ডুয়ার্সে উন্নয়ন বারবার বাধা পায় কেন?

ডুয়ার্সে উন্নয়ন বারবার বাধা পায় কেন?

ডুয়ার্সে উন্নয়ন বারবার বাধা পায় কেন? -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ২১ এপ্রিল ২০১৭; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
লাটাগুড়ি রেলপথের ওপর ওড়ালপুল নির্মাণের  কাজ আবার অনিশ্চিত হল। ন্যায়ালয়ের আদেশে স্থগিত রইল গাছ কেটে রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ। অদূর অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, বেশ কয়েক যুগ চা বাগিচা অধ্যুষিত এই ডুয়ার্স তথা উত্তরবঙ্গ ছিল বিভিন্ন বিষয়ে অবহেলিত। বিগত বাম আমলে সুন্দরবন উন্নয়নের জন্য পৃথক দপ্তর থাকলেও উত্তরবঙ্গের জন্য তেমন কিছু ছিল না। ইংরেজ আমলে গড়ে ওঠা ডুয়ার্সের চা শিল্প বিভিন্ন কারণে রুগণ থেকে রুগণতর হয়েছে। ভাঙাচোরা পথঘাট, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে গয়ংগচ্ছভাব, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, হতাশা, নৈরাজ্যের মধ্যে ঠিক যেমনটি হয়, তেমনভাবেই মাথাচাড়া দিয়েছিল বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। আর ঘন ঘন বনধ-হরতালে নাভিশ্বাস উঠেছিল এই এলাকার মানুষজনের।

রাজ্যের রাজনৈতিক পালাবদলের পর ডুয়ার্স এলাকার মানুষ নতুনভাবে আশার আলো দেখতে শুরু করেন। পর্যটন শিল্প ঘিরে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ক্রমেই উজ্জ্বলতর হচ্ছে। লাটাগুড়ি, মাদারিহাট, জয়ন্তীকে গোল্লাছুটের খুঁটি করে অনেক পর্যটক ঘুরে যাচ্ছেন আশেপাশের এলাকাগুলিতেও। চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্পের কলাকুশলীরা আসছেন এই এলাকা। অনাগত দিনগুলিতে পরিস্থিতির আরও শ্রীবৃদ্ধি হবে এ আশায় বুক বেঁধেছে অনেকে। উন্নত বাধাহীন গতিময় যোগাযোগ ব্যবস্থা শুধু পর্যটনশিল্প নয়, যে কোনো এলাকার সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি। উড়ালপুল নির্মাণের মধ্য দিয়ে এবিষয়ে গঠনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল বর্তমান সরকার। তাছাড়া সুউচ্চ উড়ালপুল থেকে নীচের অরণ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করা পর্যটকদের কাছে অন্যমাত্রা এনে দিতে পারত।
বিভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চা বলয়ের বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূর করা আজও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। রুটিরুজির আশায় নিত্যদিন ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন এই এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ। নারী ও শিশু পাচারে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে রয়েছে চা বলয়। পিছিয়ে পড়া এই এলাকা হয়ে উঠেছে কাঠচোর ও চোরাশিকারির মৃগয়া ক্ষেত্র। যার লোকাল মডিউল হিসাবে অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করছে এলাকার গরিবগুর্বো মানুষগুলি। নিরন্ন পাকস্থলী নিয়ে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের আনুপাতিক পাটিগণিত কতটা মগজস্থ করা যায়? ক্ষুধাতুর মানুষের পাশে কাজলনয়না হরিণী বা দুধেল বাইসন কতটা সুরক্ষিত ?- এ প্রশ্নের উত্তর জানতে নিশ্চয়ই এনভায়রনমেন্টাল ইকোনোমিস্ট রিচার্ড বি হাউর বা ডঃ টিল রিকোয়েট এর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

কিছুকাল ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, যখনই ডুয়ার্সে কোনো উন্নয়নমূলক প্রস্তাব বা পরিকল্পনা এসেছে, তখনই কিছু মানুষ অতি তৎপর হয়ে ওঠেন। ইতিপূর্বে যখন চারলেনের মহাসড়ক ডুয়ার্সের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কেন্দ্রীয় সরকারি পরিকল্পনা হয়েছিল, তখন পরিবেশরক্ষার ধুঁয়ো তুলে তার পথ পরিবর্তন করা হয়। বঞ্চিত করা হয় ডুয়ার্সের পিছিয়ে পড়া জাতি, জনজাতিকে। রেলপথে হাতির মৃত্যু সকলের কাছেই মর্মান্তিক, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তা বলে এই ঘটনার পর যাঁরা ডুয়ার্সের রেল চলাচল সন্ধ্যার পর বন্ধের জন্য শহরে সাংবাদিক সম্মেলনে সরব হন, তাঁদের বোধবুদ্ধি প্রশ্ন জাগায়। তাই বলব, পরিবেশরক্ষার ভূত ডুয়ার্সের উন্নয়নে পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে ডুয়ার্সের মানুষকে লংকা ও ঝাঁটা সহ ওঝার ভূমিকায় নামতে হবে। তা না হলে সবুজরক্ষার জিগিরে ডুয়ার্সের ভবিষ্যৎ হবে নিকষ কালো অন্ধকার।
ডাঃ পার্থপ্রতিম।
মধুবন. আদর্শপল্লি, বানারহাট।

গাছ ধ্বংস  করে উন্নয়ন নয়; ১৩ মে ২০১৭; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
গত ২১ এপ্রিল ডাঃ পার্থপ্রতিমের চিঠি পরিবেশপ্রেমীদের মনে আঘাত হেনেছে। পরিবেশপ্রেমীরা উন্নয়ন চায়, কিন্তু বন ধ্বংস করে নয় । এঁদের আন্দোলন বনকে রক্ষা করে তথা গাছ নিধন না করে বিকল্প পদ্ধতিতে বা অন্যত্র উড়ালপুল তৈরি করে। সুতরাং, ডুয়ার্সের উন্নয়নে বাধা তৈরির কোনো কথাই নেই। পর্যটকেরা ডুয়ার্সের সৌন্দর্য দেখতে এসে দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটা ডুয়ার্সের কলঙ্ক হবে। আমরা জানি, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ঘরকে নতুন করে  বানানো যায়। কিন্তু হাজার বা শত শত গাছ কেটে সেখানে বসতি কিংবা উড়ালপুল যাই তৈরি হোক না কেন সেই গাছগুলি আর ফিরে আসবে না। লাটাগুড়ি থেকে ময়নাগুড়ি, কিংবা জলপাইগুড়ির মধ্যে উড়ালপুল তৈরি করার মতো অনেক জায়গা রয়েছে। শুধু গরুমারা বনাঞ্চলের গাছগুলির প্রতি এই অমানবিক আচরণ কে? শুধু উড়ালপুল তৈরি করে (জাতি- উপজাতি) ডুয়ার্সের বসতিদের উন্নতি করাই কি উন্নয়ন?
বন ও বন্যপ্রাণীদের বাসস্থানই হল ঘন অরণ্য। আর এই অরণ্যের মধ্যে তারা সবসময় চলাচল করে। কখনও খাবারের খোঁজে, কখনওবা অন্য কোনো ইচ্ছেতে। তাই রেলে কাটা পড়ার সম্ভাবনা থাকে, এটা ঠিক। তাদের জন্যও ভাবতে হবে। মানুষ মাত্রই উন্নয়ন চায়। পরিবেশপ্রেমীরাও উন্নয়নের উদ্দেশেই পথে নেমেছেন, বেকারদের বা বনাঞ্চলের মানুষদের উন্নয়ন স্থগিত করতে নয়। সুতরাং তাঁদের প্রতিবাদ সমর্থনযোগ্য।
মালবিকা ঘোষ (সরকার)
হাসপাতালপাড়া, চালসা।

Join our mailing list Never miss an update