হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ম্যালেরিয়া দূর হয়

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ম্যালেরিয়া দূর হয়

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ম্যালেরিয়া দূর হয়; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা সংখ্যা তিন; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
বর্ষারাতের শেষে যখন চা-বাগিচার সবুজ গালিচায় আছড়ে পড়ে সোনা রোদের আভা, আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা- প্রতি বছর এ সময়ই দেখা যায় ম্যালেরিয়ার বাড়বাড়ন্ত। এবারেও এ রোগের কবলে বহু লোক আক্রান্ত। ম্যালেরিয়া বেশ আতঙ্কের কারণ হয়ে পড়েছে চলতি বছরে। নানা প্রক্রিয়ায় মশা দমন কিংবা বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কৃত ওষুধ ম্যালেরিয়ার রোগকে বিলীন করতে পারছে না। ডাক্তারি বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে হোমিওপ্যাথিতে ম্যালেরিয়ার অনেক ভাল ওষুধ রয়েছে।
    হোমিও পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে দেখা যায় জ্বর সেরে যাওয়ার পরবর্তী উপসর্গ, যেমন- ক্ষিধে কমে যাওয়া, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা প্রভৃতি অনেক কম থাকে।
    হোমিওচিকিৎসা মূলত রোগ লক্ষণ ভিত্তিক। অর্থাৎ জ্বর কখন আসে, জ্বরের  সঙ্গে কি কি উপসর্গ আছে এ সবের ওপর নির্ভর করে সঠিক ওষুধ কি হবে। অ্যালোপ্যাথির মত সকলের জন্য গড়পড়তা ওষুধ এ ক্ষেত্রে হয় না।
    ম্যালেরিয়া জ্বরের সাধারণভাবে তিনটি অবস্থা থাকে। প্রথমে শীত করে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। তারপর শরীর গরম হয়ে দেহতাপ খুব বেড়ে যায়। শেষে ঘাম হয়ে থাকে। সাধারণভাবে দেখা যায়, ম্যালেরিয়া জ্বর কোন এক নিরূপিত সময়ে আসে। সেই ভিত্তিতে এদের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- জ্বর যদি প্রতিদিন এক নির্দিষ্ট সময়ে আসে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টা পরপর, তাকে কোটিডিয়ান ম্যালেরিয়া (Quotidian) বলে। টার্সিয়ান (Tersian) জ্বর আসে ৪৮ ঘন্টা পর। দিনে দু’বার জ্বর এলে তাকে ডবল কোটিডিয়ান বলে। কোন কোন ক্ষেত্রে জ্বরের বিশেষ কোন বাঁধাধরা নিয়ম পাওয়া যায় না, তাকে বলে ইরেগুলার ম্যালেরিয়া। হোমিও মতে এসব জ্বরের পৃথক পৃথক ওষুধ আছে।
    এ বছরের জ্বরে যে সব ওষুধ খুব বেশি প্রয়োজন হচ্ছে সেগুলি হল- আর্সেনিক এলবাম (Arsenic Album), চিন-সাল্ফ (Chin-sulph), রাসটক্স (Rhustox), চায়না (China), হিপার সাল্ফ (Heper sulph), সালফার (Sulpher), ব্রায়োনিয়া (Bryonia)।
    ম্যালেরিয়া চিকিৎসকদের কিছু কর্তব্য আছে। প্রথমত, রোগীর রোগ লক্ষণগুলিকে তন্ন তন্ন করে দেখা। দ্বিতীয়ত, রোগ লক্ষণগুলিকে শ্রেণীবিভাগ করা। যেমন- রোগীর বিশেষ লক্ষণ, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত জ্বরের সময়ের লক্ষণ, জ্বরের বিরামকালীন লক্ষণ- এই তিনটি ভালভাবে লক্ষ্য করতে হবে। তৃতীয়ত, আগে রোগী কি কি ওষুধ খেয়েছেন তা জানা দরকার। চতুর্থত, সম্ভব হলে জ্বর থাকাকালীন রোগীর রক্ত পরীক্ষা করে নেওয়া। এতে রোগ নির্ণয় সঠিক হবে এবং জানা যাবে ম্যালেরিয়াটি কোন্ প্রকারের। সবশেষে রোগ লক্ষণের সঙ্গে ওষুধের লক্ষণ মিলিয়ে তা প্রয়োগ করা হয়।

    রোগী বারবার অল্প পরিমাণে জল খেতে চায়, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে জ্বর আসে, দেহে অবসন্নতা, রাত ১২ টা থেকে ৩ টে পর্যন্ত জ্বর বাড়ে, দেহে ফোলা ফোলা ভাব (Watery Tension) -এই লক্ষণগুলিতে আর্সেনিক এলবাম দেওয়া যেতে পারে। ঘামের সঙ্গে তৃষ্ণা, প্লীহা ও যকৃৎ অঞ্চলে ব্যথা, মাথাব্যথা, জ্বর আসার আগে বমি করার ইচ্ছা, কানে ভোঁ-ভোঁ শব্দ শোনা এসব ক্ষেত্রে চায়না খুব ভাল কাজ করে। জ্বরের সঙ্গে গায়ে-হাতে-পায়ে ব্যথা, রোগী ছটফট করে, শুষ্ক কাশি, গা মালিশ করলে আরাম পায় সেক্ষেত্রে রাসটক্স দিতে হবে। রোগী অনেকক্ষণ অন্তর বেশি পরিমাণ জল খায়, প্রবল পিপাসা, কোষ্ঠকাঠিন্য, চুপচাপ শুয়ে থাকে, নড়াচড়া করে না, জ্বরের সঙ্গে শুকনো কাশি, জিভ সাদাটে এসব লক্ষণে ব্রায়োনিয়া হবে উপযুক্ত ওষুধ।
    হোমিও চিকিৎসক মাত্রেই জানেন যে সব রোগ সাদৃশ্য লক্ষণ নিয়ে বারবার ফিরে আসে তার মধ্যে সোরা (Psora), সিফিলিস (Syphilis) ও সাইকোসিস (Sycosis) প্রভৃতির কোন একটির বা একাধিক রোগ-বীজ (Miasm) লুকিয়ে থাকে। হ্যানিম্যান তাঁর ‘অর্গানন অব মেডিসিন’ বইতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ম্যালেরিয়া রোগে সোরাঘটিত রোগবীজ প্রবল থাকে। তাই নির্বাচিত ওষুধের সঙ্গে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সোরা দোষনাশক (Deep Antipsoric) ওষুধ, যেমন-হিপার সাল্ফ অথবা সালফার দিতে হবে। ম্যালেরিয়া চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি বিষয় কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত- জ্বর আসার আগের মুহুর্তে রোগীকে কখনও ওষুধ খাওয়ানো চলবে না। যখন জ্বর কমতে শুরু করবে সেই মুহূর্তটি ওষুধ প্রয়োগের উপযুক্ত সময়। জ্বরের পূর্বে ওষুধ প্রয়োগ করলে ওষুধের ক্রিয়া এবং রোগের স্বাভাবিক গতির সাথে মিলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে তাতে রোগীর জীবনহানি না হলেও খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসক বা পরিবারের লোকজনের নির্বুদ্ধিতার জন্য রোগীর মৃত্যু ঘটে।
    ম্যালেরিয়া সৃষ্টিকারী বিভিন্ন প্রকারের জীবাণু রয়েছে। আমাদের দেশে প্লাসমোডিয়াম ম্যালেরি, প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স এবং প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম -এই তিন প্রকার জীবাণু দেখা যায়। উত্তরঙ্গের চা-বাগিচা অঞ্চলে প্লাসমোডিয়াম ম্যালেরি ও প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্সঘটিত ম্যালেরিয়াই বেশি। এই দুই ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধক হিসেবে চায়না-২০০ এবং সালফার-২০০ বেশ ভাল ফল দিচ্ছে। রোগের পরবর্তী দুর্বলতা দূর করতে অ্যালস্টেনিয়া-কিউ ও কালমেঘ-মাদার টনিকের মত ব্যবহার করা যেতে পারে।
    অ্যালোপ্যাথিক মতে ক্লোরোকুইন বা প্রাইমাকুইন খাওয়ার পর পরবর্তী উপসর্গ দূর করার জন্য হোমিওপ্যাথি করা যেতে পারে। তাতে ম্যালেরিয়া পুনঃ আক্রমণের ভয় থাকে না। অনেকের মতে ভ্রান্ত ধারণা আছে, হোমিও এবং অ্যালোপ্যাথিক একই সঙ্গে করা বিপজ্জনক। বিষয়টি তা নয়। আসলে সব চিকিৎসা পদ্ধতিরই কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সুষ্ঠু সন্মিলিতভাবে চিকিৎসা করলে এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা সম্ভব। এটা প্রমাণিত সত্য। উদাহরণের তালিকা দীর্ঘ না করে বলা যেতে পারে ‘লিভ ফিফটি টু’ নামের আয়ুর্বেদিক ওষুধটি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের সাথে সমানতালে চলছে।
    কিছু পদ্ধতিগত তফাত রয়েছে ঠিকই। তা বলে হোমিও এবং অ্যালোপ্যাথি ব্যবস্থা পরস্পরের শত্রু নয়। সবারই উদ্দেশ্য রোগীকে স্বল্প ব্যয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ, সবল করে তোলা। ম্যালেরিয়ার মত মহামারী সৃষ্টিকারী রোগ নির্মূল করতে পরস্পরের সন্মিলিত প্রয়াস খুবই জরুরি। প্রয়োজন হলে হোমিও চিকিৎসকেরাও রোগীকে রক্ত পরীক্ষা করে ক্লোরোকুইন জাতীয় ওষুধ খেতে বলবেন। আর রোগের পুনঃ আক্রমণ রুখতে বা জ্বরের পরবর্তী উপসর্গ দূর করতে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকেরা রোগীকে হোমিওপ্যাথির দ্বারস্থ হতে পরামর্শ দেবেন, এটাই কাম্য।      

Join our mailing list Never miss an update