথোভেনের-এর এই কাজ সহজ হয় স্ট্রিং গ্যালভানোমিটার ব্যবহার করার ফলে। যদিও দেরিতে তবুও তিনি তার কাজের যোগ্য স্বীকৃতি পান। ১৯২৪ সালে এক সন্ধ্যায় উইলিয়াম ইনথোভেন-এর হাতে তুলে দেওয়া হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার।
প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের সময় সারা শরীরে যে একটা মৃদু বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে যায়; তা শরীরের কয়েকটি বিশেষ স্থানে ইলেকট্রোড বা তড়িৎদ্বার বসিয়ে তড়িৎ তরঙ্গের গ্রাফ তৈরি করাই ইলেকট্রিাকার্ডিওগ্রাম যন্ত্রেরকাজ। হার্টের সংকোচন ও প্রসারণের সময় যে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তাতে ই.সি.জি. যন্ত্রের ভেতর থাকা বিশেষ পেন বা নিড্ল সচল হয়ে ওঠে। ফলে চলমান গ্রাফ পেপারের ওপর আঁকাবাঁকা দাগ কাটতে কাটতে যায়।
স্বাভাবিকভাবে ই.সি.জি.-তে যে লেখচিত্র তরঙ্গ পাওয়া যায় তাতে PQRST এই ভাবে শীর্ষবিন্দুগুলির নামকরণ করা হয়। আসলে ABCDএই ইংরেজি অক্ষরগুলি নামকরণের কাজে খুবই ব্যবহৃত হয়। সেই কারণেই চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অন্য রকমের নাম দিয়েছেন। তড়িৎ তরঙ্গের মধ্যরেখা অর্থাৎ আইসোইলেকট্রিক লাইন (Isoelectric)-কে ‘O’ দ্বারা বোঝোনো হয়। আমরা জানি স্বাভাবিক অবস্থায় একটি পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির হৃদয় প্রতি মিনিটে ৭২বার স্পন্দিত হয়। অর্থাৎ ৬০/৭২ = ০.৮ সেকেন্ডের মধ্যে একবার হৃদযন্ত্রের সংকোচন ও প্রসারণ চক্র হয়ে থাকে। সুস্থ-স্বাভাবিক হৃৎপিন্ডের PQRST তরঙ্গ ০.৮ সেকেন্ডে সম্পূর্ণ হবে।
ই.সি.জি করার সময় শরীরের বিভিন্ন অংশে তড়িতের মাত্রা নির্ণয় করার জন্য তড়িৎদ্বার বা লিড (Lead) লাগানো হয়। লিডের এই অবস্থানগুলিকে প্রচলিতভাবে নামকরণ করা হয়-
লিড-১ ডান হাত ও বাঁ-হাত
লিড-২ ডান হাত ও বাঁ-পা
লিড-৩ বাঁ-হাত ও বাঁ-পা
লিড-৪ বুকে
এই সব ধাতব তড়িৎদ্বারগুলি দেহের সঙ্গে লাগানো হয় বেল্ট বা চিমটের সাহায্যে। তড়িৎ তরঙ্গ যাতে দেহের উপরিত্বক থেকে সঠিক ভাবে লিডে পৌঁছায় সে কারণে সংশ্লিষ্ট জায়গায় লাগানো হয় বিদ্যুৎ পরিবাহী মলম।
P তরঙ্গ অলিন্দের সংকোচনকে সূচিত করে এর বিস্তার ০.০১ থেকে ০.১২ সেকেন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। হৃদযন্ত্রের অলিন্দের ত্রুটি এই P তরঙ্গ দেখে বোঝা যায়। যেমন-বাম অলিন্দ ও নিলয়ের মাঝে থাকা মাইট্রাল কপাটিকার অসুখ মাইট্রাল স্টেনসিস (Mitral Stenosis), বাম অলিন্দের বিবর্ধন (Hypertrophied) প্রভৃতি ক্ষেত্রে P তরঙ্গ সূঁচালো হয়।
QRST তরঙ্গ নিলয়ের সংকোচনকে সূচিত করে। আসলে Q তরঙ্গ থেকে ডান ও বাম নিলয়ের মধ্যবর্তী প্রাচীরের অবস্থা বোঝা যায়। সরীসৃপ ও উভচর প্রাণীদের ( যেমন-ব্যাঙ, গিরগিটি ) ই.সি.জি. করে দেখা গেছে সেখানে Q বিন্দুর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। শিশুদের হৃদয়ের লেখচিত্রে যদি Q তরঙ্গ দেখা না যায় তবে বুঝতে হবে সে আন্তঃনিলয়পর্দার ত্রুটি (Ventricular Septal Defect) নিয়ে জন্মেছে। বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে Q তরঙ্গ সুস্পষ্ট ও সূঁচালো হবে যদি তার আগে কোনো সময় মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন (Myocardial Infraction) হয়ে থাকে। অনেক হৃদরোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের অজান্তে হার্ট অ্যাটাক হয়। অর্থাৎ বড়ো রকমের অসুস্থতা ছাড়াই অল্প সময়ের জন্য ইনফ্রাকশন হয়। প্রচলিত ভাষায় একে বলে সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক। Q বিন্দু থেকে এ ধরনের হার্ট অ্যাটাকের খবর পাওয়া যায়।
R হৃদয় লেখচিত্রের সর্বোচ্চ বিন্দু। Q তরঙ্গ থেকে হঠাৎ খাড়া ভাবে ওপরে উঠে যায়। R ডান নিলয়ের অবস্থা সূচিত করে। ডান নিলয় থেকে অক্সিজেন পূর্ণ রক্ত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তাই ডান নিলয়ের সঠিক কাজ-কারবারের সঙ্গে দেহের সকল অঙ্গ যন্ত্রের কার্যকারিতা প্রভাবিত হয়। ডান নিলয়ের কোন ত্রুটি থাকলে RS তরঙ্গ থেকে তা জানা যায়। যেমন - বান্ডল্ ব্রাঞ্চ হার্টব্লকের (Bundle branch Heart Block) ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের সময়ে ০.১ সেকেন্ড থেকে বেশি হয় ও R বিন্দুর উচ্চতারও পরিবর্তন দেখা যায়।
T তরঙ্গের সাধারণ ব্যাপ্তি ০.২৭ সেকেন্ড। নিলয়ের নিচের অংশের সংকোচন বোঝা যায় T ঢেউ দ্বারা। যৌবনে সতেজ হৃদয়বান ব্যক্তির T তরঙ্গ বেশি সুস্পষ্ট থাকে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের হৃদযন্ত্র ই.সি.জি-তে T তরঙ্গ অনেকটাই স্পষ্টতা হারায়। ভেগাস বা সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রের ত্রুটি, ডিজিটেলিস বা ঐ জাতীয় কোনো হার্টের ওষুধ ভুল মাত্রায় খেলে T তরঙ্গের হেরফের দেখা যায়।
সাধারণত বিশ্রামরত অবস্থায় ই.সি.জি. করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিশ্রামের সময় হৃদরোগীর হৃদযন্ত্র স্বাভাবিকভাবে কাজ করে কিন্তু রোগী যখন পরিশ্রম করে তখন হৃদপিন্ডের গোলযোগ নজরে পড়ে। ‘ইস্কিমিক হার্ট’ রোগীর ক্ষেত্রে এই ধরনের অসুবিধা দেখা যায়। তাই অনেকক্ষেত্রে এই রোগীকে পরিশ্রম করিয়ে ই.সি.জি. করানো হয়, একে বলে স্ট্রেস ই.সি.জি.। রোগীকে চলমান প্লাটফর্মের ওপর দৌড়াতে হয় বা বিশেষ ধরনের স্থির বাইসাইকেলে (Bicycle ergometer) প্যাডল করতে হয়। এই পরীক্ষার আর এক নাম ট্রেড মিল টেস্ট (Tread Mill Test; TMT)। অর্থাৎ রোগীকে পরিশ্রম করানো মানে তার হৃদযন্ত্রকে পরিশ্রম করানো। আমরা যখন শারীরিক পরিশ্রম করি তখন হৃৎপিন্ডের কাজও বেড়ে যায়। ফলে এই সময়ে ই.সি.জি. করলে অনেক লুকানো ব্যাধি ধরা পড়ে। বর্তমানে সিক্স চ্যানল, টুয়েলভ্ চ্যানেল ই.সি.জি. মেশিন বাজারে এসেছে। এসবের সাহায্যে আরো সূক্ষ্ম ও সঠিকভাবে হৃদরোগ নির্ণয় সম্ভব।
অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, হৃদযন্ত্রের কাজ-কারবার দিনের কোনো কোনো সময় হঠাৎই অনিয়মিত হয়ে পড়ে। কিছু সময় পরে আবার তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। এসব রোগীদের ই.সি.জি.-তে কোনো ত্রুটি ধরা নাও পড়তে পারে। এই সমস্যা সমাধানে করতে করা হয় ২৪ ঘন্টা হল্টার মনিটারিং (24 hrs. Holtermonitoring)। এটি মোবাইল ফোনের মতো একটি ছোট্ট যন্ত্র। ই.সি.জি.’র মতোই এর ইলেকট্রোডগুলি রোগীর শরীরে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটি নিয়ে রোগী তার মতো চলাফেরা কাজকর্ম করে যায়। আর হল্টার মনিটার হৃদযন্ত্রের ই.সি.জি. ২৪ ঘন্টা ধরে রেকর্ডিং করে যায়। পরে অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা এই যন্ত্রটি চালিয়ে রোগীর হৃদযন্ত্রের হাল হকিকৎ কোন্ সময় কেমন ছিল তা জেনে যাবেন।
হার্টের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠের আয়তন, হৃদযন্ত্রের আকার ঠিক আছে কি না? হার্টের আচ্ছাদনের ব্যথা, অ্যানজাইনা, হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ, ই.সি.জি. থেকে জানা যায়। আমরা জানি দেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হলো হৃদয়। হৃদযন্ত্রের সব অংশের কারবার সঠিক ছন্দে চলছে কি না তা বোঝা যায় ই.সি.জি.থেকে। সহজভাবে বলতে গেলে সুছন্দই হলো সাবলীল প্রাণের প্রকাশ। আর ছন্দ পতন হলেই বিশৃঙ্খলা, তা সে যাই হোক-জীবন মৃদঙ্গের তাক্-ডুম-তাক্-ডুম বা হৃদয়ের লাব্-ডুব-লাব্-ডুব্।