হৃদয়ের কথা পর্ব-১৩; মানসিকতা ও হৃদরোগ

হৃদয়ের কথা পর্ব-১৩; মানসিকতা ও হৃদরোগ

  মানসিকতা ও হৃদরোগ; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ১৮ই নভেম্বর ১৯৯৬; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
    নিচের চোয়াল সামান্য ঝুলানো, চুরুটটি ঠোঁটের কোণে, চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি আর অতৃপ্তির ছাপ। হ্যাঁ, এটুকু বিবরণেই অফিসের সবাই বুঝে ফেলবে মি. স্যানিয়ালের কথা বলছি। পুরো নাম শ্রীযুক্ত গৌরগোপাল সান্যাল। তাঁর এই আদ্যিকালের নাম রাখার জন্য তিনি মনে মনে পিতৃদেবের ওপরেও বিরক্ত। দাসবাবু ষোলো বছর ধরে অ্যাকাউন্টস্ সেকশনে আছেন। মি.স্যানিয়ালের মুখে কখনো হাসি দেখেন নি। সাধারণত ক্লার্ক থেকে ক্রমে ক্রমে সিঁড়ি ভেঙ্গে আজ তিনি বি.আর. কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার অব সেলস্। না, তাতেও খুশি নন স্যানিয়াল সাহেব, তাঁকে আরো ওপরে উঠতে হবে। অফিস থেকে ফেরার সময় ব্রিফকেস ভর্তি করে ফাইল-পত্র নিয়ে ঘরে ফেরেন। তাঁর দাপটে গিন্নি মুখ খুলতে পারেন না। বাড়ির সবাই তটস্থ। সময়ের অপচয় তিনি বরদাস্ত করবেন না।



    হ্যাঁ, এইসব স্যানিয়ালদের শহর-নগরে আপনারাও হয়তো দেখে থাকবেন। কার্ডিওলজির পরিভাষায় এদের ‘এ’ ব্যক্তিত্বের মানুষ বলা হয়।
    তখন ১৯৫৮ সাল। ক্যালিফোর্নিয়ার দু’জন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ রে.এইচ. রোজেনম্যান (Ray H. Rosenman) ও মেয়ার ফ্রিডম্যান ((Mayer Friedmen) হঠাৎ একদিন এক মজার বিষয় লক্ষ্য করলেন। তাঁদের ক্লিনিকের ওয়েটিং রুমে রাখা চেয়ারের গদিগুলির সামনের দিক ঘষায় ঘষায় ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু পেছনের দিকে হেলান দেবার জায়গাগুলি প্রায় নতুনের মতোই আছে। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে রোজেনম্যান ও ফ্রিডম্যান বললেন, তাদের কাছে আসা রোগীরা সবসময় উত্তেজিত থাকেন। তাই তারা ঠিকমতো আরাম করে বসতে পারেন না। এ ধরনের ব্যক্তিত্বই হৃদরোগের অন্যতম কারণ।
    শুরু হয়ে গেল হৈ-হট্টগোল, বিতর্ক, হাসি-ঠাট্টা। কয়েকজন ডাক্তার এই দু’জনের উপাধি দিলেন সোফালজিস্ট। পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রকৃত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াই বিজ্ঞান। রোজেনম্যান ও ফ্রিডম্যান তাদের ৩১৫৪ জন রোগীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে, হৃদরোগীদের দু’ভাগে ভাগ করলেন। ‘এ’ টাইপ ও ‘বি’ টাইপের পার্সন্যালিটির মানুষ। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানুষের এই আচরণগত তফাৎকে ইংরাজীতে বলে-Psychodynamic behavioural characteristics classification। ‘এ’ টাইপের মানুষেরা সব সময় উৎকন্ঠিত ও অস্থির থাকেন, কোনো জিনিসের জন্য অপেক্ষা করা বা লাইনে দাঁড়ানো তাদের ধাতে সয় না। অত্যধিক উচ্চাভিলাষী, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান। এরা সংখ্যা দিয়ে সাফল্য বিচার করে; যেমন-লেখক হলে ক’টা বই লিখবেন? ডাক্তার হলে ক’টা রোগী দেখলেন, মাসে কত আয় হয়? কোনো পরাজয়কেই এরা সহজভাবে নিতে পারেন না, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে নেমেও প্রবলভাবে জেতার চেষ্টা করেন। কাউকেই বিশ্বাস করেন না, সবসময় সতর্ক থাকেন।
    আর  টাইপ ‘বি’ ব্যক্তিত্বের মানুষেরা অন্য ধরনের। এরা শান্তিপ্রিয়, কোনোরকম ঝামেলায় সহজে থাকতে চান না। কুঁড়ে না হলেও খুব একটা কর্মোদ্যোগী নন। বাড়ির টিভিটা সাদা-কালো বলে লজ্জিত নন। ছেলে-মেয়ে থার্ড ডিভিশনে পাস করলেও পড়শীদের মিষ্টি খাওয়ান। ছুটির দিনে রান্নাঘরের দোরগোড়ায় বসে গিন্নির ফাইফরমাশ খাটেন। তারপর অন্ধ্র-রুইয়ের কালিয়া খেয়ে দুপুরবেলায় সুখনিদ্রা দেন।

    রোজেনম্যান ও ফ্রিডম্যানের সমীক্ষা থেকে জানা গেছে ‘বি’ থেকে ‘এ’ টাইপ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের হৃদরোগের সম্ভাবনা সত্তর শতাংশ বেশি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন অনুসন্ধান চালিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা দেখেছেন- আমাদের দেহের মধ্যে থাকা অন্তঃক্ষরা হরমোন গ্রন্থিগুলি মানসিক আচরণ ও ব্যক্তিত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়। অত্যধিক মানসিক চাপের জন্য রক্তের অ্যাড্রিনালিন (Adrenalin), নর-অ্যাড্রিনালিন, কার্টিজল (Cartisol), টেস্টোস্টেরোন (Testosterone)  প্রভৃতির মাত্রা বেড়ে যায়। এরই ফলে বেড়ে যায় ব্লাডপ্রেসার ও করোনারি ধমনী রোগের সম্ভাবনা, কমে আসে ঘুম। স্বয়ংক্রিয় স্নায়বিক তন্ত্র বা অটোনমাস নার্ভাস সিস্টেমেও এসবের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে।
    সর্বদাই সিঁড়ি ভাঙ্গতে হবে, সব বিষয়েই আমাকে প্রথম হতে হবে, নিজের সাফল্য বা ব্যর্থতাই সবচেয়ে বড়ো কথা। অন্যের সাফল্য আমাদের আনন্দিত করে না। তথাকথিত ইঁদুর দৌড়ে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সবাই ধাবমান। এই মানসিকতাই যে হৃদরোগের অন্যতম কারণ তা  রোজেনম্যান ও ফ্রিডম্যানের গবেষণা থেকে প্রমাণিত। মানসিক চাপ এড়াতে গেলে ধীরে চলার নীতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে সেই কচ্ছপ ও খরগোশের গল্পটি মনে আসে ‘Slow and Steady wins the race’। বাড়ি তৈরি করা, গাড়ি চালানো, মেয়ের বিয়ে এসব কাজ ধীরে সুস্থে করবেন। হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে কাজে নামবেন। কাজ ফেলে না রেখে প্রতিদিন অল্প অল্প করে তা শেষ করতে হবে। কোনো জায়গায় পৌঁছতে গেলে বা ট্রেন-গাড়ি-ফ্লাইট ধরার ব্যাপার থাকলে হাতে সময় নিয়ে বের হবেন। দরকার হলে স্টেশন বা এয়ারপোর্টে আগে পৌঁছান।
    মনে বেশি উদ্বেগ বা চাপ থাকলে হাত, চোয়াল ও শরীরের মাংসপেশী আলগা করে দেওয়ার চেষ্টা করুন। ধ্যানও করতে পারেন। দু’চোখ বন্ধ করে নিজের পছন্দের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি কল্পনা করুন। তিনি আপনার আরাধ্য দেবতা, মা-বাবা, আদর্শ শিক্ষক, ধর্মীয় গুরুদেব যে কেউ হতে পারেন।
    নিজের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিতে হবে। বিশ্বের সবকিছু আপনার মনের মতো চলবে-এটা ভাবা ঠিক নয়। আপনার যা আছে তা যেন ঘুচে না যায়, যা নেই তার শোকে। আপনার চেয়ে বুদ্ধিমান ও আপনার চেয়ে নির্বোধ লোক অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে-এটাই অপ্রিয় সত্য। অন্যের নিন্দা বা সমালোচনা সবসময় এড়িয়ে চলুন। আপনার অপছন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হলে বিতর্ক বা ঝামেলা এড়াতে স্থান ত্যাগ করুন।
    হৃদয়কে প্রাণোচ্ছল রাখতে সর্বদা খুলে দিতে হবে মনের সব বাতায়ন। বেলা-অবেলায় স্মরণ করতে হবে অসীম-অনন্ত এই বিশ্বের মাঝে, বৈচিত্র্যময় প্রাণের মেলায় আমাদের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব কতটুকু। সহজভাবে মেনে নিতে হবে বিগত অতীত, ঘটমান বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যতকে। শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতার সেই শ্লোকটি মনে আছে তো-
‘‘কর্মণ্যে বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।।’’
    আপনার সব প্রয়াস সফল হবে এটা ভাবা ঠিক নয়। অনেকে উত্তেজনা কমাতে ট্রাঙ্কুলাইজার (Tranquilliser) অথবা ঘুমের ওষুধ খান। সাময়িকভাবে কষ্ট কিছুটা লাঘব হলেও; এটি সমস্যা সমাধানের পথ নয়। বরং নিয়মিত এ ধরনের ওষুধ খেয়ে আসক্ত বা নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারেন। যাইহোক, যারা সত্যই সুস্থ সবল হৃদয় নিয়ে জীবনের বাকি ক’টা দিন আনন্দ-প্রশান্তির মধ্যে কাটাতে চান- তাদের জন্য একটি মন্ত্র দিতে পারি। সব সময় মনে রাখবেন-
‘‘যা কিছু পেয়েছি কাছে
তাই সঞ্চয়,
যা কিছু পেলাম না তো-
সে আমার নয়।’’

Join our mailing list Never miss an update