হোমিওপ্যাথি ও সিমপ্যাথি; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ২৭ অক্টোবর ২০১২; পৃষ্ঠা- ষোলো; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
এসে গেল উৎসব লগন। উৎসব তো আর একলা হয় না, দলবল লাগে। আর দলবল মানেই আড্ডা, হইচই, খানাপিনা আরো কত কী। হ্যাঁ, যাই করুন না কেন শরীরটাকে সবার আগে ঠিক রাখতে হবে, তা না হলে উৎসবের সব আনন্দ মাঠে মারা পড়বে। শরীরটাকে চাঙ্গা রাখতে হোমিওপ্যাথির সাহায্য নিতে পারেন। বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা সকলের জন্যই এটা ভালো। মনে রাখতে হবে হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতে রোগের চিকিৎসা করা হয় না, রোগীর চিকিৎসা করা হয়। অর্থাৎ আপনি কী ভুগছেন সেটা তেমন বিচার্য বিষয় নয়, আপনার বয়স কত, আপনি স্ত্রী না পুরুষ, রোগা না মোটা, আপনার কষ্ট কখন বাড়ে-কমে, উপসর্গগুলি কী কী- এসবই বড়ো কথা। ওষুধ নির্বাচনের সময় এগুলিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আনন্দ উৎসবে একটু ঝালমশলা বেশি খাওয়া হয়। রাতে শোওয়ার কোনো ঠিকঠিকানা থাকে না। তা থেকে অম্বল, পেটভার খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলি ডিসপেপসিয়া। বাংলায় অজীর্ণ। মুখ টক, পচা গন্ধযুক্ত ঢেঁকুর ওঠা, পেট গড়গড় করা এইসব উপসর্গে কার্বো ভেজ ৩০ বা ২০০ পোটেন্সিসর ওষুধ খেতে পারেন। সকালে যা খেয়েছেন বিকেলবেলার ঢেঁকুর সেই খাবারের গন্ধ পাওয়া যায়, সব ধরনের খাবারে অরুচি। এসব ক্ষেত্রে পালসেটিলা ২০০ খেতে পারেন। বিশেষত শিশু ও মহিলাদের দুর্গন্ধ ঢেঁকুর ওঠা, খাবারে অনীহা, পায়খানা না হওয়া, নিচে বায়ু নিঃসরণ-এসব হলে এন্টিম ক্রুড ২০০ দিতে পারেন। এন্টিম ক্রুড- এর আরো একটি লক্ষণ হল এইসব রোগীদের জিভে সাদা প্রলেপ থাকে। দুর্বল ব্যক্তিদের অজীর্ণ ও পেটফাঁপা, কোষ্ঠবদ্ধ, সবসময় ঘুমঘুমভাব, খাওয়ার পরেই টকঢেঁকুর, টকবমি ও সামান্য খেলেই মনে হয় পেট ভরে গেছে। রোগীর মধ্যে এধরণের উপসর্গ পেলে লাইকোপোডিয়ামের কার্যকারিতা দীর্ঘসময় ধরে বজায় থাকে। তাই এটা ঘনঘন খাওয়ার প্রয়োজন নেই। আর ২০০-এর নিচে পোটেন্সি না ব্যবহার করাই ভালো।
অ্যাসিডিটি বা অম্বলে বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো বাঙালির জীবনে জড়িয়ে আছে। আর উৎসবের দিন গুলিতে অনিয়ম করলে যে অম্বলের বাড়বাড়ন্ত হবে এতো জানা কথা। পেটে ব্যাথা, অম্বঢেঁকুর, টকবমি, ঢেঁকুর উঠলে আরাম বোধ এসব লক্ষণে নেট্রাম ফস ১২এক্স খেতে পারেন। নেট্রাম ফস বায়োকেমিক ওষুধ তবে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারবাবুরা হামেশাই ব্যবহার করেন। বড়োদের ক্ষেত্রে চারটি ও ছোটদের ক্ষেত্রে দুটি ট্যাবলেট আধকাপ হালকা গরম জলের সঙ্গে দিনে দু থেকে তিনবার খাওয়া যেতে পারে। যারা একটু অমিতাচারী, যেমন আমাদের প্রশান্তবাবুর কথা ধরা যাক-নিত্যদিন তার অন্যরকম সন্ধ্যা আহ্নিকের প্রতি আসক্তি। কারণবারি তো থাকেই সঙ্গে রকমারি ভাজাভুজি। স্ত্রী গায়েত্রী নরমগরমে অন্য সময় সামলে রাখেন। কিন্ত্র পূজাপার্বণ এলে প্রশান্তবাবুকে আর কে পায়। ‘খাও খাও বুদ হয়ে ডুবে...এরকম প্রশান্তবাবুদের পেটের যেকোনো গোলমালে নাক্সভমিকা -২০০ এক উৎকৃষ্ট ওষুধ। খাওয়ার পরে পেটে যন্ত্রণা, ব্যাথা ও ভারীবোধ বুকজালা, অম্লঢেঁকুর, খাওয়ার পর খুব ঘুম পায়- এইসব লক্ষণেও নাক্সভমিকা খেতে পারেন। বমি, তেতো ঢেঁকুর, পেটজালা, পায়খানা পরিষ্কার না হওয়া ইত্যাদি লক্ষণে রোবিনিয়া মাদার টিংচার ভালো ওষুধ। রাতে শোওয়ার আগে আধকাপ হালকা গরম জলের সঙ্গে ২০ থেকে ৩০ ফোঁটা খেলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
নতুন জুতো পড়ে পায়ে ফোসকা পড়া উৎসবের মরশুমে এক সাধারণ ব্যাপার। ক্ষতস্থানে ব্যান্ড এইড তো লাগাবেনই তবে তার সঙ্গে এলিয়াম সিপা -৩০ দিনে দুবার খেতে পারেন। তাহলে বেশিদিন আর আপনাকে খুঁড়িয়ে চলতে হবে না। রোদের মধ্যে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা, কানে তালা লাগা তীব্র শব্দ, অতিরিক্ত আলোর রেশনাই এসব থেকে মাথাব্যাথা হতে পারে। চোখমুখ লাল হয়ে মাথার দপদপানি ব্যাথা হলে বেলেডোনা-৩০ তিন চার ঘন্টা পরপর তিন চারবার খেতে পারেন। যাঁদের মাইগ্রেন বা আধকপালি আছে তাঁরা আগে থেকে তুলো রাখবেন, যেখানে বেশিমাত্রায় শব্দ হবে সেখানে কানে তুলো দিতে ভুলবেন না। রোদে রের হলে অবশ্যই ছাতা ও কালোচশমা ব্যবহার করবেন। লক্ষণ অনুসারে স্পাইজোলিয়া ৩০, স্যাঙ্গুইনেরিয়া ২০০, আর্সেনিক অ্যালবাম-২০০ মাইগ্রেনের রোগীকে দিতে পারলে ভালো উপকার পাওয়া যায়। কম বেশি সব বাঙালির পায়ের নিচে সর্ষে। ছুটিতে দূর দেশে ঘুরতে যাওয়া তো বহু বাঙালি পরিবারের শখ। এই ঘুরতে গিয়ে বাসে, গাড়িতে, নৌকায় ভ্রমণে বা নাগরদোলায় চাপলে যাঁদের বমি হয় তাঁদের জন্য মহাঔষধ ককিউলাস ইন্ডিকাস ৩০। গাড়ি চড়ার দু-তিনদিন আগে থেকেই দিনে দুবার করে খাবেন। তাহলেই দেখবেন ভ্রমণকালে আর বমি হবে না। আর খাবার দাবার থেকে পেটের অসুবিধায় বমি হলে সেক্ষেত্রে ইপিকাক-৩০ খেলে উপশম হয়।
বর্ষা শেষে শরৎ এলে প্রতি বছর বাংলায় আমজনতার মধ্যে একটা উপসর্গ দেখা বাংলায় বলে চোখ ওঠা ডাক্তারিভাষায় আমরা বলি কনজাংটিভাইটিস। এবার এখনও তেমনভাবে আসেনি, তবে রোগটি খুব ছোঁয়াচে। পাড়ায় একজনের হলে হাটেবাজারে কালো চাশমাওলায় চোখে ভরে যায়। চোখ লাল হয় ফুলে যায়, জ্বালা করে, সকালবেলায় শ্লেষ্মাতে চেখের দুটি পাতা সেঁটে যায়-এইসব উপসর্গে।
মারকিউরাস সল ২০০ শক্তি কয়েকবার খেলে ভালো ফল পাবেন। এছাড়াও ইউফ্রেসিয়া হোমিও আইড্রপ ব্যবহারে তাড়াতাড়ি আরাম পাওয়া যায়।
সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে তিন-চার গ্লাস জল খেয়ে নিন। তার আধঘন্টা পর লিকার চায়ের সঙ্গে ক্রিমক্রাকার জাতীয় বিষ্কুট খান। হ্যাঁ, চায়ে কখনোই দুধ দেবেন না। এত অনেক ক্ষতি হয়। চায়ের সঙ্গে যে প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে দুধ দিলে তার কার্যকারিতা অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়। এই অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট আপনার হৃদয়ের কাজকারবারকে ঠিক রাখে। তাছাড়া চায়ে দুধ দিলে চায়ের অম্লত্ব বা পি এইচ ভ্যালু বেড়ে যায়। ফলে গ্যাস অম্বলের প্রবণতা বাড়ে। তাই সবসময় লিকার চা খাওয়ার অভ্যেস তৈরি করুন। সকালে মুড়ি, চিঁড়ে, হালকা খাবার দিয়ে ব্রেকফাস্ট করুন। লুচি, পরোটা এসব না খাওয়াই ভালো। দুপুরে তেল মশলা কম দেওয়া হালকা খাবার খান। বিকেলে লিকার চায়ের সঙ্গে মুড়ি, বিষ্কুট খান। মুখরোচক রকমারি খাবার সন্ধ্যা বা রাত্রিবেলার জন্য তুলে রাখুন। ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে হোটেলে-রেস্তোরাঁয় মস্তিতে মোগলাই, বিরিয়ানি সাঁটান।
আপনার এই তনুর উপর দিয়ে চল্লিশটা বসন্তের দখিনা বাতাস বয়ে গিয়ে থাকে, তবে উৎসবের দিনগুলিতে একটু আগেভাগে সাবধান হোন। রক্তের শর্করা পরীক্ষা বা ব্লাডসুগার পোস্ট প্যান্ডিয়া করান। ফলাফল ১৮০ মি.গ্রা/ ডেসিলিটারের বেশি হলে সিজিজিয়াম জাম্বোলিনাম মাদার টিংচার আধকাপ জলে ২০ ফোঁটা দিয়ে সকালবেলায় খান। ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। উৎসবের দিনগুলিতে আগে থেকেই নিয়মিত ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ মাপুন। রক্ত চাপ বেশি থাকলে রাউলফিয়া সার্পেনটিনা মাদার টিংচার ১৫ থেকে ২০ ফোঁটা আধকাপ ঠান্ডা জলে দিয়ে দিনে এক-দুবার খাবেন। তবে অবশ্যই স্থানীয় চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে। পুজোর সময় মনটাকে ফুরফুরে রাখার চেষ্টা করুন। বিষয় আসার লাভ-লোকসানের অঙ্ক মাথায় বেশি ঢোকাবেন না। মনে যদি বেশি চাপ থাকে, রাতে যদি ঘুম ভালো না হয়, তবে ক্যালি ফস ১২ এক্স বায়োকেমিক ট্যাবলেট চারটি করে দিনে দু-দিনবার আধকাপ গরম জলের সঙ্গে খাবেন। এতে ঘুম ভালো হবে, মনের চাপ কিছুটা হলেও লাঘব হবে, রক্ত চাপও স্বাভাবিক থাকবে।
কোনো রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে মূল বিষয়টি হল রোগীর অসুবিধাগুলিকে সহানুভুতির সঙ্গে উপলব্ধি করা। আয়ুর্বেদিক, অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি যাই ওষুধ রোগীকে দিন না কেন, ডাক্তার হিসেবে রোগীর প্রতি সিমপ্যাথিটা অবশ্যই থাকতে হবে। বুঝতে হবে তার অসুবিধের উৎস কোথায়। আর যাঁরা ডাক্তারবাবু নন, সাধারণ মানুষ তাঁদেরকেও উৎসবের দিনগুলিতে আরো উদার হতে হবে, প্রেমিক হতে হবে, পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। যে কথাটা বারবার নানাভাবে বলতে চাই -আত্মপ্রেমের কাছিম খোলা ছেড়ে বেড়িয়ে এসে বিশ্বপ্রাণের স্পন্দন অনুভব করার মধ্যেই রয়েছে উৎসবের তাৎপর্য।’