মহারাজ- ইনজামামদের সঠিক পানীয়; ডাঃ পার্থপ্রতিম; মার্চ ২০০৪; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
চলছে মহারণ। শুধু ম্যাচ নয়, দিল ভি জিতনা পরেগা। টিভি-র পর্দায় আটকে আছে কয়েক কোটি চোখ। মাঝের বিরতিতে শীতল পানীয়ের উষ্ণ বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন কোম্পানির কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরে-‘এ দিল মাঙে মোর’ বা ঠান্ডা মতলব...’ বলে যতই নাচানাচি করুন না কেন, এই তারকারা যে নিজেরা কতখানি এসব পানীয়তে গলা ভেজান সেটা কিন্তু বড়ো প্রশ্ন।
না, সে বিতর্কে আপাতত যাচ্ছি না। তবে হ্যাঁ, খেলাধুলার সঙ্গে পানীয়ের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। এক্ষেত্রে আমাদের শরীরটাকে মোটরগাড়ির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। গাড়ির ইঞ্জিনকে ঠান্ডা রাখতে যেমন তার রেডিয়েটারে জল ঢালতে হয়, তেমনই অতিরিক্ত পরিশ্রমের সময় প্রয়োজন হয় পানীয়ের।
আমাদের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৭-৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। শারীরিক পরিশ্রম করলে দেহের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে সে সময় শরীরকে ঠান্ডা রাখার জন্য ঘাম বেরিয়ে আসে। যে কারণে মাটির কলসিতে রাখা জল তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা থাকে, সেই একই কারণে ঘাম নিঃসরণে দেহ শীতল হয় ও দেহের তাপ সুনিয়ন্ত্রিত থাকে।
খেলাধুলার সময় মাথার ঘাম পায়ে পড়ে। তবে জিদান, বেকহ্যামের মতো অতো ঘাম ঝরাতে হয় না মহারাজ-ইনজামামদের। কিন্তু ক্রিকেট খেলাটি যেহেতু বেশিক্ষণ ধরে চলে তাই মোট শক্তি খরচের পরিমাণ বা ক্যালোরি-ক্ষয় প্রায় সমান। শোয়ের আখতারের ক্ষেত্রে প্রতি ঘন্টায় ১.৭ থেকে ২.১ লিটার পর্যন্ত ঘাম নিঃসরণ হতে দেখা যায়।
ভালো ফিল্ডিং ও ব্যাটিংয়ে মিস্টার ডিপেনডেবলের যে পরিমাণ ঘাম ঝরে তা তাঁর দেহের ওজনের তিন থেকে চার শতাংশ। ঘামের সময় জলের সঙ্গে বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদান দেহের বাইরে বেরিয়ে আসে। এই জৈব-অজৈব উপাদানগুলির অনুপাত নির্ভর করে খাদ্য, পরিবেশ, তাপমাত্রা, দেহে মেদের পরিমাণ ও আরো বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। শরীরতত্ত্ববিদেরা সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন-সাধারণ ঘামের তুলনায় খেলাধুলার সময় ঘামে সোডিয়াম ক্লোরাইডের মাত্রা বেড়ে যায়। শারীরিক পরিশ্রম বা ঘামের কারণে দেহে যে শক্তি বা জলীয় পদার্থের ঘাটতি দেখা দেয়, তা কোন পানীয় দ্রুত পূরণ করতে পারে তারই নিরিখে পানীয়ের গুণমান বিচার করা হয়।
খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্যসম্মত পানীয় কেমন হওয়া উচিত ? তা নিয়ে ষাটের দশকের শুরুতেই বিজ্ঞানীমহলে গবেষণা শুরু হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালে মার্কিনি স্টোকলি ভন ক্যাম্প ফুড কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে তাদের গ্যাটোরেড নামের লেমন-লাইম শরবত। প্রস্তুতকারী সংস্থার দাবি, এই আইসোটনিক পানীয়তে কঠিন ও তরল পদার্থের মিশ্রণ এমন অনুপাতে আছে যা দেহরসের কঠিন ও তরল অনুপাতের সমান। সে কারণেই এই পানীয় সাধারণ শরবতের চেয়ে ১২ গুন দ্রুতগতিতে দেহের লবণ ও জলের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। বিজ্ঞানের যুক্তি মেশানো এই বিজ্ঞাপনের ফলে আইসোটনিক পানীয় খেলোয়াড়মহলে বেশ জনপ্রিয় হয়।
স্বাস্থ্যসস্মত পানীয় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ম্যারাথন দৌড়বিদ ও বেসবল খেলোয়াড়দের। অতিরিক্ত ঘামের ফলে শরীরে জলের পরিমাণ কমে যায়, বাড়ে রক্তের ঘনত্ব। জলপানের ফলে দেহে তাপমাত্রার সমতার সঙ্গে রক্ত ও প্লাজমার ঘনত্ব কমে আসে। কিন্তু গ্যাটোরেডের এই বিজ্ঞাপন বেশিদিন সবর থাকতে পারেনি। ‘দি রানার’ ম্যাগাজিনের শারীরতত্ত্ব বিষয়ক পরামর্শদাতা গোব মার্কিন স্টোকলি ভন ক্যাম্প ফুড কোম্পানির এই বিজ্ঞাপনকে ‘পিওন ননসেন্স’ অ্যাখ্যা দেন। না এতেও ক্ষান্ত হলেন না মার্কিন সাহেব, বললেন- ‘পানীয়ের ক্ষেত্রে আইসোটনিক তত্ত্ব একটি বৈজ্ঞানিক ধাপ্পাবাজি, ক্রীড়াবিদের পানীয়ের সঙ্গে আইসোটনিক তত্ত্বের কোনো সম্পর্ক নেই।
গোব মার্কিনের সঙ্গে গলা মেলান ওহিল স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা। তাঁরা জোর গলায় বললেন- পানীয় কত তাড়াতাড়ি অন্ত্রের ভিলাই থেকে শোষিত হচ্ছে সেটা বড়ো কথা নয়। আসল বিষয় হল কোন পানীয় কত দ্রুত পাকস্থলি পেরিয়ে যেতে পারছে। মিষ্টি স্বাদের পানীয়ের মধ্যে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে বলে পাকস্থলির পথ পার হতে সাধারণ জলের চেয়ে বেশি সময় নেয়। আবার অন্যদিকে শর্করা বা সুগার যত তাড়াতাড়ি শক্তির চাহিদা মেটাতে পারে তার ধারে কাছে কেউ নেই। তাই বিজ্ঞানীরা পড়লেন দারুণ ঝামেলায়। অস্বস্তি ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি ?’
পানীয়তে শর্করা থাকা উচিত কি? উচিত নয় ?
এরপর পানীয়ের ক্ষেত্রে আসে নতুন আয়নিক তত্ত্ব। বেল স্টেটস হিউম্যান পারফরমেন্স ল্যাবরেটরির গবেষক ডেভিড কোস্টিল বলেন- পানীয়তে একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ ব্যক্তির দেহ থেকে গড়ে প্রতিদিন এক লিটার ঘাম বের হয়। খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে। ঘামের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.০০৫, ঘাম অ্যাসিডধর্মী, বর্ণহীন। ঘামের বিভিন্ন উপাদান- সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্লোরিন, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি আয়ন ও শর্করার মাত্রা এমন হওয়া উচিত যা রক্তরস বা প্লাজমার অনুপাতের সমান। দেহ থেকে কোনো কারণে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে গেলে ইলেকট্রোলাইট পানীয় সেই অভাব দ্রুত পূরণ করতে ও শক্তির যোগান দিতে পারে। কলেরা বা ডায়েরিয়ার রোগীকে তাই ইলেকট্রোলাইট দেওয়া হয়।
ঘামের স্বাভাবিক উপাদান
জলীয় উপাদান ৯৯.২- ৯৯.৭ শতাংশ
কঠিন উপাদান ০.৭৮ শতাংশ
জৈব উপাদান ০.৩১ শতাংশ
১)ইউরিয়া ০.০৩ শতাংশ
২) ল্যাকটিক ০.০৮ শতাংশ
৩) শর্করা ০.০০০৩ শতাংশ
অজৈব উপাদান ০.৫৭ শতাংশ
১) সোডিয়াম ক্লোরাইড ০.২ - ০.৫ শতাংশ
২) সোডিয়াম ০.২ - ০.৬ শতাংশ
৩) কেলারাইড ০.০৫ - ০.৩৫ শতাংশ
৪) পটাসিয়াম ০.০১৮ শতাংশ
৫) সালফেট ০.০০৫ শতাংশ
না, এতেও বিতর্কের অবসান হল না। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউদার্ন ওয়েস্টার্ন মেডিক্যাল স্কুলের গবেষক অধ্যাপক জেমস কোনচেল জানালেন, ‘কলেরা বা ডায়েরিয়া রোগীদের বারবার পায়খানা করার সঙ্গে; ইনজামাম-সচিনদের ঘাম ঝরানোর বিস্তার তফাত। দেহ থেকে বেশি ঘাম বের হতে থাকলে কিডনি তখন স্বাভাবিকভাবেই মূত্রে সোডিয়াম, পটাসিয়াম প্রভৃতি আয়নের মাত্রা কমিয়ে দেয়। ফলে শরীরে ওইসব পদার্থের সাম্যবস্থা বজায় থাকে। সে কারণে খেলাধুলার সময় ইলেকট্রোলাইট পানীয় শুধু যে অপ্রয়োজনীয় তাই নয়, এ সময় এ ধরনের পানীয় নিলে কিডনিজনিত রোগের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়।
অধ্যাপক কোনচেল গবেষণা চালিয়ে এক মজার পরামর্শ দিয়েছেন, ক্রীড়াবিদেরা যদি খেলার আগে বিয়ার জাতীয় পানীয় নেন তবে তাদের দেহে শক্তি ও জলের ঘাটতি তেমনভাবে দেখা দেবে না। সমস্যার কি সঠিক সমাধান আদৌ হল ? লিটল মাস্টার যদি বিয়ার পান করে ঢুলুঢুলু চোখে ত্রিশ গজ দূর থেকে ছুটে আসা শোয়েব আখতারকে আফ্রিদি বলে ভুল করেন ? ঘটনাটি কি দাঁড়াবে ? না, আমি আর কথা বাড়াবো না, আপনারাই আমাকে জানান।