প্রায় চার দশক আগে আকাশগঙ্গার বালুচর ধরে শুরু তার পথচলা । দিক চক্রবাল দিয়েছিল মায়াভরা ছায়া ছায়া আদুরে আলাপ। অনেক আকাশ তাদের তারকা- রবি- শশী নিয়ে আলোকময় ক’রে রেখেছে একলা পথিকের চলার পথ। সেই সূর্যস্নাত যাত্রাপথের গোধূলিবেলায়; পথিক মনের সিংহাবলোকন। আড্ডা উৎসারিত ব্যতিক্রমী জীবনের সে উপাখ্যান- আজ অক্ষরবন্দী।
সম্পাদনা- অনুপম আচার্য; আইনজীবী উচ্চন্যায়ালয়, কোলকাতা। উচ্চতম ন্যায়ালয়; নিউদিল্লী।
গ্রন্থনা- উৎপল মৈত্র; কোলকাতা।
তার বাবা, মাসি, মামা, আরো কয়েক নিকটজন মারা গেছেন হার্টের রোগে। জ্যাঠামশাই সুকুমার বসু অপরিণত বয়সে হৃদরোগে পাড়ি দেন অমৃতলোকে। স্ত্রী, তিন কন্যা ও গর্ভস্থ এক পুত্রকে রেখে যান ধরার বুকে। বেদনা বিধুর থেকে বহু কালজয়ী গান- সঙ্গীত- কাব্য-উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে। এ কোনো নতুন কিছু নয়; অতীত থেকে বর্তমান, এ ধারা নিত্য বহমান। এক্ষেত্রে একেবারে ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটলো। চিকিৎসা বিজ্ঞান। তার মনস্তাপ ফুল হয়ে ঝরে পড়লো সাদা কাগজে, কালো হরফে; হার্টের রোগ নিয়ে বই লেখা শুরু করলেন ডাঃ পার্থপ্রতিম। তার প্রথম বই ‘হৃদবিজ্ঞান’ বা ‘কার্ডিওলজি’ সংক্রান্ত- ‘‘হৃদয়ের কথা’’। হার্ট কী? হার্টের রোগ কত প্রকার? এর সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি কোনটি? কী ভাবে রুখে দেওয়া যায় এই মারণব্যাধিকে ? এসব নিয়ে জনমানসে বহু অজ্ঞতা ও ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে; রয়েছে বহু মিথ। যা দূর করা দরকার। তিনি পরিকল্পনা করলেন প্রথমে বইটি ছোটো ছোটো স্বনির্ভর প্রবন্ধ আকারে সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশ করবেন। এর ফলে তার প্রবন্ধগুলির সম্বন্ধে জনমানসে কি প্রতিক্রিয়া হয় তা তিনি অনুধাবন করতে পারবেন। কোথায় সংযোজন বা সংশোধনের প্রয়োজন সেগুলিও চিহ্ণিত করা হবে। তারপর তৈরী করা হবে মূল বইটি।
এই বইটির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট হবে, এর প্রতিটি পর্যায়ই স্বয়ং সম্পূর্ণ। অর্থাৎ প্রয়োজনে পাঠকেরা যে কোনো একটি বিষয় পড়ে বিষয়বস্তু সহজে বুঝতে পারবেন। অধ্যাপকদের তত্ত্বাবধানে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ সেভাবে পাননি। তারপর একটা বিশেষ বিষয়ে বাংলাভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের গ্রন্থ লেখা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। তারপর লেখক রয়েছেন মহানগরী থেকে আটশো কিলোমিটার দূরে। ডুয়ার্সের এক পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক উপখন্ডে। যেখানে তার আশেপাশে এমন কোনো মানুষ নেই যার সাথে আলাপ-আলোচনা করে তিনি কিছুটা হলেও এগোতে পারেন। কোলকাতা বা অন্য কোনো মহানগরীতে বসে যে মানুষটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রবন্ধ লিখছেন- কোনো জায়গায়, কোনো বিষয়ে যদি তার বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় তিনি সহজেই মহানগরীর বুকে থাকা যে কোনো অভিজ্ঞ চিকিৎসক বা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপকের সাথে যোগাযোগ করে সে বিষয়টি সহজে বুঝে নিতে পারেন। যে সময়কার কথা বলছি তা প্রায় তিরিশ বছর আগেকার। নেট দুনিয়া বা গুগলের দাপট তখন সাধারণ মানুষের থেকে অনেক দূরে। তাই পুরোটাই ল্যান্ড ফোন বা চিঠি চাপাটির ওপর নির্ভরশীল।
পিছিয়ে পড়া এলাকা থেকে রোমান্টিক গল্প, উপন্যাস বা ভাবে গদ-গদ কবিতা বহু লেখা হয়েছে। আগামীতেও লেখা হবে। তবে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে লেখার স্পর্ধা এর আগে কোনো মানুষ করেছেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ নেই। চমকপ্রদ কাজ শুরু করা চিরকালই কঠিন। তবে কিছু কিছু মানুষ এই ধরার বুকে ধরা দেন এমন এক প্রত্যয় নিয়ে; যা বহু মানুষের কাছে বিস্ময়-এর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ মানুষই প্রচলিত লাইন বা সরণিতে দাঁড়াতে অভ্যস্ত। কিছু মানুষ আছেন তারা যেখানে দাঁড়ান; সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন সরণি।
পকেটে যা কিছু টাকাকড়ি, সঞ্চয় ছিল তা নিয়ে ছুটে এলেন কোলকাতায়। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ করলেন। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপকদের সাথে পরামর্শ নিয়ে তৈরি করলেন গ্রন্থতালিকা। অর্থাৎ যে বইগুলি তাকে কিনতে হবে, পড়তে হবে, বুঝতে হবে। তারপর লিখতে হবে বাংলা ভাষায়। ডেভিডসন’স প্রিন্সিপল এন্ড প্র্যাক্টিস অফ মেডিসিন (DAVIDSON’S PRINCIPLE AND PRACTICE OF MEDICINE), হ্যারীসন্স প্রিন্সিপল অফ ইন্টারন্যাল মেডিসিন (HARRISON’S PRINCIPLES OF INTERNAL MEDICINE), জে. ল্যারী জেমসন (BY J. LARRY JAMESON), কার্ডিওলজি; ফান্ডামেন্টালস এন্ড প্র্যাক্টিস- ডেভিড এইচ স্পোডিক (CARDIOLOGY: FUNDAMENTALS AND PRACTICE- BY DAVID H. SPODICK, ব্রাউনওয়াল্ড’স হার্ট ডিজিস (BRAUNWALD’S HEART DISEASE) এ টেক্সটবুক অফ কার্ডিওভাসকুলার মেডিসিন (A TEXTBOOK OF CARDIOVASCULAR MEDICINE),
তিনি এমন জায়গায় থাকেন যেখানে তাকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের জটিল ভাষা সব জানতে হবে । তাই, এর পাশাপাশি তাকে কিনতে হবে বেশ কিছু মেডিক্যাল ডিকশনারি- মেরিয়াম-ওয়েবটার’স মেডিক্যাল ডিকশনারি (MERRIAM- WEBTER’S MEDICAL DICTIONARY), মসবি'স মেডিক্যাল ডিকশনারি (MOSBY’S MEDICAL DICTIONARY), ডরল্যান্ড’স ইলাসট্রেটেড মেডিকেল ডিকশনারি(DORLAND’S ILLUSTRATED MEDICAL DICTIONARY) ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ইলাসট্রেটেড মেডিকেল ডিকশনারি(BRITISH MEDICAL ASSOCIATION ILLUSTRATED MEDICAL DICTIONARY) . . ধার দেনা করে কিনেও নিলেন বইগুলি।
উত্তরবঙ্গের এক দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক পাতায় প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হতে থাকল ডাঃ পার্থপ্রতিমের ‘‘হৃদয়ের কথা’’। বহু মানুষের শুভেচ্ছা বার্তা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরামর্শ, কিছু ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসা ও প্রয়োজনীয় প্রশ্ন পাঠাতে থাকল পাঠককূল। পার্থবাবু যেহেতু বিভিন্ন বিষয়ের সাথে কম্পিউটার গ্রাফিক্স- এর বিষয়টিও শিখেছেন, তাই তার এই বইটির অলংকরণের বিভিন্ন কাজ তিনি নিজ হাতে শুরু করলেন।
‘‘হৃদয়ের কথা’’ লেখার ও টাইপের কাজ যখন শেষ পর্যায়ে তখন তিনি বইটির কিছু অংশ পাঠালেন অগ্রজ শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যালের কাছে। নারায়ণ বাবু ‘‘হৃদয়ের কথা’’ কিছু অংশ পড়ে আপ্লুত হয়ে যান। তিনি নিজের ঢং-এই বইটির মুখবন্ধ লিখে পাঠিয়ে দেন। তিনি শুধু মুখবন্ধ লেখা নয়, এই লেখার সাথে সংশ্লিষ্ট ছবি এঁকে পাঠান। মজার বিষয় হলো ছবিতে রয়েছে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি।
পার্থপ্রতিম বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। সে একই দর্শনে বিশ্বাসী সত্যজিৎ রায়ের বহু ছবির অভিনেতা ডাঃ শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের সৈনিক। সেই সুত্রেই পার্থপ্রতিমের সাথে হার্দিক সম্পর্ক। শুভেন্দুবাবু ১৯৬০ সালে কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল থেকে এম.বি.বি.এস পাশ করেন। তারপরে চলে আসেন চলচ্চিত্রের জগতে। বাকীটা ইতিহাস। পার্থপ্রতিমের হৃদয়ের কথার পান্ডুলিপি পড়ে তিনি ছবিসহ তার অভিমত জানিয়ে দেন। যা ছাপা হয়েছিল বইটির শেষ প্রচ্ছদে।
ডাঃ ভূমেন্দ্র নাথ গুহ প্রথিতযশা চিকিৎসক, কবি ও সাহিত্যিক। কবি জীবনানন্দ অন্তপ্রাণ। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মাস্টার অফ সার্জারি করেন। ১৯৬২ সালে ভারতবর্ষের প্রথম সফল ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল কোলকাতায়। বিখ্যাত হৃদশল্য চিকিৎসক অজিত কুমার বসুর ছাত্র ও সহকারী হিসেবে সেই অস্ত্রোপচারে ছিলেন ডাঃ বি.এন.গুহ। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর, তাঁর হাত ধরেই কার্ডিয়ো ভাস্কুলার থোরাসিক সার্জারি (সিভিটিএস) এর মতো একটি সুপার স্পেশালিটি বিভাগ চালু হয় এস.এস.কে.এম-এ। এই কার্ডিওথোরাসিক সার্জেন পার্থপ্রতিমের প্রয়াসকে মুক্তকন্ঠে প্রশংসা করেন। পার্থপ্রতিমের নামের সাথে পদবী ব্যবহার না করার দর্শনটি তার বেশ মনে লাগলো। যে বিষয় ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে পার্থপ্রতিম ‘হৃদয়ের কথা’ র মতো এক তথ্য সমৃদ্ধ বই লিখেছেন ডাঃ গুহ তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করার পরে, হঠাৎ করে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে ডাক্তারি শাস্ত্রে চলে আসা। শুধু রোগীর চিকিৎসা নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই লিখে গুণী মহলে সাড়া ফেলে দেওয়া। এই ধরনের আজব কান্ডকারখানা এ দেশে বিরল।
২০০১ সালে কোলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হলো পার্থপ্রতিমের ‘হৃদয়ের কথা’।
১৭ মার্চ ২০০১ (শনিবার); আনন্দবাজার পত্রিকা লিখল- “বাঙালি অসুখ-বিলাসী। অন্যেরা অসুখ হলে ছোটে বাঙালির কাছে, আর বাঙালি অসুখ হতে পারে ভেবে লাইন দেয় ডাক্তারখানায়। তবে স্বাস্থ্য এখন চলে এসেছে ‘লাইফস্টাইলের’ পাতায়। সুখের মাঝেও অসুখের চিন্তা করতে হবে, এই বিধান দিচ্ছেন ডাক্তাররাই।
অতএব বই পাড়াতেও স্বাস্থ্যের পেশি আস্ফালন। আলোচ্যের মধ্যে পাঠযোগ্যতায় প্রথম স্থান পাবে পার্থপ্রতিমের হৃদয়ের কথা। লেখা সরস ও আলাপি, অলংকরণ দৃষ্টিনন্দন। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি সব মতই ঠাঁই পেয়েছে। নানা ধরনের হৃদরোগ ও তার চিকিৎসা, রোগীর সাবধানতা, পরিবারের অবশ্যকর্তব্য- এর সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ব্যাধির কথাটাও ভুলে যাননি লেখক। স্বচ্ছন্দে লিখেছেন, ‘রোগী বা তার পরিবারের কাছ থেকে বিরাট পরিমাণ অর্থ উপার্জনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে তেমন প্রয়োজন না থাকলেও রোগীর করোনারী বাইপাস অপারেশন করা হয়।’ . . ”
দেশ; ৪ মে ২০০২; সংখ্যায় লিখল- পৃথিবীর সেরা যন্ত্রটি নিঃসন্দেহে মানুষের হৃদয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, কখনও কখনও একশো বছরেরও বেশি নিরলস ভাবে কাজ করে যাওয়ার নজির আছে কোন্ মনুষ্যসৃষ্ট যন্ত্রের? সত্তর বছরের জীবনে একজন মানুষের হৃৎপিন্ড কেবল সংকুচিত প্রসারিত হয় প্রায় দুশো পঁয়ষট্টি কোটি বার। ওই সময়ের মধ্যে এই যন্ত্রটি, যা আসলে একধরনের পাম্প, রক্ত সরায় প্রায় ২২ কোটি ৭ লক্ষ লিটার। মানুষ তার এই অঙ্গটিকে যেমন ভয় পায়, তেমনই ভালোবাসে; হৃদয়ের কথা শুনিতে সে ব্যাকুল। শ্রী পার্থপ্রতিম আমাদের সেই আকাঙ্খা মেটাতে চেষ্টা করেছেন। হৃৎপিন্ড সম্পর্কে জরুরি জ্ঞাতব্য প্রায় সমস্তই তিনি ব্যক্ত করেছেন প্রাঞ্জল ভাষায়। এর গঠন, কার্যপ্রণালী, হৃদয়ঘটিত রোগ, তার নিরাময়, অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক ইত্যাদি বিভিন্ন মতে চিকিৎসার বর্তমান সুযোগ-সুবিধা, হৃদয়কে নীরোগ রাখার উপায়, এমনকী সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলির হালহদিশও পাওয়া যাবে এই বইতে। শ্রী পার্থপ্রতিমের এই চেষ্টা খুবই প্রশংসনীয়। কিছু কিছু অসাবধানী উক্তি, যেমন, লেসারের পরিচিতি দিতে গিয়ে ‘‘আলট্রাভায়োলেট ও ইনফ্রারেড রশ্মির মাঝামাঝি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে রয়েছে লেসাররশ্মি” বা “হৃদয় কথাটির মধ্যে প্রায় বিপরীতার্থক দুটি ধাতু আছে, ‘হৃ’ (হরণ করা বা নিয়ে যাওয়া ও ‘দয়’ দয়া বা অনুকম্পা করা)” এড়ানো যেত।
সাপ্তাহিক বর্তমান ২৮ এপ্রিল ২০০১ লিখল- ‘হৃদয়ের কথা’ বইটির লেখক ডাঃ পার্থপ্রতিম। লেখক অল্পকথায়, সরসভাষায়, চিত্রে বিচিত্রে, মানুষের হৃদপিন্ডের জন্ম-মৃত্যু, রোগ, নীরোগ, গঠন ও কাজ নিয়ে যে কত সব জরুরী কথা বলেছেন- তা বইটি নেড়ে-চেড়ে দেখলে মালুম হয়।
‘হৃদয়ের কথা’তে ডাঃ পার্থপ্রতিম হৃদযন্ত্রের গঠন প্রণালী, কার্যপদ্ধতি থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান হৃদরোগের লক্ষণ, উপসর্গ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
শুধু তাই নয়, হৃদরোগীরা কিভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন এবং অসুস্থ হলে, কোথায় গেলে সুচিকিৎসা সম্ভব-তারও হদিস দিয়েছেন। এককথায়, বইটি হার্টের রোগী ও তাঁর পরিবারের কাছে মলাটবন্দী জীবনের আশ্বাস।
উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় ২৮ এপ্রিল ২০০১ প্রকাশিত হলো- হৃদয় দিয়ে বলা হৃদয়ের কথা। ব্যাকুল হৃদয়ের জ্বালা কিংবা বিকল হৃদয়ের যন্ত্রণা- ভুক্তভোগীই কেবল জানে তার মর্ম। ‘হৃদয়ের কথা’ গ্রন্থে ডাঃ পার্থপ্রতিম মানব হৃদয়-অঙ্গের কথা ব্যক্ত করেছেন হৃদয় দিয়ে, একেবারে সরস ঘরোয়া মজলিশি ভঙ্গিতে। হৃদয় শুধুমাত্র একটি অঙ্গ বা যন্ত্র নয়। জীবন ও মৃত্যুর মাঝে ‘হৃদয় হল সেই অঙ্গ যার নড়াচড়ার মধ্যেই আছে আমাদের জীয়ন কাঠি। বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও আজও হৃদরোগের কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। কারণ, হৃদরোগ জীবাণু ঘটিত রোগ নয়। তাই রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়াই একমাত্র পথ। এ ব্যাপারে স্বল্প পরিসরে সহজ ভাষায় সার্বিক আলোকপাত করার কাজটি লেখক ‘হৃদয়ের কথায়’ সার্থকতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। গোটা চল্লিশেক স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবন্ধে হার্টের গঠন, বৈচিত্র্য, কার্যপদ্ধতি, উচ্চ এবং নিম্নরক্তচাপ সমস্যা, বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগ (হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেল, সেরিব্রাল স্ট্রোক), ডায়াবিটিস, কোলেস্টেরেল মেদবৃদ্ধিজনিত সমস্যা, বাইপাস সার্জারি, পেস মেকার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি রয়েছে হৃদরোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকারের উপায় এবং হৃদরোগীর পথ্য-কুপথ্য নিয়ে পরামর্শ। আরও রয়েছে অ্যালোপ্যাথ, হোমিওপ্যাথ ও আয়ুর্বেদ পদ্ধতিতে চিকিৎসার নির্দেশ। আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির হদিশ সহ হৃদরোগ-চিকিৎসার খরচপত্র এবং চিকিৎসা কেন্দ্রগুলির বিস্তারিত খবরাখবরও লেখক এই পুস্তকে সংযুক্ত করেছেন। বিষয়সূচীর তালিকা থেকেই অনুমান করা যায় পুস্তকটি একজন হৃদরোগী ও তার পরিবারের জন্য কতটা উপকারী এবং প্রয়োজনীয়।
বর্তমান সময়ে অধিকাংশ চিকিৎসক যখন অর্থ উপার্জনের ইঁদুর-দৌড়ে দিনরাত ছুটছেন সেখানে ডাঃ পার্থপ্রতিম অনেক শ্রম ও সময় ব্যয় করেছেন পুস্তকটি রচনাতে। তবু পুস্তকটি সম্পর্কে আলোচনাকালে খুঁতখুঁতে চিকিৎসকদের অনেকে বলবেন হৃদয়ের কিছু কিছু কথা তো না বলা রয়ে গেল। আবার, কোনো শিক্ষাভিমানী চিকিৎসাজীবী হয়তো এতসব গূঢ় তথ্য সাধারণে বিতরণের অপরাধে অপরাধীর কাঠগড়ায় তুলবেন লেখককে। সরস ভঙ্গিতে লিখিত পুস্তকটির সাবলীলতা স্বীকার করেও অনেক সাহিত্য-আলোচক, হৃদয়ের অসুখের অনিশ্চিত পরিণামের পরিপ্রেক্ষিতে লেখকের- ‘হার্ট অ্যাটাক হলো এমন একটি ব্যাধি যা অল্প সময়ের মধ্যেই আপনার নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দিতে পারে।’ এর মতো উক্তিতে অস্বস্তি ব্যক্ত করতে পারেন।
কিন্তু এসব কিছুর ঊর্ধ্বে ‘হৃদয়ের কথার’ সাদা পৃষ্ঠার কালো অক্ষরে অক্ষরে একজন হৃদরোগী এবং তার পরিবার পাবেন মলাটবন্দি জীবনের আশ্বাস। আর সাধারণ পাঠক লেখকের মধ্যে পাবেন একজন সমাজসচেতন, মানব-দরদী ডাক্তারকে। এভাবেই পার্থপ্রতিম হয়ে উঠেছেন, ডাক্তার হিসেবে রোগীর বন্ধু এবং লেখক হিসেবে সফল। পুস্তকটির প্রচ্ছদ-মুদ্রণ-বাঁধাই সুন্দর। ‘হৃদয়ের কথা’-র বহুল প্রচার কাম্য।
এমন আরো বহু সমালোচনা প্রকাশিত হতে থাকলো আজকাল, ত্রিপুরার জ্ঞান বিচিত্রা, মাসিক গণস্বাস্থ্য আরো বহু পত্র-পত্রিকায়। প্রশংসিত হলো গুণীজন মহলে।
♦ ♦ ♦
সুকল্যাণ ভট্টাচার্য; প্রধান শিক্ষক- ২০০৮-র ডিসেম্বরে বানারহাটে আসবার পরেই পার্থবাবুর সাথে আমার পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা। তার সাথে পরিচয়ের ‘এক যুগ’ সময় পার হলেও তাকে পুরোপুরি চেনা, বোঝা যেন এখনও হয়ে ওঠেনি। কথায় কথায় ছড়া বানিয়ে ফেলতে পারেন। যে কোনো সময় রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত, নজরুল, জীবনানন্দ থেকে মানান সই কবিতার পংক্তি বলে যেতে পারেন। আড্ডা-গল্পের ক্লাইম্যাক্স পুরোনো দিনের কালজয়ী বাংলা গানের কলি গুনগুন করে মজা করার সহজাত গুণ ডাঃ পার্থপ্রতিম আমার কাছে সত্যিই মজার। গিটার, খোল, তবলা, উকুলেলে যখন যেটা মনে হয়েছে সেটা নিয়েই বেশ মজে থাকেছেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ, জটিল, ঘূর্ণবাতের সময়ে একসাথে পদচারণায় বহুবার তার সাথে আমার মতান্তর হয়েছে- মনান্তর হয়নি। পার্থবাবুর সহধর্মিণী সুকন্যা জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র বি.এড ট্রেনিং কলেজে আমার সহপাঠী। বর্তমানে সে আমারই সহকর্মী। তাই বিভিন্নভাবে আমাদের সম্পর্কটা বেশ নিবিড়।
প্রান্তিক ডুয়ার্সের জাতিগত বৈরীতার অস্থির সময়ে বহু সময় একসাথে কেটেছে, বানারহাটে সরকারী হিন্দী কলেজ স্থাপনার আন্দোলনে, ডুয়ার্স দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর অনাবিল আনন্দে ঘুরে বেড়ানো, বানারহাট ব্লক তৈরীর মিছিল- সভায় একসাথে পথচলা- মনে আছে, মনে থাকবে। স্কুলের পরিচালন সমিতিতে সরকার মনোনীত শিক্ষানুরাগী সদস্য হিসেবে একসাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনোসময় মতের অমিল হলেও; খুঁনসুটি অব্যহত থেকেছে। অনেক সময়ই দুজনে- দুজনকে যেন ঘটমান বাস্তবতার পরে বুঝতে পেরেছি। ডাঃ পার্থপ্রতিমকে আমি ‘পার্থবাবু’ সম্বোধন করি- হ্যাঁ, ওনার সাজ-পোশাক, চলা ফেরা সবেতেই ‘বাবুয়ানা’ সত্যিই আছে।
অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতায় অনেক স্মৃতিই উজ্জ্বল। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ‘নেতাজী’-র মূর্তি স্থাপন ও উদ্যান তৈরীতে তার নিরলস পরিশ্রমের কথা ভোলা যবে না। বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে তিনি বহু বই দান করেছেন। তার কথায়-“একটি বই যত বেশী লোক পড়বে ততই তার সাথে ভ্যালু এড হয়।”
নিজের ব্যক্তিগত জীবনচর্যার পরিসরে পথ চলতে গিয়ে যখনই কোনোসময় হতাশা গ্রাস করেছে, তখনই তিনি এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন সামাজিক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। তার লেখা ‘ডায়াবেটিসের মোকাবিলায়’ পুস্তিকাটি আমাকে উৎসর্গ করেছেন।
প্রান্তিক এলাকায় থেকেও বিভিন্ন সৃজনধর্মী কাজের মধ্য দিয়ে নিজের একটা বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছেন ডাঃ পার্থপ্রতিম; যা এককথায় উল্লেখযোগ্য বিষয়।
♦ ♦ ♦
তিনি একাধারে আঞ্চলিক, প্রাদেশিক, দেশীয় ও বিশ্বজনীন; ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’। নিজের জন্মভূমি বানারহাটের প্রতি তার অদম্য টান। বানারহাট, ভূটান হিলসের পাদদেশে চা-বাগিচা অধ্যুষিত এক জনপদ। বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য ব্যবহারযোগ্য জলের স্তর ভূপষ্ঠের ২৭৫-৩০০ ফুট নীচুতে। এই পাহাড়ি পাথুরে অঞ্চলে সরকারী গভীর নলকূপ ছাড়া আর কোনো জলের উৎস নেই। দৈনিক সরবরাহের মাত্রা ছিল মাথাপিছু ১১.৬ লিটার। পানীয় জলের সংকট আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে যখন বিদ্যুৎ গোলযোগের জন্য সবে ধন নীলমণিও অচল হয়ে পড়ে। আগে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হলে ডিজেল পাম্প চালানো হত। ব্যয় সংকোচন নীতির ফলে ডিজেল পাম্পের ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক পাম্পই এখন একমাত্র ভরসা। আজ থেকে প্রায় তিনদশক আগে ‘নানা সমস্যায় জর্জরিত বানারহাটের মানুষ’ শিরোনামে কলম ধরেছিলেন পার্থপ্রতিম। ৮ই নভেম্বর; দৈনিক বসুমতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার বড় প্রতিবেদন। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ডুয়ার্স ও বানারহাটের অনুন্নয়ন নিয়ে তার সোনার কলম প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়েছে। বানারহাটের প্রাকৃতিক রূপ বর্ণনা করে তিনি দাবি জানিয়েছেন- বানারহাটে গড়ে তোলা হোক পর্যটনকেন্দ্র। ধূপগুড়ি ব্লকের দুটি থানা ছিল- বানারহাট ও ধূপগুড়ি। বানারহাট থানাকে নিয়ে ব্লক গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। বহু দশক ধরে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি শোনা গেলেও বানারহাট ব্লক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। ‘বানারহাট ব্লক না হওয়ার সার্বিক ব্যর্থতা’- এই শিরোনামের তার লেখা প্রকাশ হয় এক দশকেরও বেশি আগে। পরিসংখ্যান ও যুক্তিতে ঠাসা তার এই প্রতিবেদন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সম্ভবত বানারহাট ব্লকের দাবি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন এটাই প্রথম। তারপরে রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে। অবসান ঘটেছে ৩৪ বছরের বাম শাসনের। তবুও একদশক পর্যন্ত বানারহাট ব্লক হিসেবে ঘোষিত হয়নি। তাই আবারো কলম ধরেছেন, একই দাবিতে- “বানারহাটে ব্লক অফিস প্রত্যাশার পারদ তুঙ্গে”। পরবর্তীকালে বানারহাটে ব্লকের দাবিতে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তৈরী হয় ‘বানারহাট ব্লক ডিমান্ড ফোরাম।’ পার্থপ্রতিম সেই ফোরামের সহ সভাপতি। তারপর একদিন জনগনের দীর্ঘদিনের কাঙ্খিত দাবি বানারহাট ব্লক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
স্বাধীনতা লাভের পর দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার এক অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। তবে ডুয়ার্সে রেলপথের দৈর্ঘ্য ও রেল স্টেশনের সংখ্যা স্বাধীনতার পরবর্তীকালে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। শিলিগুড়ি জংশন থেকে আলিপুরদুয়ার জংশনের মধ্যে আগে যেসব ট্রেন যাতায়াত করত, তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ডুয়ার্সে এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতির বিষয়ে সোচ্চার হয় তার জেহাদি কলম। “সংকটে ডুয়ার্সের রেলপথ, চাই সঠিক পদক্ষেপ” এই শিরোনামে তিনি দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায়। পরবর্তীতে তার এই আবেদন রেলমন্ত্রকের মান্যতা পায়। বানারহাট রেল স্টেশনে কলকাতাগামী ট্রেনের স্টপেজ হয়। সেদিনের সেই উদ্বোধন মঞ্চে আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়েন এই কলমধারী শ্রমজীবী।
বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়, বানারহাট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, বানারহাট তরুণ সংঘ গ্রন্থাগার এইসব বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে পাতাজোড়া আলেখ্য তার কলম থেকে দৈনিক পত্রিকার পাতায় উঠে এসেছে বারবার। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন- ‘ডুয়ার্সের উন্নয়ন বারবার বাধা পায় কেন?’ তার এইসব দীর্ঘলেখা নিয়ে বহু সমালোচনা, শুভেচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকার পাতায় পাতায়। ডুয়ার্সের পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য মাস্টার প্ল্যান দরকার। দরকার নতুন নতুন ভ্রমণ সার্কিট গড়ে তোলা। এর পাশাপাশি পিলগ্লিম, এথোনিক ট্যুরিজম এসব নিয়েও নতুনভাবে ভাবা দরকার একথা তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশে বলেছেন, লিখেছেন পত্রিকার পাতায় পাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকায় “এইখানেতেই হৃদয় আমার গেছে চুরি” শীর্ষক তার আত্মকথনমূলক প্রবন্ধে; তিনি তুলে ধরেছেন চা-বাগিচা এলাকার ইতিকথা। এখানকার জনমানসের না চাপা হাসি, না মাপা কান্না।
বানারহাট থানার অর্ন্তগত ভূটান লাগোয়া গ্রাম চামুর্চি। চামুর্চির অদূরে ভূটান সীমানায় রয়েছে “স্ট্যালাকটাইট- স্ট্যালাগমাইট কেভ”; স্থানীয় ভাষায় মহাকাল গুহা। চুনাপাথর বা ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের সঙ্গে পাহাড়ি আম্লিক জলের রাসায়ানিক ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলে এই আঁধার ঘেরা কন্দরে। চামুর্চি থেকে হাঁটা পথে পাহাড়ি পাকদন্ডি ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় মহাকাল মন্দিরে। পাহাড়ে ট্রেকিং করা যাদের নেশা, এ পথ তো তাদের কাছে স্বর্গরাজ্য। প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়ালে পাহাড়ের গুহার ভেতর নেমে এসেছে পাথরের তৈরী লম্বা লম্বা শিবের জটা। এগুলি আবার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জটা থেকে অবিরাম টুপটাপ ঝরে পড়ছে জলবিন্দু। এই জলে রয়েছে কিন্তু দুরারোগ্য চর্মরোগ আরোগ্য ক্ষমতা।
পার্থপ্রতিমবাবু প্রায় ২৫ বছর আগে উত্তরবঙ্গে জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায় লিখেছিলেন- এই এলাকায় রিসর্ট বা ট্যুরিস্ট সেন্টার গড়ে তোলার যৌক্তিকতা। পিলগ্রিম ট্যুরিজ্যম নিয়ে ডুয়ার্স এলাকায় নতুন পর্যটন শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা। তার এই সুচিন্তিত সৃজনশীল ভাবনা বাস্তব রূপ পেয়েছে। চামুর্চিতে গড়ে উঠেছে ইকোট্যুরিস্ট পার্ক। গ্রাম থেকে অঞ্চল, অঞ্চল থেকে বিভাগ উত্তরবঙ্গের না বলা কথা বাঙ্ময় হয়েছে তার লেখনিতে। তার লেখা প্রতিবেদনগুলি তথ্য ও পরিসংখ্যানের সাথে সাথে সাহিত্যের উৎকৃষ্ট রসে টইটম্বুর। এরসাথে তার আবেদনগুলির মধ্যে থাকে যুক্তির শাণিত ফলা। তাই তার লেখা গভীর ছাপ ফেলে যায় পাঠকের হৃদয়ে। সাংবাদিক তুষার প্রধানের সাথে যৌথ প্রয়াসে কলকাতা দূরদর্শনে বিশেষ ধারাবাহিক অনুষ্ঠান করেন ডুয়ার্সের বিভিন্ন শিল্প সম্ভাবনা নিয়ে। তিনি কখনো গ্রামীণ- আঞ্চলিক, কখনো আবার বিশ্বজনীন। নানা ছন্দে তার মন বলাকা; হৃৎগগনে মেলে পাখা . . .।
তাদের আদিবাড়ি ছিল ওপার বাংলার খুলনা শহরে। তার পিতামহ মণীন্দ্রলাল বসু ছিলেন খুলনা আদালতের আইনজীবি। ঠাকুরমা প্রভাবতী দেবী। রূপসা- ভৈরবের রূপোলী মাছ, বরিশালী বালামের সোনালী ধানের সৌরভে তাদের জীবন ছিল মধুমাখা। তারপর একসময় দেশ জুড়ে শুরু হল স্বাধীনতা আন্দোলন। বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে একদিন এল কাঙ্খিত স্বাধীনতা। আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে উত্তরের হিমালয় থেকে সাগরচুম্বী ভূখন্ড। তবে, সুখের সেই উন্মাদনা দু’দিনও টিকলো না। সুখের শরীরে দগদগে ক্ষত নিয়ে এল নতুন এক অসুখ ‘‘দেশভাগ’’। বহুদিনের লালিত স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে চুরমার। তারপরের ইতিহাস অনেকেরই জানা।
পার্থপ্রতিমের পরিবার সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে আঁধারে ভোরের আলো ফোটার আগেই রওনা দিল নতুন মাটির সন্ধানে। সে সময় ঠাকুমা প্রভাবতী দেবী কাপড়-চোপড়ের সঙ্গে নিয়ে আসেন তামাক রাখার ছোট্ট ডাবর। পরিবারের ধূমপানের উপকরণ রাখার ছোট জার্মান সিলভারের বাক্স। পিছে পড়ে রইল মধুমতী নদী, সারি বাঁধা তালসারি, ক্ষীরশাপাত আম আরোও বহু কিছু। উদ্বাস্তু পরিবার নতুন মাটির খোঁজে চক্কর কেটেছে কখনও দক্ষিণবঙ্গে, কখনও অসমে, কখনও বা ভীন রাজ্যে। তারপর একসময় পার্থপ্রতিমের বাবা সুশীল কুমার বসু ভারতীয় রেলে চাকরি পান। উত্তর পূর্বের বহু জায়গায় ঘুরে চলে আসেন বানারহাটে। বানারহাট রেলওয়ের গুডস্ অফিসের দায়িত্বে। যৌথ পরিবার এসে আশ্রয় নেয় বানারহাট রেল কোয়ার্টারে। সেখানেই জন্ম পার্থপ্রতিমের। এরপর তারা বানারহাট আদর্শপল্লীতে টিনের চালাঘরে। স্বদেশ স্বজনহারা এই পরিবারের সেটাই হয়ে ওঠে একমাত্র মাথা গোঁজার ঠিকানা।
পার্থপ্রতিম শৈশবে ঠাকুমার কাছে শুনেছিলেন- দেশ বাড়ির কথা। বাড়ির সামনে বৈঠকখানা, সেখানে দেওয়ালের একপাশে স্তরে স্তরে সাজানো থাকতো বহু ধরনের বিভিন্ন মাপের গড়গড়া বা হুকো। আচার অনুষ্ঠানে বৈঠকখানায় ফরাস বা শতরঞ্জি বিছানো হতো। গড়গড়ায় জল পাল্টে ভরা হতো তামাক।
তার পরাণের নস্টালজিক কবিমন আজন্ম তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তাই সেই ফেলে আসা গড়গড়ার কথা মনপবনে দোলা দেয়। বহু বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিনি সংগ্রহ করে চলেছেন গড়গড়া ও হুঁকো।
সেই ডাবর আর বাক্স আজও রয়েছে পার্থপ্রতিমের কাছে। সঙ্গে সংগ্রহে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের গড়গড়া বা হুঁকো। কাঠ, পিতল, কাচ, কাঁসার তৈরি বা রুপোর আস্তরে মোড়া এই সামগ্রীগুলির কোনওটি বড়, কোনওটি ছোট। সবচেয়ে বড় গড়াগড়াটির উচ্চতা ৫৫ সেন্টিমিটার। এই গড়গড়া তৈরি কাঠ ও পিতল দিয়ে। কাচ ও এবোনাইটের তৈরি সবচেয়ে ছোট গড়াগড়াটির উচ্চতা ১৩ সেন্টিমিটার । এই সব গড়াগড়া সংগৃহীত হয়েছে বেনারস, মির্জাপুর, দিল্লি প্রভৃতি জায়গা থেকে। রয়েছে বিভিন্ন রকম সুগন্ধি তামাকের সংগ্রহও। যার মধ্যে আছে ঢাকার বসুন্ধরা ‘শিশার’র ‘পানরসিলা’, মুম্বইয়ের এ কে ফজলানির ‘ডাবল অ্যাপেল’, হুক্কাহোলিকের ‘কমিশনার’, পাবনার ‘আফ্রিন’ . . .। রয়েছে নাগপুরের তামাকবিহীন ধূমপানের মশলাও। পার্থপ্রতিম বলেন- ‘‘এই গড়গড়াগুলির সাথে ছিন্নমূল বাঙালির ফেলে আসা দিনগুলিতে ফিরে যাই। এক ধরনের বিষণ্নতা আনমনা করে দেয়।’’
তার এই মধুবনে রয়েছে বেশ কিছু বিরল জিনিস। সেগুলির অ্যান্টিক ভ্যালুও রয়েছে। পার্থবাবু সেগুলি নিয়েও অবসরে দিন কাটান। হুঁকোর পাশাপাশি তার কাছে রয়েছে প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন গ্রামোফোন। এটা চালাতে কোনো বিদ্যুৎ বা ব্যাটারীর প্রয়োজন হয় না। অনেকটা দম দেওয়া ঘড়ির মতোন। হাতল ঘুরিয়ে দম দিতে লাগে। তারপর গানের রেকর্ড বসিয়ে পিন লাগিয়ে দিলেই ভেসে আসে সুরের লহরী। যদিও আধুনিক ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেমের কাছে তার এই গ্রামোফোন অনেকটাই ম্রিয়মাণ। তবুও মাঝে মধ্যে কালো চাকতি রেকর্ড বসিয়ে গ্রামোফোন চালিয়ে কান পেতে শোনেন- ‘‘আমারে ভুলিয়া যেও, মনে রেখো মোর গান,/ যেদিন রব না আমি, দিন হলে অবসান’’।
♦ ♦ ♦
ধীরেন দাস; মাছ বিক্রেতা - মাছের কানকো দেখা তো দূরের কথা, ডাক্তারবাবু কোনোদিন মাছে হাতই দেননা। বলেন- “ধীরেন ভাই, রোগীর অবস্থা কেমন সেটা আমি ভালো বুঝবো। কোন মাছটা ভালো সেটা তুমি ভালো বুঝবে।” তাই স্যারকে নরম মাছ দিতে মন চায় না। মাছ ঠিক না থাকলে ভীড়ের মাঝে, চোখ দিয়ে ইশারা করি; অন্যদিন আসার জন্য। শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়; সবজিওয়ালা, ফলওয়ালা সবার সাথেই তার এমন ব্যবহার। সবসময় হাসিখুশি মানুষ।
ডাক্তারবাবু ঘরের গল্পও করেন। আমার কবে নাতি হয়েছে স্যার সব জানেন। নাতির শরীর খারাপের কথা বললে তিন সপ্তাহ পরে তিনি এসে জিজ্ঞাসা করেন কী ? নাতি এখন কেমন আছে ? কী ভাবে যে এতো সব মনে রাখে; ভগবানই জানে। গোবিন্দের কাছে কামনা করি- “ডাক্তারবাবু যেন কোনো দিন আমাদের ছেড়ে বৈকুন্ঠে না যান. . .।”
♦ ♦ ♦
তার লেখালেখির বিষয়ও বহু রঙে রাঙা। একেক সময় এক এক বিষয় নিয়ে কলম ধরেছেন। কখনো স্কুলবেলার স্মৃতিচারণা, রেলপথে ডুয়ার্স ভ্রমণ, মহাকাশ বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি, কখনো রূপচর্চা, কুসংস্কার, পুস্পচর্চা, রান্নাবান্না, অসুখ বিসুখ, যৌন বিজ্ঞান, জ্যোতিষ ব্যবসার জালিয়াতি . . . আরো বহুকিছু। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পৌঁছে যান সাবলীলভাবে। কোন একটি বিষয়কে আঁকড়ে তিনি জীবনপাত করতে রাজি নন। তার কথাতে- “জীবন একটাই, তাই একটি বিষয়কে ধরে সারাটি জীবন কাটানোটা বোকামী। যমপুরীর অ্যাক্যাউন্টটেন্ট চিত্রগুপ্ত যখন বলবেন-‘ মানব জনম দিয়ে যখন তোকে সাধের পৃথিবীতে পাঠালাম; তখন এতো বছর ধরে কী কী করলি ? ? তখন জবাবটা যেন জুতসই হয়।” আসলে যারা প্রতিভাশালী তারা অনেকেই এভাবে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মেতে ওঠেন।
পার্থপ্রতিম এক এক সময়ে এক একটা বিষয় নিয়ে মাতেন। একসময়ে পড়াশোনা করেন রূপচর্চা নিয়ে। তিনি একটু মজা করে বলেন- ‘যারা ঈশ্বর বিশ্বাসী, তারা পূজাপাঠ করে বহু সময় কাটিয়ে দেন। ধর্মীয় মতে, আমাদের সকলের ভেতরে আত্মা বিরাজমান, বা আমরা সকলেই আল্লার বান্দা। সেদিক থেকে দেখলে আমাদের এই দেহটা হল আত্মার মন্দির। সেই মন্দির অপরিষ্কার রাখা বা অপরিচ্ছন্ন রাখা কোনো ক্ষেত্রেই ঠিক নয়।’ যারা ঈশ্বর বিশ্বাস করেন তাদের অং-বং-চং-এর সময় কমিয়ে নিজের দেহের প্রতি ও রূপের প্রতি যত্ন নেওয়া দরকার। অনেককে দেখা যায় প্রসাধনের সাহায্য নিয়ে রংচং মেখে নিজেকে সুন্দর করার চেষ্টা করে। কিন্তু আবার শরীরের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। কলপ দিয়ে চুল কালো করে বয়স কমানোর চেষ্টা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রসাধন করা আর রূপচর্চা করা এক নয়। প্রসাধন হল নকল বিষয়। আর রূপচর্চা হল নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্য খাওয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। এসবের মধ্য দিয়ে নিজের রূপ সঠিক প্রাণবন্ত রাখার প্রয়াস। স্ত্রী সুকন্যার সাথে যৌথভাবে তিনি লিখেছেন- “রূপ থেকে অপরূপে” বইটি। যে বইটি উল্লেখিত হয়েছে দেশ পত্রিকার বই সংখ্যায়।
পার্থপ্রতিম একসময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বহু গ্রন্থ সমালোচনা করেছেন। তার কথায়- ‘গ্রন্থ সমালোচক হলে বিনা পয়সায় বহু বই উপহার পাওয়া যায়। সেই সূত্র ধরে পড়াও হয়ে যায় বহু কিছু। তাই গ্রন্থ সমালোচনার প্রতি আমার একটু ঝোঁক বেড়েছিল।’
♦ ♦ ♦
অধ্যাপক ডঃ নির্মল চন্দ্র রায়; বিধায়ক; ধূপগুড়ি বিধানসভা - ডাঃ পার্থপ্রতিমের সাথে আমার দু'দশকের বেশী সময় ধরে পরিচয়। তিনি বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত। তারই উদ্যোগে ডুয়ার্সের ঐক্য ও সম্প্রীতির শপথ নিয়ে পালিত হয়ে চলেছে ‘ডুয়ার্স দিবস’। তিনি নানাবিধ কাজ করে থাকেন - মঞ্চ সঞ্চালনা, সঙ্গীত রচনা আরও বহু কিছু। পেশায় চিকিৎসক হলেও, শিল্প-সংস্কৃতির আঙ্গিনায় তিনি এক পরিচিত নাম। বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালন সমিতিতে তিনি সরকার মনোনীত সদস্য। তার দীর্ঘ কর্মমুখর জীবন কামনা করি।
কালের তরণী হয়তো এই ভাবেই বয়ে যায়। এই জগতের আজ যা দামী; সস্তা সে তো কাল। জীবনের বিভিন্ন কাজে টাইপ-রাইটিংটা এক প্রয়োজনীয় বিষয়। সবকিছু হাতেলেখা সবক্ষেত্রে সঠিক হয়না, তাই টাইপ-রাইটার এক প্রয়োজনীয় বস্তু। অনেক খোঁজ খবর করে স্থানীয় ‘টাইপ অ্যান্ড শর্টহ্যান্ড’ স্কুলে গিয়ে ভর্তি হলেন। কয়েকদিনের মধ্যে রপ্ত করে ফেললেন টাইপ শর্টহ্যান্ড। কিন্তু তাতে পুরোপুরি ঠিক হচ্ছে না। নিজের কাছে মেশিন না থাকলে এই বিদ্যা তেমন কাজে লাগে না। ডাঃ পার্থপ্রতিম কিনে ফেললেন টাইপরাইটার। স্হানীয় বিভিন্ন মানুষের চিঠি চাপাটি তিনি নিজের খরচে করে দিতেন।
কিন্তু প্রযুক্তি থেমে থাকেনা। বাজারে এসে গেল ডিজিটাল কম্পিউটার প্রযুক্তি। তাই টাইপ-রাইটার তার কাছে ঠাকুরদা, কম্পিউটারের কাছে টাইপ-রাইটার একেবারে কথা না বলতে পারা নাতি। এই তফাৎটা বেশ বড়সড়। পৃথিবীতে বেশ অল্পকিছু মানুষ আছে যাদের কাছে বহু অজানা বিষয় রয়েছে। তবে, তাদের কাছে দুর্বোধ্য কিছু নেই; পার্থপ্রতিম তেমনই একজন।
দিনে চিকিৎসা বিজ্ঞান, রাতে আবার কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। DOS দিয়ে শুরু করলেন কম্পিউটার শেখা। নিজের থেকে বয়সে অনেক ছোটো এক অনুজের কাছে শিষ্য হয়ে শুরু হল তার প্রশিক্ষণ। এম.এস.ওয়ার্ড, পাওয়ার পয়েন্ট, এক্সেল, আউট-লুক এই সব বহু কিছু শেখা হল, সে শেখা আজও বিরামহীন। যে বয়সে মানুষেরা তার জানা বিষয়গুলি ভুলে যায়, নতুন কিছু শেখা তো দূরের কথা, অতীতের শেখা বিষয় মনে করতে বা কাজে লাগাতে পারে না। পার্থপ্রতিম সে বয়সে নব উদ্যমে নতুন কিছু শেখেন।
তাই এই ডিজিটাল প্রযুক্তি শিখে তিনি শুরু করতে চললেন পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন। ফটোশপ শিখে বিভিন্ন ছবি এডিটিং, বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরী, ইউটিউবের থাম্বনেইল তৈরী করতে থাকেন পেশাদার কম্পিউটার গ্রাফিক্স আর্টিস্টের মতোন। পরবর্তীকালে শুরু করেন ভিডিও এডিটিং শেখা। ডিজিটাল প্রযুক্তির সবথেকে বড় মজা হল এই বিদ্যায় যারা পারদর্শী তারা বেশিরভাগই অল্পবয়সী তরুণ- তরুণী। এইসব তরুণ- তরুণীদের গুরু জ্ঞান করে তিনি শুরু করলেন ভিডিও এডিটিং- এর কাজ।
বর্তমানে তিনি এত সুনিপুণ ভাবে কম্পিউটার গ্রাফিক্স- এর কাজ করেন, যা পেশাদারী শিল্পীদের সাথে সমান তালে পাল্লা দিতে পারে। আসলে, যারা বিরল প্রতিভার মানুষ তাদের কাছে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়া তেমন কোনো ব্যাপার নয়। কোনো কিছু শেখার বিষয়ে তিনি শিখতে চান এটাই শেষ কথা। একইভাবে তিনি সাউন্ড এডিটিং এরও কাজ করেন।
ইনি শুধু নিজে শিখছেন তা নয়, তিনি বিনামূ্ল্যে অনেকক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে পয়সা দিয়ে তিনি তাদের এই প্রযুক্তির কারিগরি শেখান। চা বাগিচা এলাকায় বহু পিছিয়ে পড়া মেয়েরা তার কাছে এসে কম্পিউটার- এর ওয়ার্ড, এক্সেল, নেট এক্সেস আরও বহু প্রযুক্তি শিখে গেছে। এর পেছনে তার খরচও কম নয়। দুখানা ল্যাপটপ, চার পাঁচখানা ডেস্কটপ তিনি ইতিমধ্যেই ব্যবহার করে ফেলেছেন। বর্তমানে তার কাছে তিনটি ডেস্কটপ ও একটি ল্যাপটপ রয়েছে, যেগুলি কচিকাঁচারা তাদের শেখার কাজে ব্যবহার করে।
জটিল কলাকৌশল রপ্ত করার সাথে সাথে পার্থপ্রতিম বিভিন্ন ধরনের গ্রাফিক্স ও ডিজাইনিং-এর কাজে বেশ পারদর্শী। তিনি নিজে ২০১৬ সালে বাংলা ভাষায় প্রথম স্বাস্থ্য বিষয় ই-বুক তৈরী করেন। পুরো কাজটাই করেন ডুয়ার্সের প্রত্যন্ত এলাকায় থেকে। খুব সম্ভবত বাংলাদেশের পর এটাই বাংলা ভাষায় প্রথম স্বাস্থ্য বিষয়ক ই-বুক। জলপাইগুড়ি প্রেসক্লাবে এই ই-বুকের শুভ উদঘাটন করেন জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রকাশ মির্ধা। নেট দুনিয়ায় তার এই প্রয়াস ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই গ্রন্থের রচনা, অলংকরণ ও রূপায়ণ সবটাই তার নিজ হাতে করা।
উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় ইলেকট্রনিক্স মডেল তৈরী করার বিষয়ে তিনি আগ্রহী হন। সেমিকন্ডাক্টার, এন.পি.এম, পি.এন.পি জংশন নিয়ে বিশেষ পড়াশোনা করেন। সেই সময় নিয়মিত প্রকাশিত হত ‘ELECTRONICS FOR YOU’ পত্রিকাটি। তিনি তা নিয়মিত পড়তেন। এর পাশাপাশি পড়তেন সায়েন্স টু ডে ম্যাগাজিনটি ও সায়েন্স রিপোর্টার পত্রিকাগুলি। বিভিন্ন আই.সি সার্কীট, LED (LIGHT EMITING DIOD), LDR (LIGHT DEPENDENCE REGISTENCE), জেনার ডায়ড-এর পাশাপাশি শিখেছেন রেজিস্টেন্স এর বিভিন্ন কালার ব্যান্ড কোড। আরো বহু কিছু নিয়ে ছিল তার পড়াশোনার ব্যাপ্তি। সে সময় একটি স্মার্টনেস ডিটেকটার নামে একটি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস তিনি তৈরী করেন। যার দ্বারা কে, কতটা স্মার্ট তা বোঝা যায়।
আসলে, জীব বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার শর্তসাপেক্ষ প্রতিবর্তক্রিয়া (REFEX ACTION) যত দ্রুত হয় অর্থাৎ যে যত শীঘ্র কোনো প্রকার নির্দেশ বা উত্তেজনায় সাড়া দেয় সে ততটা স্মার্ট। এই তত্ত্বকে সামনে রেখে তার এই আবিষ্কার। তার আবিষ্কৃত যন্ত্রটির বিশদ বিবরণ ও কার্যপদ্ধতি ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়। তার এই আবিষ্কৃত যন্ত্রটি বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়।
ইলেকট্রনিক্সের বিভিন্ন সার্কীট ও মূল সূত্রগুলি জানার কারণে তিনি সহজেই যে কোনো ডিভাইস বা ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের ভেতরে ঢুকে যেতে পারতেন। ঘড়ি, LED LIGHT, আরো বিভিন্ন যন্ত্র তিনি মেরামতও করতে পারতেন। শোল্ডারিং আয়রন থেকে ডিজিটাল মাল্টিমিটার আরো বহু যন্ত্রপাতি তার কাছে রয়েছে। পাড়াপড়শিরাও অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক অসুখ-বিসুখের সাথে; বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির অসুখ-বিসুখ নিয়েও এই বিরল ডাক্তারবাবুর শরণাপন্ন হন।
1986 সালে তিনি কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজি মিউজিয়ামে রেডিও সিগন্যাল ট্রান্সমিশন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। অ্যামপ্লিচিউট মডুলেশান (AMPLITUDE MODULATION), ফ্রিক্যুয়েন্সি ফেজ মডুলেশান (PHASE MODULATION) এইসব আত্মস্থ করেন। ভারত সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রক (MINISTRY OF COMMUNICATION GOVT. OF INDIA) এ বিষয়ে তাকে বিশেষ সহযোগিতা করে। সেখানে পরীক্ষা দিয়ে তিনি লাভ করেন হ্যাম বা অ্যামেচার রেডিও ব্যবহারের বৈধ স্বীকৃতি। যোগাযোগ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে তাকে বিশেষ ওয়ারলেস কোড দেওয়া হয়। যেটা VU2PRZ। একই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। তার কোড- VU2RG।
♦ ♦ ♦
♦ ♦ ♦