বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়-ঝলমলে অতীতকে পাশে রেখে হীরকজয়ন্তী; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ১৪ এপ্রিল ২০০৮ ; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
ছেঁড়া খোড়া মানচিত্র হতে উঠে আসা স্বাধীনতা। তবুও লক্ষ স্বপ্ন পাখা মেলছে মাঠে ময়দানে। নতুন দেশ গড়ার আশায় বিভোর অযুত মন। মধুমতী নদী আর বালামের ভোগ ফেলে আসা মানুষজন; কোমর বাঁধলেন স্কুল গড়ার কাজে। জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্স এলাকা। উত্তরে মাথা তোলা মৌন হিমালয়। তার কোল ঘেঁষে আদিগন্ত বিস্তৃত চা-বাগিচার সবুজ গালিচা। বানারহাট চা বাগানের দেওয়া ১৩ একর জমিতে গড়ে উঠলো বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়। বার্ষিক খাজনা ছিল একটাকা। সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল কিছুদিন আগে থেকেই। আনুষ্ঠানিক সুরুয়াৎ ১৯৪৯ সালের ২৬ শে জানুয়ারী; বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের তৎকালীন সম্পাদক অতুল্য ঘোষ।
এলাকার মানুষেরা এগিয়ে এলেন সাধ্যমতো সাহায্য নিয়ে। শোনা যায় শুরুতে সংগঠকেরা সেসময়েই চৌষট্টি হাজার টাকা দান সংগ্রহ করেছিলেন। এককালীন দশহাজার টাকা দান করেন তারাচাঁদ আগরওয়াল। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা একঝাঁক অভিজ্ঞ শিক্ষক যোগ দিলেন স্কুলে। এসবের নেতৃত্ব দিলেন প্রধান শিক্ষক সত্যেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য। নিরলস, অভিজ্ঞ, অকপট এই মানুষটি স্কুলের অন্যতম রূপকার। কিছুদিনের মধ্যেই বিদ্যালয় হয়ে দাঁড়াল বানারহাট, গয়েরকাটা, বীরপাড়া, ক্যারণ, নাগরাকাটা এই বিশাল এলাকার প্রাণকেন্দ্র। শুরু থেকেই এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মহামানবের মিলনক্ষেত্র। বাঙ্গালী, বিহারী, মাড়োয়ারী, নেপালী, আদিবাসী, উড়িয়া সকলের সহাবস্থান। ‘ অত্র বিশ্বম্ ভব একো নীড়ম্ ’। প্রতিষ্ঠার বছর থেকেই চালু হল স্কুল হোস্টেল। আশেপাশের ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি ছাড়াও অসম থেকে পড়তে আসা ছাত্ররা এই হোস্টেলে থাকতো।
সৃষ্টিলগ্ন থেকেই খেলাধূলায় ছড়িয়ে পড়ে স্কুলের নাম। ১৯৫০ সালে পলাশবাড়ি সি. ডি. এন. ক্লাব পরিচালিত ঐতিহ্যশালী টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে সবার নজর কাড়ে। তখন ব্যায়াম শিক্ষক ছিলেন নির্মল সেনগুপ্ত। ব্যায়াম, ফুটবলের পাশাপাশি ছাত্রদের শেখানো হত লাঠি ও ছোরা খেলা। ১৯৫৬ সালে ফুটবলে জেলা চাম্পিয়ান হয়। ১৯৬৩ সালে আন্তঃজেলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ‘শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় স্মারক’ লাভ করে। পরের বছর আবার আন্তঃজেলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় স্কুল চাম্পিয়ানশিপ লাভ করে। ১৯৭৩ সালে ডাঃ বি.সি.রায় ফুটবল প্রতিযোগিতায় এই বিদ্যালয় ডিক্ট্রিক্ট চাম্পিয়ান হয়। ১৯৮১ সালে হ্যামিলটনগঞ্জ থেকে সরোজিৎ মজুমদার শীল্ড জয় করে উত্তরবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবল দলের স্বীকৃতি পায়। খেলাধূলায় সাফল্যের ধারা এখনো অব্যাহত আছে। ক্রীড়া শিক্ষক বিশ্বনাথ দে সরকার ও দিবাকর বিশ্বাস সুচারুরূপে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন ছাত্রছাত্রীদের। গত বছর অনুর্ধ ১৭ বছর জেলা দলে খেলার সুযোগ পেয়েছে ওয়াকিব ইসলাম। ২০০১ সালে জেলা ক্রিকেট দলে মনোজিত পাল ও অঙ্কন সরকার সুযোগ পায়। ১৯ বছরের ফুটবল প্রি-রেঞ্জার্স কাপে জেলা দলে খেলে দিব্যকান্তি মুখার্জী। ২০০৬ সালে আসন- জিমনাস্টিকে নাসমিনারা পারভিন, গৌরব কুমাল, শুভদীপ সরকার জেলায় বিশেষ সুনাম অর্জন করে। তালিকা এতো দীর্ঘ যে সবকিছু লিখতে বসলে সেটাই মহাভারত হয়ে যাবে।
১৯৫৩ সালের জানুয়ারীতে স্কাউট ট্রেনিং প্রাপ্ত শিক্ষক রমেশ চন্দ্র চক্রবর্তী স্কুলে রেগুলার স্কাউট ট্রুপ খোলেন। ১৯৬০ এর ৪ঠা নভেম্বর শিক্ষক অমল কুন্ডু এন. সি. সি প্লেটুন গড়ে তোলেন। ১৯৮০ সালে এন. সি. সি ক্যাডেট বিভূতি সিনহা রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে সর্বভারতীয় রক ক্লাইম্বিং প্রতিযোগিতায় রৌপ্য পদক পায়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০০৫ সালে শিক্ষক আসফাক আহমেদ -এর নেতৃত্বে আবার শুরু হয়েছে এন.সি.সি প্রশিক্ষণ। গত বছর মহারাষ্ট্রের নাগপুরে জাতীয়স্তরের ক্যাম্পে জুনিয়র ডিভিশনে পাঁচজন ছাত্র অংশ লাভের সুযোগ পায়।
খেলাধূলা শিল্প সংস্কৃতির সাথে জনবিজ্ঞানচর্চাতেও এই বিদ্যালয় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে। ১৯৭৬ সালে নারায়ণ পালের তৈরী ‘সোলার কুকার’ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় পুরস্কৃত হয়। ১৯৮১ সালে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে ছাত্র পার্থপ্রতিম এর তৈরী ‘ওয়াটার টেলিস্কোপ’ মডেলটি ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এস বি চ্যাবন ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রশংসা লাভ করে।
স্কুল পরিচালন সমিতির বর্তমান সম্পাদক শ্যামল মিত্র ২০০৪ সালে দায়িত্ব নেন। এই বিদ্যালয়ের ছাত্র। দীর্ঘদিন ধরে তিনি জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সাথে যুক্ত। ডুয়ার্সের প্রথম বিজ্ঞান ক্লাব ‘সন্ধানী বিজ্ঞান চক্র’ -এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তাঁর তত্ত্বাবধানে বিদ্যালয়ের জনমুখী বিজ্ঞান চর্চা ভিন্ন মাত্রা পায়। ভারত সরকারের এন সি এস এম আয়োজিত বিজ্ঞান নাটক প্রতিযোগিতা ২০০৫; উত্তরবঙ্গে প্রথম হয়ে পূর্বভারত পর্যায়ে অংশ নেয়। স্কুলের প্রযোজিত নাটক ‘ওঝা মতি করে সমাজের ক্ষতি’ বহু দর্শকের প্রশংসা লাভ করে। ২০০৭ সালে শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ বিজ্ঞান কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান নাটক প্রতিযোগিতায় স্কুলের ছাত্র ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী শ্রেষ্ঠ অভিনেতার শিরোপা লাভ করে। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সুপ্রতিম সরকার নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির আয়োজিত সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় জেলাস্তরে প্রথম হয়ে কলকাতায় রাজ্যস্তরে অংশ নেন। বিগত পাঁচবছর ধরে সুপ্রতিম আকাশবাণী শিলিগুড়ির শিশুমহল ও কিশোর জগতে নিয়মিত অনুষ্ঠান করে চলেছেন।
স্কুলের বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১০২৩ জন। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বালকদের জন্য। উচ্চমাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রী উভয়েই রয়েছে। বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য তিনটি বিভাগই রয়েছে হায়ার সেকেন্ডারী সেকশনে। স্থায়ী শিক্ষক- শিক্ষিকার সংখ্যা বর্তমানে ২৯ জন। পার্শ্বশিক্ষক রয়েছেন ৬ জন। শিক্ষাকর্মী রয়েছেন ৬ জন। ডুর্য়াসের অন্য সব স্কুলের মতো বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়েও রয়েছে আদিবাসী, নেপালী, বিহারী, বাঙ্গালী বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মের ছাত্রছাত্রী। চা- শ্রমিক পরিবার থেকেও বহুমানুষ এখানে পড়তে আসে। মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের জন্য ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা ভোকেশনাল পাঠক্রম। সিভিল এন্ড কনস্ট্রাকশন, কমপিউটার বিভাগে ক্লাস চলছে। এবছর জুলাই মাসে অষ্টম শ্রেণীর ড্রপ আউট ছাত্রদের জন্য শুরু হতে চলেছে স্বাস্থ্যকর্মী, মোবাইল ও টেলিফোন রিপিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারিং ও মোটর ওয়েনডিং প্রশিক্ষণ পাঠক্রম।
গত বছর মাধ্যমিক পরিক্ষাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে স্কুলের ঝুলিতে। পাশের হার ৭৯.৩ শতাংশ। স্টার পেয়েছে ৮জন। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ ২৫ জন। স্বাগত দাস ৭৫৯ ( ৯৪.৫ শতাংশ ) নম্বর পেয়ে ধূপগুড়ি ব্লকে প্রথম হয়েছে। সৈনিক সেন ৭২১ ( ৯১ শতাংশ) পেয়ে ব্লকে তৃতীয়। দারিদ্র ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে কৃষিশ্রমিক পরিবারের সন্তান মোহর কুন্ডু ৬২৭ পেয়ে জীবনখাতার পাতায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে। গত বছর উচ্চমাধ্যমিকে পাশের হার ৮১ শতাংশ। ছাত্রী শ্রীময়ী পাল ও অনিমেষ পাল গ্রেডেশন প্রথা অনুসারে এ(+) পেয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প ও স্থানীয় বিধায়ক তহবিল অনুদানে পাঁচটি ক্লাস রুম ইতিমধ্যে তৈরী হয়েছে। দু’টি ক্লাস রুমের নির্মাণ চলছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদ থেকেও সাত লক্ষ টাকার অনুদান পাওয়া গেছে। অবিলম্বে শুরু হবে আরো গৃহ নির্মাণ কাজ।
স্কুলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অরিন্দম মজুমদার ১৮ই জুলাই ২০০৭ থেকে এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার সামলাচ্ছেন। তাঁর তিন প্রজন্মের শিক্ষকতা। ঠাকুরদা হরিসেবক বিষ্ণুমজুমদার ছিলেন ১৯১৬ সালে তৈরী হওয়া জেলার দ্বিতীয় প্রাচীন বিদ্যালয় আলিপুরদুয়ার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। বাবা অমলেশ বিষ্ণুমজুমদার একই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক।
হীরকজয়ন্তীতে পা দেওয়া এই বিদ্যালয়ে পা রেখেছেন বহু গুণীজ্ঞানীজন। ১৯৫১ সালের ২৫শে জানুয়ারী এসেছিলেন বিশ্বসৃষ্টির রহস্য সন্ধানী বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা। ডঃ সাহা মন্তব্য খাতায় লিখেছেন-“ এই স্থানীয় স্কুলের বড়ো ভবিষ্যৎ আছে। আশাকরি এই স্কুল এতদঞ্চলে বর্তমান বৈজ্ঞানিক সভ্যতার বার্তা বহন করিয়া স্থানীয় অধিবাসীদিগকে নূতন কর্মপথে প্রবর্তন করিবে”। ১৯৫২ সালের ১৭ই ডিসেম্বর আসেন কংগ্রেস নেতা অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় । তাঁর মন্তব্য- “ নূতন প্রতিষ্ঠান হিসাবে বেশ উন্নতি করেছে। অভাব অভিযোগও কিছু কিছু আছে। স্থানীয় উৎসাহী ভদ্রলোকেরা এবং সরকার প্রয়োজন মতো সাহায্য দেবেন আশাকরি”। এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হরেণ মুখোপাধ্যায়, স্কুল বোর্ডের সম্পাদক ডি.এন. সেন, শ্রমমন্ত্রী কৃষ্ণ ঘোষ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মেহেরচাঁদ খান্না, সাহিত্যিক অমিয় ভূষন মজুমদার আরো অনেকে।
তখন সরকারী সাহায্য এতো উদার হস্তে পাওয়া যেত না। স্কুলের প্রতিটি ইট- কাঠ-পাথরের জন্য দ্বারে দ্বারে মাধুকরী করেছেন আশুতোষ দে, রাখাল চন্দ্র দে, শৈলেশ চন্দ্র চৌধুরী, সতীশ চন্দ্র কুন্ডু, মোহনলাল মহেশ্রী, হেরম্ব চন্দ্র বসু, গিরীন্দ্র চন্দ্র দে সহ পরিচালন সমিতির সাথে যুক্ত থাকা না থাকা আরো কত মানুষজন। এখন টাকার উৎস অনেক। এম এল এ ফান্ড, ডি বি আই টি এ, টি বোর্ড, স্কুল বোর্ড, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ণ পর্ষদ আরো কত কী। এছাড়াও রয়েছে শিক্ষকদের হাউস রেন্ট বাবদ আদয় করা কোয়ার্টার ভাড়া। নতুনভাবে তৈরী হচ্ছে আরো বহু শ্রেণিকক্ষ। প্রমাণ মাপের ঘর প্রধান শিক্ষকের। তাঁর ঝকঝকে মহার্ঘ টেবিলের একপাশে কমপিউটারের আধুনিক এল.সি.ডি মনিটার। সবার মাথার ওপর পাক মারছে বৈদ্যুতিক পাখা। অনেক অর্থই যেন অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্লাস রুমের পাশেই পড়ে আছে গুটকা- পানমশলা, সিগারেটের ব্যবহৃত প্যাকেট। ক্লাস চলাকালীন মোবাইলে আলাপন চলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। মাঝেমাঝেই বড়সড় গোল বাধে বাঙ্গালী- অবাঙ্গালী ছাত্রদের মাঝে। অভিভাবকেরাও জড়িয়ে পড়েন এই বালখিল্য ঝগড়াঝাটিতে। অদ্ভুত ব্যঞ্জনায় ইকোক্লাবের সাইনবোর্ডের নিচেই উন্মুক্ত জনপ্রস্রাব স্থান। বর্ষা এলেই ভরষা পায় পার্থেনিয়াম গাছের দঙ্গল। স্কুল প্রাঙ্গনের অনেকটাই চলে যায় তাদের দখলে। ক্লাস চলাকালীন স্কুলের চৌহদ্দীতে গেলে শোনা যায় মাছ বাজারের ঐকতান। ‘উচুঁ ক্লাসের ছাত্ররা নিত্যদিন টেবিল, বেঞ্চ ভাঙ্গে ’-এ দুঃখ প্রধান শিক্ষককের। এসব সত্ত্বেও প্রতিবছর স্কুলের কিছু ছাত্র যে বেশ ভালো ফল করে। স্কুলকে নয়; অভিভাবকেরা এই কৃতিত্বের বেশির ভাগটাই দিতে চান গৃহশিক্ষকদের। এতটা অধঃপতনের কারণ কী? প্রধান শিক্ষক জানালেন- “ বর্তমানে স্কুল পরিচালনার যা আইন কানুন হয়েছে তাতে ছাত্র শাসন করা বড় মুস্কিল। ”
ঝলমলে অতীতকে পাশে রেখে হীরকজয়ন্তী; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ২১ এপ্রিল ২০০৮; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত; ভাগ -২
স্কুলের প্রথম বছর থেকেই গ্রন্থাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রায় প্রতিবছর নিয়মিতভাবে বই কেনা হত। স্কুল হায়ার সেকেন্ডারি হওয়ার পর বই কেনার জন্য মোটা অঙ্কের আর্থিক সাহায্য আসে। সেসময় অনেক মূল্যবান বই কেনা হয়। তখনও ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে লাইব্রেরির দায়িত্ব সুচারুরূপে সামলেছেন শিক্ষক শৈলেন মন্ডল। এখনো স্কুল লাইব্রেরিতে আছে The Book of Popular Science Vo1. 1-10-Grolier incorporated, Heat and Thermodynamics-Mark W. Zemansky, the world J.h.stembridge, India-World & Empire-Herbert Pickles, ব্রহ্মবৈর্বত পুরাণ, মার্কোন্ড পুরাণ থেকে আরবি ভাষায় লেখা বহু পুরোনো কোরান। আছেন লাইব্রেরিয়ান। বইয়ের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। তবুও বেহাল দশা। কালেভদ্রে তালা খোলে। মাকড়সা জাল পেতেছে সর্বত্র। ধুলোমলিন দুর্লভ বইয়ের পাতায় পাতায় সিলভার পোকার পরিপাটি সংসার। বহু মূল্যবান বই ইতিমধ্যেই খোয়া গেছে।
স্কুলে অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব নেই। তবে এখানে শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। পরিচালন সমিতির প্রতি বারবার উঠে এসেছে স্বজনপোষণের অভিযোগ। কুটকচালির ভাষা এতটাই তীব্র হয়েছে যে স্কুলের সীমাবদ্ধ ভূগোল ছাপিয়ে ডিস্ট্রিক্ট ইনস্পেকটার অফ স্কুল অফিসে বিস্তর চিঠিচাপাটি হয়েছে। অভিযোগ পালটা অভিযোগে ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। স্কুল শেষ হওয়ার আগেই অনেক শিক্ষক বাড়িমুখো হন। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভিভাবকদের উপস্থিত থাকা তো দূরের কথা, অধিকাংশ শিক্ষকই থাকেন না।
স্কুলটি ১৯৭৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। সে সময়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল পর্যবেক্ষক এসেছিলেন স্কুল ল্যাবরেটরি পরিদর্শন করতে। শোনা যায় স্কুলের বিজ্ঞান ও ভূগোল পরীক্ষাগারগুলি দেখে তাঁরা এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে উপাচার্যকে এ বিষয়ে প্রশংসা শোনান। আজ সেই ল্যাবরেটরির মলিন দশা। তিন দশক পেরিয়ে যাওয়া আলমারিগুলি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষয়িষ্ণু। রাসায়নিক রাখার র্যাক ও টেবিলে ঘুণপোকা সগর্বে ঘোষণা করছে তাদের অস্তিত্ব। নতুন করে তৈরি হয়নি আসবাব। স্কুলের ভূগোল ল্যাবরেটরি ছিল গর্ব করার মতো বিষয়। সুদৃশ্য কাচের বাক্সে পরপর সাজানো ব্যাসাল্ট, গ্রানাইট, স্লেট অজস্র প্রাকৃতিক পাথরের নমুনা। রকমারি গ্লোব চার্ট আরও কত কী। ছিল স্থানীয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। ফাগুনের দক্ষিণা বাতাসে স্কুল বিল্ডিং এর মাথায় পাক খেত ধাতব মোরগ। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা.. এমনকি ছুটির দিনগুলিতেও ছাত্রদের বগলদাবা করে উচ্চ-নিম্ন তাপমাত্রা, বায়ুমন্ডলের চাপ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত নিঃশব্দে লিপিবদ্ধ করে যেতেন সত্যব্রত বিশ্বাস। না, বিশ্বাস স্যারের সেই ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা, বেলা অবেলায় ফুরিয়ে যায়নি। তাঁর হাতে গড়া ছাত্র হরেকৃষ্ণ দত্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভূগোলের অধ্যাপক হয়েছেন। প্রলয় সেনগুপ্ত হয়েছেন উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সত্যব্রতবাবুর সেই তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নসৌধ আজ তালাচাবির আড়ালে ধুলো ধূসরিত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। নব নির্মাণের বিষয়ে পরিচালন সমিতি যতটা তৎপর, অজ্ঞাত কারণে ঠিক ততটাই উদাসীন পুরোনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বে। স্কুলের দীর্ঘ ইতিহাসে কৃতী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম নয়। এই বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাস করা সৌরভ দাস টেক্সাসের রাজধানী-সান অ্যান্টিনিওতে উচ্চপদস্থ কম্পিউটার অ্যানালিস্ট। দিব্যেন্দু মুখার্জি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রতিষ্ঠিত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ রামেশ্বর আগরওয়াল এই বিদ্যালয়ের ছাত্র। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে আরও বহু কৃতী প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী।
স্কুলের আইন-শৃঙ্খলার পরিবেশ কেমন যেন পালটে গেছে এ দুঃখ অকপটে প্রকাশ করলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শৈবালকুমার ভট্টাচার্য। না, এটাতে তাঁর সঠিক পরিচয়টা দেওয়া হল না। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের তিনিই জ্যেষ্ঠপুত্র। স্কুল তৈরির বছর থেকে এই বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৫৭ সাল থেকে আবার এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক। জেলার নামি স্কুল ফণীন্দ্রদেব ইন্সটিউটিশনে শিক্ষকতার সুযোগ পেয়ে যাননি। ডাব্লু বি সি এস হয়েও যাননি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চেয়ারে বসতে। তখন শিক্ষকদের বেতন এখনকার মতো হাই-ফাই ছিল না। তবে কিসের জন্য উপেক্ষা করলেন গাড়ি, বাংলো, আরও কত কী লাভের সুবর্ণ সুযোগ? সেজন্য কোনো দুঃখ-আক্ষেপ নেই, স্পষ্ট ভাষায় জানালেন। তবে স্কুলটা এখন একটু শৃঙ্খলাপরায়ণ হলে... গলাটা কেমন বুজে এল, শেষের কথাগুলি শোনা গেল না। তাঁর লাগানো চাঁপা গাছটার দিকে অপলকে চেয়ে রইল উজ্জ্বল গৌরবর্ণের দীর্ঘদেহী ব্রাহ্মণ।
স্কুলের প্রথম ছাত্র প্রাণকুমার খাসনবীশ। দ্বিতীয় ছাত্র অরবিন্দু বসু পরবর্তীকালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে এই বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক হন। জীবনানন্দের কবিতা সমগ্রের ইংরাজি অনুবাদ করে শ্রীবসু গুণীমহলে বিশেষ প্রশংসিত হয়েছেন। সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন সমিতির তিনিই ছিলেন সভাপতি। ‘ইট-কাঠ-কংক্রিটে তৈরি হয় শিক্ষার সোপান’- একথা কোনোভাবেই মানতে রাজি নন অরবিন্দবাবু। প্রকৃত শিক্ষার জন্য দরকার সুন্দর পরিমন্ডল। শিক্ষক-ছাত্র, শিক্ষক-অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষকের মেলবন্ধন খুবই জরুরি। এসবের মূল দায়িত্ব অবশ্যই পরিচালন সমিতির। তবে তিনি আশাবাদী -‘যেহেতু পরিচালন সমিতিতে কিছু প্রাক্তন ছাত্র রয়েছে তাই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে বলে আশা করা যায়।’ অরবিন্দুবাবুর মতোই ছাত্র থেকে শিক্ষক হয়েছেন উত্তরবঙ্গের স্বনামধন্য সাহিত্যনুরাগী কবি ও বাগ্মী সুনীল চক্রবর্তী। গুরুজি রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি ও স্বামীজির ভাবশিষ্য। অকৃতদার ঋষিতুল্য এই মানুষটি এক সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আগুন ঝরানো বক্তৃতা দিয়েছেন। সেই কবিস্যারের উদাত্ত কণ্ঠও একই বেদনায় বিধূর।
এই বিদ্যালয়ের সহোদরা বানারহাট বালিকা বিদ্যালয়। আগে দুই স্কুল এক ছিল। শিখা সরকার ১৯৭১ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন বালিকা বিদ্যালয়ে। কলা ও বিজ্ঞান দুই শাখাতেই তার অবাধ বিচরণ। তাছাড়াও যে কোনো গঠনমূলক কাজে তিনি নিজে থেকে দু পা বাড়িয়ে থাকেন। তার কাছে শিক্ষা মানে শুধু বই মুখস্থ নয়। মন-মনন-মানসিকতার প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠাই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য। আবেগ জড়ানো কন্ঠে স্মৃতিচারণ করলেন। আগে এই স্কুল ঘিরে ছিল এক সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। নির্মল আবেগে নাট্যরূপ পেত শরৎ, সুকান্ত, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ। শিক্ষক অমল কুন্ডু, ছাত্রদের ভূগোল, এন সি সি, অঙ্ক শেখাতেন। তবে নিজে আখের গোছানোর পাটিগণিতে এক্কেবারে কাঁচা। শ্রেণিহীন সমাজের চির বাসনা ছিল তাঁর ঘুমে-জাগরণে। সাম্যবাদের স্বপ্নমেদুরতায় একের পর এক দিনবদলের নাটক মঞ্চস্থ করেছেন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। তারপর রাজ্যের রাজা বদলেছে, দিন বদলায়নি। কর্মরত অবস্থাতেই চিরঘুমের দেশে চলে গেছেন ব্যাকডেটেড অমল মাস্টার । ছেলেমেয়েদের দিয়ে বিজ্ঞান-ভূগোলের মডেল বানাতেন অজিত সরকার ও সত্যব্রত স্যার। আশেপাশের মানুষজন হুমড়ি খেয়ে আসত এই আনন্দযজ্ঞে মিশে যেতে। ঘড়ির কাঁটা চেষ্টা করেও বাঁধ সাধতে পারত না আসরগুলিতে। সরস্বতীপুজোর সময় সাতদিন ধরে চলত প্রদর্শনী, চারদিন ধরে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকদের নাটক, গান, আবৃত্তির বিচিত্র অনুষ্ঠান। সেই সোনালি দিন আর রুপোলি রাত আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেল। হয়তো ষাট ছুঁইছুঁই মন্টুবাবুর মতো স্কুলের চুলেও পাক ধরেছে। বয়সের বলিরেখা ঢেকেছে উজ্জ্বল মুখাবয়ব। না কি, সবটাই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সমকালীন চালচিত্র।
‘যত দোষ, দূরদর্শন নন্দঘোষ’- একথা মানতে রাজি নন শিখাদি। তাঁর কথায়- ‘অমলদা, সুভাষবাবুর মতো পাগল মাস্টারের এখন বড়োই অভাব। অনেকেই ডি. এ. , এরিয়ার, টি. এ.-র হিসাব-নিকেশ নিয়ে ব্যস্ত। তাঁরা শিক্ষকতা করতেন, এখন অনেকেই স্কুলে চাকরি করেন।
স্বাক্ষরতার হার, অর্থনৈতিক অবস্থা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা- সব বিষয়েই পিছিয়ে রয়েছে আদিবাসী অধ্যুষিত এই ডুয়ার্স এলাকা। অনুন্নত এই সবুজ উপত্যকায় শতফুল বিকশিত হোক, এই রঙিন স্বপ্ন মেখে শৈবালবাবু, কবি স্যার, শিখা দিদিমণির সঙ্গে আরও বহুচোখ চেয়ে আছে কালের দিগচক্রবালে। ভবিষ্যৎ ক্যানভাসে কী ছবি আঁকে? সে হয়তো সময়ই বলবে।