জিরাফের আত্মীয় ওকাপি

জিরাফের আত্মীয় ওকাপি

জিরাফের আত্মীয় ওকাপি;ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১০ই আষাঢ় ১৩৯৮ (মঙ্গলবার) বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত

এসো, একবার তাকাই আফ্রিকা মহাদেশের মানচিত্রের দিকে, ওই যে মধ্য-পূর্ব আফ্রিকার বুক জুড়ে রয়েছে চিরসবুজ নিরক্ষীয় বনভূমি। পূর্বে সিমলিকি নদী থেকে পশ্চিমে কঙ্গো ও উবাঙ্গি নদীর সঙ্গমস্থল পর্যন্ত এই অরণ্য বিস্তৃত। আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ১৪০ মাইল, পূর্ব-পশ্চিমে ৬২৫ মাইল। এই বৃষ্টিভেজা বনভূমিতে ঘুরে বেড়ায় ওকাপি নামের এক বিরল প্রাণী।

    এদের নিকট আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে প্রায় সকলেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। বেঁচে আছে খালি জিরাফ। ওকাপির গলা জিরাফের মতো অত লম্বা না হলেও, দেহের অন্যান্য আকারে জিরাফের সাথে খুব মিল। গায়ের রঙ গাঢ় লালচে বাদামী মখমলের মতো; যদিও বয়স বাড়লে গায়ের রঙ কিছুটা হালকা হয়ে যায়। পায়ের হাঁটুর নীচের ভাগ সাদা, হাঁটুর উপরে সাদাডোরাকাটা দাগ রয়েছে। এদের মুখটি খুব সাদা এবং কপাল হয় গাঢ় ধূসর। দেহের এই বিভিন্ন রঙের জন্য, বনের গাছপালার আলো-ছায়ার মধ্যে এরা অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে। সহজে কারো নজরেই পড়ে না।
    এদের মাথাটি পিছনের অংশ থেকে খানিকটা উঁচুতে থাকে, পূর্ণবয়স্ক ওকাপির মাটি থেকে মাথার উচ্চতা ৬ ফুট, কাঁধের ৫ফুট ও পিছনের ৪ফুট। এদের গড় ওজন ২৫০ কেজি। পুরুষ ওকাপির বছর দুই বয়স হলে মাথায় একজোড়া ছোট চামড়া ঢাকা শিং দেখা যায়। কান দু’টি বেশ বড়োসড়ো তাই শোনার ক্ষমতা খুব প্রখর। ঝোপঝাড় লতাগুল্মের বাঁধা টপকে অসম্ভব দ্রুত গতিতে পালাতে পারে।
কচি ডালপালা, ঘাস পাতা, ফল এরা সাধারণত খেয়ে থাকে। ফার্ণ জাতীয় উদ্ভিদ এদের কাছে পোলাও বিরিয়ানী। জিভটি অত্যাধিক লম্বা এবং যে কোন দিকে কোন অসুবিধা হয় না। ওকাপির স্বভাব সমন্ধে যেটুকু জানা গেছে তাতে বলা যায়, এরা সাধারণত বনের মধ্যে বাধাধরা পথেই চলাফেরা করে। ভীড়ভাট্টা দলাদলিতে নেই; একা থাকতেই ভালোবাসে। শান্ত নিরীহ ও বন্ধুসুলভ ব্যবহার করে। তবে রেগে গেলে প্রতিপক্ষকে লাথি মারে ও কামড়েও দেয়। স্ত্রী ওকাপি একবার এক থেকে তিনটি বাচ্চা প্রসব করে। জন্মানোর পর বাচ্চা দেড়-দু’মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ খেয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হল- এ সময়ে এরা কোন মলত্যাগ করে না। প্রাণী বিজ্ঞানীদের ধারণা ওকাপির দুধ খুবই পুষ্টিকর ও শাবক পুরোটাই হজম করে ফেলে, কোন অপাচ্য অংশ থাকে না।

    খুবই আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এত বড়োসড়ো হওয়া সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সভ্য জগতের কেউই এদের কথা জানতো না। হ্যারি জনস্টন নামে এক ইংরেজ কঙ্গোতে গিয়ে প্রথম এদের কথা জানতে পারেন। তিনি স্থানীয় পিগমীদের কাছ থেকে দু’টি চামড়া সংগ্রহ করে লন্ডন জুলজিক্যাল সোসাইটির সম্পাদক ডঃ পি.এল. স্কলেটর (Dr. P.L.Sclatar)-এর কাছে পাঠান। ডঃ স্কলেটর ১৯০২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথম এর কথা উল্লেখ করেন; নতুন প্রজাতির জেব্রা হিসাবে। নাম দেন ইক্যোয়াস জনস্টোনি (Equas jhonstoni)  অর্থাৎ ঘোড়ার বর্গভুক্ত। কিছুদিন পর বেলজিয়ামের ফরেস্ট অফিসার ইরিকসন (Eriksson)  দুটি মাথার খুলি সম্পূর্ণ চামড়া ও খুঁর নিয়ে আসেন। দ্বি-খন্ডিত খুঁড়ের সাহায্যে তিনি প্রমাণ করেন এরা জেব্রার নয়, জিরাফ পরিবারের সদস্য। কারণ ঘোড়া ও জেব্রার খুঁর অবিভক্ত। সে বছরই ১৪ই জুনে স্যার রে ল্যানকেষ্টার (Sir Ray Lankester) এর নাম দেন ওকাপি, বৈজ্ঞানিক নাম ওকাপিয়া জনস্টোনি (Okapia janstoni)।
    এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন চিড়িয়াখানা এরা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ১৯৪০ সালের মধ্যেই ২০টি ওকাপিকে বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে একটি লন্ডনে ১৯৩৭-৫০ আর একটি বেলজিয়ামের অ্যান্টউরুপ (Antwerp)-এ ১৯২৭ থেকে ১৯৪২ সাল অবাধ জীবিত ছিল। বাকি সবাই ছ’বছরের মধ্যেই মারা যায়। ১৯৪৮ সালে অ্যান্টউরুপ জুলজিক্যাল সোসাইটি কঙ্গো থেকে এদের ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় পাঠাতে শুরু করে। এই সংস্থার মূল কেন্দ্রটি ছিল ইপুলু (Epulu)-তে।

    অরণ্যের বাইরে প্রথম ওকাপির জন্ম হয় ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অ্যান্টউরুপে। কিন্তু দুঃখের বিষয় শাবকের আয়ু ছিল মাত্র একদিন। তারপর বিভিন্ন পশুশালায় ওকাপি শাবক প্রসব করলেও কেউই বেশিদিন বাঁচে নি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা বৃষ্টি ভেজা কঙ্গো অরণ্যের বাইরে এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কমে যায়। তাই ১৯৫৮ সালে ইপুলু ও প্যারিসে যে দু’টি ওকাপি জন্মে, তাদের জীবানুমুক্ত খাদ্য দেওয়া হয় ও রাখা হয় বিশেষ আস্তাবলে। এরা বহু বছর বেঁচে ছিল। ওকাপিই সর্বশেষ আবিষ্কৃত বৃহৎ স্তন্যপায়ী।
        

Join our mailing list Never miss an update