মঙ্গল-মহাজাগতিক ঘটনা ও রটনা

মঙ্গল-মহাজাগতিক ঘটনা ও রটনা

মঙ্গল-মহাজাগতিক ঘটনা ও রটনা; পার্থপ্রতিম; শনিবার ২০ ভাদ্র ১৪১০; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত

গত ২৮ আগস্ট উত্তরবঙ্গ সংবাদ-এর প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘মঙ্গল আজ ভালো করে দেখা যাবে’ শীর্ষক প্রতিবেদনের  প্রতিবাদে এই চিঠি। প্রতিবেদক মালদা-এর জ্যোতির্বিদ সমরেন্দ্র দাস-এর উদ্বৃতিতে জানিয়েছেন-‘মঙ্গল পৃথিবীর কাছাকাছি আসার জন্য পৃথিবীর উপর যে প্রভাব পড়বে তাতে বৃষ্টি কম হবে। বিভিন্ন জায়গায় দাবানল দেখা দেবে, আসবে অন্যান্য দুর্যোগ, বাড়বে মানুষের অপরাধ প্রবণতা।’
পাঠকের প্রশ্ন স্বনামধ্যন্য সমরেন্দ্রবাবু কি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ? নাকি হাতে কোষ্ঠি দেখে পেট চালানো জ্যোতিষী। উদ্বৃতি পড়ে মনে হল দ্বিতীয়টাই সত্যি।
এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারের শেকড় রয়েছে অনেক গভীরে। আসুন শুরু থেকে শুরু করা যাক- আমরা প্রায় সকলেই জানি প্রাচীন কালে মানুষ ছিল গুহাবাসী। তখন ছিল না আলো ঝলমলে বিজলি বাতির রোশনাই। দিনের শেষে প্রকৃত অর্থেই নেমে আসতে অন্ধকার। সেই রাতের আঁধারে গুহাবাসী মানুষ একদিকে যেমন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে আকাশের তারার আলোতে খুঁজে পেতে চেয়েছে তাদের আশা আকাঙ্খার উৎসকে। আকাশের জ্যোতিষ্কদের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে জড়িয়ে ফেলার এটাই শুরু।
    পরবর্তীকালে কিছু উজ্জ্বল তারাকে কল্পনার রেখা দিয়ে যোগ করে প্রাচীন মানুষ ভাবলো এটা মাছের মতো দেখতে নাম হল মীন রাশি। সিংহের মত দেখতে যেটি তার নাম সিংহ রাশি, ছোটবেলায় আমরা অনেকে আকাশের মেঘ দেখে যেমন কল্পনা করেছি এটা হাতির শুঁড়, ঐটা ঘোড়ার মাথা, রাশির ধারণা অনেকটা সেরকম।
এরই মধ্যে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ গ্রহ উপগ্রহের দেবী-দেবতার রূপ দিয়ে পূজাপাট শুরু করে। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে রাহু, কেতুর বাস্তব অস্তিত্ব না থাকলেও জ্যোতিষসমাজে তারা বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি।

প্রাচীনকালে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ছিল সীমিত। সূর্য-চন্দ্রগ্রহণ, ভূমিকম্প এইসব প্রাকৃতিক ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা তাদের সাধ্যের মধ্যে ছিল না। নিজেদের বিচারবুদ্ধি অনুসারে কল্পনাকে হাতিয়ার করে চারপাশের প্রকৃতিকে তারা বুঝতে বা বোঝাতে চেষ্টা করেন। সামন্ততন্ত্রের সময়কালে রাজা ও তার অনুচর ব্রাহ্মণেরা প্রচার করতে শুরু করে যে মানুষের ভাগ্য, ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রিত হয় দূর আকাশের গ্রহনক্ষত্র দ্বারা। রাজা মহারাজারা হলেন সেই ভাগ্যবিধাতা বা ঈশ্বরের ডাইরেক্ট এজেন্ট। এই ধরনের প্রচারের পেছনে যে ক্ষমতাসীনের ব্যক্তি স্বার্থ জড়িত ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্থান ও কাল ভেদে মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণার ছবিটা সব জায়গাতে মোটামুটি একরকম। প্রাচীন রোম সম্রাট নিরো ও ক্যালিগুলা নিজেদের পরিচয় দিতেন ‘নিউ হেলিওস’ বা নতুন সূর্য দেবতা নামে। মিশরীয় সম্রাট ফ্যারাও বলতেন তিনি ‘সন অব অ্যামনরা’ অর্থাৎ সূর্যের সন্তান।
বর্তমানে পাল্টে গেছে সমাজ ব্যবস্থা। জগত ও মহাজগতের অনেক ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আজ আমাদের জ্ঞানের আঙিনায়। তবুও বর্তমান মানুষের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান, মধ্যযুগীয় পিছুটান কিছু মানুষকে করে রেখেছে জ্যোতিষমুখী। আসলে আমাদের সকল সমস্যার কার্যকারণ সম্পর্ক সাধারণ বিচারবুদ্ধি দিয়ে আমরা সবসময় বুঝে উঠতে পারি না। সংকটকালে হারিয়ে যায় আত্মবিশ্বাস ও বাস্তব বিচারশক্তি। বিপদে বা পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে ভগবানের নাম যে একবারও মনে আসেনি একথা বুক চিতিয়ে আমিও বলতে পারবো না।
আমাদের এই বংশানুক্রমিক দূর্বলতা জ্যোতিষীদের কাছে সম্পদ। মানুষের মানসিক দৃঢ়তার অভাবই এই কারবারের মূলধন। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা জানেন ‘দূর আকাশের গ্রহ নক্ষত্রে নয়, মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয় তার আর্থ সামাজিক অবস্থান ও কর্মের দ্বারা।
ঘৃণ্য ক্ষুদ্র স্বার্থে সমরেন্দ্রবাবুদের মতো জ্যোতিবির্দরা এর উল্টো কথাটিই সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। মঙ্গল গ্রহের পৃথিবীর কাছে আসার ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে কোমর বাঁধেন।
মঙ্গলগ্রহ কাছে আসার ফলে যে ধরনের প্রভাবের কথা সমরেন্দ্রবাবু বলেছেন তার কোনো যুক্তিসম্মত ভিত্তি নেই। আগ্রহী পাঠকেরা যদি প্রকৃত বৈজ্ঞানিক তথ্য জানতে চান তবে লগ অন করুন এইসব ওয়েবসাইটে। 'নাসা'-র আবিষ্কৃত সকল তথ্য জানতে পারবেন-
http://cmex –www.arc.nasa.gov, http://marsweb.jpl.nasa.gov, http://mpf://www.jpl.nasa.gov/mgs/                 
-ডাঃ পার্থপ্রতিম। সভাপতি, ডিয়ার; বানারহাট; জলপাইগুড়ি।

Join our mailing list Never miss an update