গরমে সোনামণির খাবার-দাবার

গরমে সোনামণির খাবার-দাবার

গরমে সোনামণির খাবার-দাবার ; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ৯ই জুলাই ২০০৬; রবিবারের সাময়িকী; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
    গরম মানেই ভ্যাপসা ব্যাপার। ঘামে প্যাচপ্যচে শরীর, খাবারে অনীহা, অল্পতেই পেটের গোলমাল আরো কত কী। এ সময় আপনার সোনামনির শরীরে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় জলীয় পদার্থের। তবে যে শিশু পুরোপুরি বুকের দুধের ওপরে রয়েছে তাকে আর আলাদা করে জল খাওয়ানোর দরকার নেই। কারণ, মায়ের দুধে ৮৭ শতাংশই জল। তাছাড়া এদের আলাদা করে জলখাওয়াতে গেলে বেশ কিছু অসুবিধা দেখা দিতে পারে। জল ফোটাতে শুরু করার পর অন্তত ২০ মিনিট লাগে পুরোপুরি জীবাণু মুক্ত হতে। যারা দুধের শিশুদের আলাদাভাবে জল খাওয়ান তারা বাচ্চার শরীরে বিভিন্ন রকম সংক্রমণ ঢুকিয়ে দিতে পারেন। এই জীবাণুগুলি মূলতঃ ঢোকে জলের বোতলের নিপল,  ঝিনুক- বাটি থেকে। অনেকে আবার ফোটানোর পর জলকে ছেঁকে নেন। ছাকনিতে বা কাপড়ে থাকতে পারে বিভিন্ন রকমের রোগ-জীবাণু। মোটামুটিভাবে ৬ মাস বয়সের পর বাচ্চা মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবার খেতে শুরু করে। এসময় বাচ্চাকে পরিশ্রুত জল খাওয়াতে পারেন।
    যারা এ গরমে স্কুলে যাচ্ছে তাদের হাল্কা খাবার ভাত, ডাল, সবজি, মাছের ঝোল দেবেন। স্কুল থেকে বাচ্চা যখন এক পেট খিদে নিয়ে ফেরে তখন তাকে লেবুর সরবত বা গ্লুকোজ জল দেবেন না। এতে তো তাদের খিদে কমে যায়; তাছাড়া খালি পেটে সরবত বা গ্লুকোজ বাচ্চার অম্বল বা অ্যাসিডিটি তৈরী করতে পারে।     
  

  যে সব শিশু সকালে স্কুলে যায় তাদের ঘরে পাতা দই, চিড়া, কলা দিতে পারেন। বাচ্চা যদি দই, চিড়া খেতে নিতান্তই রাজি না হয়। পিন্ডি ভেবে মুখ ঘুরিয়ে রাখে তবে তাকে টোস্ট, বিস্কুট দিতে পারেন। টোস্ট-এ জ্যাম, মাখন বেশি না লাগানোই ভালো। মাঝেমধ্যে চালে-ডালে মিশিয়ে খিচুরী করে দিন। দু’একদিন মুখে মন্দ লাগবে না। টিফিনে নুডুলস, এগরোল,  ভাজাভুজি একদম দেবেন না। নানা রঙের ফল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিন। হালকা করে রাঁধা সবজি দিন। গরমের দিনে দুপুরে বাড়িতে পাতা দই খুবই ভালো খাবার।     দুধ নয়, গরমকালের অন্যতম আদর্শ খাদ্য হল দই। অবশ্যই টক দই। তবে বাজারের কেনা দইতে যাবেন না। বাড়িতেই পেতে নিন দই। অল্প গরম দুধে কিছুটা দই মিশিয়ে রেখে দিন তাহলেই ১২ ঘন্টা পর আপনার দুধটি দই হয়ে যাবে। দই পাতলে দুধে যে দই মেশানো হয় তার অনেক প্রচলিত নাম আছে। কেউ বলেন সাজা, কেউ বা বীজ, কেউ বা আবার একে দম্বল বলেন। সে যে নামেই ডাকুন না কেন এই সাজাতে থাকে দেহের এক অতি উপকারী জীবাণু। নামটা একটু খটমট। ল্যাকটোব্যাসিলাস অ্যাসিডোফিলাস (Lactobacillus acidofilus)। যার অন্যতম কাজ দুধের শর্করা বা ল্যাকটোজকে ল্যাকটিক অ্যাসিডে পরিণত করা। এরা আমাদের অন্ত্র তথা ইন্টেস্টাইন (Intestine) -এর মধ্যেও বাসা বেঁধে থাকে ল্যাকটোব্যাসিলাস জীবাণু। যা দই-এর ল্যাকটোব্যাসিলাস-এর সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে। এই জীবাণু পৌষ্টিক নালীর ভেতর সর্বদা সেনাবাহিনীর মত তৈরী। অন্ত্রে কোন রকম ক্ষতিকর জীবাণু বাসা বাঁধতে চাইলে এই ল্যাকটোব্যাসিলাস সঙ্গে সঙ্গে তাদের জবাই করার তৎপরতা চালায়।
     কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য (যেমন- ভাত, রুটি,আলু...) পরিপাকে ল্যাকটোব্যাসিলাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। মাছ, মাংসে থাকা জটিল প্রোটিন অণুকে ভেঙে সরল অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরীতে দই বিশেষভাবে সাহায্য করে। খাদ্যের পচন রোধ করতেও দই বিশেষ ভূমিকা নেয়। গরমের দিনে মাছ-মাংসতে দই মিশিয়ে রাখুন, তাহলে অনেকক্ষণ পচন মুক্ত থাকবে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে দই আপনাকে বিশেষ সাহায্য করতে পারে।
    যাঁরা মোটা বা স্থলকায়া তাঁদের জন্য আদর্শ দই। দুধ ও ছানার তুলনায় দইয়ে ক্যালরিটিক ভ্যালু  কম । সম ওজনের দুধ বা ছানা খেলে যে পরিমাণ শক্তিমূল্য আপনার শরীরে ঢোকে দইতে তা কম। তাছাড়া দইতে দুধ বা ছানার চেয়ে বেশী ভিটামিন পাওয়া যায়। ছানার তুলনায় দইতে কম ফ্যাট বা চর্বি থাকে।
    দই খেলে ঠান্ডা লাগবে বা গলার বারোটা বাজবে এ ভাবনা অনেকের মগজে রয়েছে। এধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। দই ছাড়া দুপুরের খাওয়া শেষ হতো না কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের।  তবে ফ্রিজের ঠান্ডা দই খেলে তাতে কারো কারো গলা বসে যেতে পারে। তার দোষ দইয়ের ঘাড়ে চাপানো যাবে না।  এক্ষেত্রে দায়ী হল অতিরিক্ত ঠান্ডা দই। আর এ ঘটনা তো যে কোনো খাবারেই হতে পারে। আইসক্রিম, জল, ডাল-ভাত যাই খান না কেন। ফ্রিজ থেকে বের করে বেশ কিছুক্ষণ সাধারণ তাপমাত্রায় রেখে দিতে হবে। তারপর সেটা খাওয়া চলতে পারে। দই খেলে অ্যাসিড হয় এ ধারণা এক্কেবারে ভুল। বরং উল্টোটাই হয়; দই খেলে অ্যাসিড কমে।

আগেই বলেছি মাছ, মাংস, ডিমে থাকা জটিল প্রোটিন দই এর ক্রিয়ায় সরল প্রোটিন বা অ্যামিনো অ্যাসিডে পরিণত হয়। বিশেষতঃ এই গরমকালে মাছ, মাংস, ডিম খাওয়ার পরে অবশ্যই টক দই খাবেন। টক দই খেতে যদি আপনার বিশেষ  ইচ্ছে না করে তবে দইয়ের সাথে সামান্য বিট নুন মিশিয়ে নিতে পারেন। দই শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক ও হাড়ের প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম ভালোভাবে সরবরাহ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন বিশেষতঃ গরমকালে প্রতি শিশুকে প্রতিদিন ১৫০ গ্রাম করে দই খওয়া উচিত। দইয়ের এত যে গুণাগুণ বললাম এসবই কিন্তু বাড়িতে পাতা বিশুদ্ধ দুধের দইয়ের ক্ষেত্রে খাটে। বাজার থেকে কেনা রঙিন ও ভেজাল মেশানো দই খেয়ে কারও যদি পেট খারাপ, অ্যাসিড, বদ হজম এসব হয়;  তার জন্য আমাকে আবার গাল দেবেন না।

    বাচ্চাকে কখনই বোতলবন্দি স্কোয়াস, লাল-নীল সরবত, কোলা জাতীয় ড্রিংক্স দেবেন না। আমাদের দেশে এইসব সরবত, স্কোয়াসে প্রিজারভেটিভ তথা সংরক্ষক হিসাবে গ্রেট টু প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়। যা কী না আপনার সোনামনির লিভার ও কিডনিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। শিশুকে কোন অবস্থাতেই ফ্রিজের ঠান্ডাজল, আইসক্রিম দেবেন না। গরম থেকে বাড়ি এলে ঘামভেজা শরীরে প্রথমে যেন ঠান্ডাজল খেয়ে না বসে।  একটু জিরোতে দিন পাখার নিচে বসুক, গায়ের ঘাম শুকানোর পর জল খেতে পারে। এসময় ঠান্ডা-গরমে সর্দি, গলাব্যথা, ফ্যারিনজাইটিস, টনসিলাইটিস আরও হাজার উপসর্গ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখা যায়।
    সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার পরে ও রাতের বেলায় ৮টা কিংবা ৯টায় খাইয়ে দেওয়া উচিত। তাতে খাবার হজম হয় ভালো। খাবার পর হাটাহাটি বা পড়াশোনা করতে পারে। গরমের দিনে ব্রেকফাস্ট বা সকালের খাবার একটু পেটপুরে দেবার চেষ্টা করবেন। দুপুর বেলাতে বাচ্চা যদি বেশি কিছু খেতে না চায় তাহলে খাবার নিয়ে জোরাজুরি করবেন না। এসময় খুব অল্পতেই হজমের গন্ডোগল দেখা দেয়। প্রচন্ড গরমের মধ্যে ঠান্ডা কিছু না খাওয়াই ভালো। এতে শরীরের মৌলবিপাক হার (বেসাল মেটাবলিক রেট) ও আভ্যন্তরীন তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা উল্টো-পাল্টা হয়ে যায়। একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাবেন গরমের দিনে ঠান্ডা খেলে কিছুক্ষণ পর গরম অনুভূতি বেড়ে যায়। উপরন্তু লেবু দিয়ে লিকার চা খেলে দেহে শীতল অনুভূতি আসে। ঝাল, তেল, মশলা যতটা পারা যায় কম খাওয়াই ভালো। খাবার পাতে অবশ্যই স্যালাড খাবেন। দুপুরে খাবার পর প্রতিদিন ফল খাওয়া ভালো। তবে ফলের খোসা ভালো করে ছাড়িয়ে তবেই খেতে দেবেন। ফলের খোসাতে বহু মিনারেলস ও ফাইবার থাকে ঠিকই তবে এখনকার খোসাতে থাকে বেশি মাত্রায় কীটনাশক। এইসব অর্গানক্লোরিক বা অর্গানোফসফরাস কীটনাশক সোনামনির পেটে ঢুকলে আপনার অজান্তেই তাকে নিয়ে যাবে দুরারোগ্য রোগের দেশে। আর দিতে পারেন ছাতুর সরবত। টিভির বিজ্ঞাপন দেখে কমপ্লিট হেল্থ ড্রিংক্স এর চক্করে পড়বেন না। তারচেয়ে তাজাফল, চিড়া, মুড়ি, ছাতু অনেক ভালো। যেসব ডাক্তার-বদ্যি টিভির পর্দায় হেল্থ ড্রিংক্স এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন; জানবেন সেসব চিকিৎসকদের পকেট ভরিয়েছে বড় বড় বহুজাতিক সংস্থা। যারা এই সব হেল্থ ডিংকসের প্রস্তুত কারক ।

 

Join our mailing list Never miss an update