হৃদয়ের কথা; পর্ব-১২; হৃৎপেশির ব্যাধি

হৃদয়ের কথা; পর্ব-১২; হৃৎপেশির ব্যাধি

হৃদয়ের কথা; পর্ব-১২; হৃৎপেশির ব্যাধি
    দু’পারে দু’জন। জন্ম আর মৃত্যু। মাঝে কান্না-হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা- এই তো জীবন। আর হৃদয় হ’ল সেই অঙ্গ যার নড়াচড়ার মধ্যেই আছে আমাদের জিয়নকাঠি। হৃদযন্ত্রের পেশিগুলি তিনটি স্তরে সাজানো থাকে। ভেতরে থাকে এন্ডোকার্ডিয়াম (Endocardium), মাঝে রয়েছে মায়োকার্ডিয়াম (Myocardium) ও সবচেয়ে বাইরে থাকে পেরিকার্ডিয়াম (Pericardium)।
ভেতর থেকেই শুরু করা যাক্। প্রথমেই আসি এন্ডোকার্ডিয়ামের রোগ-ব্যাধি প্রসঙ্গে। এন্ডোকার্ডিয়ামে জীবাণুর আক্রমণ হলে তাকে বলে এন্ডোকার্ডাইটিস (Endocarditis)। এ রোগ সরাসরি নিজে থেকে হয় না। নিউমোনিয়া, থাইসিস, টনসিলাইটিস, ডায়াবিটিস, বাত, গনোরিয়া আরো কতগুলি ব্যাধির পরবর্তী উপসর্গ হিসাবে এই রোগ সৃষ্টি হয়। তিন ধরনের এন্ডোকার্ডাইটিস সাধারণভাবে বেশি দেখা যায়-
  

    সাব-অ্যাকিউট এন্ডোকার্ডাইটিস (Sub- Acute Endocarditis): এ রোগের উপসর্গ খুব তীব্রভাবে দেখা যায় না। হৃৎপেশিতে বিভিন্ন প্রকার জীবাণুর সংক্রমণ এ রোগের অন্যতম কারণ। স্ট্রেপটোকক্কাস স্যানগুইস (Streptococcus Sanquis) বা আলফা হেমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস পোকা দাঁত সিল করা, দাঁতের স্কেলিং বা দাঁত তোলার সময় রক্তে মিশে যায় ও পরে হৃদযন্ত্রে বাসা বাঁধে। এছাড়া স্ট্রেপটোকক্কাস ফিকলিস (S. Faecalis), স্ট্রে মিলিরি (S. Milleri) ও স্ট্রে বোভিস (S. Bovis) প্রভৃতি জীবাণু বৃহদন্ত্র ও মূত্রনালীর মাধ্যমে রক্তে আসে। এসব ছাড়াও কিছু ছত্রাক (Fungus), স্পাইরোকিট (Spirochets) সংক্রমণের জন্য এ ধরনের ব্যাধি হতে পারে।
    এ রোগের অন্যতম লক্ষণ বিনা কারণে ক্লান্তিবোধ, হতাশা, হাতের আঙ্গুলের মাথাগুলি ফুলে ওঠা, সারা গায়ে ম্যাজম্যাজে ব্যথা হয়। অনেক সময় আঙ্গুল বেঁকে যেতে পারে। প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে রোগীর প্রস্রাব পরীক্ষা করলে তাতে রক্তের অস্তিত্ব ধরা পড়ে।
    অ্যাকিউট এন্ডোকার্ডাইটিস (Acute Endocarditis) : সাব-অ্যাকিউট এন্ডোকার্ডাইটিসের লক্ষণগুলি এক্ষেত্রে আরো প্রবলভাবে দেখা দেয়। স্ট্যাফাইলোকক্কাস আউরিয়াস (Staphylococcus aureus) ছাড়াও নাইসেরিয়া গনোরিয়া Nesseria Gonor-rhoea), স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া (Streptococcus Pneumoniae) জীবাণুগুলি এই ব্যাধি ঘটিয়ে থাকে। এই রোগে সাধারণত ক্ষতিগ্রস্থ হয় হৃদযন্ত্রের ট্রাইকাসপিড কপাটিকা। এছাড়া হৃৎপেশিতে ফোঁড়াও (Absess) হতে পারে। এ ধরনের এন্ডোকার্ডাইটিসের ফলে হার্টের কপাটিকার মুখের আবরণে (cover of the value) ছোটো আঁচিলের মতো (Warty Vegitations) হয়। এগুলি একসঙ্গে দেখতে ছোটো ফুলকপির মতো। কখনো এগুলি শুকিয়ে কপাটিকার মুখে একটি আঁচিলের মতো আটকে থাকে। অ্যাকিউট এন্ডোকার্ডাইটিসে হৃদযন্ত্রে অস্বাভাবিক ধ্বনি বা মার্মার শোনা যায়। পরবর্তী সময়ে এ থেকে কিডনির অসুখ রেনাল ফেলিওর (Renal Failure) হতে পারে।

    পোস্ট অপারেটিভ এন্ডোকার্ডাইটিস (Post Operative Endocarditis):  হৃদযন্ত্রের ভালভের অপারেশনের পর বিশেষ করে যেখানে কৃত্রিম ভালভ লাগানো হয়েছে সে সব ক্ষেত্রে এই ধরনের এন্ডোকার্ডাইটিস দেখা যায়। স্ট্যাফাইলোকক্কাস অ্যালবাস (Staphylococcus albus) জীবাণু মূলত দায়ী। হৃদযন্ত্রের কোনো অপারেশনের পর যদি রোগীর মাঝে মাঝে জ্বর হতে দেখা যায়, তবে সময় নষ্ট না করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এই রোগ পুরোপুরি সারতে চায় না। কিছুদিন যাওয়ার পর আবার দেখা দেয়।
    এন্ডোকার্ডাইটিস হলে রোগীর রক্তের ই.এস.আর. (E.S.R.) বেড়ে যায়। তাছাড়া প্লাজমা সি-রিয়াকটিভ প্রোটিন পরীক্ষা (C-Reactive Protein)  থেকে রোগ সনাক্ত সম্ভব। ব্লাড কালচার করতে হলে এক্ষেত্রে প্রতি দু-তিন ঘন্টা পর পর রক্তের নমুনা নিতে হবে। এন্ডোকার্ডাইটিসে রক্তের শ্বেতকণিকা (Leucocyte) -এর অনুপাত বেড়ে যায়। এ ব্যাধিতে হৃৎপিন্ডের ভালভ ক্ষতিগ্রস্থ হলো কী না, তা জানার জন্য ইকোকার্ডিওগ্রাফির সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে।
    এ রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেঞ্জো পেনিসিলিন (Benzyl Penicilin), জেন্টামাইসিন (Gentamycin), টেট্রাসাইক্লিন (Tetracycline), অ্যাম্পিসিলিন (Ampicilin) ব্যবহার করা হয়। সে সব রোগীর পেনিসিলিন জাতীয় ওষুধে অ্যালার্জি আছে তাদেরকে অনেক সময় ভ্যানকোমাইসিন (Vancomycin) ও মেট্রোনিডাজল (Metronidazole) দেওয়া হয়।
    হোমিওপ্যাথিতে- একোনাইট, বেলেডোনা, ব্রায়োনিয়া, ক্যাকটাস. জি, সিমিসিফিউগা, স্পাইজেলিয়া প্রভৃতি ওষুধ লক্ষণ অনুসারে ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যায়।
    এছাড়া রোগ প্রতিরোধ করতে হলে প্রথম থেকেই দাঁতের যত্ন নিতে হবে। কারণ বহু ক্ষেত্রে দাঁতের ক্ষয় থেকে এ রোগের জীবাণু রক্তে মেশে। পৌষ্টিকনালী, কিডনি ও মূত্রনালীতে অপারেশনের আগে-পরে ডাক্তারবাবুর নির্দেশ মতো জীবাণুনাশক ওষুধ ব্যবহার করে যেতে হবে। অভিজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ না করে শুধুমাত্র বাজার থেকে ওষুধ কিনে খাওয়া যাদের বদভ্যাস আছে, সেইসব হাফ-জান্তাদের এ ধরনের অসুখ দেখা দিতে পারে।
    হৃৎপেশির মধ্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হ’ল মায়োকার্ডিয়াম স্তর। হৃদযন্ত্রের অনেক রোগের উৎপত্তিস্থল এই মায়োকার্ডিয়াম। এই স্তরে জীবাণু সংক্রমণে কোনো রোগ হলে তাকে বলে মায়োকার্ডাইটিস (Myocarditis)। আর জীবাণু ছাড়া অন্য কোনো কারণে ব্যাধি হলে তার নাম কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Cardio Myopathy)।
    মায়োকার্ডাইটিসকে মোটামুটিভাবে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। অ্যাকিউট মায়োকার্ডাইটিস ও ক্রনিক মায়োকার্ডাইটিস।
    অ্যাকিউট মায়োকার্ডাইটিস (Acute Myocarditis): এ রোগে জীবাণু সরাসরি মায়োকার্ডিয়ামে আসতে পারে বা দেহের অন্য কোনো অঙ্গ বা যন্ত্র থেকে এ স্তরে সংক্রমিত হয়ে থাকে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও মায়োলাইটিস ভাইরাসের ফলে এ রোগ সবচেয়ে বেশি হয়। অনেক সময় রেডিয়েশন চিকিৎসার পর এ রোগ দেখা যায়।
    এই রোগের লক্ষণ হিসাবে হৃৎস্পন্দনের হার হঠাৎ বিনা কারণে দ্রুত হয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ, দৌড়ঝাঁপ না করে বিশ্রামরত অবস্থায় থাকলেও হৃদয়ের সংকোচন প্রসারণ দ্রুত লয়ে চলে। নিলয়ের স্পন্দন অনিয়মিত হতে পারে। যার ফলে হার্ট ফেল পর্যন্ত হয়ে থাকে। শরীর দুর্বল হয়, পা ফোলে ও ফোলা অংশ টিপে ধরলে আঙ্গুলের ছাপ পড়ে। এছাড়াও বুক ধড়পড়, বুক ব্যথা ও আরো কিছু উপসর্গ দেখা যায়।  
    রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ই.সি.জি-তে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। তবে এন্ডোমায়োকার্ডিয়াল বায়োপসি (Endomyocardial Biopsy) করলে প্রকৃত স্বরূপ ধরা পড়ে।
    মায়োকার্ডাইটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগের কারণ ও লক্ষণগুলির ওপর বেশি নজর দেওয়া হয়। ওষুধ নির্বাচন করা হয় সেই অনুসারে।

    ক্রনিক মায়োকার্ডাইটিস (Chronic Myocarditis):- অনেক দিন ধরে অ্যাকিউট মায়োকার্ডাইটিস চলার পর তা ক্রনিক মায়োকার্ডাইটিসের রূপ নেয়। এর চিকিৎসা ও লক্ষণ মোটামুটিভাবে অ্যাকিউট মায়োকার্ডাইটিসের মতো। তবে উপসর্গগুলি তীব্ররূপ নেয়।

    কার্ডিওমায়োপ্যাথি(Cardiomyopathy):- লক্ষণ অনুসারে কার্ডিওমায়োপ্যাথিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়Ñ
১) ডাইলেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Dilated Cardiomyopathy)  
২) রেস্ট্রিকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Restrictive Cardiomyopathy)
৩)হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Hypertrophic Cardiomyopathy)
    ডাইলেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Dilated Cardiomyopathy):- একে কনজেসটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথিও বলে। হৃদযন্ত্রের মাইট্রাল ও ট্রাইকাসপিড কপাটিকা সরু হলে নিলয় থেকে রক্ত পুরোপুরি বেরিয়ে যেতে পারে না। আবার অনেক সময় ভালভগুলি ঠিক মতো বন্ধ না হলে (Regurgitation) রক্ত নিলয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে কিছুটা আবার নিলয়ে ফিরে আসে। এই কারণে নিলয়ে সবসময় বেশ কিছুটা রক্ত রয়ে যায়। এটি ডান বা বাম অথবা দু’টি নিলয়েও হতে পারে। এর ফলে রক্তসংবহন ব্যাহত হয়।
    রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে গেলে, অ্যাকিউট মায়োকার্ডাইটিসের পর, মহিলাদের ক্ষেত্রে সন্তান প্রসবের পর, অতিরিক্ত মদ খাওয়া-এসব বিভিন্ন কারণে এ রোগ হয়ে থাকে।
    নিঃশ্বাসে কষ্ট-এ কষ্ট বিশেষত রাতে বাড়ে। পা-ফোলা, হাই ব্লাডপ্রেসার, হৃদযন্ত্রে অস্বাভাবিক মার্মার শব্দ শোনা যায়। তবে ই.সি.জি. ও ইকোকার্ডিওগ্রাফি থেকে রোগ সমন্ধে সঠিকভাবে জানা যায়। এ রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে নজর রাখা হয়, যাতে পরবর্তী সময়ে রোগীর হার্টফেল না হয়। রোগীর খাবারে লবণের পরিমাণ কম রাখা উচিত। রোগের লক্ষণ অনুসারে বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে ওষুধে তেমন কাজ না হলে হৃদযন্ত্র সংস্থাপন (Cardiac Transplantation) করতে হয়।

    রেস্ট্রিকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Restrictive Cardiomyopathy):- একে অবলিটারেটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Obliterative)  ও বলে। বিভিন্ন কারণে নিলয় পেশির স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে গেলে বা শক্ত হয়ে গেলে নিলয় ঠিকমতো সংকুচিত ও প্রসারিত হতে পারে না। ফলে রক্তসঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয়।
    এ রোগের কারণে অলিন্দের চাপ বাড়ে ও অলিন্দ ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে। এন্ডোমায়োকার্ডিয়াল ফাইব্রসিস (Endomyocardial Fibrosis), অ্যামাইলডোসিস (Amyloidosis), ইওসিনোফিলিফ হার্ট ডিসিজ্ (Eosinophilic Heart Disease), গ্লাইকোজেন স্টোরেজ ডিসিজ্ (Glycogen Storage Disease), এন্ডোকার্ডিয়াল ফাইব্রিলাস্টোসিস (Endocardial Fibrilastosis)) ও আরো বহু কারণে এ রোগ হতে পারে।
    রেস্ট্রিকটিভ কার্ডিয়োমায়োপ্যাথি শনাক্ত করা বেশ কঠিন কাজ। ডপলার কার্ডিওগ্রাফি, সিটি স্ক্যান, এম.আর.আই. স্ক্যানিং, মায়োকার্ডিয়াল বায়োপসি এসবের সাহায্য নিতে হয়।
    এ রোগে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা, কাশি, গলার শিরা (Jugular vein) ফুলে ওঠে, যকৃৎ বড়ো হয়ে যায়। হৃৎস্পন্দনের লাব্-ডুব্ ধ্বনি খুব ক্ষীণ হয়ে পড়ে।
    এ রোগের ক্ষেত্রে উপসর্গ অনুসারে চিকিৎসা করা হয়। সেই হিসাবেই ওষুধ দেওয়া হয়। তবে অনেক সময় অপারেশন (Excision of Fibrotic Endocardium) করা হয়ে থাকে।
    হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Hypertrophic Cardiomyopathy):- এই রোগে নিলয়ের প্রাচীর পুরু হয়ে  যায়।  কিন্তু তার কার্যক্ষমতা কমে আসে। এ কারণে আন্তঃনিলয় প্রাচীরের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলস্বরূপ বাম নিলয় থেকে রক্ত ঠিকমতো সঞ্চালিত হতে পারে না। অনেকক্ষেত্রে মাইট্রাল ভালভের ত্রুটি (Mitral Regurgitation) হয়ে থাকে। অনেক মৃতদেহের মেডিকেল পোস্টমর্টম (Autopsy) করে দেখা গেছে অল্প বয়সী যুবকদের এ কারণে হঠাৎ মৃত্যু হয়। প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ রোগের বংশগত প্রবণতা দেখা গেছে। কিছু কিছু সময় ব্যাধির প্রকৃত কারণ জানা যায় না।
    বুকের বাঁ-দিকের নিচের অঞ্চলে স্টার্নামের কাছে স্পষ্ট মার্মার শোনা যায়। রোগীর বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা, কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান (Syncope) হয়ে যাওয়া, হঠাৎ মৃত্যু এ রোগের অন্যতম লক্ষণ।
    চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিটা অ্যাড্রিনারজিক ব্লকার (Beta- adrenergic blocker), ডাইসোপাইরামাইড (Disopyaramide), ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, এমিওডারোন এসব ওষুধ ব্যবহার করা হয়। হৃদযন্ত্র বেশি বড়ো হয়ে গেলে পেশি কেটে বাদ দিয়ে আবার সেলাই করে তা ছোটো করে দেওয়া হয়।
    ই.সি.জি. থেকে বাম নিলয় বড়ো হয়ে যাওয়ার খবর জানা যায়। হল্টার মনিটারিং, রেডিও নিউক্লিও মনিটারিং, রেডিয়ো নিউক্লিড সাইনট্রিগ্রাফি (Radio Nuclide Scintigraphy) এসব আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগের তীব্রতা বোঝা যায়।
    হৃদযন্ত্রের একেবারে বাইরের দিকে রয়েছে পাতলা আবরণ যার নাম পেরিকার্ডিয়াম। এই স্তরে দু’টি পাতলা চাদরের মধ্যে থাকে এক ধরণের জলীয় পদার্থ। এর পরিমাণ ১৫ মিলিমিটার থেকে ৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। পেরিকার্ডিয়ামে রোগ বাসা বাঁধলে তাকে বলে পেরিকার্ডাইটিস (Pericarditis)।
    এই রোগে বুকের মাঝখানে থাকা হাড়ের (Sternum)  পেছনে ব্যথা হয় ও সেই সঙ্গে জ্বর আসে। এই ব্যথা কাঁধ এবং গলায় ছড়িয়ে পড়ে। বেদনা সবচেয়ে বেশি হয় জোরে নিঃশ্বাস নিলে, নড়াচড়া করলে ও খাবার গিলে খাওয়ার সময়। স্টেথোস্কোপ দিয়ে রোগীর বুক পরীক্ষার সময় ঘর্ষণের খসখস শব্দ শোনা যায়। বুকের বাঁ-দিকে স্টার্নামের নিচে এ শব্দ সবচেয়ে ভালো ধরা পড়ে।
    বিভিন্ন কারণে পেরিকার্ডাইটিস হতে পারে। ভাইরাস  সংক্রমণের ফলে যে রোগ হয় তাকে বলে ভাইরাল পেরিকার্ডাইটিস (Viral Pericarditis)। শ্বাসযন্ত্র থেকে এ জীবাণু হৃদযন্ত্রে আস্তানা গাড়ে। শতকরা ৯০টি ক্ষেত্রে দেখা গেছে কক্সসাককি (Coxsakie) সংক্রমণ দায়ী।
    কার্টিকোস্টেরয়েড্ (Carticosteroid) অনেক সময় চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। রোগীর সুস্থ হতে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়।
    যক্ষা রোগের ফল হিসেবে পেরিকার্ডাইটিস হলে তাকে বলে টিউবারকিউলাস পেরিকার্ডাইটিস (Tuberculas Pericarditis)। সাধারণভাবে ফুসফুসীয় যক্ষা (Pulmonary Tuberculosis এ বিষয়ে দায়ী থাকে। এছাড়াও হার্ট অ্যাটার্কের পরে, বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফিভার-এ বেশিদিন ভুগলে, কিডনির রোগে পেরিকার্ডাইটিস হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর ব্যথা, জ্বালা-যন্ত্রণা কমাতে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। প্রয়োজন মতো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধে বা রোগের কারণ অনুসারে চিকিৎসা চলে।
    রোগ নির্ণয়ের জন্য এক্স-রে, ই.সি.জি., ইকোকার্ডিওগ্রাফি ও পেরিকার্ডিয়ামের মধ্যে থাকা ফ্লুইড কালচার করা হয়।
    পেরিকার্ডিয়ামের দু’চাদরের মাঝে যে জলীয় পদার্থ থাকে তার পরিমাণ বেড়ে গেলে তাকে বলে পেরিকার্ডিয়াল এফিউশন (Pericardial Effusion)। এ রোগের লক্ষণ হিসাবে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে যায়, রক্তচাপ কমে আসে। হৃদ্যন্ত্রের ভেতর রক্ত ঠিকমতো প্রবেশ করতে পারে না, ফলে ঘাড় ও গলার শিরা ফুলে ওঠে। হৃদযন্ত্রের লাব্-ডুব্ শব্দ ক্ষীণ হয়ে যায়, পা ফোলে।
    যক্ষা পেরিকার্ডিয়াল এফিউশন এর অন্যতম কারণ। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলিতে এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মিক্সিডিমা (Myxedema)  এক ধরনের ব্যাধি যাতে শরীরের বিভিন্ন অংশে শোথ দেখা যায়। ঠোঁট ফুলে ওঠে, মুখমন্ডলের পরিবর্তন হয়, থাইরয়েড গ্রন্থির ক্রিয়া হ্রাস পায়- এ রোগ থেকেও পেরিকার্ডিয়াল এফিউশন হয়ে থাকে। কিডনির নেফ্রনের ব্যাধি, রিউম্যাটরেড আর্থারাইটিস (Rheumatoid Artheritis), সিফিলিস জাতীয় যৌনরোগ সংক্রমণে পেরিকার্ডিয়াল এফিউশন বা হৃৎপর্দার স্ফীতি দেখা যায়।
    অনেক সময় পেরিকার্ডিয়াল এফিউশনের ফলে শিরা থেকে রক্ত ডান নিলয়ে ঠিকমতো আসতে পারে না। এর ফলে মারাত্মক জটিলতা দেখা যায়। খুব তাড়াতাড়ি সঠিক চিকিৎসা না হলে রোগী মারা পড়ে। এই জটিলতাকে বলে কার্ডিয়াক ট্যামপোনেড্ (Cardiac Temponade)। সাধারণত যে সব কারণে এই অসুবিধা দেখা দেয় তার মধ্যে পেরিকার্ডিয়ামে টিউমার (Neoplastic Disease), প্রস্রাবে অতিরিক্ত ইউরিয়া বা নাইট্রোজেন যৌগ থাকা (Uremia), অজ্ঞাত কারণে পেরিকার্ডাইটিস (Idiopathic Pericarditis)s প্রধান।
      পেরিকার্ডিয়াল এফিউশন রোগ নির্ণয়ের জন্য বুকের এক্স-রে, ই.সি.জি., ডপলার, ইকোকার্ডিওগ্রাফি, পেরিকার্ডিয়াল বায়োপসি, পেরিকার্ডিয়াল ফ্লুইড পরীক্ষা, মূত্র পরীক্ষা করা হয়।
    চিকিৎসার ক্ষেত্রে সূচের সাহায্যে পেরিকার্ডিয়ামে জমা জল বার করে দেওয়া হয়। তাছাড়া ব্যাধির কারণ ও উপসর্গের তীব্রতা অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
    হৃৎপেশিতে রোগ বাসা বাঁধলে সে প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-যন্ত্র-তন্ত্র। তাই আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ুর জন্য সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কীটমুক্ত থাকে হৃৎকোমলের পাপড়িগুলি।

Join our mailing list Never miss an update