হৃদয়ের কথা; পর্ব-১৫; গর্ভবতীর হৃদরোগ

হৃদয়ের কথা; পর্ব-১৫; গর্ভবতীর হৃদরোগ

হৃদয়ের কথা; পর্ব-১৫; গর্ভবতীর হৃদরোগ; -ডাঃ পার্থপ্রতিম।
উত্তেজনার পারদ এখন লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছে। দীর্ঘরোমহর্ষক নাটকের অন্তিম দৃশ্য। শরীরের মাপজোখ, অঙ্গভঙ্গী, ফটোজনিক টেস্ট-এসব কিছুর শেষে এখন চরম পরীক্ষা, প্রশ্নের বাণ। নারীর জীবনে শ্রেষ্ঠত্ব কিসে? উত্তরে বিশ্বসুন্দরী জানালো-‘এক সুন্দর শিশুর মাতৃত্বই নারীর জীবনের চরম পূর্ণতা।’
    কথাটির মধ্যে চমক থাকলেও নতুনত্ব নেই। কে না জানে-স্নেহ বিহ্বল করুণা ছলছল, শিয়রে জেগে থাকা ঐ দুটি আঁখির জন্যই আমাদের জীবন এত রঙ্গিন স্বপ্নে ভরপুর। অন্যসব প্রসঙ্গ না হয় ছেড়েই দিলাম; শুধু গর্ভসঞ্চার থেকে শিশুর জন্ম পর্যন্ত মা যে কষ্ট স্বীকার করে, তা সত্যই অতুলনীয়।
    এবার ডাক্তারি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখা যাক। গর্ভাবস্থায় হৃদযন্ত্রের কার্যকলাপ প্রায় ত্রিশ শতাংশ বেড়ে যায়। বেড়ে যায় হৃৎস্পন্দের হার ও রক্তের পরিমাণ। ভাবী মা নিজের পুষ্টি ও অক্সিজেনের সাথে সাথে গর্ভস্থ ভ্রূণকেও রসদ যোগায়। স্বাভাবিকভাবেই এ সময় মহিলাদের মধ্যে কিছু শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন- প্রথম হৃদধ্বনি  (First Heart Sound) বেশ জোরে হয়, ডায়াস্টোলিক প্রেসার কমে আসে, হৃদযন্ত্র সংকোচনের সময় ফুসফুসীয় ধমনী ও মহাধমনীর কাছে মার্মার শোনা যায়, বেড়ে যায় শিরার রক্তচাপ (Venous pressure), গোড়ালির কাছে অল্পস্বল্প ফোলাভাব-এসবই গর্ভাবস্থার স্বভাবিক লক্ষণ।
    যে সব বালিকা হৃদযন্ত্রের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়, তারা পরবর্তীকালে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর বিশেষ কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হন। উপসর্গগুলি সাধারণত দেখা দেয় গর্ভধারণের ১২ সপ্তাহ পর থেকে। তবে ২৪ সপ্তাহ পর থেকে অসুবিধাগুলি সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়।
    গর্ভবতীর হৃদরোগের অন্যতম লক্ষণ হলো শ্বাসকষ্ট ও দেহের বিভিন্ন অংশ ফুলে যাওয়া। এসময়ে যে রোগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনে তা হলো মাইট্রালভালভ সংকুচিত হওয়া বা মাইট্রাল স্টেনসিস। এরফলে নিঃশ্বাসের কষ্ট, কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া, গলার শিরা ফুলে ওঠা, পায়ে খুব ফোলাভাব, হৃৎস্পন্দনের গতি খুব দ্রুত ও কোনো কোনো সময় অনিয়মিত এছাড়াও আরো বহু উপসর্গ দেখা যায়। যদি কোন মহিলার এ রোগ আগে ভাগেই ধরা পড়ে তাহলে প্রথম থেকেই চিকিৎসা করা দরকার। গর্ভসঞ্চারের পর মাইট্রাল বেলুন ভালভিউলোপ্লাস্টি (Mitral ballon valvuloplasty) করে সংকুচিত কপাটিকাকে প্রসারিত করা যায়। তবে গর্ভধারণের ১৬ সপ্তাহের মধ্যেই ভালভিউলোপ্লাস্টি করা উচিত। এসব রোগিণীদের লবণ খুব কম খেতে হবে। ডাক্তারবাবুরা এ ধরনের রোগিণীর হৃৎস্পন্দন নিয়মিত করার ওষুধ বা অ্যান্টি অ্যারিদমিক ড্রাগ (Anti Arrhythmic Drug) -এর সাথে প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধও (Diuretics) দেন।

   গর্ভিণীর আর একটি মারাত্মক হৃদরোগ হল অ্যাওর্টিক স্টেনসিস। বাম নিলয় থেকে উঠে যাওয়া মহাধমনীর মুখে যে অ্যাওর্টিক ভালভ থাকে, তা সরু হয়ে গেলে দেখা দেয় বহু রকমের বিপত্তি। ভাবী মা’র বুকে ব্যথা, কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (Syncope), বিশেষত সিস্টোলিক রক্তচাপ কমে যাওয়া, প্রচন্ড দুর্বলতা-এসবের লক্ষণ ফুটে ওঠে। এক সমীক্ষায় জানা গেছে, সন্তান প্রসবের সময় যত মহিলা হৃদরোগে মারা যান (Maternal Mortality), তার প্রায় ১৫ শতাংশ অ্যাওর্টিক স্টেনসিসের  শিকার ।
    যে সব মহিলার ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ্ আছে তাদের গর্ভাবস্থায় বিশেষ নজর দিতে হবে। এসময়ে ধারে কাছে অক্সিজেন গ্যাস সিলিন্ডার ও স্যালাইনের ব্যবস্থা রাখা দরকার। কারণ যখন তখন প্রয়োজন হতে পারে। আগে থেকে গুরুত্ব না দিলে শেষে মা ও ভ্রূণের মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।
    হৃদ্পেশীর ভেতরের স্তরটির নাম এন্ডোকার্ডিয়াম (Endocardium)। এখানে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে তাকে বলি ব্যাকটেরিয়াল এন্ডোকার্ডাইটিস (Bacterial Endocarditis)। রোগিণীর যদি আগে কখনো এরোগ হয়ে থাকে তবে গর্ভাবস্থায় প্রতিষেধক হিসাবে অ্যান্টিবায়টিক ওষুধ নিতে হয়। ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, যক্ষা এসব অসুখ বেশি দিন ধরে থাকলে, ফুসফুসের রক্তজালকগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরফলে ফুসফুসীয় ধমনীর রক্তচাপ বেড়ে যায়। যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে পালমোনারি হাইপারটেনশন (Pulmonary Hypertension)। ফুসফুসে রক্ত থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যায়, রক্তে অক্সিজেন আসে। কিন্তু পালমোনারি হাইপারটেনশন থাকলে রক্তে কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা বাড়ে, দেখা দেয় অক্সিজেনের অভাব। ফলস্বরূপ ভাবী মা’র শরীর নীলচে হয়ে যেতে দেখা যায়। একে আমরা বলি ম্যাটারনাল সায়ানোসিস (Maternal cyanosis)। এ থেকে অনেক সময় গর্ভস্থ ভ্রূণ মারা যেতে পারে।
    যাদের হৃদযন্ত্রের ভালভ পাল্টে কৃত্রিম কপাটিকা বসানো হয়েছে তাদের নিয়মিত রক্তজমাট না বাঁধার ওষুধ (Anti-coagulating drug)  খেতে হয়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এধরনের ওষুধ খেলে ভ্রূণের  দেহ থেকে রক্তপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই অসুবিধা এড়াতে গর্ভিণী হিপারিন (Heparin) জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন । কারণ ভ্রূণের ওপর হিপারিনের কোন বিরূপ প্রভাব নেই।
    এসব ছাড়াও যে সব মহিলাদের আন্তঃঅলিন্দ বা আন্তঃনিলয় প্রাচীরে ছিদ্র, হাইপারট্রফিকার্ডিও মায়োপ্যাথি থাকে তাদের গর্ভাবস্থায় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। গর্ভবতীর রক্তে শর্করার মাত্রা বেশী হলে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর প্রবণতা বেশী থাকে। তাই ডায়াবিটিস থাক বা না থাক, গর্ভাবস্থায় প্রথম ১০ সপ্তাহ ও ৩১ সপ্তাহের পর থেকে ভাবী মা’র চিনি বা অন্যকোন মিষ্টি খাবার না খাওয়াই ভালো। অন্তঃসত্ত্বা হৃদরোগিণীর পূর্ণবিশ্রাম ও ঘুম দরকার।
    যে সব মহিলার হৃদরোগ আছে তাদের প্রসব যন্ত্রণা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বা আগে সিজারিয়ান ডেলিভারী (Cesarean Delivary) করে দেওয়া দরকার। আসলে স্বাভাবিক প্রসবের সময় প্রসব বেদনার ফলে হৃদযন্ত্রে খুবই চাপ পড়ে। যাদের হৃদরোগ  আছে  তাদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক আকার নিতে পারে। প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে গর্ভপাত ঘটিয়ে মা’র প্রাণ রক্ষা করতে হবে। সব সময় মনে রাখতে হবে যদি সংকট আসে তবে আগে মা-কে বাঁচাতে হবে, পরে সন্তানের ভাবনা।
    গর্ভাবস্থায় যদি দেখা যায়-গর্ভিণী কিছু সময় পর পর অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন, শরীরের ত্বকে নীলচে ভাব দেখা দিচ্ছে, বুক ধড়ফড়ানি (Palpitation) খুব বেশি, কাশির সঙ্গে সঙ্গে রক্ত পড়ছে, হাত-পা-মুখ বেশ ফুলে গেছে, উচ্চরক্তচাপ (১৩০/৯০mm.Hg.-র বেশি) তবে স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সঙ্গে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।

    গর্ভাবস্থায় হৃদরোগ দেখা দিলেও; শৈশব-কৈশোরেই হিয়ার মাঝে এ ব্যাধির বীজ বপন হয়। কিছু মাধ্যমিক স্কুলে সমীক্ষা চালিয়ে জানা গেছে-প্রতি একশো জন বালিকার মধ্যে দু’জন কোনো না কোনো হৃদরোগে আক্রান্ত। অপুষ্টি, দারিদ্র, স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞানের অভাব সৃষ্টি করে এই মারণ ব্যাধি। চটক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা প্রতিশ্রুতি পালনের প্রতিশ্রুতি নয়। এসবের মোকাবিলা করতে চাই সঠিক পরিকল্পনা ও তার আন্তরিক রূপায়ণ।

Join our mailing list Never miss an update